অশোক প্রসূন চট্টোপাধ্যায়
শুরুর কথা
রসায়নে এবছরের নোবেল পুরষ্কার দেওয়া হয়েছে দুজন মহিলাকে। তাঁরা হলেন আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের জেণিফার ডাঊডনা এবং ফরাসী দেশের ইমানুএল শারপেন্তিএর। প্রথম জন আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া প্রদেশের বারক্লিতে (UC Berkeley) রসায়ন এবং আণবিক ও কোষ জীববিদ্যার অধ্যাপক। দ্বিতীয় জন বার্লিনের সংক্রামক জীববিদ্যার ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইন্সিটিউটে মাইক্রো-বায়োলজি বিভাগে অধ্যাপক ও পরে পরিচালিকা ছিলেন, ইদানিং নিজের একটি আলাদা প্রতিষ্ঠান খুলেছেন। এঁদের নিজেদের দেওয়া সাক্ষাৎকার অনুযায়ী এঁরা ২০১১ সালে একটি কনফারেন্সে মিলিত হন। সেখানে ওঁদের একসঙ্গে কাজ করার পরিকল্পনা হয়। তার ফল সেই CRISPR-Cas9 দিয়ে জিন সংশোধন (gene editing)। বিষয়টা একটু বোঝার চেষ্টা করা যাক।
নতুন কি পেলাম আমরা
কোষ জীববিদ্যায় বহুদিন DNA, RNAএর গঠন, কাজকর্ম ইত্যাদি নিয়ে চর্চা হয়েছে। পছন্দ মত কাটাছেঁড়ার জন্যে প্রথমে এসেছে restriction enzyme (শারীরবিদ্যায় নোবেল পুরষ্কার ১৯৭৮)। তারপর এল PCR পদ্ধতি (রসায়নে নোবেল পুরষ্কার ১৯৯৩)। অবশেষে ২০১২ সালে এল এই দুই মহিলার আবিষ্কার CRISPR-Cas9 পদ্ধতি। ডাঊডনা ব্যাকটেরিয়া কিভাবে প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন করে তা নিয়ে গবেষণা করছিলেন জেণিফার। উনি দেখেন ব্যাকটেরিয়াতে প্রতিরোধ ক্ষমতা আসে তিন ভাবে – অভিযোজন (adaptation), crRNA পদ্ধতি (যেখানে CRISPR শৃঙ্খলা ব্যাকটেরিয়ার DNA তে ঢুকে পড়ে) এবং তার দ্বারা DNAর কাজে হস্তক্ষেপ (interference)। CRISPR হল Clusters of Regularly Interspaced Short Palindromic Repeats এর সংক্ষিপ্ত রূপ।
কাকে বলে ক্রিস্পার (CRISPR)?
ওসাকা বিশ্ববিদ্যালায়ের কয়েকজন জাপানি গবেষক ১৯৮৭ সালে এর ওপর প্রথম গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। তারপর ২০০০ সালে ফ্রান্সিসকো মোহিকা স্পেনের আলিকান্তে বিশ্ববিদ্যালায় থেকে দেখান আরও অনেক ব্যাকটেরিয়ার DNA তে এরকম পুনরাবৃত্তি হওয়া অ্যামিনো অ্যাসিডের শৃঙ্খলা পাওয়া যায়। উনি এর নাম দিলেন সংক্ষিপ্ত নিয়মিত ব্যাবধানে পুনরাবৃত্তি বা SRSR (Short Regularly Spaced Repeats)। তারপর ২০০২ সালে আরেকটি গবেষণাপত্রে মোহিকা CRISPR-Cas9 নাম প্রথম প্রকাশ করলেন। ২০০৫ সালে কিছু ফরাসী বিজ্ঞানী বললেন ক্রিস্পার ব্যাকটেরিয়াকে