হর্ষ দাস
ভূমিকা: কয়েকদিন ধরে ভারতীয় জনতা পার্টির দুই মুখপাত্রের, হজরত মহম্মদ এর উপর করা মন্তব্যকে ঘিরে বর্তমান ভারতীয় সমাজ এবং বিশ্ব রাজনীতি সরগরম। বিরোধীদের মত হচ্ছে ভারতবর্ষ বিশ্বের দরবারে উদার এক মহানুভব দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ছিল, তাকে ধর্মীয় অসহিষ্ণু এক দেশ হিসাবে প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছে শাসক দল তাদের ইদানিং আচরণের মধ্য দিয়ে। বিজেপির উগ্র হিন্দুত্ববাদী মানসিকতাই এই ক্ষতির কারণ।
বিজেপি দলের প্রতিক্রিয়া:
১৬টি মুসলিম দেশ তাদের অসন্তোষের কথা ভারত সরকারকে জানাবার পর পরই, বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব উক্ত দুই দলীয় মুখপাত্রের দলীয় সদস্যপদ খারিজ করে দেয় , কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে সরকারি / প্রশাসনিক কোন পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এরপরে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয় – ভারতবর্ষ সমস্ত ধর্মকে সমানভাবে সম্মান করে থাকে। কেউ যদি অন্য ধর্মের সম্পর্কে কিছু বলে থাকেন তবে সেটা তার ব্যক্তিগত মত, তা দলীয় মত নয়।
অন্যদিকে বিজেপির এই স্ববিরোধিতা প্রসঙ্গে বিরোধীদের মত হচ্ছে – গত আট বৎসরকাল যাবৎ, ভারতীয় শাসক দল যেভাবে দেশের মধ্যে সংখ্যালঘুদের উপর একের পর এক আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছেন তাতে মুসলিম দেশগুলিকে দেওয়া বক্তব্যের সাথে তাঁদের আচরণ মিল খায় না বরং স্ববিরোধিতা দেখা যাচ্ছে।
এই স্ববিরোধ কেন:
ভারতীয় অর্থনীতি আজ রপ্তানি নির্ভর হয়ে গেছে। যে ১৬টি মুসলিম দেশ প্রতিবাদ করেছে তার সাথে বাংলাদেশকে জুড়লে ভারতবর্ষে উৎপাদিত পণ্যের একটা বিরাট অংশ রপ্তানি হয় উক্ত মুসলিম দেশগুলোতে। আর এই দেশগুলিতে ওখানকার জনগণ ভারতীয় পণ্য কেনার বিরোধিতা করছে। সমস্ত শপিংমলে ভারতীয় পণ্যকে কাপড় দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। তাই এই ধরনের উগ্র হিন্দুত্ব ভারতীয় রপ্তানি নির্ভর অর্থনীতিকে বিপদের মুখে ফেলে দিয়েছে।
এই চ্যালেঞ্জ এর কারণ কি:
নব্বই দশকের পর যে ধরনের পুঁজিবাদ বিকশিত হয়েছে তার মধ্যেই এই কারণটি নিহিত। বড় বড় শিল্পকে বন্ধ করে দিয়ে তার কাজকে আউটসোর্স করে দেওয়া হয়েছে সস্তা শ্রমের জগতে, আর বাজার তৈরি করা হয়েছে উচ্চ আয়ের দেশে। উক্ত মুসলিম দেশগুলোতে তেল-অর্থনীতির সুবাদে যে উচ্চ আয়ের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জন্ম হয়েছে তারাই ভারতীয় শিল্প-পণ্যের এক বড় ক্রেতা। ফলে উক্ত দেশগুলিতে পণ্য বিক্রয় না হলে ভারতীয় শিল্পগুলো ধুঁকতে শুরু করবে, যে শিল্পগুলো আবার মূলত আদানি আম্বানিদের শিল্প। যে শিল্পপতিদের চ্যানেলগুলি আবার বিজেপির সাথে গলা মিলিয়ে দেশের মধ্যে উগ্র হিন্দুত্বের এক বাতাবরণ তৈরি করেছে।

দেশের মধ্যে উগ্র হিন্দুত্ববাদ কেন:
