প্রীতিলতা বিশ্বাস
উড়িষ্যার জগতসিংহপুর জেলার ধিনকিয়া গ্রামে জিন্দাল প্রস্তাবিত উৎকল স্টীল লিমিটেড প্রজেক্টের বিরোধিতায় অবস্থানরত স্থানীয় মানুষ গত ১৪-ই জানুয়ারী রাজ্য পুলিশের নির্মম দমন প্রক্রিয়ার শিকার হন। আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা কেউ রেহাই পায়নি পুলিশের লাঠি চার্জ থেকে। পা থেকে মাথা পর্যন্ত যেকোন জায়গায় পড়ে পুলিশের লাঠি। হাত-পা ভেঙে এবং মাথা ফেটে আহত হয়েছেন শতাধিক মানুষ। অনেককে অ্যারেস্ট করে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ভিত, সন্ত্রস্ত হয়ে আছে এলাকাবাসী।
বঙ্গোপসাগর থেকে দু কিমি ভিতরে জগতসিংহপুর জেলা অঞ্চল সুপরিচিত তার উৎকৃষ্ট মানের পান পাতা উৎপাদনের জন্য। ওখানকার বেশিরভাগ মানুষ এই পানের বরজ থেকে জীবীকা নির্বাহ করে। এছাড়া রয়েছে কাজুবাদামের চাষ। আর উপকূলবর্তী অঞ্চল হবার কারণে এখানকার বেশ কিছু মানুষ মৎস্যজীবী। জিন্দাল প্রস্তাবিত স্টীল প্ল্যান্টের অনুসারী শিল্প হিসাবে এখানে একটি তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং একটি সিমেন্ট কারখানাও গড়ে উঠবে। ৬৫ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প। প্রতি বছর ইস্পাত তৈরির লক্ষ্যমাত্রা ১ কোটি ৩২ লক্ষ মেট্রিক টন। বিদ্যুত ও সিমেন্ট তৈরির লক্ষ্যমাত্রা যথাক্রমে ৯০০ মেগাওয়াট ও ১০ এমটিপিএ। এই অঞ্চল সংলগ্ন জাতাধর নদীতে জেটি তৈরী করা হবে মাল পরিবহনের সুবিধার্থে। যা এখানকার প্রকৃতি, পরিবেশ এবং মানুষের জীবন-জীবিকার উপর আক্ষরিক অর্থেই ঘন অন্ধকার নামিয়ে আনবে। ধিনকিয়া সহ আরও ছ-সাতটি গ্রামের মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই মানুষ উপায়ান্তহীন হয়ে প্রতিবাদ-প্রতিরোধের পথে যেতে বাধ্য হয়েছে। এই সেই জায়গা যেখানে ২০০৫ সালে রাজ্য সরকারের সঙ্গে মৌ স্বাক্ষরিত হবার পর দক্ষিণ কোরিয়ার স্টীল কোম্পানি পস্কো এসেছিল তাদের প্রজেক্ট নিয়ে। উপকূলবর্তী উর্বর ভূ-অঞ্চল যেখানে ৫০০০ পানের বরজ ছিল সেইরকম প্রায় ৩০০০ একর জমি পস্কোকে দেওয়া হয়েছিল। সেই সময়ও ধিনকিয়ার মূলত আদিবাসী মানুষ জল-জমি-জঙ্গলের উপর তাদের অধিকার রক্ষার জন্য দীর্ঘ সংগ্রাম করে। অবশেষে পস্কো এখানকার জমি রাজ্য সরকারকে হস্তান্তর করে চলে যেতে বাধ্য হয় ২০১৭ সালে। পস্কো চলে গেলেও এবং ২০০৬ সালের ফরেস্ট রাইট এক্ট থাকা স্বত্বেও বংশ পরম্পরায় এখানে বসবাসকারী আদিবাসী মানুষেরা এই জমির অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। ২০০৮ সালে একটি বাণিজ্যিক সংস্থার করা হিসাব অনুযায়ী পস্কোর প্রজেক্ট রূপায়িত হলে ৩৫৭৮ টি পরিবারের চাষের জমি ও ৭১৮ টি পরিবারের গৃহহীন হবার কথা ছিল। তবে পস্কো প্রজেক্ট রূপায়িত