বন্যায় বিপর্যস্ত পাকিস্তান, বাংলাদেশ সহ উত্তর-পূর্ব ভারত, চীন ও ইউরোপের এক বড় অংশ তীব্র দাবদাহ ও খরার কবলে নাজেহাল

সম্প্রতি কয়েকদিনের তুমুল বৃষ্টি ও হিমবাহ গলে যাওয়ায় আমাদের প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তানে সাড়ে তিন কোটির বেশি মানুষ বন্যাদুর্গত, হাজার কোটি টাকার অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতি।

flooded small village with green trees

সন্তোষ সেন

সম্প্রতি কয়েকদিনের তুমুল বৃষ্টি ও হিমবাহ গলে যাওয়ায় আমাদের প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তানে সাড়ে তিন কোটির বেশি মানুষ বন্যাদুর্গত, হাজার কোটি টাকার অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতি। বিশ্বের নানান প্রান্তে একই সাথে মেঘভাঙা প্রবল বৃষ্টিপাত, হড়পা বান, ধস, প্লাবন আর অনাবৃষ্টি, খরা, তীব্র দাবদাহ, জলের সংকট, চাষাবাদের ক্ষয়ক্ষতি – সব ধরনের এক্সট্রিম (চরম) প্রাকৃতিক দুর্যোগ কেন ঘটছে বারবার, আমি আপনি নিরাপদ তো? আমরা চাই বা না চাই, এইসব প্রশ্নগুলো আমাদেরকে ভাবাচ্ছে, পীড়িত করছে। দেশের নানান রাজ্য, প্রতিবেশী দেশ বা অন্যদেশ বারবার প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের করাল গ্রাসে জর্জরিত, বিধ্বস্ত হচ্ছে জনজীবন, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মৃতের সংখ্যাও। আমরা কি এখনো নীরব নিশ্চুপ থাকব ঘরের দোরে জল না ওঠা পর্যন্ত, নাকি হাজারো রাজনৈতিক তরজা কূটকাচালি নিয়েই নিজেদের ব্যতিব্যস্ত রাখব???

পাকিস্তানের ভয়াবহতা:

বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদসংস্থা থেকে যা জানা যাচ্ছে – আগস্টের শেষ সপ্তাহ থেকে প্রবল বৃষ্টি ও হিমবাহের অস্বাভাবিক হারে গলনের কারণে বিপর্যস্ত বিধ্বস্ত পাকিস্তানের এক বড় অংশ। যেদিকে চোখ যায় শুধুই জল, জল আর জল।

এই বন্যাকে জাতীয় বিপর্যয় বলে ঘোষণা করা হয়েছে। আসলে ২০২২ সালের জুন থেকে পাকিস্তান স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যার সম্মুখীন হয়েছে। ২২ কোটি জনসংখ্যার দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশটির প্রায় এক তৃতীয়াংশ মানুষ জলমগ্ন হয়ে পড়েছেন। বিধ্বংসী এ বন্যায় এখনো পর্যন্ত তেরোশোর বেশি মানুষ মারা গেছেন। দশ লক্ষাধিক বাড়িঘর মাটিতে মিশে গেছে এবং কম করে ২২০০ মাইল রাস্তা সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে, স্বভাবতই পরিবহন ব্যবস্থা বিপর্যস্ত। পাঁচ লক্ষের বেশি বাস্তুচ্যুত মানুষকে ত্রান শিবিরে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, অনেকের কোথাও যাওয়ার জায়গাটুকু পর্যন্ত নেই। তিন কোটি তিরিশ লক্ষ মানুষ বন্যাদুর্গত। সোয়াট, শাঙ্গলা, মিঙ্গরা এবং কোহিস্তান প্রদেশে হড়পা বানে ২৪টিরও বেশি সেতু ভেসে গিয়েছে, জলের তোড়ে নিশ্চিহ্ন অন্তত ৫০টি হোটেল। রাষ্ট্রসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের মতে –পাকিস্তানের এই বন্যা জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে এখনই সঠিক পদক্ষেপ করার জন্য সারা বিশ্বের কাছে সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে বড় সতর্কবার্তা (Unb News, 4.9.22)।

