সন্তোষ সেন
আবারো ফিরে এলো ২০১৩ সালের কেদারনাথ বিপর্যয়ের স্মৃতি। চামোলির জোশীমঠে হিমবাহ ভাঙ্গা বিপুল জলস্রোত নদীবাঁধ, সেতু, বোল্ডার, বাড়িঘর সবকিছুকে উপড়ে ভাসিয়ে নিয়ে গেল। হড়পা বানে ভাসল অলকানন্দা, ধৌলি, গঙ্গা নদী। নদীর পাড়ের বেশকিছু জনবসতি, রেনি গ্রামের বড় অংশ কার্যত নিশ্চিহ্ন। সরকারি পরিসংখ্যান বলছে নিখোঁজ কমপক্ষে ২০০ জন, যাদের মধ্যে অধিকাংশেরই মৃত্যু হয়েছে বলে আশঙ্কা প্রকাশ প্রশাসনের।
এবারের বিপর্যয় ফিরিয়ে এনেছে ২০১৩’ র জুনে মেঘ ভাঙ্গা বৃষ্টির ভয়াবহ স্মৃতি, যাতে প্রাণ গিয়েছিল প্রায় ছয় হাজার মানুষের। সেবার বর্ষা এবং মেঘ ভাঙ্গা প্রবল বৃষ্টি ডেকে এনেছিল বিপর্যয়। যদিও তখনও নদী বিশেষজ্ঞ পরিবেশবিদ ও বিজ্ঞানীদের এক বড় অংশ জোর দিয়ে বলেছিলেন পাহাড়ি নদীর ওপর যত্র তত্র বাঁধ নির্মাণ এবং নদীর পাড় বরাবর ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে ওঠা হোটেল রিসোর্ট এর কারনে এই বিপর্যয় আরো ভয়াবহ হয়েছিল। শয়ে শয়ে গ্রাম জলের স্রোতে তলিয়ে গিয়ে হাজার হাজার মানুষের জীবন দুর্বিসহ করে তুলেছিল। এবারের বিপর্যয়ের দিকে তাকালেও সে একই চিত্র দেখা যাবে।
তথ্য কি বলছে?
কাঠগড়ায় সেই উত্তরাখণ্ডের যত্রতত্র ভুইঁ ফোড়ের মতো গজিয়ে ওঠা জলবিদ্যুৎ প্রকল্প আর অবাধে বনভূমি ধ্বংস। এবারের বিপর্যযের পিছনে প্রকৃতির রুদ্ররোষ একটা কারন তো বটেই, কিন্তু এর পিছনে man-made ডিজাস্টার এর সম্ভাবনাও পুরোপুরি উড়িয়ে দিচ্ছেন না বিশেষজ্ঞরা। এবারের বিপর্যয়ে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ঋষি গঙ্গা ও তপোবন জলবিদ্যুৎ প্রকল্প। এই দুটি প্রকল্প সম্পূর্ণ ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। কর্মরত শ্রমিকরা টানেলে আটকে পড়ে সবাই মারা গেছেন। সরকারি মতে- এই দুই প্রকল্প ধূলিসাৎ হওয়ায় ১,৫০০ কোটি টাকার অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে। ২০১৩ সালের বিপর্যয়ের কারণ খুঁজতে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে গঠিত পরিবেশ ও বনমন্ত্রকের বিশেষ কমিটির রিপোর্টে আঙ্গুল তোলা হয়েছিল পার্বত্য রাজ্যটিতে অপরিকল্পিত জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের বাড়বাড়ন্তের দিকেই। দেরাদুনের পিপলস সায়েন্স ইনস্টিটিউটের অধিকর্তা রবি চোপড়ার নেতৃত্বে কমিটি যে রিপোর্ট সুপ্রিমকোর্টে ২০১৪ সালে জমা দেয় তাতে স্পষ্ট সুপারিশ ছিল- অলকানন্দা ও ভাগীরথী নদীর অববাহিকায় অন্তত ২৬ টি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প অবিলম্বে বাতিল করতে হবে। কারণ এই নির্মাণের ফলে নদীর জলস্তর এবং গতিপথ, ধস আটকানোর বনভূমি, মাটি- পাথরের স্থিতিশীলতা– ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সবকিছুই। কেটে গেছে সাতটি বছর কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি বরং জলবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র গড়ে তোলার যে পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল তার মধ্যে একশ কুড়িটি নির্মাণের কাজ ইতিমধ্যেই শেষ। কাজ এগিয়েছে কিছু প্রকল্পের, অনুমোদনের অপেক্ষায় আরো বেশ কিছু প্রকল্প।
তপোবনের ছবি, সৌজন্যে ইসরো
বিশেষজ্ঞদের মতামত কি?
