অধ্যাপক মেঘনাদ সাহা: জাত-জালিয়াৎ খেলছে জুয়া

পোস্টটি দেখেছেন: 44 বঙ্কিম দত্ত              খড়্গপুরে অবস্থিত ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির নেহেরু মিউজিয়াম অফ সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি ২০২১ সালের একটি ক্যালেন্ডার প্রকাশ করেছে। লক্ষ্য জ্ঞানবিজ্ঞানে ভারতের সার্বভৌমত্ব তুলে ধরা। শিরোনাম: Indian knowledge system: past, present and future. প্রাচীন মুনিঋষির আধিক্য এদেশে খুবই প্রবল। তার মধ্যে থেকে সাত ঋষিকে যেমনকাশ্যপ,বিশ্বামিত্র, ভরদ্বাজ ইত্যাদিকে প্রাচীন  বৈদিক ভারতের […]

মেঘনাদ সাহা

বঙ্কিম দত্ত

             খড়্গপুরে অবস্থিত ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির নেহেরু মিউজিয়াম অফ সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি ২০২১ সালের একটি ক্যালেন্ডার প্রকাশ করেছে। লক্ষ্য জ্ঞানবিজ্ঞানে ভারতের সার্বভৌমত্ব তুলে ধরা। শিরোনাম: Indian knowledge system: past, present and future. প্রাচীন মুনিঋষির আধিক্য এদেশে খুবই প্রবল। তার মধ্যে থেকে সাত ঋষিকে যেমনকাশ্যপ,বিশ্বামিত্র, ভরদ্বাজ ইত্যাদিকে প্রাচীন  বৈদিক ভারতের জ্ঞানচর্চার প্রতিনিধি হিসাবে নির্বাচিত করা হয়েছে। আধুনিক ভারতের সপ্তর্ষি হিসাবে প্রতিনিধি স্থানীয় যে সাতজন বিজ্ঞানী   রয়েছেন তাঁদের সকলকে আচার্য সম্বোধিত করা হয়েছে। এই নামগুলি অত্যন্ত সুপরিচিত— প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, জগদীশ চন্দ্র বসু, শ্রী নিবাস রামানুজন,  সত্যেন্দ্রনাথ বসু, অসীমা চট্টোপাধ্যায়, জানকি আম্মাল, ইরাবতী কার্ভে। অবাক লাগে না মেঘনাদ সাহার মতো বিশ্বখ্যাত বাঙালী  বিজ্ঞানীকে ব্রাত্য করে রাখা নিয়ে। ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু ভাবধারার পৃষ্ঠপোষক বর্তমান কেন্দ্রিয় সরকারের মন রাখতে সদা সচেষ্ট আই আই টি প্রতিষ্ঠানগুলির বর্তমান অবস্থানের সঙ্গে তা খুবই মানানসই। কারণ মেঘনাদ সাহা ভারতীয় জাত ব্যবস্থায় ‘নিম্ন জাতের’, ব্রাহ্মণ বা কায়স্থ নন। তাই তিনি কখনই আচার্য হতে পারেন না। তিনি কেবল অধ্যাপক মেঘনাদ সাহা। সারা জীবন ধরে যত আন্তর্জাতিক খ্যাতিই পান না কেন, হিন্দুধর্মের এই জাতব্যবস্থার কারণে ‘নীচুজাত’ হিসাবে, বারবার এদেশে অপমানিত হতে হয়েছে তাঁকে। এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটে নি। পরিকল্পিতভাবেই তাঁকে বাদ রাখা হয়েছে ভারতের জ্ঞানচর্চার ইতিহাসখোদিত জ্ঞানপীঠ আই আই টি-র এই কর্মকান্ডে ।

         ১৮৯৩ সালের ৬ ই অক্টোবরে মেঘনাদ সাহা জন্মগ্রহণ করেন। স্বল্পস্থায়ী জীবনকাল (মৃত্যু ১৬ ই ফেব্রুয়ারী ১৯৫৬)। জন্মকালীন তার নাম ছিল মেঘনাথ। ভাইদের নাম জয়নাথ, বিজয়নাথ ইত্যাদি। এক্ষেত্রে  ছন্দপতন কেন?

