সন্তোষ সেন
“সিংহদরজা ভেঙে পড়ে ওই
পাহাড় ফাটায় নদী
রাজপথ ওই ইস্পাত ফলা
ঘেরে দাম্ভিক গদি ।
ফসলের ক্ষেতে রুদ্র নাচন
নিহত লাঙল কাঁধে
রক্ত তিলকে বিজয়ীর সাজ
চেয়ে দেখো ওই চাঁদে”।
(সংগৃহিত)।
আজ ১৯ শে নভেম্বর, গুরু নানকের জন্মদিন। এই বিশেষ দিনের সকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশ্যে এক ভাষণে ঘোষণা করেন–” তিনটি কৃষি আইন বাতিল করা হলো”। কৃষক ও জনগণের স্বার্থবিরোধী তিনটি কালা কৃষি বিল সংসদে পেশ করার পর থেকেই কৃষকরা এই বিল (পরে যা অগণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সংসদে পাশ করানো হয়) সম্পূর্ণরূপে বাতিল ও কৃষিপণ্যের নূন্যতম সহায়ক মূল্যের দাবিতে মরণপণ লড়াই শুরু করেন। আন্দোলনরত কৃষকরা সরকারের সাথে একাধিক আলোচনায় তাঁদের এই দাবিতে সরব থাকেন এবং সরকারের দেওয়া নানান প্রস্তাবকে সঙ্গত কারণেই বাতিল করেন। উল্লেখ্য এই নভেম্বরেই এই অসমসাহসিক লড়াইয়ের বর্ষপূর্তিতে অন্নদাতারা দেশব্যাপী আরো বড় লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিয়েছিলেন।
লক্ষ লক্ষ চাষীদের এই দৃঢ়, একরোখা এবং ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের কাছে মাথা নোয়াতে বাধ্য হলেন প্রধানমন্ত্রীজী। নিন্দুকেরা বলছেন- আগামী বছর পাঁচ রাজ্যের নির্বাচনে ভরাডুবির কথা ভেবেই প্রধানমন্ত্রীর এই ডিগবাজি।
আমরা মনে করি–মোদী সরকারের এই পিছু হঠা নিঃসন্দেহে কৃষক আন্দোলন এবং সংগ্রামী শক্তিদের জয়। আজ ‘সচ্চে মন সে(!)’ প্রধানমন্ত্রী ‘দীয়ার বাতির মত সরল সত্য’ কৃষকদের থেকে ঢেকে রাখতে অসফল হয়ে তথাকথিত ‘আন্দোলনজীবী’-দের দাবী মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন ঠিকই কিন্তু প্রগতিশীল শক্তিদের সতর্ক থাকতে হবে। কৃষক বন্ধুরা কি বলছেন দেখা যাক। ইতিমধ্যেই ‘সারা ভারত কিষান মহাসভা’ জানিয়েছে যে সংসদে তিনটে আইন প্রত্যাহার, ন্যূনতম সহায়ক মূল্য গ্যারান্টি আইন প্রনয়ন এবং লখিমপুর খেরীতে কৃষক হত্যাকারী কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী অজয় মিশ্রকে বরখাস্ত করার পরই দিল্লীর বর্ডার থেকে কৃষকরা ফিরবেন। ‘সংযুক্ত কিষান মোর্চা’ তাদের বিবৃতিতে কেন্দ্র সরকারের এই ঘোষণাকে স্বাগত জানানোর সাথে সাথে বিদ্যুৎ (সংশোধনী) আইন বাতিল করার দাবী স্মরণ করিয়ে উল্লেখ করেছেন যে, তারা গোটা পরিস্থিতির উপর নজর রাখছেন।
প্রধানমন্ত্রী ক্ষমা চাইলেন-কী তাঁর অভিসন্ধি:
দেশের দন্ডমুন্ডের কর্তা দেশবাসীর কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছেন। আপনার বোধোদয়কে আমরা কুর্নিশ জানাই। কিন্তু ডিমানিটাইজেশন, এন আর সি থেকে আরম্ভ করে কৃষি আইন, শ্রম কোড, দেশের জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা–আর কত, কত ভুল করবেন ও ক্ষমা চাইবেন আপনি? আপনার জেদের আগুনে কেন পুড়তে হলো সাতশ’এর বেশি কৃষক ভাইকে? তীব্র তাপপ্রবাহ, রোদ, জল মাথায় নিয়ে কেন দেশের অন্নদাতাদের এক অসম লড়াই চালিয়ে যেতে হল টানা একবছর ধরে? এন আর সি’এর নামে কেন লক্ষ লক্ষ দেশবাসীকে বেনাগরিক হতে হলো? কৃষি আইন প্রত্যাহারের জন্য গুরু নানকের জন্মদিনকেই বেছে নিতে হলো কেন? পাঞ্জাবের কৃষকদের ধর্মের সুড়সুড়ি দিয়ে গড়ে ওঠা ঐক্যকে ভাঙতে? এইসব নাছোড় প্রশ্ন তো ধেয়ে আসবেই প্রধানমন্ত্রীজী।