পাকিস্তান। ছবি. AP Photo/Fareed Khan vis the Atlantic

এই ভয়ানক পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার পাওয়ার আশার আলো এখনো পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না, কারণ এখনও তুমুল বৃষ্টি চলায় নদীগুলির জলস্তর বিপজ্জনকভাবে বেড়ে চলেছে। ফলে পরিস্থিতি ক্রমশ ভয়াবহ হচ্ছে। এই পরিস্থিতি সামলাতে অবিলম্বে ৬০ লক্ষাধিক মানুষের কাছে মানবিক সাহায্য পৌঁছে দেওয়ার আর্জি জানিয়েছে ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন। অন্যদিকে জাতিসংঘের জনসংখ্যা বিষয়ক সংস্থা জানিয়েছে– বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে অন্তঃসত্ত্বা মহিলা ও শিশুরা। বন্যাদুর্গতদের মধ্যে সাড়ে ছয় লাখ গর্ভবতী মহিলা আছেন, যার মধ্যে ৭৩ হাজার নারীর সেপ্টেম্বরে সন্তান প্রসবের কথা রয়েছে। অথচ ত্রাণশিবিরগুলোতে কোন স্যানিটাইজার নেই, গবাদি পশুর সাথে গাদাগাদি করে তাদের থাকতে হচ্ছে। অচেনা অজানা মানুষের সঙ্গে অস্বস্তিকর ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে দিন গুজরান করতে হচ্ছে এইসব মহিলাদের। চারদিক জলমগ্ন, গ্রাম শহরগুলো এক একটি নদীতে পরিনত হয়েছে, কিন্তু পানীয় জলের হাহাকার তুঙ্গে উঠেছে। ত্রাণশিবিরে শিশুদের দুধ, খাবার, ওষুধপত্র সহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীর অভাব প্রকট। চারিদিকে ভেসে রয়েছে গবাদি পশুর মৃতদেহ, ফলত স্বাভাবিকভাবেই জলবাহিত রোগ অসুখের প্রাদুর্ভাব বাড়ছে। বেশ কয়েকদিন ধরে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে কাটাতে হচ্ছে পাক নাগরিকদের এক বিপুল অংশকে (Editorji News Desk, 7.9.22)।

আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অন্তত ১০ বিলিয়ন ডলারের অর্থনৈতিক ক্ষতির আশঙ্কায় রয়েছে পাকিস্তান। দক্ষিণ পাকিস্তানের সিন্ধু নদ লাগোয়া সিন্ধু প্রদেশ অতিরিক্ত বৃষ্টির প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল আগেই (এই বছরের জুন মাসে)। অতিরিক্ত জল জমে যাওয়া ও পর্যাপ্ত নিকাশি ব্যবস্থা না থাকায় ফসলেরও ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। তবে কৃষকেরাই শুধু ভুক্তভোগী নন। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সামগ্রিক সরবরাহ ব্যবস্থা। চাষের জমি থেকে বন্যার জল না নামলে শীতকালীন গম চাষ করা কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়বে, যার প্রভাব পড়বে দেশের খাদ্যসুরক্ষায়। একজন কৃষকের ২৫০০ একর তুলো ও আখের খেত ডুবে গিয়েছে বন্যার জলে। সংবাদমাধ্যমকে তিনি জানান, ‘‘বন্যার ফলে আমরা ৫০ বছর পিছিয়ে গিয়েছি।’’ কৃষকদের মর্মবেদনা ধ্বনিত হচ্ছে দিকে দিকে – “এবারের চাষ তলিয়ে গেল জলের তলায়। শুধু তাই নয়, জমে থাকা জল যদি আর এক মাসের মধ্যে না নামে, তবে সেই জমিতে এ বছর গম চাষও করা যাবে না। আমাদের হয়ত না খেয়েই দিন গুজরান করতে হবে”। এই পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক মহলের কাছে মানবিকতার খাতিরে সাহায্যের হাত বাড়ানোর আবেদন জানাল পাকিস্তান। আমেরিকা, ব্রিটেন-সহ নানা দেশ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেও পরিস্থিতি সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে পাক সরকার।

মোহাম্মদ ফারুক আজম, আইআইটি ইন্দোরের গবেষক জানান, গত ১০০ বছরের সমস্ত রেকর্ড ভেঙে ফেলেছিল এই বছরের গরম। এপ্রিল মে মাসে দেশে প্রচণ্ড গরম পড়েছিল, তাপমাত্রা ঘোরাঘুরি করছিল ৪০ থেকে ৪৫ ডিগ্রির ঘরে, যা পাকিস্তানের স্বাভাবিক তাপমাত্রার থেকে আট – দশ ডিগ্রি বেশি ছিল। অত্যধিক তাপমাত্রা এবং তাপপ্রবাহের কারণেই এই শিসপার হিমবাহ গলে গিয়েছে বলে মনে করছেন তাঁরা। গোটা বিশ্বজুড়েই ভয়াবহ তাপপ্রবাহ চলেছে এই বছর, তার কারণে হিমালয়ের একাধিক হিমবাহের সঙ্গে ইউরোপের আল্পসের বহু হিমবাহ গলে গিয়েছে। বাদ যায়নি উত্তর এবং দক্ষিণ মেরু। আগে যেমনটা মনে করা হয়েছিল তার থেকে অনেক বেশি দ্রুতগতিতে হিমালয়ের বরফের চাদর গলে যাচ্ছে বিশ্ব উষ্ণায়নের কারণে। এর ফলে গোটা সিস্টেমটাই নড়বড়ে হয়ে যাচ্ছে, সেটা বায়ুমণ্ডল হোক বা জল চক্র, এমনকি সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্র সব কিছুই প্রভাবিত হচ্ছে।

