প্রীতিলতা বিশ্বাস
সাবেকী দোকান ঘরে সাজানো পসরার মাঝে ক্রেতা-বিক্রেতার প্রত্যক্ষ সংযোগের সুযোগ ক্রমশ কমে আসছে। ঘরে বসেই ফোন বা ল্যাপটপ থেকে কোন একটি অ্যাপের মাধ্যমে জিনিস অর্ডার করে নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে নিজের বাড়ির দরজা থেকেই বাহকের হাত থেকে জিনিসটি সংগ্রহ করে নেওয়া—এটাই আজকের দিনে এক শ্রেনির মানুষের কেনা-বেচার স্বাভাবিক চিত্র। আর এই ধরনের কেনা-বেচার নাম ই-বাণিজ্য। বিশ্বব্যাপি অন্তর্জালের প্রচলন হবার অনেক আগেই 1972 সালে মাইকেল অ্যালড্রিচ নামক একজন ব্রিটিশ প্রথম টেলি শপিং বলে একটি পদ্ধতির উদ্ভাবন করেন। এই পদ্ধতিতে টেলিভিশন ও টেলিফোন ব্যবহার করা হতো। এরপর নব্বই এর দশক থেকে শুরু হয় বিশ্বায়নের যুগ, তথ্য প্রযুক্তির যুগ। আজকের ই-বাণিজ্যের দৈত্যাকার রূপ যে অ্যামাজনের, তার শুরুটা হয়েছিল 1994-এ। এরপর আসে ক্যালিফোর্নিয়ার ইবে, চীনের জিংডং, আলিবাবা, ইউরোপের জালান্ড, ইত্যাদি ই-কোম্পানি।
একটি রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে ই-বাণিজ্যের মাধ্যমে সারা বিশ্বে হওয়া খুচরো ব্যবসার আর্থিক পরিমান 2014 সালে ছিল 1.3 ট্রিলিয়ন ডলার। প্রতি বছর বৃদ্ধি পেতে পেতে 2019 সালে এর পরিমান দাঁড়ায় 3.5 ট্রিলিয়ান ডলার। 2020 তে প্যানডেমিকে তা বেড়ে হয়েছে 4.1 ট্রিলিয়ান ডলার। অতিমারিতে সারা বিশ্বে ‘ব্রিক এন্ড মর্টার রিটেল’ অর্থাৎ সাবেকী খুচরো ব্যবসা কমেছে 7.5%, সেখানে এককভাবে অ্যামাজনের ব্যবসা বেড়েছে প্রথম কোয়র্টারে 15%, দ্বিতীয় কোয়র্টারে 40%। অপর একটি সমীক্ষা থেকে দেখা যাচ্ছে পশ্চিম ইউরোপ এবং আমেরিকায় গড়ে 50 শতাং মানুষ বলছেন তারা এখন থেকে ই-শপিং ই করবেন।
ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার পরিবর্তন, বিশ্বব্যাপী পুঁজির অবাধ চলন, সমাজ জীবনে অর্থনৈতিক মেরুকরণ ই-বাণিজ্যের বাজার প্রস্তুত করেছে। ই-বাণিজ্যের বিক্রেতাদের প্রধান সুবিধা হলো, অনেক কম খরচে সারা বিশ্বের মানুষের কাছে পৌছনো যায়। আর সর্বশেষ মূলধন হিসাবে কাজ করেছে অতিমারির আতঙ্ক। গ্লোবাল ফিনান্সিয়াল টেকনোলজি কোম্পানি “এফ আই এস”র মতে অতিমারির পরবর্তী সময়ে 2024 সালের ভিতরে ভারতে ই-বাণিজ্যের মাধ্যমে খুচরো ব্যবসায় 80 শতাংশ বৃদ্ধি প্রত্যাশিত।
ছবি: দি নিউজ মিনিটস
এখন প্রশ্ন হলো অ্যামাজন, আলিবাবার মতো দৈত্যাকার ই-বাণিজ্যের দৌলতে ভারতের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে ক্ষুদ্র খুচরো ব্যবসায়ীদের ঝাপ বন্ধ করে বেকার হওয়ার সম্পর্ক আছে, কিন্ত পরিবেশের সম্পর্ক কোথায়? এবার আসি সেই প্রসঙ্গে। ই-বাণিজ্যের মাধ্যমে বিপণন হওয়া জিনিসপত্র যাতে সুরক্ষিত অবস্থায় ক্রেতার হাতে পৌঁছায় তার জন্য অতিরিক্ত প্যাকেজিং এর প্রয়োজন হয়। এই অতিরিক্ত প্যাকেজিং এর বেশির ভাগটাই হয় প্লাসটিক দিয়ে। অর্থাৎ অযথা বর্জ উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই প্লাস্টিক গুলির কিছু অংশ রিসাইক্লেবল। কিন্ত তা হলেও খুব একটা লাভ নেই। মানুষের অসচেতনতা এবং প্রশাসনিক স্তরে দুর্বল বর্জ ব্যবস্থাপনা প্রতিদিন দূষণের মাত্রা বাড়িয়ে যাচ্ছে যথেচ্ছ ভাবে। এছাড়া অতিমারিতে আই টি অফিসগুলি পরিকাঠামো সংকুচিত করে কর্মীদের বাড়ি থেকে