হোমো ভার্চুয়ালিস: পর্ব ৪

পোস্টটি দেখেছেন: 56 শঙ্খদীপ ভট্টাচার্য ( একবিংশ শতাব্দীতে প্রযুক্তির চরম বিকাশের যুগে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও নবতম সংযোজন হলো মেটাভার্স।  এই বিষয়টি নানান দিক দিয়ে বিশদে আলোচনার দাবি রাখে, যা আজকের দিনে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ও প্রাসঙ্গিক। তাই এই সুদীর্ঘ লেখাটি কয়েকটি পর্বে ধারাবাহিকভাবে পরিপ্রশ্নের ওয়েব ম্যাগাজিনে প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে পরিপ্রশ্ন পত্রিকার সম্পাদক মন্ডলী। […]

শঙ্খদীপ ভট্টাচার্য

( একবিংশ শতাব্দীতে প্রযুক্তির চরম বিকাশের যুগে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও নবতম সংযোজন হলো মেটাভার্স।  এই বিষয়টি নানান দিক দিয়ে বিশদে আলোচনার দাবি রাখে, যা আজকের দিনে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ও প্রাসঙ্গিক। তাই এই সুদীর্ঘ লেখাটি কয়েকটি পর্বে ধারাবাহিকভাবে পরিপ্রশ্নের ওয়েব ম্যাগাজিনে প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে পরিপ্রশ্ন পত্রিকার সম্পাদক মন্ডলী। পাঠক ও শুভ্যানুধায়ীদের সহৃদয় সহযোগিতার প্রত্যাশায় বুক বাঁধলাম আমরা। আগের পর্বের ধারাবাহিকতায় প্রকাশিত হলো চতুর্থ পর্ব। চোখ রাখুন পরবর্তী ও শেষ পর্বে)।