আর হিমালয়ের হিমবাহ গলার কারণে সবথেকে বেশি ক্ষতির মুখে পড়ছে পাকিস্তান। বহু শহর, গ্রাম, চাষের জমি জলের তলায় চলে গিয়েছে, রাস্তাঘাট সহ সব যেন এক একটি নদী। এখানে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ অনেক বেড়ে গিয়েছে আগের থেকে। সবটা মিলিয়ে এক চরম জলবায়ু বিপর্যয়ের শিকার হয়েছে ভারতের এই পড়শি দেশ। তবে বলে রাখা ভাল এটা সবে শুরু! অতিরিক্ত বন্যাও অনেক সময় খরা ডেকে আনে। সিন্ধু নদী, যার উৎস তিব্বতে সেটাই পাকিস্তানের বন্যার মূল কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু কম সময়ে প্রবল বৃষ্টিপাত ও বন্যা হলে সেটার অধিকাংশ জল মাটির নিচে প্রবেশ করে ভুগর্ভস্থ জলের স্তর বাড়ানোর বদলে তা পানীয় জলের উৎস দূষিত করে সোজা সমুদ্রে গিয়ে মিশছে। বিশ্ব ব্যাংকের হিসেব অনুযায়ী ২০৫০ এর মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার ১.৫ থেকে ১.৭ বিলিয়ন মানুষ জলসংকটের মুখোমুখি হবেন। এদিকে যেমন বন্যা বাড়ছে অন্যদিকে তেমনই খরা দেখা দিচ্ছে। ফলে সবটা মিলিয়েই জলবায়ু পরিবর্তনের ছবিটা দিন দিন প্রকট হয়ে উঠছে।

বাংলাদেশ।

ভারতবর্ষের সাম্প্রতিক বন্যা পরিস্থিতি ও জলবায়ু পরিবর্তনের চালচিত্র:

ঝাঁ চকচকে তথ্যপ্রযুক্তির শহর বেঙ্গালুরুতে দুইদিনের প্রবল বৃষ্টিতে পরিবহন ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ায় কর্মীদের বাড়িতে বসে কাজ করার নিদান দিতে বাধ্য হয়েছে কর্তৃপক্ষ। অবিরাম বর্ষণে ভারতের ‘সিলিকন ভ্যালি ‘ বেঙ্গালুরুর দক্ষিণ নগরীর লাখ লাখ মানুষ বন্যাদুর্গত। ৫ ই সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হওয়া অবিরাম বৃষ্টিতে অনেক রাস্তাই জলের তলায় তলিয়ে গেছে, যোগাযোগ ব্যবস্থা মারাত্মকভাবে বিপর্যস্ত। অনেকেই নৌকায় করে শহরের মধ্যে যাতায়াত করছেন। তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের অফিসের বেসমেন্ট সহ একতলা জলের তলায়, চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে বেঙ্গালুরুর বাসিন্দাদের, এই মরশুমে এখানে ১৬২ শতাংশ বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে। এরই মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা থেকে হাজার হাজার মানুষকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে, দুর্গত এলাকায় যথারীতি বিশুদ্ধ জলের সংকট দেখা দিয়েছে। অনেক এলাকায় বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন। এই বিপর্যয়ের জন্য নগরীর অপরিকল্পিত ড্রেনেজ ব্যবস্থাকে দায়ী করছেন স্থানীয়রা। তথ্য প্রযুক্তি কর্মী পৌষালী গুহ’ র বক্তব্য বেশ প্রণিধানযোগ্য। তাঁর মতে –” বেহাল পরিকাঠামো আর পরিবেশ নির্বিচারে ধ্বংস করলে তার ফল যে কী মারাত্মক হতে পারে, এবারের এই বৃষ্টিতে বেঙ্গালুরুতে বসে খুব ভালো করে বুঝতে পারছি। এই পরিস্থিতির কারণ খুঁজতে গেলে প্রথমে যা চোখের সামনে আসবে, তা হল বেআইনি নির্মাণের বাড়বাড়ন্ত। লেক এমনকি নর্দমা বুঝিয়েও বড় বড় বাড়ি, অফিস বিল্ডিং, শপিং মল তৈরি করা হয়েছে। রাস্তাঘাটে যেখানে সেখানে বর্জের স্তূপ”। পুঁজির আরো আরো বিনিয়োগ ও মুনাফার জন্য যেখানে সেখানে, যেন তেন প্রকরণে গড়ে উঠছে অফিস, কাছারি, হোটেল – রিসোর্ট। ফলে তথাকথিত উন্নত শহরগুলোর আসল চেহারা বেরিয়ে পড়ছে দুই দিনের ভারী বৃষ্টিতেই, যার ফল ভোগ করতে হচ্ছে তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী সহ আমআদমি সকলকে। এটা মেনে নেওয়ার সময় এসেছে – মানুষের টাকা, গাড়ি, বাড়ির আস্ফালন প্রকৃতির দারুন রোষের কাছে নেহাতই তুচ্ছ। আসলে প্রকৃতির জগতে পরম বলে কিছুই হয় না।

