সুন্দরলাল বহুগুনা – পরিবেশ আন্দোলনের এক উজ্জ্বল পথিকৃৎ

পোস্টটি দেখেছেন: 60 পুলক গোস্বামী “ক্যা হ্যায় জঙ্গল কে উপর মিট্টি, পানি ঔর বায়র মিট্টি, পানি ঔর বায়র ইয়ে হ্যায় জিন্দিগী কা আধার ক্যা হ্যায় জঙ্গল কে উপর “ এক সময় এই স্লোগান অনুরনিত হয়ে বতর্মান উত্তরাখন্ডের আকাশে বাতাসে গ্রামে গঞ্জে ছড়িয়ে পড়ত। হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন – এ বাণী সুন্দরলালজী বহুগুনার তৈরী চিপকো আন্দোলনের সময়। […]

সুন্দরলাল বহুগুণা

পুলক গোস্বামী

“ক্যা হ্যায় জঙ্গল কে উপর

মিট্টি, পানি ঔর বায়র

মিট্টি, পানি ঔর বায়র

ইয়ে হ্যায় জিন্দিগী কা আধার

ক্যা হ্যায় জঙ্গল কে উপর “

এক সময় এই স্লোগান অনুরনিত হয়ে বতর্মান উত্তরাখন্ডের আকাশে বাতাসে গ্রামে গঞ্জে ছড়িয়ে পড়ত। হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন – এ বাণী সুন্দরলালজী বহুগুনার তৈরী চিপকো আন্দোলনের সময়।

          গত ২১শে মে ২০২১ শুক্রবার বেলা ১২:০৫ মিনিটে এই মহামতি যিনি সাধারণত হিমালয় রক্ষক বলেই পরিচিত ঋষিকেশের এইমস হসপিটালে কোভিড নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন ৯৪ বছর বয়সে। তিনি ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ জনিত রোগেও আক্রান্ত ছিলেন।

        আজ যদি গাছেরা শোক পালন করতে পারত তাহলে তারা কোভিড ভাইরাসকে অভিযোগ করত – যেসকল অর্থলোভী মুনাফাখোর কর্পোরেট সংস্থা আমাদের কেটে জল-জমি-জঙ্গলকে ধ্বংস করে, রাস্তাঘাট-নগরায়ন করছে, উন্নয়নের নামে নদীবক্ষে বাঁধ তৈরি করে জলবিদ্যুৎ তৈরি করে পাহাড়ে হড়পাবানকে আহবান করছে – হিমালয়ের জনজীবনকে পর্যুদস্ত করে তুলেছে, তাদের বিরুদ্ধে যে বন্ধু আওয়াজ তুলে এসেছে আজ তাকেই তোমরা পৃথিবী থেকে সরিয়ে নিলে এ কেমনতর বিচার?

           বাংলার সাথে এই বহুগুণা পরিবারের একটি যোগসূত্র রয়েছে। ওখানকার সম্রাট একবার অসুস্থ হয়ে সুন্দরলালজির পূর্বপুরুষকে ডেকে আনেন আয়ুর্বেদ চিকিৎসা করানোর উদ্দেশ্যে। তিনি সম্রাটকে সারিয়ে তোলার পর ওখানে দুটি গ্রাম তাকে দেওয়া হয় বসবাস করার জন্য। সেই থেকে তাঁরা ওখানের স্থায়ী বাসিন্দা। হিমালয়ের বনাঞ্চলের ঔষধি ও তার গুনাবলী নিয়ে চর্চা করতেন তাঁরা এবং এক গভীর ভালোবাসা জন্মেছিল এই পরিবারের সঙ্গে প্রকৃতির।

           সেই পরিবারে তেহরি জেলার মারোদা গ্রামে ৯ই জানুয়ারি,১৯২৭ সালে সুন্দরলালজীর জন্ম। সমাজের কল্যাণের জন্য সংগ্রাম করা এবং লেখনি দিয়ে সমাজকে উদ্বুদ্ধ করার জন্যই যেন তার জন্ম। মাত্র তের বছর বয়স থেকে তিনি ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে বিনোবা ভাবের সর্বোদয় সংগ্রামে অংশীদার।