হতে না পারলেও বৃক্ষনিধনের হাত থেকে পুরোপুরি রক্ষা পায়নি ওখানকার পরিবেশ। পুনরায় রাজ্য সরকার এই জমি জিন্দাল গোষ্ঠীর হাতে তুলে দিয়েছে একই রকম ইস্পাত ও তার অনুসারী শিল্প গড়ে তোলার জন্য। যার উৎপন্ন বর্জ্য ওখানকার স্থলভূমি ও সমুদ্রের জলজ জীব বৈচিত্র্যকে বিপন্ন করে তুলবে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য বর্তমান প্রজেক্টটি এখনও পর্যন্ত ইউনিয়ন মিনিস্ট্রি থেকে পরিবেশ সংক্রান্ত ছাড়পত্র পায় নি।

ভারতের ইস্পাত শিল্প
লৌহ মানব সভ্যতায় একটি অপরিহার্য ধাতু। আর্মেনিয়ান পর্বতমালায় বর্বর স্তরে বসবাসকারী হিটাইট উপজাতি প্রথম লৌহ নিষ্কাশন পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিল। ইস্পাত তৈরির জ্ঞান প্রথম অবস্থায় মানুষের জন্য একেবারেই সুখকর ছিল না। কারণ পাথর কিংবা ব্রোঞ্জের তুলনায় ইস্পাতের অস্ত্র ছিল অনেক বেশি দৃঢ় ও ধারালো এবং মারণক্ষমতা সম্পন্ন। দ্বিতীয়ত এটি সহজলভ্য হওয়ায় ছিল অনেক সস্তা। তাই অস্ত্র চলে এল সাধারনের হাতে। ১২০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে ব্রোঞ্জযুগের শেষে মানুষ লৌহযুগে প্রবেশ করল অন্ধকারকে সঙ্গী করে। একটি বড় অঞ্চল জুড়ে মুছে গিয়েছিল স্বাক্ষরতা, মানব সভ্যতায় নেমে এসেছিল বিরতি।
এবার আসি ভারতের প্রসঙ্গে। ভারত ইস্পাত শিল্পের কাঁচামাল উৎপাদনে পৃথিবীতে দ্বিতীয়, চীনের পরে। আর ইস্পাতজাত দ্রব্যের উপভোক্তা হিসাবে পৃথিবীতে তৃতীয় স্থানে আছে, চীন এবং আমেরিকার পরে। ইস্পাতের কাঁচামাল বা অশোধিত ইস্পাত তৈরি হয় দুটি পদ্ধতিতে। একটি পদ্ধতিতে উৎপন্ন দ্রব্যকে ‘পিগ আইরন’ বলে আর অপর পদ্ধতিতে উৎপন্ন দ্রব্যকে ‘স্পঞ্জ আইরন’ বলা হয়। ২০১৯-২০ সালে ভারত ১৪% পিগ আইরন আর ৮৬% স্পঞ্জ আইরন উৎপাদন করেছে। এত বেশি স্পঞ্জ আইরন পৃথিবীর আর কোথাও উৎপন্ন হয় না।
পদ্ধতি ও দূষণ
স্পঞ্জ আইরন—এই নিষ্কাশন পদ্ধতিটি ভীষন প্রাচীন একটি পদ্ধতি। এতে আকরিক বা প্রাকৃতিক আইরন অক্সাইডকে কার্বনের উপস্থিতিতে পোড়ানো হয় যাতে এর ভিতরে থাকা অপদ্রব্য বেরিয়ে যায়। এতে কঠিন অপদ্রব্য হিসাবে তৈরি হয়—কালো ছাই, চুল্লীর পোড়া অংশ, ভাসমান কণা, যার মধ্যে থাকে সিলিকা ও কার্বনের কণা। এছাড়া হাইড্রোজেন, কার্বন মনোক্সাইড ও সালফার ডাইঅক্সাই গ্যাস তৈরি হয়। দূষণ তৈরির নিরিখে একে রেড ক্যাটাগরির শিল্প হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে যাকে “ডার্টি ইনডাস্ট্রি”ও বলা হয়। চিমনি থেকে নির্গত গ্যাস এবং সিলিকা সহ অন্যান্য ভাসমান কণা বহুদূর পর্যন্ত বায়ুতে মিশে ছড়িয়ে যায়। পরে ধীরে ধীরে নীচে নেমে লাল চাদরের আস্তরণ তৈরি করে মাটিতে। কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের সুপারিশ মত চিমনির উচ্চতা ৭৫ মিটার হবার কথা ছিল। কিন্তু বেসরকারি উদ্যোগপতিদের চাপে ওটা শেষ পর্যন্ত কমিয়ে ৩০ মিটার করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় ইলেকট্রনিক প্রেসিপিটেটরস যাকসংক্ষেপে esps বলা হয়, তা লাগিয়ে বায়ু দূষণের মাত্রা কিছুটা কমানো সম্ভব।