কী পেলাম আন্দোলন থেকে:
প্রাথমিক জয়ের উচ্ছাস কাটিয়ে কৃষক আন্দোলন যেসব গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হাজির করলো আমাদের সামনে, তা একনজরে দেখা যাক। প্রথমত: স্বাধীনতার পর রেল শ্রমিকদের টানা ২০ দিনের ধর্মঘটের পর এটাই সম্ভবত আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় ঐক্যবদ্ধ ও নিজেদের দাবিতে অনড় থাকার এক যুথবদ্ধ লড়াই। কৃষকরা নিজেদের জীবন দিয়ে বুঝেছেন – এই লড়াই বাঁচার লড়াই, জীবন-জীবিকার লড়াই, এই লড়াই জিততে হবে সমস্ত বাধা বিপত্তি হেলায় হারিয়ে। তাই কৃষক আন্দোলনে মহিলা, ছাত্র ছাত্রী এবং যুবা বাহিনীর এক অভূতপূর্ব ঐক্য ও মিলন লক্ষ্য করলাম আমরা। লক্ষ্য করলাম– হিন্দু মুসলিম শিখদের তথাকথিত বিভেদ ঘুচিয়ে জোটবদ্ধ হতে। যে খাপ পঞ্চায়েতগুলো ছিল মূলত নারী ও জাতি বিদ্বেষী, তা সব কিছু দূরে সরিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াইয়ের ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়লো, হাতে তুলে নিল নানান বর্ণের পতাকা, যার মূল সুর হলো- সব বিভেদ, ভাগাভাগি ভুলে লড়াইয়ের ময়দানে একসাথে থেকে, লঙ্গরখানায় খেয়ে, অন্যদের খাইয়ে সংগ্রামী চেতনায় শান দেওয়া। তাই আজকের জয়–এই সমমেলের, সম সুরের, সমবেত জয়গান। এই যুথবদ্ধতা ও সম্মিলনের শক্তিকে ভয় পেয়েই মাথা নোয়াতে হলো কেন্দ্রীয় সরকারকে।
দ্বিতীয়ত: কৃষকদের হার না মানা জেদ, সংগঠিত লড়াইকে নিজ নিজ স্বার্থেই নানাভাবে সমর্থন জানাতে বাধ্য হল বিজেপি বাদে সমস্ত সংসদীয় দল। লড়াকু কৃষকরা তাদের সামনে অন্য কোন পথ খোলা রাখেননি। যদিও লড়াই সংগঠিত করলেন মূলত পাঞ্জাব-হরিয়ানা-রাজস্থান-উত্তরপ্রদেশের বড় কৃষক, সাথে হাত বাড়িয়ে দিলেন–পায়ে পা মেলালেন প্রান্তিক চাষী, দিনমজুর, ভাগচাষীররাও, এমনকি ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক, যুবাবাহিনী সহ সমাজের নানান স্তরের মানুষ নানাভাবে মিশে গেলেন লড়াইয়ের ফল্গুধারায়। দিল্লি, হরিয়ানা, গুরগাঁও এর অটোমোবাইল শিল্পের শ্রমিকদের একটা অংশও সাধ্যমত এগিয়ে এলেন কৃষকদের পাশে।