বিপর্যস্ত উত্তরপূর্ব ভারত:

অসম, মেঘালয়, ত্রিপুরা সহ উত্তর পূর্ব ভারতের এক বড় অংশ এই বছরের মে -জুন – জুলাইয়ে জলমগ্ন হয়ে পড়ে, গ্রাম শহর সব জল থইথই। অসমের ৩২ টি জেলার আশি লক্ষের বেশি মানুষ বন্যায় বিপর্যস্ত, প্রাণহানির খবরও আছে। বিঘার পর বিঘা কৃষিজমি ও কৃষিশস্য জলের তলায়। বন্যার কবলে পড়া কয়েক লক্ষ মানুষকে আশ্রয় শিবিরে নিয়ে যেতে বাধ্য হল প্রশাসন, জলে ভেসে গেছে কয়েক হাজার গবাদি পশু। রেল সহ গণ পরিবহন ব্যবস্থা পুরোপুরি ব্যাহত হল কয়েক দিন ধরে। তথ্য বলছে, ৪০ বছরে অন্তত পাঁচবার বন্যায় ডুবেছে শিলচর, বরাক উপত্যকা ও কাছাড় জেলা। নদীমাতৃক আসামের মানুষ জল-যন্ত্রণার ছবি দেখে জন্ম গ্রহণ করেন –বেড়ে ওঠেন –মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু এ বছরের মে মাসের মাঝামাঝি আর জুনের বন্যা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। পানীয় জল, আলো-পাখা, মোবাইল ও ইন্টারনেট সংযোগহীন শহুরে মানুষদের বেশ কয়েক দিন চলল শুধুই দুর্ভোগ- আতঙ্ক- উৎকণ্ঠার প্রহর গুনে। অন্যদিকে মেঘভাঙা তুমুল বৃষ্টি, হড়পা বান ও ভূমিধসে অমরনাথে ১৬ জন মানুষ মারা গেলেন, নিখোঁজ কম করে ৪০ জন পুন্যার্থী (যদিও বেসরকারি মতে নিখোঁজের সংখ্যা ১০০ ছাড়িয়ে যাবে), ভেসে গেছে একাধিক তাঁবু, ১১২ জন বাঙালি পর্যটক সহ আটকে পড়েছিলেন বহু মানুষ। কাদামাটি সরিয়ে মৃতদের নিথর দেহ তুলে আনা হয়। যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। উত্তরাখণ্ডের স্মৃতি আবারও ফিরে এলো অমরনাথের মানুষের জীবনে।

হিমাচল প্রদেশের সিমলাতেও কয়েকদিন আগে মেঘ ভাঙ্গা তুমুল বৃষ্টি, হড়পা বাণ ও ধসের কবলে নাজেহাল হলেন কয়েকহাজার মানুষ। পর্যটকদের একাধিক গাড়ি মাটি, পাথর চাপা পড়ে তালগোল পাকিয়ে গেল।

এমনিতেই ভঙ্গুর ও এখনো স্থিতিশীল না হওয়া হিমালয়ের বুকে ডিনামাইট ফাটিয়ে রাস্তাসহ অন্যান্য নির্মাণ কার্য, নদীর স্বাভাবিক গতিপথ আটকে দেওয়া ও যত্রতত্র বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের অবৈজ্ঞানিক পরিকল্পনার চাপে হিমালয় আজ আক্ষরিক অর্থেই বিপন্ন। এখন এটা স্পষ্ট করে বুঝে নেওয়ার সময় এসেছে যে, এইসব ঘনঘন তীব্রমাত্রার প্রাকৃতিক দূর্যোগ ও মানুষের দুর্ভোগ প্রকৃতির রোষে নয়, বরং তা অনেক বেশি করে মানুষের দোষে। তাই বিনষ্ট হয়ে যাওয়া পরিবেশকে কিভাবে সুস্থ করে তোলা যায় সেই বিষয়ে যেমন আমাদের ভাবতে হবে, বিজ্ঞানী ও পরিবেশবিদদের মতামত ও প্রস্তাবকে গুরুত্ব দিতে হবে। ভাবতে হবে তথাকথিত উন্নয়ন কাদের স্বার্থে, কিসের বিনিময়ে? পাশাপাশি এই প্রশ্ন তোলারও সময় এসেছে – হিমালয়ের উত্তুঙ্গে, প্রকৃতির কোনায় কোনায় এত পর্যটক ও তাদের আরাম আয়েসের জন্য পরিবেশ বিঘ্ন করে পর্যটন শিল্পের রমরমায় রাশ টানার প্রয়োজন কিনা?

