বিপদে আমাজন: বিপন্ন আমাদের গ্রহ

পোস্টটি দেখেছেন: 37 বঙ্কিম দত্ত পূর্বপুরুষদের বাড়ি :  আমাজন  বৃহত্তমসংখ‍্যক আদিবাসীদের  আবাসস্থল, যারা তাদের সংস্কৃতি এবং পরিচয় আজও ধরে রেখেছে। তারাই আজ সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত — জমি জোর করে কেড়ে নেওয়া  হয় এবং তাদের প্রাকৃতিক সম্পদ যেমন কাঠ এবং আকরিক চুরি হয়, লুঠ হয়।  বাড়িতে হামলা : ব্রাজিলের আমাজনে, খনির কারণে 2005 থেকে 2015 সালের […]

বঙ্কিম দত্ত

পূর্বপুরুষদের বাড়ি :

 আমাজন  বৃহত্তমসংখ‍্যক আদিবাসীদের  আবাসস্থল, যারা তাদের সংস্কৃতি এবং পরিচয় আজও ধরে রেখেছে। তারাই আজ সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত — জমি জোর করে কেড়ে নেওয়া  হয় এবং তাদের প্রাকৃতিক সম্পদ যেমন কাঠ এবং আকরিক চুরি হয়, লুঠ হয়।

 বাড়িতে হামলা :

ব্রাজিলের আমাজনে, খনির কারণে 2005 থেকে 2015 সালের মধ্যে 1.2 মিলিয়ন হেক্টর (12,000 বর্গ কিলোমিটার) আমাজন বন উজাড় হয়েছে যা ঐ সময়কালে মোট  আমাজন বনের ক্ষতির প্রায় 9% অংশীদার। 98,300 হেক্টর (983 বর্গ কিলোমিটার) সহ, এই বন উজাড়ের 8%  ঘটেছে সম্মতি হিসাবে। কিন্তু খননের পরিকাঠামো তৈরী , অর্থনৈতিক উন্নয়নের নামে আকৃষ্ট ক্রমবর্ধমান শ্রমশক্তির বসতি  সম্প্রসারণ এবং খনিজ পণ্য সরবরাহ-শৃঙ্খল  তৈরির কারণে এই ছাড়ের বাইরেই বেশিরভাগ বন উজাড় ঘটে চলেছে ।

এই  গ্রহের বৃহত্তম লৌহ আকরিক খনিটি ব্রাজিলের আমাজনে অবস্থিত। স্থানীয় জনগণের কোনরকম  উপকারের নামগন্ধ ছাড়াই VALE (Vale do Rio Doce, পৃথিবীর বৃহত্তম খণিজ উত্তোলনকারি) কোম্পানি লৌহ আকরিক  রপ্তানি করে । ফার্নান্দো হেনড্রিক কার্ডোসো সরকারের (1995 সালের কান্দির আইনের মাধ্যমে) এমনি বদান‍্যতা যে খণিজ এবং কৃষি পণ্যের সমস্ত রপ্তানির জন্য  কর ছাড় রয়েছে ব্রাজিলে ।

রপ্তানিকারক সংস্থাগুলির অর্থায়নে প্রায় 20 হাজার ছোটবড়ো সংস্থা আদিবাসী এলাকায় কাজ করছে। সুরক্ষা জোগাচ্ছে  জইর বলসোনারোর স্বৈরতান্ত্রিক  সরকার।  এই সংস্থাগুলি ঐ অঞ্চলে সোনারও খননকার্য  করে। এরা  পারদ ব্যবহার কোরে জল ও নদীকে দূষিত করে,আদিবাসি ও প্রাণীদের (বিশেষ করে মাছ) হত্যা করে আর  বিশাল অঞ্চলগুলিকে জীবনহীন করে ছেড়ে দেয়।

আমাজন হল এই গ্রহের সবচেয়ে সংবেদনশীল ইকোসিস্টেম এবং দক্ষিণ আমেরিকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ  বায়োমগুলির মধ্যে একটি। প্রকৃতি এবং পরিবেশ রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত ব্যবস্থা আমাজনের সুরক্ষা দিয়েই শুরু করতে হবে। আমাজন বনভূমি রয়েছে প্রায় অপরিবর্তনীয় বিপর্যয়ের (Tipping point) মধ‍্যে।

 মূল কারণ সমূহ :

