লিঙ্গ বৈষম্য: হাথরাসের পথ ছুঁয়ে

পোস্টটি দেখেছেন: 42 ড. সুপর্ণা দে একজন আদর্শ পুরুষ যে গুনে সমন্বিত নারী প্রতিরূপ ঠিক তার বিপরীত গুনাবলীর আধার । এই প্রতিরূপগুলির ধারক হল লিঙ্গধর্ম । যেমন বলতে পারি পুরুষ হবে নির্ভীক, যুক্তিপ্রবণ আর নারী হবে প্রেম- মমতা- আবেগের প্রতিমূর্তি। এই চিরন্তন ধারনা আজও বহন করে চলেছি আমরা। নারী-পুরুষ না হয়ে আমরা কবে ‘মানুষ’ হবো […]

hathras

ড. সুপর্ণা দে

একজন আদর্শ পুরুষ যে গুনে সমন্বিত নারী প্রতিরূপ ঠিক তার বিপরীত গুনাবলীর আধার । এই প্রতিরূপগুলির ধারক হল লিঙ্গধর্ম । যেমন বলতে পারি পুরুষ হবে নির্ভীক, যুক্তিপ্রবণ আর নারী হবে প্রেম- মমতা- আবেগের প্রতিমূর্তি। এই চিরন্তন ধারনা আজও বহন করে চলেছি আমরা। নারী-পুরুষ না হয়ে আমরা কবে ‘মানুষ’ হবো ,অর্ধেক আকাশের দাবী কবে প্রতিষ্ঠা পাবে। ইকো ফেমিনিজমের মতে লিঙ্গ নিরপেক্ষ মানুষের ধারনা আসলে একটি ছলনা মাত্র, কারণ ইতিহাস বলে পিতৃতন্ত্রে পুরুষের জানাটাই হয়ে যায় মানুষের জানা। তাই পিতৃতন্ত্রের বিরাট মহীরূপের আগ্রাসন থেকে নিস্তার নেই । পুঁজিবাদী পিতৃতন্ত্রের আবহে মানুষের নির্মিত ধর্ম ও পুরুষের নির্মিত ধর্মের সাদৃশ্য থাকায় মানুষ হতে গেলে পুরুষের তুলনায় নারীকে অনেক বেশি উদ্যোগী হতে হবে–এখানেই শুরু নারী অবদমনের ধারাবাহিকতার।

পিতৃতন্ত্র বৈষম্যবিহীন প্রভেদ করতে জানে না। নারী –পুরুষের প্রভেদ তো আছেই যেমন আছে সাদা-কালোয় , মানুষ ও প্রকৃতিতে – তার মানে এই নয় যে এই জোটগুলি বি-সম । পিতৃতন্ত্রের নীতি ও রাজনীতি উভয়ে মিলে সবার অলক্ষ্যে চালিয়ে যায় একটা অবদমনের প্রক্রিয়া । বৈষম্যহীন মানুষ তখনই গড়ে উঠবে যখন মানুষ মানসিক স্বনির্ভরতা অর্জন করবে , সাবালক হয়ে উঠবে । সাবালক হয়ে ওঠার অর্থ এক্ষেত্রে স্বকীয়তা ও পরকীয়তার ভেদ স্পষ্ট করে বোঝা । প্রতিটি মানুষের মৌলিক স্বতন্ত্রে গড়ে ওঠে তার ব্যক্তিত্ব কিন্তু পুরুষতন্ত্রে নারীর ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠে পিতৃতন্ত্রের ছায়ায়। পুরুষ নিসর্গবাদীরা মনে করেন যে মানুষ আর প্রকৃতির সম্পর্ক এমন যে, ব্যক্তি নিজের কথা ভাবলে অপরের  কথা ভাবতে পারে না। মানুষ কখনও স্বার্থের কথা ভাবে আবার কখনও দরদ দেখায় আবার কখনও স্বার্থের প্রেক্ষিতে দরদ দেখায় । এখন প্রশ্ন আমরা কি প্রকৃত অর্থে মানুষ হতে পেরেছি ! যদি শিক্ষার আলোয়, যুক্তিশীল আধুনিকতায়- মধ্যবিত্ত সমাজ আধুনিক মানুষ হয়ে ওঠে তাহলে চারিদিকে এত নারী বিদ্বেষ, শোষণ ও নিপীড়ন কেন? কেন উত্তরোত্তর বেড়ে চলেছে কন্যাভ্রূণ হত্যা , ধর্ষন , পারিবারিক শোষণ-নীপিড়ন- আমাদের তথাকথিত সভ্য সংস্কৃতিতে? প্রশ্ন জাগে সত্যিই কি আমরা মানুষ হয়ে উঠতে পেরেছি ! তা না হলে দলিত ধর্ষিতা কন্যার পরিবারকে জোর করে বলানোর চেষ্টা করা হয় কেন –‘তাদের  দোষ ছিল’। রক্ষকই হয়ে ওঠে ভক্ষক । নারী নির্যাতন, নারী বিদ্বেষ , ধর্ষন -খুন , নারী-পুরুষ বৈষম্য সমগ্র ভারতবর্ষকে এক ক্ষয় রোগের দিকে ঠেলে দিচ্ছে । এ এক অবক্ষয়, মানব সভ্যতার অবক্ষয় ।