বাংলার নদী-বিশেষজ্ঞ কল্যান রুদ্র মনে করছেন, ” রান অফ দ্য রিভার মডেলে” জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মিত হলে তা নদীর বাস্তুতন্ত্রকে অনেক সময়ই ক্ষতিগ্রস্থ করে। বিখ্যাত পর্বতারোহী বসন্ত সিংহ রায় মনে করছেন-” নদীবাঁধ ও জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণের পাশাপাশি বনভূমি ধ্বংসও এই বিপর্যয়ের অন্যতম কারন।” এইসব ঘটনা থেকে রাষ্ট্রনায়করা কী কিছু শিখবেন, না কী কর্পোরেটের পাহাড়প্রমাণ মুনাফার জন্য চলবে নির্বিচারে বনভূমি ধ্বংস, যত্রতত্র নদী বাঁধ নির্মাণ ও জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের ঘনঘটা?
উত্তরাখণ্ডের মন্ডল গ্রামে প্রথম শুরু হয়েছিল রাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে চিপকো আন্দোলন ১৯৭৩ সালে। সাড়া জাগানো এই চিপকো আন্দোলনের অন্যতম নেতা, যিনি প্রকৃতিকে নিজের প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসেন, পাহাড়ের প্রতিটি গ্রাম, প্রতিটি নদীকে হাতের তালুর মতো চেনেন সেই চন্ডীপ্রসাদ ভাট তাঁর দীর্ঘ প্রবন্ধে হিমালয়ের বুকে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রবল বিরোধিতা করেন। সরকারকে এই চেতাবনি তিনি এরপরও শুনিয়েছেন বেশ কয়েকবার। অন্যদিকে ‘পহর’ পত্রিকার সম্পাদক, বিশিষ্ট পরিবেশবিদ ও “হিস্ট্রি অফ চিপকো মুভমেন্ট” গ্রন্থের প্রণেতা শেখর পাঠকও সরকারকে একই উপদেশ শুনিয়েছেন বারেবারে। কাকস্য পরিবেদন! উত্তরাখণ্ড ও দেশের রাজনীতিবিদরা এইসব চেতাবনি কানে তুললে এই ভয়াবহ বিপর্যয়ের সাক্ষী হয়তো হতে হতো না ভারতবাসিকে।
এটা কি প্রাকৃতিক দুর্যোগ?
১৯৭০ ও ১৯৭৮ সালে ভাগীরথী ও অলকানন্দার প্রবল বন্যা, ১৯৮৩ সালের কেদারনাথ কাণ্ড, তারপর আবারও ২০২১’র বিপর্যয়। ভূমিকম্পন প্রবণ, বয়সে নবীন ও ভঙ্গুর হিমালয় সংলগ্ন এলাকায় এইসব বিভীষিকাময় দুর্যোগগুলোর পিছনে প্রকৃতির রুদ্ররোষ কাজ করলেও এর মূলে মনুষ্যসৃষ্ট কারণগুলো কম দায়ী নয়। কারন খুব পরিষ্কার। হিমালয়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সবুজে মোড়া সুউচ্চ বনানী, নদীর স্বাভাবিক গতিপথ সহ তামাম জীব-বৈচিত্র্য অটুট থাকলে প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিভীষিকা ও ক্ষতিসাধন ক্ষমতা অনেকটা কম হয়।
বাস্তবে কি হলো?
