IPCC (Intergovernmental Panel on Climate Change) – র ষষ্ঠ রিপোর্ট: ভয়ঙ্কর প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন মানব সভ্যতা

যদিও এটা  রিপোর্টের প্রথম ধাপ, পুরো রিপোর্টটি প্রকাশিত হবে ২০২২ সালের মধ্যে।

বিশ্বের প্রতিটি এলাকার জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে প্রচুর পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও গবেষণার পর ১৯৫ টি সদস্য দেশকে নিয়ে দুই সপ্তাহ জুড়ে বৈঠকের পর ষষ্ঠ রিপোর্ট পেশ করেছে রাষ্ট্রপুঞ্জের জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত আন্তঃরাষ্ট্র প্যানেল ( IPCC- 6th Report1) এই বছরের ৯ ই আগস্ট। এই রিপোর্টের পদে পদে পৃথিবীবাসীর জন্য রয়েছে চরম বিপদ বার্তা। যদিও এটা  রিপোর্টের প্রথম ধাপ, পুরো রিপোর্টটি প্রকাশিত হবে ২০২২ সালের মধ্যে। এই রিপোর্টের ভয়ানক বার্তাগুলি নিম্নরূপ।

 প্রথমত:  মনুষ্যকৃত নানা উন্নয়ন, নগরায়ন এবং জীবাশ্ম জ্বালানির অত্যধিক ব্যবহারের ফলে কার্বন ডাইঅক্সাইড সহ অন্যান্য গ্রীন হাউজ গ্যাস নির্গমন বেড়ে গেছে প্রচুর পরিমাণে। ফলে ১৮৫০ থেকে ১৯০০ সালের মধ্যে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বেড়েছে ১.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা আগামী এক দশকেই (২০৩০ সালের মধ্যে) ১.৫ ডিগ্রী এমনকি ২.০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের সীমাও ছাড়িয়ে যাবে। উন্নত মানের প্রযুক্তি ও উষ্ণায়নের সমস্ত ঐতিহাসিক তথ্য ব্যবহার করেই এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন আইপিসিসি। আইপিসিসি ওয়ার্কিং গ্রুপের সহ উপদেষ্টা Masson Delmotte বলেছেন- “এই রিপোর্ট বাস্তব তথ্য বিশ্লেষণ করেই করা হয়েছে। অতীত- বর্তমান- ভবিষ্যৎ’ র জলবায়ু পরিবর্তনের স্পষ্ট চিত্র বর্তমানে হাজির হচ্ছে আমাদের সামনে।”

দ্বিতীয়ত:  স্থলভাগের তাপমাত্রা পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধিকেও ছাড়িয়ে গেছে এবং আর্কটিক অঞ্চলে এই বৃদ্ধি দ্বিগুণেরও বেশি। এর প্রভাব বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশেই লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ফলে তীব্র তাপপ্রবাহ, গ্রীষ্মকালের সময়সীমা বৃদ্ধি এবং শীতের সময় কমে যাওয়া আজ নিউ নরমালে পরিণত হয়েছে। যার ভয়ঙ্কর প্রভাব পড়ছে মানুষের স্বাস্থ্য ও চাষ-বাস এর ওপর।

তৃতীয়ত: জলবায়ুর দ্রুত পরিবর্তন ও ভূউষ্ণায়নের কারণে যেসব বিপদগুলোর সম্মুখীন হচ্ছে বিশ্ববাসী তা হল নিম্নরূপ।

◆ মেঘভাঙ্গা বৃষ্টি, বন্যা-প্লাবন এবং তীব্র তাপপ্রবাহ ,দাবানল, খরা পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে একই সাথে লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

( দাবানলের লেলিহান শিখায় জ্বলছে গ্রীস। একই ছবি তুরস্ক- ইতালি- রাশিয়া- কানাডা ও ক্যালিফোর্নিয়াতেও। অন্যদিকে প্রবল বৃষ্টি-বন্যায় ধুয়ে-মুছে গিয়েছে চীন ও জাপানের বিস্তীর্ণ অঞ্চল। ভারতবর্ষের একাধিক শহরও বন্যার কবলে)।