        এন্ট্রান্স পরীক্ষা দেবার সময় নিজেই নামের ‘থ’ কেটে ‘দ’ বসিয়ে দিলেন। মেঘনাথ হয়ে গেলেন মেঘনাদ, মাইকেল মধুসূদন দত্তের মেঘনাদ বধ কাব্য ছিল যার অত্যন্ত প্রিয়। দেবতাদের আশীর্বাদ ধন্য লক্ষণের  প্রবঞ্চনার চেয়ে মেঘনাদের বীরত্ব তাঁর কাছে ছিল অনেক বেশি আকর্ষণীয়। বিভিন্ন সময় যে অনাচার ও অবদমনের মুখোমুখি শুধু নিম্ন-জাতি হবার কারণে মেঘনাদকে হতে হয়েছিল, জীবনের প্রথম পর্বে ধর্মীয় অনুষঙ্গে রাখা পারিবারিক নামের পরিবর্তনের এই ঘটনার মধ্যে দিয়ে প্রতিবাদের সে ছিল এক সূচনা। আমরা জানি মাত্র দশ বছর বয়সে পড়াশুনার জন্য অন্য গ্রামে এক আশ্রয়দাতার বাড়িতে তাঁকে থাকতে হয়েছিল। সেখানে খাওয়ার জন্য বাসনপত্রই যে আলাদা ছিল শুধু তাই না, তা পরিস্কার করার জন্য বাড়ির বাইরে পুকুরের জল ব্যবহার করাটা ছিল বাধ্যতামূলক। ১৯০৫ সালে মিডিল স্কুলের পরীক্ষায় তিনি বিশেষ কৃতিত্ব প্রদর্শন করেন। ঢাকা শহরে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য ভর্তি হন ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ার কারণে কলেজিয়েট স্কুল থেকে বরখাস্ত করা হয় তাঁকে। মেধার কারণে স্থানীয় বেসরকারি বিদ্যালয় কিশোরীলাল জুবিলী স্কুল তাকে পড়াশোনার সুযোগ করে দেয়। জাতপাত ভিত্তিক এক নিকৃষ্টতম উৎপীড়নের ঘটনা এই স্কুলেই ঘটে তার জীবনে। রমা সাহা লিখছেন– সরস্বতী পূজার দিন তিনি দেবী প্রতিমার সামনে অঞ্জলি দিতে গেলে একজন ব্রাহ্মণ ছাত্র অঞ্জলি দিতে বারণ করেন। যতক্ষণ না ব্রাহ্মণ ছাত্ররা অঞ্জলি দেবে, ততক্ষণ তিনি অঞ্জলি দিতে পারবেন না –কারণ তিনি জাতের মর্যাদায় তাদের সমকক্ষ নন। এই ঘটনায় তাঁর মনে অত্যন্ত তিক্ত মনোভাবের সৃষ্টি হয়  এবং অঞ্জলি না দিয়েই তিনি পূজা মণ্ডপ ত্যাগ করেন। সম্ভবত এই ঘটনার পরেই হিন্দু দেবদেবীর উপরে শ্রদ্ধা হারান এবং কালে কালে তা  নিরীশ্বরবাদীতার রূপ নেয় (শীর্ষা বার্ষিকী ১৯৯২, পৃষ্ঠা ৪)।

১৯১১ সাল। আই এস সি-র ফলাফলে সত্যেন্দ্রনাথ বসু প্রথম, মেঘনাদ সাহা তৃতীয়। ওই বছর বি এস সি পড়তে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হলেন। ঘটলো আবার ‘নিম্ন-জাতি’ এই কারণে অপমানিত  হবার ঘটনা। হিন্দু হস্টেলে থাকবার সময় উচ্চবর্ণের ছেলেরা ঘরে খেতেন, সাহার খাবার দেওয়া হতো ঘরের বাইরে করিডরে। বর্ণবৈষম্যের জন্য লাঞ্ছনা দিতে শহরের এমন একটা উচ্চমার্গের প্রতিষ্ঠানেও কোন বিকল্প ঘটল না। তবে জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ

(পরবর্তীকালে একজন বিশিষ্ট বিজ্ঞানী হিসাবে খ্যাত)  -এর নেতৃত্বে তাঁর একদল সহপাঠী সাহাকে নিয়ে প্রতিবাদ করলেন এবং হিন্দু হোস্টেল ছেড়ে ১১০ নং  কলেজ স্ট্রিটের এক মেস বাড়িতে এসে জায়গা নিলেন। বলা বাতুলতা হবে না যে, এই প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে মেঘনাদ সাহা মিশ্র গণিতে এম এস সি পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে দ্বিতীয় হন, প্রথম সত্যেন্দ্রনাথ বসু। ১৯১৭ সালে এক সমীক্ষাপত্রে

(কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন আয়োজিত, যার প্রধান ছিলেন এম ই স্যাডলার) মেঘনাদ সাহা লেখেন, “যদি বিদ্যালয়কে আবাসিক করে তোলার কথা ভাবা হয় এবং যথাযথ ব্যবস্থা করা হয় তাহলে ‘ডেমোক্র্যাটিক ক্লাস’ বা গণতান্ত্রিক শ্রেণীর ( আমি তাদেরই গণতান্ত্রিক শ্রেণী বলে অভিহিত করছি যাদের পিছিয়ে পড়া শ্রেণী বলা হয় ) কথা ভাবতেই হবে। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে লাগোয়া হস্টেল রয়েছে, তাতে তথাকথিত উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণদের মৌরসিপাট্টা চলছে। সঙ্গে যোগ দিয়েছে কায়স্থ ও বৈদ্য ছাত্ররা। কোন গণতান্ত্রিক শ্রেণীর ছাত্রকেই ব্রাহ্মণ বা কায়স্থ ছাত্র একঘরে মেনে নেয় না বা একসঙ্গে খেতে বসলেও আপত্তি জানানো হয় “। এই সমানাধিকারের লড়াই সে সময়ের বিচারে নি:সন্দেহে বিশেষ উল্লেখ্যোগ্য।

             ক্রমশ খ্যাতি ও পরিচিতির সুবাদে সরাসরি জাতপাতভিত্তিক আক্রমণ কমে এলেও ব্রাহ্মণ্যবাদী সমাজ ব্যবস্থায় মেঘনাদ সাহাকে নানা সময় ও বিষয়ে বাধার পাহাড় টপকাতে হয়েছে তুলনায় সমসাময়িক বিজ্ঞানীদের চেয়ে অনেক বেশী।  চিন্মোহন সেহানবীশ ‘বারোমাস’ পত্রিকার ডিসেম্বর সংখ্যার পৃষ্ঠা ৫৪ তে লিখছেন, ” আধুনিক যুগের পাশ্চাত্য বিজ্ঞানীদের প্রশ্ন ওঠেই না, এমনকি এদেশের কোন খ্যাতিমান বিজ্ঞানীর সঙ্গে মেঘনাদের তুলনা চলে না এদিক থেকে। জগদীশচন্দ্র, প্রফুল্লচন্দ্র থেকে তরুণ বিজ্ঞানী পর্যন্ত সকলেই স্বচ্ছল ও শিক্ষিত পরিবারের সন্তান, কেউ কেউ তো রীতিমতো বড় ঘরের ছেলে। হয়তো পৈত্রিক অস্বচ্ছলতার মাপকাঠিতে একমাত্র রামানুজনের সঙ্গে মেঘনাদের কিছুটা তুলনা চলে–যদিও মনে রাখতে হবে রামানুজন ছিলেন ব্রাহ্মণ সন্তান”।

       ভারতের বিজ্ঞান চর্চার ইতিহাসে মেঘনাদ সাহার নাম ও ভূমিকা দীর্ঘদিন শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করাটা আমাদের বিশেষ দায়িত্ব। একে ভুলিয়ে দেবার যে কোন প্রচেষ্টাই নিন্দনীয়।

1 thought on “অধ্যাপক মেঘনাদ সাহা: জাত-জালিয়াৎ খেলছে জুয়া”

  1. When I was a child I was considered precocious.At the age of 10 or 12 I used to read Bengali magazines for adults at the homes of my playmates who showed no interest in them.In those days many educated Assamese used to subscribe to Bengali magazines.
    I distinctly remember reading with fascination a series of articles by Meghnad Saha on bombastic claims about ancient Hindu achievements in science.He punctured these balloons with a scholarship that was both amazingly extensive and precise.Otherwise I would not have remembered the incident today.
    My elder sister who has crossed ninety years now, had as classmate Krishna,Meghnad Saha’s daughter, when she was studying at the govt.medical college in Kolkata.When I wanted to know more about him my sister told me of his impressive,somewhat forbidding personality.Perhaps his years of humiliation had forced him to wear such a public mask.
    By the way Satyen Bose and he together published the first English translation of Einstein’s epoch-making making paper on special relativity.

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top