১২২ বছরের ইতিহাসে বাংলাদেশে সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যা:

২০২২ সালের জুন মাসে বর্ষা মরশুমের শুরুতে বাংলাদেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বভাগের অঞ্চলগুলিতে প্রবল বন্যার কারণে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ও মৃত্যুর স্বাক্ষী থাকলেন বাংলাদেশের আপামর জনগন। সিলেট, সুনামগঞ্জ, রংপুর ও কুড়িগ্রাম জেলায় সবমিলিয়ে ৩৫ লক্ষ জনসাধারণ বন্যায় আক্রান্ত হলেন। অধিকাংশ নদী বিপদসীমার ওপর দিয়ে বয়ে ১২টির বেশি উপজেলাকে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছে জলের তোড়ে। বিশাল বিশাল জনপদ জলবন্দী হয়ে গেছে, বিদ্যুৎসংযোগ ও টেলিযোগাযোগ বন্ধ হয়ে গিয়েছে, দেশের অনান্য অঞ্চলের সাথে সড়ক যোগাযোগ কার্যত বিচ্ছিন্ন ছিল বেশ কিছুকাল ধরে। ১৯৮৮ ও ১৯৯৮ সালের বন্যার পরে বাংলাদেশের এবারের বিপর্যয়কে সাম্প্রতিক ইতিহাসের সবচেয়ে মারাত্মক বন্যা হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। সিলেট ও সুনামগঞ্জের যথাক্রমে ৮০% ও ৯০% এলাকা বানভাসি হয়েছে।

বাংলাদেশে বন্যার কারণ বিবিধ:

২০২২-এর জুন মাসে মাত্র তিন দিনে ভারতের আসাম ও মেঘালয়ে আড়াই হাজার মিলিমিটারের মতো বৃষ্টিপাত হয়, যা গত ২৭ বছরে তিন দিনে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাতের রেকর্ড। এই পর্যায়ে বিশ্বের সবচেয়ে বৃষ্টিপ্রবণ অঞ্চল মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জিতে (বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে মাত্র ৩০ কিলোমিটার দূরে) ২৪ ঘণ্টায় ৯৭২ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়, যা বিগত ১২২ বছরের মধ্যে এক দিনে তৃতীয় সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত। অতিবৃষ্টির কারণে সৃষ্ট আসাম ও মেঘালয়ের ঢলের জলস্রোত ভারতের বরাক নদী হয়ে সিলেট অঞ্চলের সুরমা ও কুশিয়ারা নদীসহ বহুসংখ্যক উপনদী ও হাওর অঞ্চল হয়ে  কিশোরগঞ্জে মেঘনা নদীতে মেশে। হাওরগুলিতে অপরিকল্পিতভাবে সড়ক, স্লুইসগেট ও বাঁধ নির্মাণ ও উন্নয়নের নামে নদীর গতিপথ সংকোচন, নদীতে বর্জ্য ফেলা, নদী দখল, উজানে নির্বিচারে পাহাড় ও টিলা কাটার ফলে ভূমিক্ষয়ের কারণে পলি জমা হয়ে বাংলাদেশের নদীগুলির ক্রমশঃ নাব্যতা হ্রাস, ভারতে উজানে বাঁধ নির্মাণ ও বর্ষার সময় ড্যাম থেকে অতিরিক্ত জল আকস্মিক ছেড়ে দেওয়া, ইত্যাদি কারণে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বন্যার ঝুঁকি সাম্প্রতিককালে বৃদ্ধি পেয়েছে।

ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তানের বন্যার মূল কারণগুলো বিশ্লেষণ করলে এটা জলের মত পরিষ্কার যে, পরিবেশের বিপর্যয় আজ রাষ্ট্রীয় সীমানা ছেড়ে আন্তর্জাতিক পরিসরে হাজির। আজ পৃথিবীজোড়া প্রাণ-প্রকৃতির আন্দোলন এই প্রশ্ন তুলে দিয়েছে যে, সাইবেরিয়ার একখণ্ড বনভূমি কেটে উড়িয়ে দিলে তার critical impact শুধু সাইবেরিয়ায় সীমাবদ্ধ থাকবে না, সারা পৃথিবী সেই সঙ্কটের ভাগীদার হবে এবং বাস্তবে সাম্প্রতিক সময়ে তা সর্বোচ্চ অর্থে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। এটাও সত্য যে, এইসব দূর্যোগ ও মানুষের দুর্ভোগ রাজনৈতিক দল, জাতি ধর্ম, শিশু মহিলা নির্বিশেষে সকলকে সমানভাবে ধস্ত করে ও করবে। তাই এর সমাধান করতে হবে আন্তর্জাতিক স্তরেই সৌহার্দ্য- সহযোগিতা ও বৈজ্ঞানিকভাবে সামগ্রিক পরিকল্পনা গ্রহণের মধ্য দিয়ে। নাহলে শিয়রে শমন, শেষের সেই ভয়ঙ্কর দিনের জন্য উদ্বেগ উৎকণ্ঠা নিয়ে বসে থাকা আর হাহুতাশ করা ছাড়া হাতে পড়ে থাকবে শুধুই পেন্সিল।