ভাইরাসের আক্রমণ থেকে বাঁচাতে সাহায্য করতে পারে। ব্যাকটেরিয়ার DNAকে ক্রিস্পার নষ্ট করে। কিছু আমেরিকান গবেষকে দেখালেন আরও Cas জিন আছে যা ব্যাকটেরিয়াকে ভাইরাসের আক্রমণ থেকে বাঁচায়। ২০০৭এ প্রথম দেখানো গেলো CRISPR-Cas9 কিভাবে ভাইরাসের আক্রমণের বিরুদ্ধে কাজ করে। ২০০৮এ দেখা গেলো ক্রিস্পারের লক্ষ্য হল DNA, RNA নয়। তবে ক্রিস্পার RNA নিয়ে কি করে তা বোঝা গেলো। জানা গেলো ক্রিস্পার কেমন ভাবে RNAর জিনকে নিষ্ক্রিয় করে দিতে পারে (একে gene silencing বলা হয়)।
এবার সরাসরি ডাঊডনা আর শারপেন্তিএরের কাজে যাওয়া যাক। শারপেন্তিএর দেখিয়েছিলেন Cas9 প্রোটিন আর ক্রিস্পার একজোট হয়ে কাজ করে। Cas9 এর কাজ যেন crRNA ও tracer RNA যুগ্ম ভাবে দেখাশুনা করে। তাহলে, ওঁরা ভাবলেন, Cas9 কে ঠিক ভাবে চালাতে পারলে ও DNAর একদম নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে তাকে কেটে দিতে পারবে। ওঁরা Cas9 এর সঙ্গে চারটি আলাদা আলাদা গাইড লাগিয়ে দিলেন। তারপর দেখা গেলো তাতে সত্যি সত্যি একটি গোল (প্লাজমিড) DNA চারটি আলাদা জায়গায় কাটা পড়েছে। ২০১২তে এই কাজ প্রকাশ হবার আগেই নিয়ম মত ওঁদের পেটেন্টের আবেদন জমা পড়লো, তারপর গবেষণাপত্রও প্রকাশ পেল। অবশ্য মাস খানেক পরে আরেকটি গবেষণাপত্র ছাপা হল। সেটা আরেকটু অখ্যাত এক ইউরোপীয় বিশ্ববিদ্যালায় থেকে। সেটা নাকি ডাঊডনাদের পাণ্ডুলিপির আগেই জমা পড়েছিল। কিন্তু এহ বাহ্য!
তাহলে বোঝা গেলো Cas9 ব্যাকটেরিয়ার DNAকে কাটতে পারে। শুধু তাই নয়, গাইড RNAর সাহায্যে একদম নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে কাটতে পারে। এবার আসে DNAকে পছন্দমত সাজিয়ে তোলা। এটাকেই আমরা জিন (বা DNA) এডিট করা বলবো। DNA কোথাও কাটা পড়লে কোষ তা দুরকম ভাবে সারানোর চেষ্টা করে। এক, দস্তার আঙুল নিউক্লিয়েজ (Zinc finger nuclease, সংক্ষেপে ZFN)। আরেকটি TAL কার্যকর নিউক্লিয়েজ (TAL effector nuclease, সংক্ষেপে TALEN)। প্রথমটি অ-হোমোলগিয় পথ, দ্বিতীয়টি হোমোলগিয় পথ। সহজ ভাষায় প্রথমটি যেমন তেমন, দ্বিতীয়টিতে পছন্দমত টুকরো DNA তে ঢোকানো যায়। এর পর এলো CRISPR-Cas9 , যা অনেকটা দ্বিতীয় রাস্তার মত।
অতএব এটি একটি সাঁড়াশি প্রকল্প। সাঁড়াশির মতই RNA-DNA র অ্যামিনো অ্যাসিডের শৃঙ্খলা মিলিয়ে কোথায় কাটাছেঁড়া হবে ঠিক সেই জায়গায় CRISPR-Cas9কে বসানো। তারপর Cas9 দিয়ে DNA কেটে পছন্দ মত অ্যামিনো অ্যাসিডের টুকরো শৃঙ্খলা সেখানে জুড়ে দেওয়া।