◆ বৃষ্টিপাতের ধরনেও পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে উচ্চ-অক্ষাংশ অঞ্চলে বৃষ্টির পরিমাণ বেড়েছে। অন্যদিকে বিষুব-অঞ্চলে (যা বেশি বৃষ্টিপাতের অঞ্চল বলেই পরিচিত) বৃষ্টিপাতের পরিমাণ অনেক কমেছে। তার মানে বৃষ্টিপাতের ধরণ উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে হয়ে গেছে।

◆ পুরো একবিংশ শতাব্দী ধরেই সমুদ্র জলের উচ্চতা বাড়ায় উপকূলবর্তী এলাকাগুলিতে ভূমিক্ষয় ও প্লাবন হচ্ছে বারে বারে। জলস্তর বৃদ্ধির কারণে নানান বিপর্যয় আগে ১০০ বছরে একবার হতো, যা এই শতকের শেষ নাগাদ বছরে এমনকি একাধিকবার ঘটবে।

◆ পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় পার্মাফ্রস্ট (শুষ্ক বরফের চাঁই), মেরুপ্রদেশ এবং হিমালয়ের বরফ গলছে অতি দ্রুত হারে। ২০০৬–২০১৮ সালের মধ্যে প্রতিবছর সমুদ্রের জলস্তর বাড়ছে প্রায় চার মিলিমিটার করে। সমুদ্র জলস্তরের তাপমাত্রা ও উচ্চতা দ্রুত হারে বেড়ে যাওয়ায় সমুদ্রে অক্সিজেনের পরিমাণ কমছে, সমুদ্র জলের অম্লতা বাড়ছে আরো বেশি করে। এর ফলে জলজ প্রাণী সহ সমুদ্রের সামগ্রিক বাস্তুতন্ত্রের উপর ভয়ানক বিপর্যয় নেমে আসবে এবং জীবন জীবিকার জন্য সমুদ্রের উপর নির্ভরশীল মানুষও ব্যাপকহারে বিপর্যস্ত হবেন।

◆ বায়ুদূষণ অতন্ত্য বেড়ে যাওয়ায় ফুসফুস ও শ্বাসনালীর অসুখ বিসুখ বাড়ছে। শুধুমাত্র এই কারণেই বিশ্বজুড়ে প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ মানুষ মৃত্যুর কবলে পড়ছেন।

◆ নির্বিচারে বন ধ্বংস, সবুজ বনানী কেটে ও জলাশয় বুজিয়ে আরবানাইজেশন’ র ফলে শহর গুলি পরিণত হয়েছে উষ্ণায়নের হটস্পটে। সারা বিশ্বের পাশাপাশি কলকাতাও যে বড় বিপদে তা স্পষ্ট রাষ্ট্রপুঞ্জের রিপোর্টে। এর পিছনে দুটো বিষয়কে প্রধানত দায়ী করা হয়েছে– বিশ্বজুড়ে গ্রিনহাউস গ্যাসের অত্যধিক নির্গমন এবং অপরিকল্পিত ও অবৈজ্ঞানিকভাবে গড়ে তোলা নগরায়ন। আইপিসিসি’র  রিপোর্ট বলছে– শহরাঞ্চলে বায়ু চলাচলের সুযোগ কমিয়ে দিচ্ছে নগরায়নের বাড়াবাড়ি। শহরাঞ্চলে সূর্যের তাপ ঢুকছে, কিন্তু সেটা বেরিয়ে যেতে পারছে না। গায়ে গায়ে প্রাসাদ-অট্টালিকা, চাষের জমি নেই। সবুজ ধ্বংস করে জলাশয়-পুকুর বুজিয়ে কংক্রিটের জঙ্গল আর বিভিন্ন ইমারতি পরিকাঠামো তাপ শুষে নিচ্ছে অনেক বেশি করে। কারখানা বা বাড়ির হিটিং,  কুলিং সিস্টেম থেকে বেরোনো তাপও দায়ী এর পিছনে। একেই বলে “আরবান হিট আইল্যান্ড”। আর এর ফলে আশেপাশের এলাকার তুলনায় কলকাতার মত মেট্রো শহরগুলির তাপমাত্রা বাড়ছে দ্রুত এবং অনেক বেশি হারে। এর প্রভাব পড়ছে জল-চক্রেও। কখনো অল্প সময়ে বেশি বৃষ্টি শহর ভাসিয়ে দিচ্ছে, আবার কখনো বিপত্তি বাড়াচ্ছে “আরবান ড্রাইনেস আইল্যান্ড”।