উগ্র হিন্দুত্ববাদ হচ্ছে মুসলিম, দলিত এবং আদিবাসীদের অগ্রাহ্য করার এক মনুবাদী সংস্কৃতি। মুসলিমদের বিরুদ্ধাচরণ করে, সেই মর্মে দলিত ও আদিবাসীদের হিন্দুত্বের ছাতায় নিয়ে আশার আপ্রাণ চেষ্টা চলছে শাসক শিবিরের পক্ষে। আবার নাগরিকত্বের জিগির তুলে ‘এনআরসি’র মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষের সংবিধানের বাইরে এইসব দলিত, আদিবাসী ও মুসলিম মানুষদের বার করে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। তার কারণ, এই অংশের মানুষরা মূলত মেহনতী মানুষের মধ্যে পড়ে। আসামে এই পরিকল্পনার হাত ধরে অনেক মানুষকেই নাগরিকত্বের বাইরে বার করে দিয়ে নূন্যতম মজুরির থেকেও অনেক কম টাকায় কাজ করতে বাধ্য করানো হচ্ছে। তাঁদের প্রতিবাদ করার কোন অধিকার নেই, কারণ আইনমতে তাঁরা আর ভারতীয় নাগরিক নন।
তাই দেশে উগ্র হিন্দুত্ববাদ দিয়ে কম মজুরিতে কাজ করানো, আর মুসলিম রাষ্ট্রে অধিক দামে পণ্য বেচে মুনাফার পাহাড় গড়ার হাত ধরেই আদানি, আম্বানিদের এত বাড় বাড়ন্ত।
কিন্তু কি হলো:
যেই আদানি, আম্বানিদের পণ্য বিক্রয় থমকে গেল উক্ত দেশগুলিতে, তখনই তারা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে তাদের চ্যানেলেই বিজেপি নেতাদের ডেকে ধোলাই শুরু করলেন। যে চ্যানেলগুলি দুদিন আগেও উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের হয়ে জ্ঞানব্যাপী মসজিদে শিবলিঙ্গ পাওয়া গেছে বলে ভারতবর্ষব্যাপি ধর্মীয় উত্তেজনা তৈরীতে ব্যস্ত ছিল। এইসব চ্যানেলের হর্তাকর্তারা এখন বিজেপি নেতাদের ধরে ধরে বলছেন – এই সব ধর্মীয় প্রচার ছাড়া আপনাদের কোনো অ্যাজেন্ডা নেই। এই হচ্ছে বাজারের লীলাখেলা। কম মজুরিতে পুঁজি উৎপাদন করে যদি অধিক দামে বেচে পুঁজি রিয়েলাইজ না করা যায়, তাহলে পুঁজি আর পুঁজি থাকে না, পুঁজি তখন মৃত হয়ে যায়। আদানি আম্বানীদের কাছে মানুষ ও দেশের থেকে পুঁজিকে জীবন্ত রাখাই একমাত্র লক্ষ্য। তাই তাদের কথা হচ্ছে হিন্দুত্বকে দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখ, বিদেশে ছড়িও না। গ্লোবালাইজেশনের যুগে এটা কি সম্ভব? যেখানে ভারতবর্ষে ১৪ শতাংশ মুসলিম বাস করে। শুধু তাই নয় উক্ত মুসলিম দেশগুলিতেও ভারতীয় মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বেশকিছু যুবক-যুবতী কর্মরত, তাদের উপরও যে প্রভাব পড়বে সেটাও ভারতবর্ষের রাজনীতিতে খুব সুফল আসবে না।
বিরোধীদের ভারতের নাককাটার যুক্তি:
বিবিধের মাঝে দেখ মিলন মহান– ভারতবর্ষের এই আদর্শ পৃথিবীতে চিরকালই সমাদৃত হয়েছে এবং ভারত সেইভাবেই চলেছে। কিন্তু আজ তা ধুলায় লুণ্ঠিত। বিরোধী দলগুলিও ভারতের এই নাক কাটা যাওয়ার পিছনে একই ভাবে দায়ী। ভারতবর্ষে যখনই কোন না কোন মেহনতী মানুষের আন্দোলন গড়ে উঠেছে (শ্রমিকেরশ্রেনীর, কৃষক সম্প্রদায়ের বা ছাত্র যুবকদের) তখনই বিজেপি বারবার সেটাকে ধর্মীয় মেরুকরণ করে আন্দোলনের শক্তিকে ধ্বংস করেছে (যা স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়ও করেছে তাদের দল হিন্দু মহাসভা)। তখন বিরোধীরা নিশ্চুপ থেকেছে শুধু তাই নয় কোন না কোন ভাবে এই জাতীয় রাজনীতিকেও তারা মদত করেছে মেহনতী মানুষের বিরুদ্ধে। অধুনা কৃষক আন্দোলনের ক্ষেত্রেও দেখা গেল শুধুমাত্র মৌখিক সমর্থন ছাড়া বিরোধীরা কোন কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়নি। ফলে বিজেপি বারংবার ফাঁকা ময়দানে তাদের আগ্রাসী হিন্দুত্বের রাজনীতিকে বাড়িয়েই চলেছে মেহনতী মানুষকে ছত্রভঙ্গ করে দিয়ে।
তাই ধর্ম ও জাতপাতের বিরুদ্ধে মেহনতী মানুষের ঐক্য গড়ে এই নাক কাটা যাওয়াকে আটকানো সম্ভব, নচেৎ নয়।