নদীর পাড় বরাবর রাস্তা নির্মাণ, নদীর প্রাকৃতিক গতিপথ রুদ্ধ করে যত্রতত্র বাঁধ ও জলবিদ্যুৎ প্রকল্প, নদী চুরি করে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠলো হোটেল-রিসর্ট। নদীর বুকে ও পাহাড়ের কোলে জমা হতে থাকলো যতসব অপরিকল্পিত, অবৈজ্ঞানিক নির্মাণের কঠিন বর্জ্য। চারধামে যাওয়ার চার লেনের রাস্তা নির্মাণ। রুদ্ধ হলো নদীর স্বাভাবিক গতিপথ। এসবই হলো সরকারের প্রত্যক্ষ মদতে ও অদূরদর্শিতার কারণে। অথচ ঋষিগঙ্গা জল বিদ্যুত প্রকল্প যে পরিবেশ সহ স্থানীয় মানুষের ব্যাপক ক্ষতিসাধন করবে, তা বুঝতে পেরেই গ্রামবাসীরা এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রতিবাদে মুখরিত হয়েছেন প্রথম থেকেই। তারা আদালতে গেলে আদালতের স্পষ্ট রায় ছিল- ” হিমালয়ের একেবারে ভিতরে নদীকে অনেকটা পথ ঘুরিয়ে নিয়ে গিয়ে বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপন করলে তা হিমালয়ের সামগ্রিক পরিবেশ ধ্বংস করে বিপর্যয় ডেকে আনবে”। এই রায় কে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে নানান পন্থা-পদ্ধতি অবলম্বন করে নির্মাণ কাজ চলছেই। আসলে সরকার ও কর্পরেটের একটাই বাণী- যে কোন মূল্যে ছুটিয়ে নিয়ে চলো ছিন্নমস্তা উন্নয়নের রথ। ফল যা হবার তাই হলো।
অন্য আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের দিকে পাঠকদের নিয়ে যাব এবার। জম্মু- কাশ্মীর থেকে লাদাখ, হিমাচল প্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, সিকিম, অরুণাচল প্রদেশ, মনিপুর মিজোরাম, ত্রিপুরা, মেঘালয়, আসাম হয়ে পশ্চিমবঙ্গ পর্যন্ত বিস্তৃত হিমালয় একদিকে যেমন হাজার লক্ষ প্রাণ ও উদ্ভিদ প্রজাতি নিয়ে অফুরন্ত জীব বৈচিত্র সমৃদ্ধ ভারতবর্ষের অন্যতম পর্বতশ্রেণী। অন্যদিকে এই হিমালয়ই আমাদের রক্ষা করে দানবীয় ঝড় ঝঞ্জার হাত থেকে, জন্ম দেয় অসংখ্য নদীর- যার ফলে ভারত নদীমাতৃক দেশ, বয়ে নিয়ে আসে মৌসুমী বায়ু- দেশ হয়ে ওঠে সুজলা সুফলা। অথচ দেশের পাহারাওয়ালা হিমালয় আজ বিপন্ন বহুজাতিক কোম্পানির পাহাড় প্রমাণ মুনাফা ও লোভের করালগ্রাসে আর নেতা- বাবু- ঠিকেদার ত্রিফলা বর্শার কোপে। প্রতিটি পরিকল্পনা করা হয় কর্পোরেটের অঙুলিহেলনে এই ত্রিফলা জোটের হাত ধরে। বিজ্ঞানী, হিমবাহ বিশারদ, পরিবেশবিদ, স্থানীয় মানুষের সহজাত বুদ্ধি, অভিজ্ঞতা সেখানে অপাংক্তেয়। এমনকি হিমালয়ের বিশেষ বিশেষ বৈশিষ্ট্যগুলোকে বুঝে নিয়ে প্রকৃতি পরিবেশের ক্ষতি না করে কতটা এবং কিভাবে নির্মাণ-কার্য করা সম্ভব সেই বিষয়ে কোন গবেষণা না করেই উত্তরাখণ্ডে টুরিজ্যম অর্থনীতিকে প্রধান গুরুত্ব দেওয়া হলো।