পরিপ্রশ্নে আরও পড়তে পারেন : নারী: সেকাল, একাল, ভাবীকাল

IPCC ‘র এই ষষ্ঠ রিপোর্টকে এক কথায় বললে দাঁড়ায়– তীব্র তাপপ্রবাহ, দাবানল, খরা, অতিবৃষ্টি- বন্যা-প্লাবন, সামুদ্রিক ঝড়ঝঞ্জা, বরফের গলন, সমুদ্র জলের তাপমাত্রা ও উচ্চতা বেড়ে যাওয়া, উপকূলবর্তী অঞ্চলগুলো ঘনঘন প্লাবিত হওয়া — এই সব ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয়গুলো সংখ্যায় ও প্রাবল্যে দিন দিন বাড়ছে এবং আগামী দিনে তা আরো ভয়ঙ্কর আকার নেবে। আর এইসব দুর্যোগ দুর্বিপাক একটি অঞ্চলে আটকে না থেকে ছড়িয়ে পড়বে বিশ্বের নানা প্রান্তে। ২০৩০ সালের মধ্যে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ১.৫ থেকে ২.০ ডিগ্রি বেড়ে গেলে মানবসভ্যতার ওপর চরম বিপর্যয় নেমে আসবে। রাষ্ট্রপুঞ্জের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস যাকে বলেছেন – ” সমগ্র মানব সভ্যতার জন্য লাল সতর্কবার্তা”।

তাহলে এর থেকে মুক্তির কী কোন পথ নেই? এক এবং একমাত্র সমাধান: মুষ্টিমেয় বহুজাতিক কর্পোরেটের লোভ-লালসা ও পাহাড়প্রমাণ মুনাফার স্বার্থে নির্বিচারে প্রাণ প্রকৃতি পরিবেশ লুঠ বন্ধ করতে হবে অবিলম্বে। বাজারের স্বার্থে গাদাগাদা অপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য উৎপাদন নয়, মানুষের ন্যুনতম প্রয়োজনের স্বার্থে জনকল্যাণমূলক, সমাজমুখি ও প্রকৃতিবান্ধব উৎপাদনে জোর দিতে হবে। জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার অতি দ্রুত কমিয়ে আনতে হবে এবং তা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে হবে যত দ্রুত সম্ভব। কিন্তু রাষ্ট্রনায়করা কী এই কথাটা কানে তুলবেন? রাষ্ট্রপুঞ্জের রিপোর্ট বলছে– এত এত বৈঠকের পরও দেশগুলি নিজেদের কার্বন নিঃসরণে তেমন রাশ টানতে পারে নি বলেই তাপমাত্রা হুহু করে চড়ছে। চলতি বছরের শেষদিকে গ্লাসগোয় রাষ্ট্রপুঞ্জের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর বৈঠক। সেখানে ১৯৫ টি সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে রয়েছে ভারতও। রাষ্ট্রনায়করা একের পর এক চুক্তি করেছেন, কিন্তু কথা রাখেননি। তাই ওদের কুম্ভকর্ণের ঘুম ভাঙাতে এগিয়ে আসতে হবে বিশ্বের প্রতিটি মানুষকে। প্রকৃতি পরিবেশ রক্ষার সমস্ত আঞ্চলিক প্রতিবাদ-প্রতিরোধ গুলোকে মেলাতে হবে আন্তর্জাতিক আঙ্গিনায়। পরিবেশ বাঁচানোর দাবিতে বিশ্বজুড়ে ছাত্রছাত্রীরা রাস্তায় নেমেছে, আমরা কি হাতটা বাড়িয়ে দেব না কচিকাঁচাদের দিকে?

তথ্যসূত্র:

প্রতিবেদনটি লিখেছেন সন্তোষ সেন।

লেখক পরিচিতি:

বিজ্ঞান শিক্ষক, বিজ্ঞান ও পরিবেশ কর্মী।

Contact:  santoshsen66@gmail.com

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top