ফিনান্স ক্যাপিটাল এবং ইন্টারনেটব্রেটন উডস থেকে  শতাব্দীর সেরা পঞ্জি স্কিম

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তখন সবে শেষ হয়েছে। যুদ্ধ-বিধ্বস্ত ইউরোপের অবস্থা শোচনীয়। অর্থনীতি একেবারে তলানিতে। অবকাঠামো বিপর্যস্ত। যুদ্ধে হেরে যাওয়া দেশগুলোর ঘাড়ের ওপর নিঃশ্বাস ফেলছে বিপুল অঙ্কের দেনা। বিশ্ব অর্থনীতির হালচাল স্থিতিশীল নয়, তাছাড়াও চরম মুদ্রাস্ফীতি, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে সীমাবদ্ধতা, কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর বৈদেশিক রিজার্ভে উত্থান-পতন, সোনার সঙ্কট, মুদ্রামান কমে যাওয়া ইত্যাদি বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত হয়ে পড়েছিল বিশ্ব অর্থনীতি। এইরকম একটা অবস্থায় বিশ্ব নেতাদের মনে হয়েছিল, নতুন কোনও মহামন্দা বা বিশ্বযুদ্ধ গ্রহটির জন্য মোটেও সুখের নয়। কারণ অর্থনৈতিক প্রভাব অনেকটা বাটারফ্লাই এফেক্টের মতো, পৃথিবীর এক প্রান্তের অর্থনীতিতে কোনো অস্থিতিশীলতা দেখা দিলে তার রেশ গ্রহের বিপরীত প্রান্তে অবস্থিত সুদূর দেশটিতেও লাগবে। মূলত প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন পরিস্থিতিতেই পুঁজিবাদের পক্ষে থাকা মাতব্বরেরা (expert) বুঝতে পেরেছিলেন, পুঁজি  রপ্তানির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক চেহারা নিয়েছে। জাতীয় গণ্ডীর মধ্যে আবদ্ধ থেকে পুঁজিকে নিয়ন্ত্রণ করতে গেলেই যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়বে। পুঁজির আন্তর্জাতিক সংগঠন ছাড়া এই সংকট থেকে পরিত্রাণের কোনও উপায় নেই। অতএব প্রয়োজন আন্তর্জাতিক পুঁজি-বিশেষজ্ঞদের এমনই এক সংগঠন যা যুদ্ধ ও মহামন্দা এড়িয়ে ফিনান্স ক্যাপিটালের (finance capital) আন্তর্জাতিক এক কাঠামোর জন্ম দেবে। মার্কিনদের হয়ে দায়িত্বে ছিলেন ডেক্সটার হোয়াইট আর ব্রিটেনের তরফ থেকে মেনার্ড কেইন্স। বিশ্ব অর্থনীতির লাগাম ধরতে ১৯৪৪ সালে আমেরিকার নিউ হ্যাম্পশায়ারে  শুরু হয় হয় ব্রেটন উডস সম্মেলন। এখানেই জন্ম হয় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল ( International Monetary Fund, IMF), বিশ্বব্যাংক (World Bank) সহ আরও কয়েকটি আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান, যেগুলো সম্মিলিতভাবে ব্রেটন উডস ইনস্টিটিউশনস নামে পরিচিত। সেই সময় আইএমএফ-এর প্রতিষ্ঠাতারা সোনার বিনিময়কে আদর্শ মাপকাঠি হিসেবে গ্রহণ করেন যা গোল্ড এক্সচেঞ্জ স্ট্যান্ডার্ড নামে পরিচিত (gold exchange standard)। তখন এক আউন্স সোনার দাম ধরা হয়েছিল ৩৫ ডলার। আমেরিকা দেশ নয়, নিজেই যেন তখন একটি ব্যাঙ্ক।  আমেরিকান ডলারের সঙ্গে সম্পর্ক শুধু সোনার কিন্তু  জার্মান ডয়েশ মার্ক, ব্রিটিশ পাউন্ড ইত্যাদি বাকি সমস্ত মুদ্রার সঙ্গে সোনার সরাসরি কোনও যোগ নেই, তাদের লেনদেন কেবল ডলারের সঙ্গে। এক ঢিলে দুই পাখি। ফরেন বন্ডের  (foreign bond) সুদ খেয়ে আমেরিকার নিজস্ব সম্পদ বৃদ্ধি আর গোটা বিশ্বে অর্থনৈতিক আধিপত্য বজায় রাখার একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ। অথচ ভাবখানা এমন যে তারাই যেন গোটা পৃথিবীর  উদ্ধারকর্তা। এই ব্যবস্থা অবশ্য বেশিদিন টিকল না। অসীম হারে নিজেকে বাড়িয়ে চলার পুঁজির স্বাভাবিক গতির বাধা হয়ে দাঁড়ালো সোনার নির্দিষ্ট ও সসীম ভান্ডার। পুঁজি খেয়ালখুশি মতো যতই ফুলে ফেঁপে উঠতে চায় সোনা তার লাগাম টেনে নিচে নামিয়ে আনে। পুঁজির সঞ্চয়নের এই সংকট থেকে বেরিয়ে আসার একমাত্র উপায় হল ডলারকে সোনার বন্ধন থেকে মুক্ত করা।

আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ১৯৭১ সালে Fixed Exchange Rate ভেঙে দিলেন। ডলার তখন পুরোমাত্রায়  স্বাধীন। সোনার সঙ্গে আর কোনও সম্পর্কই থাকল না। সূত্রপাত  ঘটল ডলার সাম্রাজ্যবাদের। কার্যত ফেডারেল রিজার্ভ ও মার্কিন ট্রেজারি এই দুইয়ের ভূমিকা প্রধান হয়ে উঠল। আমেরিকার কাজ এখন পরিবর্তিত এই ব্যবস্থাকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া। কিন্তু পুঁজিবাদের সংকট এখনও পুরোপুরি কাটেনি কারণ সঙ্কট থেকে বেরোতে নতুন কাঠামো তৈরি করলেও পুঁজিবাদের সঙ্কট মুক্তি কখনোই ঘটে না। সবই সাময়িক পরিত্রাণ। এই ব্যবস্থার মূলে কাজ করে দুটি আলাদা প্রকোষ্ঠ । পুঁজিবাদ প্রথম পর্বে উৎপাদন জগতে প্রবেশ করে যেখানে প্রকৃতিকে শ্রমের মাধ্যমে পরিবর্তন করে পণ্যে রূপান্তরিত করা হয়। এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় পুঁজিবাদী উৎপাদন। দ্বিতীয় পর্বে আবার পণ্যকে বাজারে বিক্রি করে অর্থের (বিনিয়োগকারী অর্থ + বর্ধিত অর্থ) আকারে ফেরত আসতে হয়। এই অংশটিকে পুঁজিবাদী রিয়েলাইজেশন (realisation)  বলা হয়। এখনও পর্যন্ত এই পর্যায়ে পুঁজিবাদী উৎপাদনই ছিল প্রধান ভূমিকায়। ডেট্রয়েটের মতো শহরগুলিতে বড়ো বড়ো কলকারখানায়  শ্রমিকেরা একইসঙ্গে কাজ করত। গোড়া থেকে অন্তিম উৎপাদ ( finished product) সবটাই তৈরি হত একই ছাদের নিচে। সাইরেন বাজতেই সকলেই ছুটে যেতেন কারখানার দিকে। ঠিক এই পর্বেই সঞ্চয়নের সমস্যায় পুঁজিবাদী উৎপাদন গুরুত্ব হারাল। মুখ্য হয়ে দেখা দিল রিয়েলাইজেশন। যেহেতু পুঁজির স্বাভাবিক গতি বজায় রাখতে ফিনান্স ক্যাপিটাল পৃথিবী জুড়ে তার প্রবাহকে স্বাধীন করতে চায় তাই বাজার-কেন্দ্রিক অর্থনীতির নিয়মে সস্তা শ্রম এবং মজুরির দিকেই পুঁজির প্রবাহিত হওয়ার প্রবণতা  গড়ে ওঠে। পুঁজির সঞ্চয়ন প্রক্রিয়ার এই নতুন ধাপে তৈরি হল বিশ্বব্যাপী ভ্যালুচেন (Global value adding chain)। শ্রম সস্তা হওয়ার কারণে উৎপাদনের ব্যাপক ক্ষেত্র হয়ে উঠল ভারত, বাংলাদেশ, চিনের মতো সেই সময়ের উন্নয়নশীল দেশ। আর যেখানে উৎপাদিত পণ্যের দাম বেশি সেখানে  বিক্রির মধ্যে দিয়ে পুঁজি তার মুনাফার হারকে সর্বোচ্চ স্তরে তুলে নিতে চাইল এবং সেটাই হয়ে দাঁড়ালো সেই সময়ের পুঁজির স্বাভাবিক গতি।

আমেরিকার তাবড়-তাবড়  কর্পোরেট সংস্থা FDI (Foreign Direct Investment)  প্রবাহের মাধ্যমে পুঁজির উৎপাদন জগত ও রিয়ালাইজেসন জগতের (পণ্য বেচে অর্থে রূপান্তর হল realisation) মধ্যে পরিবর্তন আনল। যার থেকে স্বাধীন হওয়ার উপায় কারও নেই। ব্যাঙ্কের নেতৃত্বে ব্যাঙ্ক ও বাজারের মেলবন্ধনে এমনই এক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা পেল যেখানে উৎপাদনে বিনিয়োগ না করেও ব্যাঙ্ক ও বাজারের মিলিত ব্যবস্থায় উদ্বৃত্তমূল্যকে পুঁজিতে রূপান্তর করা যায়। ব্যাঙ্ক হচ্ছে মূল্যের প্রসার ঘটানোর সংগঠন আর বাজার হচ্ছে পণ্য বিনিময়ের সংগঠন। পৃথিবী জুড়ে  অসম মজুরির ফলে এই মূল্যের প্রসার ব্যাঙ্ক ও বাজারের এই গতির অধীনে থাকা বৃহৎ শিল্পকে টুকরো করল, সারা বিশ্বব্যাপী বৃহৎ শিল্পের কাজকে ছড়িয়ে দেওয়া হল এবং জোড়া হল value adding chain মারফৎ।

ব্রেটন উডস সম্মেলন

জমজমাট শিল্প-শিহর ডেট্রয়েট শ্মশানের চেহারা নিল। পুঁজিপতিদের সম্পদ অবাধ হারে বেড়ে চলার খেসারত দিতে কত মানুষ চাকরি হারিয়ে সর্বস্বান্ত হল তার হিসেব পাওয়া মুশকিল। ডেট্রয়েটের উৎপাদনকে ছোট ছোট টুকরোতে ভাগ করা হল। প্রত্যেক টুকরোতে ঢুকে পড়ল বাজার। যে আইফোন কেনার জন্য আজকের মধ্যবিত্ত প্রজন্ম মুখিয়ে থাকে সেই আইফোনটি তৈরি হয় ১৪৩টি দেশের শ্রমিকের মিলিত শ্রমে। সুদীর্ঘ বিশ্বব্যাপী এই শৃঙ্খলাকেই বলা হয় গ্লোবাল ভ্যালু চেন । এই মূল্য শৃঙ্খলার সবচেয়ে নীচের স্তরের শ্রমিকদের ওপর শোষণ যত বেশি সবচেয়ে ওপরের স্তরে মুনাফার পরিমাণও ততটাই বেশি।