                তাঁর চলার পথ ছিল নানা দিকে বিস্তৃত। স্বাধীনতা আন্দোলনের পর তিনি তেহরি থেকে ২০ কিমি দূরে সিলিয়ারীতে একটি আশ্রম তৈরী করেন – বিশেষ করে দলিত নারীদের জন্য। সেই সময় দলিতদের মন্দিরে প্রবেশাধিকার ছিল না এবং স্থানীয় বাসিন্দারা যদিও মাদকাসক্ত ছিলনা কিন্তু ঐপথে মদ পাচার হতো। নারীদের সংগঠিত করে গান্ধীবাদী আন্দোলন করে মন্দিরের প্রবশাধিকার অর্জন করেন এবং সরকারি সহায়তায় মদ পাচার বন্ধ করতে সমর্থ হন। তিনি প্রচুর বিদ্যালয় এবং হোস্টেল তৈরী করেন বিশেষ করে প্রান্তিক মানুষদের ছেলে মেয়েদের পড়াশোনার জন্য।

চিপকো আন্দোলন
চিপকো আন্দোলন

                   কিন্তু সমগ্র বিশ্বের কাছে বিশেষ করে চিপকো আন্দোলনের সময় থেকে তিনি পরিবেশ আন্দোলনকারী হিসাবে পরিচিত। চিপকো কথার অর্থ ‘চিপে রাখা’। এই সময় সরকার ও ঠিকাদারদের যৌথ উদ্যোগে তেহরি অঞ্চলে প্রতিদিন শতাধিক গাছ কেটে সেখানে নগরায়ণ এবং রাস্তা ঘাট তৈরী করার পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হচ্ছিল। এলাকার আদিবাসী মহিলাদের উদ্যোগে ১৯৭৩ সালে এই আন্দোলন এক অভুতপূর্ব রূপ নেয়। গৌড়া দেবীর নেতৃত্বে মহিলারা গাছকে আঁকড়ে ধরে ঠিকাদারদের করাত চালাতে ব্যর্থ করেন। এই সময় বহুগুনাজীর আরেক সাথী ছিলেন পরিবেশ আন্দোলনকারী চন্ডী প্রসাদ ভাট। এমারজেন্সির সময় এই আন্দোলনের ভাটা পড়লেও পরবর্তীকালে তা ফুলেফলে ছড়িয়ে পড়ে। এ সময়ে সুন্দরলালজী কাশ্মীর থেকে কোহিমা পর্যন্ত পদযাত্রা করেন প্রায় ৪৮০০ কিমি রাস্তা। পিঠে ৩০ কেজি ওজনের ব্যাগ – তার মধ্যে চিপকো আন্দোলনের বই-কাগজ পত্র। উদ্দেশ্য – হিমালয়বাসীর মধ্যে পরিবেশ সম্পর্কিত জনচেতনা জাগিয়ে তোলা। এ সময়ে তিনি লক্ষ করেছেন- conection between forests, livelihood, gender inequalities and sheer injustice of development that stole trees, soil, water away from villagers to benefit the city dwellers.

             চিপকো আন্দোলনের প্রধান স্লোগান ছিল – Ecology is permanent economy. তিনি মনে করতেন স্থায়ী অর্থনীতির জন্য প্রয়োজন বাস্তুতন্ত্রের সমতা। কারণ হিমালয়ের বনাঞ্চলকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে গ্রামীন সভ্যতা। নগরায়ণ ও জল বিদ্যুতের প্রয়োজনে ভঙ্গুর হিমালয়ের বাস্তুতন্ত্রকে নষ্ট করলে তার প্রভাব যে কি মারাত্মক হবে তা তিনি যেমন নিজে উপলব্ধি করেছেন, আজ বাস্তবতঃ কয়েক বছর ধরে চামোলীতে যেভাবে হড়পা বান এসে জনজীবন পর্যুদস্ত করে তুলেছে তাতে হিমালয়ের অস্তিত্ব কতদিন থাকবে এই প্রশ্ন ভারতীয় জনমনে উঠে আসছে। তাঁর মতে বনরক্ষাকে কখনোই অর্থনৈতিক শর্তে বিচার করা যাবেনা।

                ভাগীরথী নদীর উপর তেহরি ড্যাম নির্মাণ করে তার জলপ্রবাহকে দিল্লীতে নিয়ে যাওয়ার বিরুদ্ধে তিনি ১৯৮০ সাল থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত আন্দোলন করেছেন গান্ধীবাদী পথে। সত্যাগ্রহ করেছেন-অনশন করেছেন। ১৯৮১ সালে তিনি পদ্মশ্রী উপাধি গ্রহন করেন নি যেহেতু তেহরি ড্যামের প্রকল্প বাতিল হয়নি। পরবর্তীকালে পদ্মবিভূষণ তাঁকে দেওয়া হয়। রাজ্য-কেন্দ্র সরকার এবং কনস্ট্রাকশন কোম্পানির যৌথ শক্তির কাছে তার তেহরি ড্যাম বিরোধী আন্দোলন ব্যর্থ পর্যবসিত হয়।

                    এখন বোঝার- তিনি হিমালয়ের রক্ষক হিসেবে যেভাবে দেখেছেন হিমালয়কে তাঁর সেই দেখা একজন সমতলের মানুষ কিভাবে দেখবেন?