কাজ করার নির্দেশ দিয়েছে। এক্ষেত্রে তারা অফিস ক্যানটিনের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। শিশুদেরও স্কুল বন্ধ। এদিকে রয়েছে অফিসের প্রজেক্ট টারগেট মেটানোর দায়বধ্যতা। ফলে তাদের খাবারের জন্য প্রায়শই হোম ডেলিভারি বা টেকঅ্যাওয়ে জাতীয় ব্যবস্থাপনার উপর ভরসা করতে হচ্ছে। খাবার প্যাকেজিং অধিকাংশটাই হয় মূলতঃ অ্যালুমিনিয়াম ফয়েলের বাক্সে বা কাগজে মুড়ে। এই অ্যালুমিনিয়াম ফয়েল প্রকৃতিতে মিশতে সময় নেয় 400 বছর। অনেক সময় রিসাইক্লিং কারখানাগুলোও এই অ্যালুমিনিয়াম ফয়েলের বর্জ নিতে চায় না, কারন এর সঙ্গে লেগে থাকা খাদ্যবস্তু আলাদা করাটা খুবই শ্রমসাধ্য বিষয়।
ভারতে মোট কঠিন বর্জ পদার্থের 8% প্লাস্টিক বর্জ। এ দেশে বর্জ পদার্থ সংগৃহীত হয় প্রায় কোন রকম পৃথকীকরণ ছাড়া এবং রিসাইক্লিং এর ব্যবস্থাটি চলে অপ্রাতিষ্ঠানিক একটি শৃঙ্খলের মাধ্যমে। ভারতে নথিভুক্ত এবং অনথিভুক্ত মিলিয়ে 7500 টি প্লাস্টিক রিসাইক্লিং এবং 312 টি ইলেকট্রনিক বর্জ রিসাইক্লিং কারখানা আছে। যে সংখ্যাটি যথেষ্ট নয় কোনভাবেই। সঠিক ব্যবস্থাপনা এবং বর্জ পৃথকীকরণের অভাবে সংগৃহীত বর্জের মাত্র 30% এর রিসাইক্লিং সম্ভব হয়। বাকিটা আবার ল্যান্ডফিলে ফিরে যায় স্বাভাবিক পদ্ধতিতে মাটিতে মেশার জন্য। আসুন একটু দেখে নিই কোন জিনিস কতদিনে প্রকৃতিতে মেশে।
- প্লাস্টিক বোতল: 70—450 বছর,
- প্লাস্টিক ব্যাগ: 500—1000 বছর
- কাঁচের বোতল: 1—2 লক্ষ বছর
- স্যনেটরি ন্যাপকিনস ও ডায়াপার: 500—800 বছর
- নাইলনের পোশাক: 30—40 বছর।
তালিকা আর দীর্ঘায়িত নাইবা করলাম। 2011 এর হিসাব অনুযায়ী ভারতে প্রতিদিন 63 মিলিয়ন টন বর্জ উৎপন্ন হয়। ঐ একই রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে যে 2000 থেকে 2011 সালে ভারতের 18 টি রাজ্যে বর্জ উৎপাদনের পরিমান বৃদ্ধি পেয়েছে 256%। অতিমারির পরবর্তী সময়ের কোন হিসাব এখনও নেই, যখন বিপুল পরিমানে চিকিৎসা বর্জও বৃদ্ধি পেয়েছে। আশার কথা কেরালার একটি সংস্থা পিপিই কিট থেকে বেডের মেট্রেস বানিয়েছে। লকডাউনে কার্বন গ্যাস নির্গমনের দরুন বায়ু দূষণ যখন অনেক কমেছিল তখন নিঃশব্দে জল, মাটি দূষণের আয়োজন বেড়েছে প্রচুর পরিমানে। আগামীদিনে ই-বাণিজ্যের বাড় বাড়ন্ত তাকে আরও অনেক পরিমানে বাড়িয়ে তুলবে বলেই মনে হয়। পরিবেশবিদরা এ বিষয়ে তিনটি R এর কথা বলেন। অর্থাৎ ‘Reduce’, ‘Reuse’, এবং ‘Recycle’। বর্জ উৎপাদন কমানো হলো প্রথম ধাপ। দ্বিতীয়তঃ উৎপন্ন বর্জকে পুনরায় ব্যবহার করা (সে জন্য গবেষনা এবং নতুন উদ্ভাবন প্রয়োজন)। শেষতঃ উপযুক্ত বর্জ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পৃথকীকরণ ও রিসাইক্লিং করা। মানব সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে গেলে এখনই প্রশাসন থেকে আমজনতা প্রত্যেকেরই সতর্ক হওয়া জরুরি।
লেখক পরিচিতি:
বিজ্ঞানের ছাত্রী, গণিতে সহকারী শিক্ষিকা হিসেবে কাজ করেছেন এক দশকের উপর। বর্তমানে প্রবাসী এবং ইতিহাস ও সমাজ বিজ্ঞান বিষয়ে জানা বোঝায় আগ্রহী।
যোগাযোগ:
পরিপ্রশ্নে আরও পড়তে পারেন : মুখ ও মুখোশ
গুরুত্বপূর্ণ লেখা। নির্মেদ এবং নির্ভরযোগ্য।
ধন্যবাদ অরুণজ্যোতি । আমাদের ব্লগের অন্য লেখাগুলো পড়ুন, মতামত দিন, শেয়ার করুন।