তৃতীয়ত: কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে লড়াকু নেতৃত্ব দেশজুড়ে ফ্যাসিবাদের রমরমা ও চক্রান্তের জাল বিস্তারের বিরুদ্ধেও সরব হলেন। সংগ্রামী কৃষকরা বুঝলেন–দেশি বিদেশি বহুজাতিক কর্পোরেটের শ্যেন দৃষ্টি পড়েছে কৃষিব্যবস্থা ও কৃষিজমির ওপর। চুক্তি চাষের নামে তারা চায় নিজেদের মুনাফার স্বার্থে রপ্তানিযোগ্য পণ্য উৎপাদন করতে আর চুক্তি ভাঙার দোহাই দিয়ে কৃষকের জমি গ্রাস করতে। তারা চায় সরকারি মান্ডি তুলে দিয়ে কৃষি-বাজারকে নিজেদের দখলে রাখতে। তারা চায় অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইন ও মজুতদারি আইন তুলে দিয়ে পুরো কৃষিপণ্য ও বাজারকে কুক্ষিগত করে নতুন বিনিয়োগ ও মুনাফার পাহাড় গড়তে। কর্পোরেটের ফুলে ফেঁপে ওঠা কাল্পনিক-পুঁজির (ফিকটিশাস ক্যাপিটাল) ফানুস যাতে ফেটে না পড়ে তাই নতুন করে তাদের কৃষি জমি দখলের চক্রান্ত, নতুন বিনিয়োগের মধ্য দিয়ে কাল্পনিক পুঁজির মাটি খুঁজে পাওয়ার মরিয়া চেষ্টা, যাকে যোগ্য সঙ্গত করে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকার। তাই কৃষকরা তাঁদের লড়াইয়ের বর্শামুখ শানিত করলেন হাঙ্গর কোম্পানিগুলোর দিকে।
চতুর্থ: আজকের কৃষকদের জীবন-জীবিকার সমস্যার সাথে সরাসরি যুক্ত হয়ে পড়েছে প্রকৃতি পরিবেশ সহ কৃষি বাস্তুতন্ত্রের সামগ্রিক বিপর্যয়ের প্রশ্নটিও। কৃষকরা লড়াই করতে করতে বুঝলেন–তথাকথিত সবুজ বিপ্লবের নামে প্রচুর জল, রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করে উচ্চফলনশীল চাষ ছিল আসলে কর্পোরেটের ব্যবসা ও মুনাফার আর এক গল্প। এর বিরুদ্ধে তারা সরব হতে থাকলেন। ঠিক এই কারণেই পরিবেশ কর্মীরা সরাসরি কৃষক আন্দোলনকে সমর্থন করলেন। রাষ্ট্রের কোপানলে পড়তে হল দিশা রবি এমনকি গ্রেটা থুনবার্গকেও। আজ দেশ জুড়ে বিভিন্ন কোনায় কোনায় দাবি উঠেছে– প্রকৃতি মেরামতি করে মানুষকে সুস্থ রাখতে হলে সমস্ত রাসায়নিকের ব্যবহার বন্ধ করে দেশজুড়েই প্রকৃতিবান্ধব জৈবচাষ ও মিশ্রচাষের এক সামগ্রিক রূপরেখা হাজির করতে হবে। অনেকে হাতেকলমে এর প্রয়োগও করছেন। কৃষি-বাস্তুতন্ত্রকে বাঁচাতে ও খাদ্যশৃঙ্খলের দূষণ থেকে বাঁচতে রাসায়নিক চাষের বিকল্প পথ খুঁজতেই হবে কৃষক ভাইদের।
অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের দিকে চোখ রাখবো এবার। WTO (World Trade Organization) তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে কৃষিতে ভুর্তুকি দেওয়ার বিরুদ্ধে জোর কদমে আন্তর্জাতিকস্তরে আইনি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। তারা চায়- কৃষি থেকে সরকার হাত গুটিয়ে নিক, কৃষি ব্যবস্থা ও জমিকে কর্পোরেটের মৃগয়া ক্ষেত্র করে দেওয়া হোক (যদিও আমেরিকা ও ইউরোপের অনেক দেশেই প্রচুর পরিমানে ভুর্তুকি দেওয়া হয় কৃষিক্ষেত্রে)। ঠিক এই বাধ্যবাধকতার জায়গা থেকেই কৃষকদের তীব্র লড়াই সত্ত্বেও কৃষি আইন থেকে সরে আসতে পারছিল না কেন্দ্রীয় সরকার। কর্পোরেটের স্বার্থবাহি এইসব আন্তর্জাতিক সংঘগুলোর চাপ কিভাবে মোকাবিলা করা যায় সেই বিষয়টি নিয়েও ভাবতে হবে লড়াকু কৃষকদের। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে বামপন্থী দলগুলো কি এগিয়ে আসবেন ভারতবর্ষের কৃষি ও কৃষকদের বাঁচাতে?