           ভারতবর্ষের তিনদিকে সমুদ্র – বঙ্গোপসাগর, আরব সাগর এবং ভারত মহাসাগর। উত্তরে বিশালাকার প্রাচীরের ন্যায় দন্ডায়মান সুউচ্চ হিমালয় এই মৌসুমী বায়ুকে বাধা দান করে তার জলীয় বাষ্পকে বরফে পরিনত করে এবং বৃষ্টিরও উৎপত্তি হয়। এখান থেকে বরফ গলা জলে সারা বৎসর ধরে নদীগুলি বয়ে চলে যায় আরব সাগরে এবং বঙ্গোপসাগরে। পলিবাহিত এই নদীগুলি বিস্তৃত সমভূমি তৈরী করেছে যেখানে অল্প শ্রমেই ফসল উৎপন্ন হয়। আজকের ভারতবর্ষের যে নগরগুলি, শিল্পক্ষেত্রগুলি, বানিজ্যক্ষেত্রগুলি গড়ে উঠেছে এই নদীগুলিকে কেন্দ্র করে তা কি টিকে থাকবে যদি হিমালয়ের অস্তিত্বই না থাকে? গ্লোবাল ওয়ার্মিং-এর কারণে হিমালয়ের বরফ গলতে শুরু করেছে। হড়পা বান নিত্যসাথী হয়ে উঠেছে – বসন্ত ধীরে ধীরে লোপ পাচ্ছে। ছয় ঋতুর যে দেশ ভারতবর্ষ যার ভিত্তি হিমালয় তার কি অস্তিত্ব থাকবে? হয়তো হিমালয়ের ধ্বংসের কারনে ভারতবর্ষ একটি মরুভূমি অঞ্চলে পরিনত হবে। সুজলা সুফলা দেশে শুধুই বালুচর। এতো কোটি কোটি মানুষ, জন্তু-জানোয়ার, গাছ পালা এ সবের কি হবে?

                এই প্রশ্নে আমরা ভাবতে পারছি না কারণ আমাদের মনে গভীর অসুখ প্রবেশ করেছে। অর্থসাধনায় এবং উন্নয়নের পূজায় আজ আমরা সব মানবিক তথা জাগতিক সম্পর্ককে ভুলে নিজস্ব সুখ সাধনায় মেতে উঠেছি।

                  পুঁজির লোভাতুর গ্রাসে আজ সারা বিশ্ব জুড়েই পরিবেশ বিপন্ন – বিপন্ন মানুষ – বিপন্ন সমাজ। আজ আরব সাগরে ও বঙ্গোপসাগরে নিয়ম করে প্রতি বছর ঝড় আছড়ে পড়ছে বোম্বাই ও বঙ্গের উপকূলে। সীমাহীন ক্ষতি আজ উপস্থিত মানব সমাজে। ভাইরাসের আক্রমণও তার একটা নমুনা।

                     তাই কর্পোরেট স্বার্থ ও পরিবেশ এক অসমাধিত দ্বন্দ্বে উপস্থিত হচ্ছে। সমগ্র বিশ্বমানবকে এর সমাধানে হাত লাগাতে হবে – নতুবা মানব সভ্যতাই শেষ হয়ে যাবে। সেখানে সুন্দরলালজী বহুগুনা এক আলোক বর্তিকা।

লেখক পরিচিতি:

কয়লা- খনির শ্রমিক ও সমাজ কর্মী।

Contact:

pulakg720@gmail.com

1 thought on “সুন্দরলাল বহুগুনা – পরিবেশ আন্দোলনের এক উজ্জ্বল পথিকৃৎ”

  1. ভীষন ভালো পর্যবেক্ষণ।কোথাও জানো ঠাকুরের মুক্ত ধারার স্পর্শ পেলাম।সত্যই আগামী দিনে পরিবেশ নির্ভর অর্থনীতি সারা বিশ্বের পর্যালোচনায় আশা উচিৎ।ধন্যবাদ লেখক কে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top