গ্লোবাল ভ্যালু চেনে কীভাবে সস্তা শ্রমের ব্যবহার হয় তা বিস্তারিত বুঝতে বার্বি পুতুলের একটা উদাহরণ নেওয়া যাক।  ১৯৯৬ সালে ক্যালিফোর্নিয়ায় একটি বার্বি পুতুল বিক্রি হতো ৯.৯৯ ডলারে। তাতে লেখা থাকত Made in China। কিন্তু ওই পুতুল তৈরির সব কাঁচামাল এবং অংশগুলির প্রায় সবই চীনে আমদানি করা হয়েছিল। যেমন নাইলনের চুল জাপান থেকে এবং প্যাকিং করার কার্ডবাক্স, পুতুল সাজানোর রং তেল ইত্যাদি আমদানি করা হতো আমেরিকা থেকে। বার্বি জামাকাপড়ের তুলো অবশ্য আসত চিন থেকেই। চিনে প্রতিটি কারখানায় তখন শ্রমিক সংখ্যা ছিল ৫৫০০। তাদের মিলিত শ্রমে পুতুলটি সম্পূর্ণ রূপ পেতো। একটি পুতুলের তখন দাম ছিল বাজারে প্রায় ১০ ডলার, অথচ শ্রমিকদের মজুরি ছিল মাসে মাত্র ৪০ ডলার মতো। আবার বার্বি পিছু মোট মজুরি পড়তো মাত্র ৩৫ সেন্ট অর্থাৎ একটা বার্বি মূল্যের মাত্র ৩.৫ শতাংশ। (1)

 এই অমানবিক শোষণ থেকে বেরিয়ে আসার কোনও উপায় নেই কারণ নিজেদের দেশের পুঁজির মূল্য সংরক্ষিত করতে আন্তর্জাতিক স্তরে পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক কাঠামোয় প্রবেশ করতেই হবে তা যে দেশই হোক না কেন।

১৯৮০ সালের পর ডেট্রয়েটের মতো আরও অনেক শহরের বড় বড় কারখানাগুলিকে ভেঙে টুকরো করে ছোট ছোট অ্যাসেম্বেল প্লান্ট (assemble plant) তৈরি করা হয়। একটি কারখানাতেই যেখানে এতদিন একটি গাড়ির সমস্ত সরঞ্জাম থেকে সম্পূর্ণ গাড়িটি তৈরি করা যেত সেখানে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে এই কাজগুলিকে ভাগ করে আউটসোর্স করা হল। গাড়ি তৈরির প্রাথমিক ধাপে কাঁচামাল লাগে। কাঁচামাল ও খনিজ সমৃদ্ধ দেশ, যেখানে সস্তায় শ্রমিকও পাওয়া যায়, তা-ই হল শিল্পপতিদের হটস্পট। সেখানেই চালান করা হল বৃহৎ শিল্পের মূল এবং প্রাথমিক কিছু কাজকে। স্বভাবতই এইসব জায়গায় শ্রম আইন বলে কিছুই নেই বা সেসবের কোনও গুরুত্বই নেই। অতএব যথেচ্ছভাবে খাটিয়ে নেওয়া যায় শ্রমিককে। এখানে দুটি জিনিস সহজলভ্য হতেই হবে। কাঁচামাল এবং সস্তা শ্রম। বাংলাদেশের স্বনির্ভর তাঁতি থেকে ভারতের প্রযুক্তিপ্রেমী তথ্যবিদ সকলেই জুড়ে গেল realization-এর জগতের সঙ্গে। এই realization-এর জগতের সঙ্গে জুড়ে রয়েছে ব্যাঙ্ক ও বাজার।