জেণিফার ডাঊডনা কতকগুলো সম্ভাবনার কথা বলেছেন।
গবেষণার হাত ধরে যেসব সম্ভাবনা সামনে এল–
- কোনও ওষুধের জন্য নির্দিষ্ট জায়গা ঠিক করা DNA তে
- মানুষের জিন চিকিৎসা
- উন্নত মানের কৃষিকাজ ও পশুপালন
- কৃত্রিম জীববিদ্যা – নতুন নতুন বিক্রিয়ার পথ খোঁজা
- RNA র কোথায় কোথায় বদলাতে হাবে সেটা ঠিক করে ফেলা
- প্রাণীবাহিত ব্যাধির চিকিৎসা – যেমন মশার বন্ধ্যাকরণ
- ভাইরাসের জিন পরিবর্তন
- ব্যাকটেরিয়ার জিন পরিবর্তন।
আপনারা লক্ষ্য করবেন ২০১২-১৩ সালের পর নতুন গবেষণার কথা কিছুই বলা হয়নি। অনেক কাজ হয়েছে ওই সময়ের পরে। সেসব নিয়ে অন্য কেউ আলোচনা করতে পারেন। এছাড়া আরও টুকরো টুকরো কিছু ব্যাপার ছিল, যেমন PAM (protospacer adjacent motif এর সংক্ষিপ্ত চেহারা)। DNAর যে অংশটিকে কাটা হবে অর্থাৎ যেখানে গিয়ে CRISPR-Cas9 লাগবে, তার ঠিক পাশেই এই অ্যামিনো অ্যাসিডের শৃঙ্খলটুকু না থাকলে ব্যাকটেরিয়ার DNA আর CRISPR-Cas9 এর নিউক্লিও অ্যাসিডের টুকরো আলাদা করা যাবে না। ফলে শেষের জিনিসটিও কাটা পড়তে পারে।
বিতর্ক ও মতবিরোধ
উপরের কথাগুলি ছাড়া আরও অনেক সম্ভাবনা থাকতেই পারে। তবে এখনও বিশেষজ্ঞ মহলে উপরের কয়েকটি বিষয় নিয়ে যথেষ্ট মতবিরোধ আছে। যেমন জেনেটিক মশা বা অন্য প্রাণী। বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে সমবেত সিদ্ধান্ত হয়েছে এখনই এসব নিয়ে কাজ করা থেকে বিরত থাকি আমরা। কারণ পরিবেশ এবং অবশ্যই মানুষের ওপর এসব জিনিসের প্রভাব – সাময়িক ও দূরবর্তী (long term) – কি হাবে, তা আমাদের জানা নেই। তবে আমরাও তো মানুষ! আমাদের কৌতূহল বাধা মানতে চায় না। যেমন মাস কয়েক আগে কাগজে খবর ছিল চীনের এক বিজ্ঞানী একটি মানব ভ্রূণের জেনেটিক পরিবর্তন করে বসেছেন। তারপর অবশ্য সেদেশের সরকার তাঁকে জেলে পুরেছে, সে খবরও বেরিয়েছিল।
উপসংহারে
যাই হোক, সব মিলিয়ে আমরা এক উত্তেজক এবং আকর্ষক সময়ে আছি। কারণ বেশ কিছু নতুন নতুন আবিষ্কার হচ্ছে, নতুন অনেক কিছু জানা যাচ্ছে, নতুন অনেক কিছু করার সম্ভাবনা ভাবা যাচ্ছে আগে যা চিন্তাও করা যেতো না। গল্প কথা মনে হত। তবে এর সঙ্গে দরকার বৈজ্ঞানিক মনোভাবের প্রচার ও প্রসার, এবং পঠনপাঠন ও গবেষণায়, অর্থাৎ শিক্ষাক্ষেত্রে, আরও অনেক বেশি সরকারি বিনিয়োগ। তা না হলে আমাদের এমন সব আবিষ্কারের গল্প শুনেই সন্তুষ্ট থাকতে হবে।
লেখক পরিচিতি:
অধ্যাপক, রসায়ন বিভাগ,কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালায়।
Contact: asoke@klyuniv.ac.in