গ্লোবের অন্যপ্রান্তে ঘটে চলেছে আর এক চরম বিভীষিকা:

একই সময়ে বিশ্বের আর একপ্রান্তের মানুষ নাস্তানাবুদ হচ্ছেন প্রবল দাবদাহ, খরা ও মাত্রাছাড়া তাপমাত্রার ভয়ানক রোষে। ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, স্পেন সহ ইউরোপের একাধিক দেশের তাপমাত্রা জুলাই মাসে ৪০- ৪৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ঘরে। জুলাই – অগাস্টে এইসব অঞ্চলের তাপমান ১৮-২০ এর মধ্যে থাকে বলে উষ্ণ অঞ্চলের মানুষ কয়েকদিন আরামে কাটানোর জন্য এখানে ভিড় করতেন, সেইসবই এখন অতীত –পুরোটাই গরম আর তীব্র তাপপ্রবাহ। ওখানকার মানুষজনের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা তাপপ্রবাহের ঝলকানিতে জ্বলেপুড়ে খাক হচ্ছে। জল দেখলেই মানুষ ঝাঁপ দিচ্ছেন ক্ষণিকের স্বস্তি পেতে, শীততাপ যন্ত্রের চাহিদাও বেড়ে গেছে এইসব শীতপ্রধান অঞ্চলে। আর সর্বাধিক গ্রীনহাউস গ্যাস নির্গমনের দেশ আমেরিকার এক বিশাল অংশের বেশ কয়েকটি জঙ্গল দাবানলের তীব্র অনলে পুড়ে ছাই হচ্ছে, মারা যাচ্ছে কতশত বন্যপ্রাণ তার সঠিক হদিস হয়ত মিলবে না কোনদিনই। ইতিহাসে প্রথমবার কলোরাডো নদীতে জলসঙ্কট ঘোষণা করতে মার্কিন প্রশাসনকে।

চীনের ভয়াবহ বিপর্যয়:

দীর্ঘ কয়েক মাস ধরে তাপপ্রবাহ পরবর্তী দাবানলে বিদ্ধস্ত হয়েছে দক্ষিণ-পশ্চিম চীন। খরার মোকাবিলা করতে হচ্ছে চীনকে। আগস্টের শেষ সপ্তাহে পাওয়া খবর অনুসারে –৭০ দিনেরও বেশি সময় ধরে তাপপ্রবাহ পুড়িয়ে দিচ্ছে চীনের বিস্তীর্ণ এলাকা। এই সময় জুড়ে এইসব অঞ্চলের তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি পেরিয়ে যায়। সরকারি নথি অনুসারে, ১৯৬১র পর এমন গরম ও তাপ্রবাহ দেখেননি এইসব অঞ্চলের অধিবাসীরা। ইয়াংজি ও তার একাধিক শাখানদীর জল গেছে শুকিয়ে। চীনের সবচেয়ে বেশি শস্য উৎপাদনকারী জিয়াংঝি প্রদেশে খরাকালীন জরূরী অবস্থা জারি করতে বাধ্য হয়েছেন কর্তৃপক্ষ। কৃষিজাত পণ্যের উৎপাদন কমে যাওয়ায় বন্ধ বেশ কিছু শিল্প কারখানাও। সেই সঙ্গে বিদ্যুৎ উৎপাদনেও ঘাটতি চলছে। খরার কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের সংকট ও তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে দাম। তীব্র তাপমাত্রা ও দাবদাহের পরেই আসে একনাগাড়ে বৃষ্টি, ঠিক যেন উলট পুরাণ। ফলে ২৭ আগস্ট থেকে নাগড়ে কয়েকদিন প্রবল বৃষ্টি হয়ে গেল চীনের সিচুয়ান প্রদেশে। যার জেরে বিশেষ ভাবে বিপর্যস্ত শহর এবং শহরতলী মিলিয়ে মোট সাতটি জায়গা। শিলিং স্নো মাউন্টেনে একদিনে কয়েক ঘন্টায় ১৬৫ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে। স্থানীয় আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, উচ্চ তাপমাত্রা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা বাড়িয়ে তুলেছে সিচুয়ানে। খরার জেরে সেখানকার মাটি হয় আগের চেয়ে ছেড়ে গিয়েছে কিংবা অনেক বেশি শক্ত হয়ে উঠেছে। ফলে সেখানে এরকম ভারী বৃষ্টি চলতে থাকলে কাদা ধসের পাশাপাশি আরো চরম প্রাকৃতিক বিপর্যয় উপস্থিত হতে পারে। পূর্ব সিচুয়ান সহ দেশের বেশ কিছু এলাকার জন্য ‘ইয়লো অ্যালার্ট ‘ জারি করা হয়েছে দ্য ন্যাশনাল মিটিয়োরোলজিক্যাল সেন্টারের তরফে। সব মিলিয়ে তীব্র তাপপ্রবাহ, খরা ও পরবর্তী বন্যার কারণে চীনের আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি লাগামছাড়া।