পুঁজিবাদের এই নতুন উৎপাদন কাঠামোর প্রাণকেন্দ্র হিসেবে যে প্রযুক্তিটি বিশ্ববিখ্যাত হয়ে ওঠে তা হল ইন্টারনেট। এটি কার্যত ছিল এক ধরনের  সামরিক প্রযুক্তি। কিন্তু বিশ্বায়নের যুগে সারা বিশ্বের সমস্ত বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডকে একটা সাধারণ প্ল্যাটফর্মের মধ্যে রাখা ভীষণ জরুরি হয়ে পড়ে আর এই কাজ একনাগাড়ে নির্বিঘ্নে চালিয়ে যাওয়ার একমাত্র প্রযুক্তি হল ইন্টারনেট। পণ্য পরিষেবায় যাতে কোনও ঘাটতি না হয় তা সুনিশ্চিত করতে ইন্টারনেট তখন তো বটেই আজও অপরিহার্য। ইন্টারনেট অফ থিংস (internet of things), সংক্ষেপে আইওটি (IOT) নামের উন্নত প্রযুক্তি-ব্যবস্থা আজকের ডিজিটাল উৎপাদন ব্যবস্থার মেরুদণ্ড। এই ব্যবস্থার সাহায্যেই আজকের পণ্য বিলাসী মানুষ   মনের মতো জিনিসটি তার নিজের বুঝে ওঠার আগেই আমাজন, ফ্লিপকার্ট তাকে জানিয়ে দিচ্ছে। আজকের এই ব্যবস্থার কথা মাথায় রেখেই তখন পরিকল্পিত পদক্ষেপে সামাজিক সম্পর্কগুলোকে কৌশলে চুরমার করে মানুষকে করা হল অ্যাটমিক। আগে সামাজিক মেলামেশার মধ্যেই মানুষ বৌদ্ধিক চর্চা থেকে বিনোদনের যাবতীয় উপাদান খুঁজে পেত। বিনোদনের খুব বেশি চাহিদাও ছিল না আজকের মতো। যেটুকু ছিল যৌথ পরিবার একটি মাত্র টিভি কিনেই তা পুষিয়ে দিতে পারত । কিন্তু তাতে পুঁজির খিদে মেটে না। একটি যৌথ পরিবার ভেঙে দশটি পরিবার হলে তবেই না দশটি টিভি বিক্রি হবে বাজারে। ভাগ বাটোয়ারা করে যা কিছু মানুষ ব্যবহার করত তার বিক্রি বহুগুণ বাড়িয়ে তোলা যাবে। এরই মধ্যে ইন্টারনেটের প্রসার যত বাড়ল পণ্য-কেন্দ্রিক মানুষ হয়ে উঠল অনলাইন তথ্যে সমৃদ্ধ আরও বেশি আত্মপর সমাজ বিচ্ছিন্ন জীব। মোবাইল আসার পর অনেক সুযোগ সুবিধা মানুষ পেলেও সাক্ষাতে কথাবার্তার প্রবণতা কমল। ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ আসার পর মোবাইলে কথাবার্তা বলার প্রবণতাও কমে এল। একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগের অবশিষ্ট ইচ্ছেটুকুও শেষ হওয়ার উপক্রম আগামীর অর্থনৈতিক ব্যবস্থায়। এমতাবস্থায় স্বাধীন বিচরণের সুযোগ পেয়ে পুঁজির গতি অস্বাভাবিক মাত্রায় বেড়ে উঠল। মোবাইলের স্ক্রিনে ডিজিটাল কিছু সংখ্যা দেখেই মানুষ বিশ্বাস করতে শিখল ব্যাঙ্কে ঠিক সেই সংখ্যার টাকাই মজুত। কেবলমাত্র বিশ্বাস, সোনার মতো কোনও স্পর্শযোগ্য ধাতব সুরক্ষা আর নেই। ইন্টারনেটে এই ডিজিটের ওপর ভরসা করেই চলতে লাগল দেদার বাণিজ্যিক লেনদেন আলোর গতিতে। ২০০৭ সালে UNCTAD এর হিসাব বলছে- 2007 represented a real in global FDI flows reaching their highest level ever ($133 billions) surprising the 2000 peak. (2)