পিগ আইরন—এই পদ্ধতিটি ১১ শতকে চীনে আবিষ্কৃত হয়। এখানে আকরিক ব্লাস্ট ফারনেসে অতি উচ্চ তাপমাত্রায় গলিয়ে তার থেকে অপদ্রব্য বার করে দেওয়া হয়। গলিত অপদ্রব্য সঙ্গে সঙ্গে জল দিয়ে ঠান্ডা করে এক ধরনের চাঙ্গর তৈরি করা হয়, যা রাস্তা তৈরিতে ব্যবহার করা যায়। অনেক সময় সমুদ্র উপকূলে বাঁধ দিতেও কাজে লাগে। এর ভিতরে থাকা সিলিকা সমুদ্রের জলে অ্যালগি বা শ্যাওলা জন্মাতে সাহায্য করে, যা জলে অক্সিজেনের মাত্রা কিছুটা বাড়ায়। এটি তুলনামূলক ভাবে ব্যায় সাপেক্ষ। এখানেও দূষণ তৈরী হয়। তবে অনেকটা কম। এই প্রক্রিয়ায় প্রচুর জল খরচ হয়।
ভারতে ইস্পাত শিল্পের বৃদ্ধি
ভারতের মিনিস্ট্রি অব স্টীলের ওয়েব পেজ থেকে পাওয়া তথ্য অনুসারে দেখা যাচ্ছে ১৯৯১-৯২ সালে লৌহ আকরিক রপ্তানী ও আমদানীতে নীতিগত ভাবে বেশ কিছু পরিবর্তন করা হয়েছে। যার সংক্ষিপ্ত সারাংশটি নিম্ন রূপ:
১.পাবলিক সেক্টর হিসাবে সংরক্ষিত শিল্পের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া ও বাধ্যতামূলক লাইসেন্স গ্রহণ থেকে ছাড় দেওয়া হয়।
২.লৌহ আকরিক রপ্তানীকে উচ্চ গুরুত্ব সম্পন্ন শিল্পের তালিকায় রেখে ৫১ শতাংশ সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের কথা বলা হয়, যা বর্তমানে ১০০ শতাংশ করা হয়েছে।
৩.দাম নিয়ন্ত্রনের বিধি তুলে নিয়ে বাজারের দ্বারা নির্ধারিত হবার কথা বলা হয়।
৪.লৌহ ও ইস্পাতের আমদানী-রপ্তানীকে শুল্ক বিহীন করা হয়।
৫.লৌহ ও ইস্পাতজাত বস্তু আমদানীর উর্দ্ধসীমা তুলে দেওয়া ও শুল্ক মারাত্মক রকম কমিয়ে দেওয়া হয়।
৬.দ্বিতীয় মানের ও ত্রুটিপূর্ণ ইস্পাত কেবলমাত্র মুম্বাই, কোলকাতা ও চেন্নাই বন্দর দিয়ে আমদানী করা যাবে। যেখানে শুল্ক ২০০৭-৮ সালে ২০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করা হয়।
তালিকা আর দীর্ঘায়িত না করলেও পাঠক নিশ্চয় ধরতে পারছেন এই শিল্পে বৃদ্ধির প্রয়োজনীয় নীল নক্সা কবে কীভাবে তৈরি হয়েছিল। এবার দেখে নেব প্রাকৃতিক ভাবে সমৃদ্ধ ও বৈচিত্র্যপূর্ণ ভারতের মাটিতে কোথায় কোথায় লৌহ আকরিক সঞ্চিত আছে। মূলত উড়িষ্যা, ঝাড়খন্ড, ছত্তিশগড় ও কর্ণাটকে লৌহ আকরিক সব থেকে বেশি পাওয়া যায়। এছাড়াও অন্য কিছু রাজ্যেও পাওয়া যায়। তবে সব ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক ভাবেই ঘন জঙ্গলের নীচে সঞ্চিত এই সম্পদ, মূলত আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চল, যারা জীবন ধারণের জন্য একান্তভাবেই ঐ জঙ্গল ও তৎসংলগ্ন ভূমির উপর নির্ভরশীল। পৃথিবীর ৮০ শতাংশ কোল নির্ভর স্পঞ্জ আইরন উৎপন্ন হয় ভারতে, যার মধ্যে ৬০ শতাংশ আসে ক্ষুদ্র শিল্প থেকে। যদিও এই শিল্পে আমদানী-রপ্তানীর সঙ্গে যুক্ত বৃহৎ পুঁজির কর্পোরেট হাউস যারা আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে যুক্ত।
ক্ষুদ্র শিল্পের কারখানাগুলি বেশীরভাগ সময় কোন ধরনের নিয়মাবলীর মধ্যে দিয়ে গড়ে ওঠে না। যেমন প্রত্যেক রাজ্য esps লাগানো বাধ্যতামূলক করলেও উৎপাদনের খরচ বাঁচাতে কেউই প্রায় লাগায় না। কোম্পানিগুলো স্থানীয় অর্থনীতিতে কোন অবদানও রাখে না। কর্মসংস্থান বা পুনর্বাসনের গালভরা গল্প বললেও শেষপর্যন্ত প্রশিক্ষণহীন আদিবাসী মানুষদের ঠিকা শ্রমিক হিসাবে নিয়োগ করা হয় মাত্র। তাও ঘোষিত নূন্যতম মজুরিও দেওয়া হয়না। অনেক সময় পরিযায়ী শ্রমিক দিয়ে কাজ চালানো হয়। কারণ এই শিল্পে বেশিদিন কাজ করলে শ্রমিকরা সিলিকোসিস নামক ফুসফুসের রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। পরিযায়ী শ্রমিকরা সেক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণের দাবি নিয়ে বিশেষ অগ্রসর হতে পারে না।
জমি অধিগ্রহনের সময় বেশীরভাগ ক্ষেত্রে কী কারণে জমি নেওয়া হচ্ছে তাও পরিষ্কার করে বলা হয়না। গ্রামসভার সম্মতি আদায়ের জন্য অনেক ক্ষেত্রেই শরপঞ্চকে বাগে এনে কাজ হাসিল করা হয়। সর্বশেষ অস্ত্র হিসাবে কাজ করে পেশিশক্তি, অর্থ ও রাজনৈতিক ক্ষমতা। এই শিল্পে উন্নতির প্রতি পাতায় লেখা হয় আদিবাসী, দলিত ও শ্রমজীবী মানুষের ঠকে যাওয়ার কাহিনী।
আন্তর্জাতিক ক্ষেত্র
লৌহ ও ইস্পাত উৎপাদনে বিশ্বের প্রথম দেশ চীন তার বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রনের কারণে লিনেই ও চেংড়ে তে দুটি কারখানা বন্ধ করে দিয়েছে। চাহিদা কমে আসা ও বাড়তি উৎপাদনের কারণে ২০২০ এর মধ্যে আরও বেশ কিছু কোল ও স্টীল কারখানা বন্ধ করার কথা ২০১৬ তেই ঘোষণা করে। যে ক্ষেত্রগুলিতে চীনের মোট শ্রমশক্তির ১৫ শতাংশ নিয়োজিত আছে। এখানে চীন এক ঢিলে দুই পাখি মারার চেষ্টায় আছে। কারণ ঐ কোম্পানিগুলোর অনেকগুলিই zombie companies অর্থাৎ যাদের ঋণের দায় বহন করার বিষয় থাকে।
আমেরিকা তার প্রয়োজনের দুই তৃতীয়াংশ লৌহ ও ইস্পাত উৎপাদন করে স্ক্র্যাপ থেকে রিসাইক্লিং করে। ২০১৪ সালে ৮১ মিলিয়ান টন লৌহ ও ইস্পাত উৎপাদন হয়েছে স্ক্র্যাপ থেকে। ২০১৯ এ অ্যাস্থাবুলাতে দূষণ সংক্রান্ত প্রোটোকল মেনে একটি পিগ আইরন তৈরির কারখানা স্থাপন করেছে, যা চলতি বছরে কাজ করতে শুরু করবে।