তপ্ত ইউরোপ।

পরিবেশ বিপর্যয় বাড়ল কোন পথে:

নব্বইয়ের দশক থেকে উদার অর্থনীতি ও বিশ্ব বাণিজ্যের সুযোগে ফিন্যান্স-পুঁজি ফুলে-ফেঁপে উঠল এবং বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান ও কারখানাগুলোকে ভেঙে টুকরো করে উৎপাদন সামগ্রী ও প্রক্রিয়া ছড়িয়ে দেওয়া হল তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে। এর ফলে পুঁজির মূল শত্রু শ্রমিক বাহিনীর যুথবদ্ধতাকে যেমন ভেঙ্গে দেওয়া গেল, পাশাপাশি উন্নয়নশীল দেশগুলোর সস্তা শ্রম ও প্রাকৃতিক সম্পদকে আরো নিংড়ে নিয়ে পুঁজিপতিদের মুনাফা বৃদ্ধির হার কয়েকগুণ বেড়ে গেল। অটোমোবাইল শিল্প ও গাড়ির যন্ত্রাংশ তৈরির কারখানাগুলো ছড়িয়ে দেওয়া হল বিশ্ব-গ্রামে। মূলত আমেরিকা- ইউরোপ কেন্দ্রিক ভোগ্যপণ্যের উৎপাদন ব্যবস্থা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ায় পরিবেশ দূষণ ও তাপমাত্রা বৃদ্ধি অংকের সূচকীয় নিয়ম মেনে বাড়তে থাকায় বাতাসে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ ২০২০ সালে গিয়ে দাঁড়াল ৪০ বিলিয়ন মেট্রিক টনে। কারখানাগুলোকে টুকরো করে “ভার্টিকেল ডিভিশন অফ লেবার”-এর মধ্য দিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে গাড়ি ও অন্যান্য পণ্যের যন্ত্রাংশ তৈরি ও অন্য কোন প্রান্তে অ্যাসেম্বল করার প্রয়োজনে নিয়ে আসা হল অটোক্যাড (computer aided design) এবং www. com কে আমেরিকার সামরিক বাহিনীর কব্জা থেকে মুক্ত করে এক ‘ওপেন প্ল্যাটফর্ম’-এর জন্ম দেওয়া হল। এইসব প্রযুক্তি, জ্ঞান অর্থনীতি এবং পুঁজির আউটসোর্সিং-এর মধ্য দিয়ে বিশ্বব্যাপী এক ভোগ্যপণ্যের বাজার তৈরি হল। যার ফলে প্রয়োজন হয়ে পড়ল আরো আরো বিদ্যুৎ উৎপাদনের।

অন্যদিকে ভোগ্যপণ্যের বাজার ফুলে-ফেঁপে ওঠার সাথে সাথে সমুদ্রের জলস্তরও ফুলে-ফেঁপে উঠছে। সমুদ্রের জলের উষ্ণতা বৃদ্ধির সাথে সাথে মেরুপ্রদেশ ও হিমালয়ের বিশাল বিশাল বরফের চাঁই গলে যেতে থাকল চোখের নিমেষে। এই বরফ গলা কালো জল সূর্যের তাপ আরো বেশি করে শুষে নেওয়ায় সমুদ্রের তাপমাত্রা ও জলস্তরের উচ্চতা দুই-ই বাড়তে থাকল চক্রাকারে। বাড়ল দানবীয় সামুদ্রিক ঝড়ঝঞ্ঝার সংখ্যা ও তীব্রতা। সমুদ্র ও সুউচ্চ হিমালয় ও অন্যান্য পর্বতশ্রেণী দিয়ে সজ্জিত ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তানের মতো দেশগুলোতে যে ঋতুছন্দ ও জীববৈচিত্র্যে ভরপুর এক সুন্দর প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় ছিল, তার মূলে কুঠারাঘাত করা হল ইউরোপ আমেরিকার উৎপাদন ব্যবস্থাকে এসব দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ লুঠের অছিলায় ছড়িয়ে দিয়ে। এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশের তামাম জনগণকে এর ফল ভুগতে হচ্ছে নিত্যদিন, যা দিনদিন আরো ভয়াবহ ভয়ঙ্কর হচ্ছে।