 যদিও এমন অনেক কারণ রয়েছে যা বর্তমান সময়কে চালিত করছে কিন্তু প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুতর বিষয় হলো এই যে আমরা পুঁজিবাদী উৎপাদন ব‍্যবস্থার গভীর সংকটের ঐতিহাসিক সময়ে বাস করছি। সংকটের সময় এবং আরো বেশি অর্থ- পুঁজির আধিপত্যের সময়ে বড় কোম্পানি এবং কল্প- পুঁজি (fictitious capital) তীব্র আগ্রহ নিয়ে প্রাকৃতিক সম্পদের লোভে দিক-বিদিক ছুটে যায়। পুঁজির এই আক্রমণের লক্ষ‍্যে রয়েছে বিভিন্ন প্রাকৃতিক সম্পদ যেমন  জমি, জল, বনভূমি , জৈব-বৈচিত্র‍্য, খনিজ এবং শক্তির উৎস (জলবিদ্যুৎ,সৌর এবং বায়ু বিদ্যুৎ) যার সাহায্যে  শাসকশ্রেণী  তাদের পুঁজিকে রক্ষা করে এবং কাল্পনিক-পুঁজিকে (fictitious capital) শিল্প-পুঁজিতে রূপান্তরিত করে। প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের ব‍্যবহারজনিত কারণ সত্ত্বেও প্রকৃতির সম্পদগুলির কোন মূল্য নেই, কারণ সেগুলি মানব শ্রমের ফসল নয়। প্রযুক্তি তাকে পণ‍্যে রূপান্তরিত  করে। তাদের ব‍্যবহার মূল‍্যের চেয়ে অনেক বেশি মূল্যে বিক্রয়ের জন্য তা পণ্যে রূপান্তরিত হচ্ছে (শ্রম ও সময় প্রয়োজন এগুলোকে পণ্যে রূপান্তরিত করে বাজারে নিয়ে যাওয়ার জন্য)।  যার ফলে এসবই দিচ্ছে মুনাফার একটি চমৎকার হার যা একটা কারখানা বা ব্যবসার মাধ‍্যমে এত দ্রুত পৌঁছানো যায় না। উদাহরণস্বরূপ  কোকাকোলা এবং নেসলে জলের উৎস দখল করে বছরে 400 শতাংশ লাভ করে। কৃষকরা  জঙ্গল পরিষ্কার করে  এবং সেই জমিকে  সয়া বা গবাদিপশু উৎপাদন করে  এমন ব্যবসায়ীদের তাদের জমি পুনরায় বিক্রি করেন। আর ব‍্যবসায়ীগোষ্ঠি  500 শতাংশ হারে লাভ করে। সোনা, লোহা ও বক্সাইট খনি কোম্পানিগুলির লাভের হার 700 শতাংশের বেশি। বৃহৎ কোম্পানি এবং ব্যাঙ্কগুলির এই আক্রমণের ফলে পরিবেশগত অপরাধ, পরিবেশের  ধ্বংস এবং জলবায়ু  পরিবর্তনের ও জলদূষণ ও জলের অলভ‍্যতা বাড়ছে।

আদিবাসীরা

সময়ের দাবী :

একথা সুস্পষ্ট যে কাঠামোগত পরিবর্তনগুলি  প্রকৃতির আরো ক্ষতি, জলবায়ু পরিবর্তন এবং বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি করে। তাকে তখনই রোখা সম্ভব হবে যখন  লাভের  প্রণোদনাকে যা প্রকৃতির সম্পদের প্রতি লোভকে জাগিয়ে রাখতে ইন্ধন জোগায় তা  কাটিয়ে ওঠা যাবে। এক কথায় বললে প্রকৃতির  উপর ব‍্যক্তিগত অধিকার থাকতেই পারে না। আমরা সমাজের জন্য খাদ্য এবং শক্তির উৎসগুলিকে পণ্য হিসাবে বিবেচনা করতে পারিনা। বরং এটা সবসময়ই  জনগণের অধিকার হিসাবে গ্রাহ‍্য হওয়া দরকার।

প্রকৃতির শুশ্রুষার জরুরী ব্যবস্থাগ্রহণ দরকার, কিন্তু সরকার ও কর্পোরেটগুলি তা  নিতে চায় না। তাই এর জন্য সমগ্র মানবতার প্রচেষ্টা এবং সর্বোপরি জনগণের প্রতি  দায়বদ্ধ সংস্থাগুলির সাথে জড়িত থাকা এবং সংস্থাগুলির মধ্যস্থতার প্রয়োজন হবে।

 কিছু প্রস্তাব :

 • স্বাস্থ্যকর খাদ্য উৎপাদন এবং প্রকৃতির সাথে ভারসাম্য রক্ষার জন্য বিশ্ব কৃষি ব্যবস্থাকে পুনর্গঠন করা