আদিবাসী সমাজে নারী-পুরুষ সম্পর্ক:

আদিবাসী সমাজে নারী –পুরুষের বৈষম্য কম।  চাষের জমিতে , পাথরের খাদানে , কয়লার খনিতে  আদিবাসী নারী পুরুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজকরে । সংসারের কাজেও দুজনে সমানভাবে হাত লাগায় । হাতে হাত মিলিয়ে একসাথে প্রায় সব ধরনের কাজ করার কারণে এবং হয়ত অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্যতা নেই বলেই এদের সমাজে বৈষম্য কম । নারী পুরুষের মধ্যে শাসক ও শোষকের সম্পর্ক নয়।  অরণ্য ভূমিশ্রীর এই সব পুত্র-পুত্রীরা লিঙ্গগত বৈষম্যের হাত ধরে কোন ধারণাকে পোষন করে না । নারী-পুরুষের সমাজসৃষ্ট কোন প্রতিরূপ নেই –পৃথিবীর অন্যান্য প্রাণের মতো এরা স্বতন্ত্র ।

শোভন অশোভন শব্দটি আমাদের সমাজে থাকলেও এদের সমাজে তা অচল । নারীর পোষাক কেমন হওয়া উচিত সে নিয়ে শোভনতাবাদীদের লম্বা  চওড়া বক্তব্য থাকলেও আদিবাসী নারীর দেহের কোন অংশ দেখা গেল সে নিয়ে পুরুষ মহলের কোনো কাটাছেঁড়া- বিশ্লেষণ নেই ।

  উপসংহারে:    

দুঃখের বিষয়- হিন্দু সংস্কৃতি , ব্রাহ্ণন্যবাদ ও তথাকথিত মধ্যবিত্ত শিক্ষিত সমাজ এইসব দলিত আদিবাসী নারীদের ভোগের সামগ্রী হিসাবে দেখছে। কিছুদিন আগে ঘটে যাওয়া হাথরাসে উনিশ বছরের দলিত কন্যার ওপর নারকীয় অত্যাচার ও হত্যা আমাদের স্তব্ধ করে দিয়েছে । ধর্ষনকারীদের বিরুদ্ধে যারা প্রতিবাদ করবে তাদের জীভ কেটে নেওয়া হবে, যৌন নির্যাতন করে ছিহ্নভিহ্ন করে দেওয়া হবে শরীরটাকে- এ কোন সমাজ ! এ কোন মনুষ্য্যত্ব ? সরকারী তথ্য অনুযায়ী ধর্ষন করে খুনের সংখ্যা বেড়ে চলেছে উত্তরোত্তর । যারা ধর্ষনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছে তাদের রাতারাতি লোপাট করে দেওয়া হচ্ছে । আশ্চর্যের বিষয় তাদের মধ্যে দলিত –আদিবাসী ও সমাজের প্রান্তিক মহিলাদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। মধ্যবিত্ত শিক্ষিত ধর্ষকেরা নিজেদের লালসা মেটানোর জন্য বেছে নিয়েছে প্রান্তিক মেয়েদের। “অর্ধেক আকাশের” দাবীদাররা প্রতি নিয়ত নির্যাতিত হচ্ছে ।

মাতৃপক্ষের শুভক্ষনে মায়ের অধিকার , মেয়ের অধিকার সর্বোপরি নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠিত হোক । উৎসবের মরশুমে প্রতিষ্ঠা পাক অর্ধেক আকাশের যথার্থ সার্বিক অধিকার। দিকে দিকে মানবিক আবেদন জেগে উঠুক । দলিত, প্রান্তিক ,মুসলিম, পিছিয়ে পড়া -সর্বোপরি সব নারীর মধ্যে জেগে উঠুক আমার দুর্গা । পুরুষের প্রয়োজনে দেবী দুর্গার সৃষ্টি হলেও নিজের ক্ষমতায় তিনি  হয়ে ওঠেন মা দুর্গা ।

লেখক পরিচিতি:

লোকসংস্কৃতির গবেষক, পরিবেশ কর্মী ও নাট্যকর্মী।

মেইল আই ডি:suparnadey2010@gmail.com

1 thought on “লিঙ্গ বৈষম্য: হাথরাসের পথ ছুঁয়ে”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top