চামোলি কি আবার বিপর্যয়ের কবলে পড়তে পারে:
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে আরো একটি বিষয়কে স্পষ্ট করতে হবে। উপগ্রহ চিত্রে দেখা গেছে- এবারের হিমবাহ ধসের জেরে ঋষিগঙ্গা নদীর গতিপথে তৈরি হয়েছে বিপজ্জনক একটি হ্রদ। সেই হ্রদের দেওয়াল ভেঙে পাহাড়ি পথে ফের নেমে আসতে পারে বিশাল জলরাশি, নেমে আসবে হড়পা বান, আবারো বিপদগ্রস্ত হবেন হাজার হাজার মানুষ। এই ধরনের প্রাকৃতিক ঘটনাকে বলা হয় গ্লেসিয়াল লেক আউটবার্স্ট। আরো একটি ব্যাপার ঘটতে থাকে হিমালয়ীয় অঞ্চলে। বিশাল মাপের ভুমিধস (landslide) হলে সেই জায়গায় তৈরি হয় এইরকম বিপজ্জনক হ্রদ। এই হ্রদগুলিতে নুড়ি পাথর, বালি কাদা, বরফ গলা জলের পরিমাণ বাড়তে থাকলে যে কোন সময় হ্রদের বাঁধ(মোরেন) ভেঙে পড়ে বিপুল জলরাশির হড়পা বান দেখা দিতে পারে যে কোন সময়। বরফ গলা দুষিত কালো জল সূর্যের বিকিরণকে আরো বেশি করে শোষণ করে, ফলে জলের উষ্ণতা ও উচ্চতা দুইই বাড়তে থাকে। অন্যদিকে তীর্থযাত্রা, ট্যুরিজম ও তথাকথিত উন্নয়নের জাঁতাকলে ডিনামাইট চার্জ করে পাহাড় ফাটিয়ে রাস্তাঘাট, হোটেল-রিসর্ট নির্মাণকার্যের ফলে এইসব হ্রদগুলোর ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়ে যে কোন সময় আবারো ঘটতে পারে এই ধরনের
প্রাণঘাতী বিপর্যয়।
উপসংহারের পরিবর্তে:
হিমালয়ের অন্য এক কোলে অরুণাচল প্রদেশেও পরিবেশ ধ্বংস করে যেভাবে উন্নয়নের রথযাত্রা তুমুলবেগে ধাবমান তাতে আগামী দিনে এরকম ভয়ানক বিপর্যয়ের জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া গতি নেই। অন্যদিকে ভূউষ্ণায়ণ ও লাগামছাড়া দূষণের কারণে হিমবাহ গলতে থাকলে আগামীদিনে নৈসর্গিক হিমালয় হয়তো আরবের মরুভূমিতে পরিণত হবে। যার প্রভাব শুধু ভারতবর্ষের ওপর পড়বে এমনটা নয়, তিব্বত-নেপাল-ভুটান-চীন প্রতিটি দেশের নাগরিককে এর ফল ভোগ করতে হবে। তাই, কর্পোরেটের সেবাদাস ও দালাল সরকার- প্রশাসনের লোভ-লালসার উদগ্র বাসনায় নির্বিচারে প্রাণ- প্রকৃতি-পরিবেশ লুঠের যে খেলা চলছে তার বিরুদ্ধে প্রতিটি মানুষকে রুখে দাঁড়াতে হবে। পরিবেশ ভাবনা, পরিবেশ রক্ষার বিষয়টিকে দৈনন্দিন জীবন-যাপনের আঙিনায় নিয়ে আসতে হবে।
লেখক পরিচিতি:
বিজ্ঞান শিক্ষক, বিজ্ঞান ও পরিবেশ কর্মী।
Contact: santoshsen66@gmail.com