শেয়ার মারকেট, হেজ ফান্ড ইত্যাদির বাজার ক্রমশ ফুলে ফেঁপে উঠতে লাগল কেবলমাত্র বিশ্বাসের ভিত্তিতে। এত টাকার যে অবিরাম কারবার চলছে তার উৎস কোথায় কেউ জানে না। পরিণতি শতাব্দীর সেরা পঞ্জি স্কিম ( ponzi scheme), অর্থনৈতিক মহামন্দা। পঞ্জি স্কিম অর্থনীতির এক বহুল পরিচিত শব্দ। স্বল্প সময়ে কোনও পরিশ্রম ছাড়াই দ্রুত অর্থ উপার্জনের প্রায় সকল প্রতারণামূলক কাজকেই পঞ্জি স্কিম হিসেব ধরা হয়। পঞ্জি স্কিমগুলোর উদ্দেশ্য, বিনিয়োগকারীদের আস্থা অর্জন করার মাধ্যমে তাদের বিনিয়োগের সর্বস্ব আত্মসাত করা। এ ধরনের স্কিম থেকে মূল পরিকল্পনাকারীই কেবল লাভবান হয়ে থাকেন। বিনিয়োগকারীরা এখানে তুরুপের তাস মাত্র। সাম্প্রতিক সময়ে পঞ্জি স্কিম ও বার্নার্ড ম্যাডফ—এই দুটি শব্দ প্রায় সমার্থক হয়ে গেছে। এই শতাব্দীরই প্রথম দশক। একটা গোটা অর্থনৈতিক কাঠামোকে ধসে পড়তে দেখেছিল আমেরিকা। যার নেপথ্যে ছিল ক্যারোলিনার লগ্নিদানব বার্নার্ড ম্যাডফ ওরফে বার্নি। তখনকার  অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ভিতরের ফাঁপা চরিত্র বুঝতে এই পঞ্জি স্কিম ভালো করে বুঝে নেওয়া দরকার। কেবল বিশ্বাসের ওপর মোটা টাকার লেনদেন চলার সু্যোগ ছিল বলেই  নিজের ব্যবসার ভিত পাকা করতে বেশি সময় লাগেনি বার্নির। কথার ফাঁদ আর যাদু-মিষ্টতায় তাঁর প্রথম বড়ো শিকার হন মার্কিন ব্যবসায়ী কার্ল সাপিরো। বিনিয়োগ করেন ১ লক্ষ মার্কিন ডলার। আর তারপরেই ক্রমশ ব্যবসার শাখা-প্রশাখা বাড়তে থাকে বার্নির। ঠিক যেভাবে অন্যান্য পঞ্জি স্কিম ছাতার মতো ছড়িয়ে পড়ে একটি মূল কেন্দ্রবিন্দু থেকে, ঠিক সেভাবেই। বিনিয়োগকারীদের হাত ধরে তাঁদের পরিচিত ও বন্ধুরা বার্নির এই প্রতারক সংস্থার নতুন সদস্য হয়ে উঠতেন। আর নতুন কোনো বিনিয়োগকারী খুঁজে এনে দিতে পারলে বেশ ভালো অঙ্কের বোনাসও দেওয়া হত তাঁদের। ফলত বেশ রমরমিয়েই চলতে থাকে এই ব্যবসা। তবে ম্যাডফের এই সংস্থা থেকে কি কিছুই ফেরত পাননি বিনিয়োগকারীরা? একেবারেই তেমনটা নয়। বরং শুরুর দিকে যেসব বিনিয়োগকারী তাঁদের লগ্নি ফিরিয়ে নিয়েছেন, তাঁরা ব্যাপক লাভবান হয়েছেন ম্যাডফের থেকে। আসলে বিশ্বাস অর্জনের জন্যই এমন চাল চেলেছিলেন ম্যাডফ। কিন্তু কোথা থেকে আসত সেসব টাকা? তদন্ত বলছে, নতুন লগ্নিকারীদের অর্থ থেকেই পুরনো বিনিয়োগকারীদের সুদে-মূলে হিসাবে মেটাতেন বার্নি। এবং এই লাভ দেখেই বড়ো অঙ্কের টাকা দীর্ঘ মেয়াদে রাখা শুরু করেন তাঁরা। পাশাপাশি আইনি স্বচ্ছতার প্রমাণস্বরূপ বহু ভুয়ো ফান্ড তৈরি করেছিলেন তিনি খাতায়-কলমে। মার্কিন শেয়ারে তাদের কোনো বাস্তবিক অস্তিত্ব না থাকলেও, কেবলমাত্র লগ্নিকারীদের কাছেই পেশ করা হত তা। অন্যদিকে তাঁর গ্রাহকের তালিকায় ছিলেন পরিচালক স্টিফেন স্পিলবার্গ, অভিনেতা কেভিন বেকনের মতো হলিউডের তারকারা। ফলে তাঁদের দেখে অনুপ্রাণিত হয়েই এগিয়ে আসত সাধারণ মানুষ। এভাবেই  ব্যবসার পরিধি ছড়িয়ে পড়েছিল পাঁচটি মহাদেশে! বিনিয়োগের মোট মূল্য প্রায় ৮০০-১০০০ কোটি মার্কিন ডলার। হিসেব বলছে, ৪০ বছরে জালিয়াতির কর্মকাণ্ডে ৫০ বিলিয়ন ডলার ছিল তাঁর দেনার পরিমাণ। মানে ৫ হাজার কোটি মার্কিন ডলার। আর, প্রতারণার পরিমাণ ৬৮ বিলিয়ন ডলার।(3)