 • দেশেদেশে শহরতলীতে স্থানীয় ফলের গাছ লাগানোর জন্য একটি গণ কর্মসূচি তৈরি করা

 •  জলের গুণমান এবং এর উৎস গুলিকে রক্ষা করা

 • তেল এবং কয়লার উপর ভিত্তি করে বর্তমান শক্তি ব্যবস্থাপনার বিরোধিতা করা এবং অবিলম্বে যৌথ ব্যবস্থাপনার অধীনে নির্মল এবং পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তিভিত্তিক মডেল গড়ে তোলা

 • পারিবারিক কাজ এবং প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে কৃষিকে শক্তিশালী করার উপায় হিসাবে বিশ্বজুড়ে সমস্ত ভূমিহীন কৃষকদের জমি বিতরণের একটি বিস্তৃত কর্মসূচি পরিচালনা করা

 • বিশ্বব্যাপী সকল রাসায়নিক কীটনাশকের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা

• ধ্বংসোন্মুখ খনন নিষিদ্ধ করা এবং যৌথ নিয়ন্ত্রণে খনিজ উত্তোলন সম্পূর্ণ জাতীয়করণ

 • সমস্ত শহরে গণ এবং যৌথ পরিবহন ব্যবস্থাকে অগ্রাধিকার দেওয়া এবং নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার করা

 • খাদ‍্য-সার্বভৌমত্ব গড়ে তোলার উপায় হিসেবে শহুরে-বাগান তৈরি করা এবং শহরের ফলের গাছ লাগানো

• গরু শুকরের মাংসের উৎপাদন হ্রাস  ও মানুষের খাদ্যে প্রোটিনের অন্যান্য উৎসের মাধ‍্যমে তাকে প্রতিস্থাপন করা

 • বিশ্ব কৃষি বাণিজ্য এবং কৃষিতে কর্মরত বৃহৎ ট্রান্সন‍্যাশনাল কম্পানির মুনাফার উপর কর বৃদ্ধি

 • সমস্ত স্থানীয় বনভূমিতে বাণিজ‍্যিক উদ্দেশ্যে বন উজাড় নিষিদ্ধ করা

• শুষ্ক অঞ্চলের জল সংরক্ষণ এবং সঞ্চয়নের জন্য কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা

 • খাদ‍্যের দূরপাল্লার পরিবহন পরিহার করা এবং স্থানীয় পর্যায়ে খাদ্য উৎপাদন জোরদার করা

•  সকল অতি-প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যের জন্য করের হার বৃদ্ধি করা

 • ট্রান্সজেনিক বীজের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা এবং বিশ্বের যেকোন বীজের মালিকানা ও উৎপাদনের একচেটিয়া ক্ষমতা রোধ করা

 বিশ্ব বাম :

 সারাবিশ্বে বামপন্থীদের রাজনৈতিক সংগঠন এবং তাত্ত্বিক চিন্তাধারা সাধারণ অর্থে জনগনের কাছে ঋণী। বামদের  আত্মসমালোচনা করা জরুরি এবং এই বিষয়গুলি এবং ধারণাগুলিকে তাদের কর্মসূচি এবং বিতর্কে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। অথচ খুব কম বামপন্থী বুদ্ধিজীবী এই বিষয়গুলি নিয়ে বিতর্ক করছেন।

 আমাদের শ্রমজীবী কৃষক যুবক নারী ছাত্র ধর্মপ্রাণ মানুষ— সমস্ত শ্রমজীবী মানুষকে সংগঠিত করতে অবদান রাখতে হবে যাতে আমাদের জীবন, আমাদের গ্রহ ও মানবতা রক্ষার্থে মহান গণজমায়েত এবং সংগ্রাম গড়ে ওঠে।

 খুব বেশি সময় নেই। গণসংগ্রাম ছাড়া কোনো পরিবর্তন হবে না। শুধুমাত্র একটি গ্রহ আছে আমাদের যাকে রক্ষা করার জন্য দ্রুত  ব্যবস্থা গ্রহণের আশু প্রয়োজন।

ঋণ স্বীকৃতি :

বর্তমান লেখাটি একটি অতি  সংক্ষিপ্ত ও পরিমার্জিত অনুবাদকর্ম। প্রেরণা ও তথ‍্যসূত্র  Monthly Review পত্রিকার 2022 এর 1 জুলাই সংখ‍্যায় প্রকাশিত  Joao Pedro Stedile এর We only have one planet— defending it will require collective measure.

লেখক পরিচিতি:

গনবিজ্ঞান প্রসার ও পরিবেশ আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top