উপসংহার:
প্রধানমন্ত্রীর দম্ভ ও অহংকার ভেঙে চুরমার হয়ে গেল কৃষকদের লড়াকু মেজাজের কাছে। এই অহংকার নিয়ে তিনি এতদিন চলতে পারছিলেন মূলত তিনটি কারণে। এর আগে দেশজুড়ে সেভাবে শ্রমিক-কৃষকের কোন ঐক্যবদ্ধ তীব্র লড়াই ছিল না।
আদর্শহীন, নীতিহীন ভাঙাচোরা বিরোধীপক্ষের অবস্থানও তাঁকে সুবিধে করে দিচ্ছিল। তিনি মনে করতেন এই দুর্বল বিরোধীপক্ষকে ধরাশায়ী করা খুব সহজ। সাথে ছিল সি বি আই, ইডি’ এর মত কেন্দ্রীয় সংস্থা দিয়ে বিরোধী দল ও নানান দাবিতে প্রতিবাদমুখর জনগণের কোমর ভেঙে দেওয়া এবং জাতি-ধর্ম-বর্ণে মানুষকে বিভক্ত করে রাখার ঘৃণ্য রাজনীতি। কৃষকদেরকেও দাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল খালিস্তানী, পাকিস্তানি বলে। যদিও এই চক্রান্তকে পুরোপুরি ব্যর্থ করে দিল কৃষকদের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক স্তরে ট্রাম্পের সাহায্য-সমর্থন তিনি পেয়ে যাচ্ছিলেন সমানতালে। কিন্তু বাইডেনের নেতৃত্বে আমেরিকা অর্থনৈতিকভাবে চীনের পাশে দাঁড়িয়ে যাওয়ায় মোদি সাহেব কি ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়লেন? অন্যদিকে কৃষকরা মতাদর্শগত লড়াইকেই সামনে রেখেই ঐক্যবদ্ধ হলেন, কর্পোরেটের বিরুদ্ধে দাঁড়ালেন, ফ্যাসিবাদের পদচারণায় বিপক্ষে পা রাখলেন, কেন্দ্রীয় সরকারের ভিত নড়বড়ে করে দিলেন। এখানেই কৃষক আন্দোলনের আসল জয়ের চাবিকাঠি, এটাই আজকের দিনের বড় শিক্ষা ও চরম প্রাপ্তি। ঠিক এটাই বুঝতে হবে আজকের বামপন্থী দলসহ লড়াকু শ্রমিক বাহিনী ও খেটে খাওয়া মানুষকে।
প্রধানমন্ত্রীর আজকের ঘোষণা সংগ্রামী কৃষকদের কাছে প্রাথমিক জয়ের বার্তা ও উচ্ছাস বয়ে নিয়ে এল, তা নিসন্দেহে বলা যায়। পাশাপাশি এই জয় দেশের শ্রমিকসহ সাধারণ মানুষের কাছে অনেক সদর্থক বার্তা হাজির করলো। ঐক্যবদ্ধ হয়ে নিজেদের দাবিতে অনড় থাকলে, পরিস্থিতির সামগ্রিক বিচার করে লড়াইয়ের সঠিক পন্থা নির্বাচন করলে যে কোন দাম্ভিক শক্তিকেও পরাজিত করা সম্ভব। এই অভূতপূর্ব দীর্ঘ জেদী লড়াই আন্দোলন থেকে শিক্ষা নিয়ে শ্রমিকসহ আমজনতাকে লড়াইয়ের ময়দানে এগিয়ে আসতে হবে শ্রমকোড বাতিলের দাবিতে, নাগরিক পঞ্জির নাম করে দেশের মানুষকে বেনাগরিক করার চক্রান্তের বিরুদ্ধে, ফ্যাসিবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে। নিজেদের বেঁচে থাকার স্বার্থে ও পরবর্তী প্রজন্মের জন্য দূষণহীন সুস্থ সুন্দর একটা গোটা পৃথিবী রেখে যেতে সবস্তরের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে প্রকৃতির পুনরুদ্ধার ও পুনরুৎপাদনের স্লোগানকে সামনে রেখে। কৃষক শ্রমিক আন্দোলনের সাথে মেলাতে হবে প্রকৃতি মেরামতের লড়াইকে। তবেই বাঁচবে মানবসভ্যতা। এসো মানুষের জয়গান গাই।
লেখক পরিচিতি:
বিজ্ঞান শিক্ষক, বিজ্ঞান ও পরিবেশ কর্মী।
Mail id: santoshsen66@gmail.com