পঞ্জি স্কিমের কাঠামো

 ডলারের মূল্য তখনও আমেরিকার  আর্থিক সংগঠনগুলি নিয়ন্ত্রণ করছে। অর্থনৈতিক  ভরাডুবির পর এই মূল্য নির্ধারণকে ঘিরে আমেরিকার স্বার্থের সঙ্গে অন্যান্য দেশের স্বার্থের সংঘাত প্রকট হয়ে দাঁড়ায়। দাবি ওঠে সর্বজন স্বীকৃত নতুন ধরনের এক মুদ্রার। সেখান থেকেই জন্ম হয় বিটকয়েনের। দেশ, আন্তর্জাতিক সংগঠন, বিশেষ ক্ষমতাশালী ব্যক্তি, ব্যাঙ্ক কোনও কিছুরই  নিয়ন্ত্রণ থাকবে না এই বিটকয়েনের ওপর।

 এখনও কিন্তু সেই কারচুপিই বহাল তবিয়তে রয়েছে। বিশ্বাস। বিশ্বাসের ভার্চুয়াল আদান-প্রদানের ওপর ভিত্তি করে আগামীর ক্রিপ্টোকারেন্সিকে কেন্দ্রে রেখেই ভিডিও গেমের নকশাও বদলে দেওয়া হচ্ছে। মানুষ সর্বস্বান্ত হলেও পুঁজির প্রবাহে যেন বাধা না পড়ে। এই হল মূলমন্ত্র।  শোষণ এখন নিছকই ভার্চুয়াল গেমের ভিতর। চার্লি ওয়েলস যথার্থই বলেছেন-  For years, players like Peurifoy have paid the overlords of a $175 billion industry — Sony, Nintendo, Tencent, Microsoft — homage to play in digital fiefs. They’ve watched the fruits of their labor — those stars and hearts earned, levels transcended — vanish into nothing once the game is over. They want something more, something closer to capitalism, with private ownership of the means of production, wage labor, voluntary exchange. (4)

এই বিটকয়েন এবং হাজারো রকমের ক্রিপ্টোকারেন্সিকে নিয়ে মেটাভার্সের মধ্যে দিয়ে পুঁজি খুঁজে নিতে চাইছে তার নতুন অভিমুখ।  বস্তুত এই অভিমুখ সঙ্কট কাটিয়ে গভীরতর সঙ্কটের সংকেত। এই অভিমুখ পুরোনো পঞ্জি স্কিম ভুলে ব্যাপকতর, আরও অনেক বেশি ভয়ংকর মারণ ছকের দিকেই।

তথ্যসূত্র :

  1. অসফল এক সমাজ-ব্যবস্থাঃ পুঁজিবাদী বিশ্বায়নের বিশ্ব-সংকট ও চীনের ওপর এই সংকটের প্রভাব, জন বেলামি ফস্টার
  2. Socialist Register, 2012, page 65
  3. https://www.prohor.in/ponzi-schemer-bernie-maddof-passes-away-in-jail
  4. https://www.bloomberg.com/news/features/2021-10-30/what-is-the-metaverse-where-crypto-nft-capitalism-collide-in-games-like-axie

আগের পর্বগুলি

হোমো ভার্চুয়ালিস

হোমো ভার্চুয়ালিস: পর্ব ২

হোমো ভার্চুয়ালিস পর্ব ৩

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top