জলবায়ু পরিবর্তনকে মোকাবিলা করতে হবে আন্তর্জাতিক পরিসরেই:

‘Act locally, think globally ‘ এই স্লোগানকে সামনে রেখে পরিবেশ মেরামতির দাবির লড়াইয়ের সামনের সারিতে এগিয়ে আসতে হবে শ্রমিকশ্রেণী ও বিশ্ব জুড়ে বামধারার আন্দোলনের নেতৃত্বকে। শ্রমিক আন্দোলনের আত্মা হল আন্তর্জাতিকতা প্রকৃতি মেরামতির দাবির আন্তর্জাতিক লড়াইয়ের সাথে যুক্ত হয়ে শ্রমিকশ্রেণী সহ মানুষ সমাজ ও প্রকৃতিকে বাঁচানো সম্ভব পুঁজির বিশ্বজোড়া হিংস্র আক্রমণের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যদিও বিজ্ঞানীদের মতেআমাদের হতে সময় স্বল্প, আমরা এক অপরিবর্তনীয় জলবায়ু বিপর্যয়ের চক্রে পড়ে গেছি, যাকে বলা হচ্ছে irreversible climate change. তাই প্রাণ প্রকৃতি পরিবেশ বাঁচানোর বিশ্বব্যাপী লড়াই আন্দোলনের মধ্যে দিয়েই সমস্ত মানুষ শুধু integrated হবে তাই না, সাংস্কৃতিক জগতেও ছন্দবদ্ধতা ফিরে আসবে এক বিশ্বমানবতার সংস্কৃতি গড়ে উঠবে শিল্পকলা ও বিজ্ঞানের মিলনে, যেখানে সমস্ত ধরণের শ্রমবিভাজনের পরিসমাপ্তি ঘটবে মানুষকে তার চামড়ার মধ্যে আবদ্ধ এক ছোট জীবের বদ্ধভাবনা থেকে বার করে প্রাকৃতিক করবে কিন্তু তাতে পুঁজির চলন ও বিকাশ হয়ে যাবে রুদ্ধ। আর তাই পুঁজির স্বার্থেই প্রযুক্তি, জ্ঞান অর্থনীতি এবং পুঁজির আউটসোর্সিং-এর মধ্য দিয়ে বিশ্বব্যাপী ফুলে-ফেঁপে ওঠা এক পণ্যের বাজার তৈরি হল। নব্য-মধ্যবিত্তকে টেনে আনা হল কর্পোরেটের স্বার্থে ওদেরই তৈরি করা গাদাগাদা অপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের বাজারে। ভোগবাদী জীবনধারায় অভ্যস্ত সমাজের একশ্রেণীর মানুষ প্রকৃতি থেকে, এমনকি সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে শুধু আরো আরো টাকার পিছনে ছুটে চলেছেন অন্ধগতিতে তাঁদের সবচেয়ে প্রিয় সন্তানসন্ততি ও নতিপুতিদের জন্য কোন্ ভয়ঙ্কর পরিবেশ রেখে যাচ্ছেন, সেই নিয়েও বিচলিত নন

সারা পৃথিবীব্যাপী নিদারুণ এক পরিবর্তনের দিকে এগিয়ে চলেছে মানুষসহ তামাম প্রাণীকুল। এসবের হাত ধরে পরিবেশগত উদ্বাস্তুর মিছিল লম্বা থেকে লম্বাতর হচ্ছে। ভিটে-মাটি, পরিবার- পরিজন, সংস্কৃতি সব হারিয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রবজনের সংখ্যাটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা ভেবে শিউরে উঠছেন বিজ্ঞানী ও পরিবেশবিদরা। তাই রাষ্ট্রসঙ্ঘের সচিব গুতেরস অতি সম্প্রতি এক সম্মেলনে যথার্থভাবেই বলেছেন – “এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আমাদের সকলকে পথে নামতে হবে, আর নাহলে সবাইকে একসাথে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হবে”। আমাদের স্পষ্ট বুঝে নিতে হবে –যা চলছে চলুক, আমার ঘরে যখন আগুন লাগবে তখন দেখা যাবে। কিন্তু সবার ঘরে আগুন লাগলে তা নেভানোর জন্য প্রয়োজনীয় জল পাওয়া যাবে তো, নাকি এক বুক বা এক কোমর জলে দাঁড়িয়ে রাজনৈতিক প্রপাগান্ডা চালিয়ে যাব?

লেখক পরিচিতি:

বিজ্ঞান শিক্ষক এবং বিজ্ঞান ও পরিবেশ আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক

যোগাযোগ:

Mail id: santoshsen66@gmail.com

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top