এই শিল্পে ভারত সরকারের ১০০ শতাংশ বিদেশি বিনিয়োগের নীতি, এবং বিশ্বব্যাপী ফিন্যান্স পুঁজির দৌরাত্ম—এই দুই এর সংমিশ্রণে এদেশের সস্তা শ্রমকে ব্যবহার করেই লুট হচ্ছে আমাদের জল-জমি-জঙ্গল, বিষাক্ত হচ্ছে বায়ু।
জিন্দাল প্রজেক্টে সম্ভাব্য ক্ষতির খতিয়ান
উত্তরে হিমালয় আর তিন দিকে সমুদ্র দিয়ে ঘেরা দাক্ষিনাত্য ভারতভূমিকে একটি নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে পরিণত করেছে। বিশাল এই ক্রান্তিয় দেশটি যেমন জীব বৈচিত্র্যের আধার তেমন বৈচিত্র্যে ভরা এর জলবায়ু। দক্ষিণ পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর উত্তরমুখী গতি হিমালয়ে বাঁধা পেয়ে গাঙ্গেয় সমভূমি ঘুরে আবার উত্তর পূর্ব পথে দক্ষিণে ফেরত আসে। তার এই যাত্রা পথে ভারতের বনাঞ্চলগুলির তৈরী জলীয় বাষ্পের ঘনীভবন থেকে মাটিতে নেমে আসে বারিধারা। তৃষ্ণার্ত প্রাণ-প্রকৃতি পায় বেঁচে থাকার অপরিহার্য রসদ। এই বৃষ্টিপাতের উপর নির্ভর করে ভারতের কৃষি। কৃষিক্ষেত্রে ভারতের ৪৬ শতাংশ শ্রমশক্তি নিযুক্ত আছে বর্তমানে, যারা যোগান দেয় আপামর ভারতবাসীর সারা বছরের খাদ্যের একটি বড় অংশ।
২০০৭ সালে রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গের বিজ্ঞানীরা সারা পৃথিবী জুড়ে পরীক্ষার পরে সিদ্ধান্তে আসে যে সর্বত্র উপকূলবর্তী বনাঞ্চলে তৈরি হওয়া জলীয়বাষ্প স্থলবেষ্টিত বনভূমির দিকে যায় এবং নিকটবর্তী অঞ্চলে বৃষ্টিপাত ঘটায়। যদি উপকূলবর্তী বনাঞ্চলগুলি নষ্ট করে ফেলা হয় তাহলে ক্রমে বৃষ্টিপাতহীন ধুসর মরুভূমিতে পরিণত হবে বিস্তীর্ণ অঞ্চল। প্রসঙ্গত উল্লেখ করি, উড়িষ্যার জগতসিংহপুরের বনাঞ্চল একটি উপকূলবর্তী বনভূমি। তাই এই প্রজেক্ট রূপায়িত হলে ভবিষ্যতে ভারতবর্ষের মধ্যভাগে তৈরি হবে মরুভূমি। সেই সঙ্গে দেখা দেবে খাদ্য সঙ্কট।

গাছের খাদ্য উৎপাদনের অপরিহার্য উপাদান বাতাসের কার্বন-ডাইঅক্সাইড। এই কার্বন গাছের জীবন চক্রের মধ্যে দিয়ে তার দেহে কাঠ হিসাবে সঞ্চিত হয়। ২০০৪ সালের একটি গবেষণা পত্র জানাচ্ছে যে গাছ যত বয়স্ক হয় তার বৃদ্ধির হার তত বেশি অর্থাৎ বাতাস থেকে তত বেশি কার্বন-ডাইঅক্সাইড শোষন করে। এই কারণে ঘন বনাঞ্চল পরিবেশের তাপমাত্রা খুব সহজেই কমিয়ে রাখতে পারে। দেখা গেছে সমুদ্র পৃষ্ঠের বায়ুস্তরের চাপ ২০০ মিলিবার এবং তাপমাত্রা ২৬.৫° সেন্টিগ্রেড হয়ে গেলেই ঘূর্ণিঝড়ের সূত্রপাত হয়। উপকূলবর্তী বনাঞ্চল ধ্বংস হলে আয়লা, আমফানের মত বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড়ের প্রকোপ আরও বেড়ে যাবে।
এছাড়াও বনাঞ্চল সব সময়ই বাস্তুতন্ত্রের আধার। এখানে উদ্ভিদ-প্রাণী-অনুজীবানু এমন একটি শৃঙ্খলে বাস করে যেখানে ক্ষয় ও পুনরুৎপাদন সুষম ভাবে হয় এবং শৃঙ্খলটি বজায় থাকে। কিন্ত যখন গাছের পর গাছ কেটে জঙ্গল উজার করে ফেলা হবে তখন এই শৃঙ্খলটিতে পুনরুৎপাদন আর হবে না, শুধু ক্ষয়ই হতে থাকবে। বাস্তুতন্ত্রের শৃঙ্খল ভেঙ্গে যাবে, যাকেই মেটাবলিক রিফ্ট বলা হয়। কারখানার বর্জ গিয়ে সমুদ্রে পড়বে। জল-দূষণের ফলে জলজ প্রাণীর শৃঙ্খলটিও ভেঙ্গে গিয়ে রিফ্ট তৈরি হবে।
কারখানায় উৎপাদন যত বাড়তে থাকবে পুঁজির পুনরুৎপাদনও তত বৃদ্ধি পেতে থাকবে, যা শুধুমাত্র মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের লোভকে চরিতার্থ করবে। এর বিপরীতে একই ভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকবে বাস্তুতন্ত্রের মেটাবলিক রিফ্ট, যা ক্রমে বিপন্ন করে তুলবে এদেশের জন সমষ্টিকে।
প্রতিরোধ
উড়িষ্যার সুন্দরগড় জেলার মানুষ স্টীল প্ল্যান্টের দূষণের কারণে কখনও পরিষ্কার আকাশে সূর্যোদয় দেখতে পায় না। সুন্দরগড়ের পাশে রতনপুরে নতুন স্টীল প্ল্যান্টের জন্য গ্রাম সভার আয়োজন চারবার ব্যর্থ হওয়ার পর পঞ্চমবারে ৪০০০ মানুষ উপস্থিত হয় এবং পুলিশের লাঠিচার্জ উপেক্ষা করে সম্মিলিত স্বরে ‘না’ বলে প্রজেক্ট আটকে দিতে সমর্থ হয়। ধিনকিয়ার মানুষেরও পস্কোর বিরুদ্ধে লড়ায়ের দীর্ঘ ইতিহাস আছে। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে আবারও তারা জীবন-জীবিকা রক্ষার জন্য লড়াই-এ নামতে বাধ্য হয়েছে।
উন্নয়নের সংজ্ঞা পরিবর্তনের আশু প্রয়োজন। প্রকৃতি নির্ভর আদিবাসী মানুষের জীবন, সংস্কৃতি ভারতের জাতিগত বৈচিত্র্য এবং বৈশিষ্ট্যের অংশ। নৃ-তাত্ত্বিক গবেষণার উপাদান। তারাই আমাদের প্রকৃতি পরিবেশের যথার্থ রক্ষক। যে উন্নয়ন সভ্যতার প্রান্তীয় পরিধিতে থাকা এই জনগোষ্ঠীগুলির স্বাভাবিক বিকাশের পথ রুদ্ধ করে তাদের অস্তিত্ব রক্ষার সঙ্কটে ফেলে দেয়, সেই উন্নয়ন সভ্যতার কেন্দ্রে থাকা মানুষের উপরেও আঘাত হানবে। হয়ত একটু দেরিতে হবে সে দুর্ঘটনা। প্রকৃতি পরিবেশের ধ্বংস মানুষকে এমন ভাবে রিক্ত করে যে, কোনো উন্নয়নই তা পূরণ করতে পারে না। বাস্তুতন্ত্রের ক্ষতি প্রথমিক ভাবে স্থানীয় মানুষকে বিপর্যস্ত করে তোলে। কিন্তু প্রকৃতি এমন এক শৃঙ্খলায় আবদ্ধ যে সেই শৃঙ্খল ভেঙ্গে মেটাবলিক রিফ্ট তৈরি হলে তার আঘাত ক্রমে চতুর্দিকে অনুভূত হয়। তাই পরবর্তী প্রজন্মের স্বার্থে, সভ্যতাকে বাঁচিয়ে রাখতে সকল শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের ধিনকিয়ার মত আন্দোলনগুলির পাশে থাকা প্রয়োজন।
সূত্রঃ
Sponge iron industries are killing fields (downtoearth.org.in)
Steel industry in China – Wikipedia
Direct reduced iron – Wikipedia
What Happened in History written by V Gordon Childe
The Hidden Life of Trees written by Peter Wohlleben
Iron and steel industry in the United States – Wikipedia.





