সবুজ বাজি আদতে কতটা পরিবেশ বান্ধব?

পোস্টটি দেখেছেন: 44 সন্তোষ সেন মুখবন্ধ: বাজি কে আমরা চিনি পরিবেশ দূষণকারী ও স্বাস্থ্যহানিকর হিসেবেই। এই নিয়ে কারোর কোন দ্বিমত আছে বলে মনে হয় না, এমনকি যারা বাজি ফাটায় তাদেরও না। এই বাজির বিরুদ্ধে বিজ্ঞান ও পরিবেশ আন্দোলনের কর্মীদের প্রচার প্রতিবাদ জারি আছে দীর্ঘদিন ধরেই। বাজি নিষিদ্ধ করার দাবিতে মামলা- মোকদ্দমাও কম হয়নি। এই প্রেক্ষিতকে […]

সন্তোষ সেন

মুখবন্ধ: বাজি কে আমরা চিনি পরিবেশ দূষণকারী ও স্বাস্থ্যহানিকর হিসেবেই। এই নিয়ে কারোর কোন দ্বিমত আছে বলে মনে হয় না, এমনকি যারা বাজি ফাটায় তাদেরও না। এই বাজির বিরুদ্ধে বিজ্ঞান ও পরিবেশ আন্দোলনের কর্মীদের প্রচার প্রতিবাদ জারি আছে দীর্ঘদিন ধরেই। বাজি নিষিদ্ধ করার দাবিতে মামলা- মোকদ্দমাও কম হয়নি। এই প্রেক্ষিতকে সামনে রেখেই সবুজ বাজি কী, কেন ও তা আসলে কতটা পরিবেশবান্ধব তা বিচার করা দরকার। দেখার দরকার –সুপ্রিম কোর্টের রায় ও CSIR’ র নজদারি সত্বেও বাস্তবে ঠিক কী ঘটল। নিবন্ধের শেষে আলোচনা করব –আজকে প্রকৃতি পরিবেশকে বাঁচাতে, মানব প্রজাতিকে এই নীল গ্রহে টিকিয়ে রাখতে আমাদের ভাবনা চিন্তার জগতে কোন পরিবর্তন সাধন অত্যন্ত জরুরী।

সবুজ বাজির ইতিহাস:

বাজির দূষণ ও স্বাস্থ্যের উপর তার ক্ষতিকারক প্রভাব থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য ২০১৮ সালে সুপ্রিম কোর্টে একটি পিটিশন জমা পড়ে। এই মামলায় মহামান্য আদালত শব্দদানব ও বিষাক্ত বাজি তৈরি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন এবং কম দূষণ সৃষ্টিকারী ক্ষতিকারক বাজি তথা গ্রীন ক্র্যাকারস তৈরি ও বিপণনের পক্ষে রায় দেন। বিচারপতি M.R.Shah মন্তব্য করেন –”প্রতিদিন এই সমাজে কোনো না কোনো অনুষ্ঠান / দিবস উদযাপিত হয়। কিন্তু বাজি পোড়ানোর আগে চারপাশের পরিবেশ ও মানুষের স্বাস্থ্য সম্পর্কে মনোযোগী হওয়া দরকার”। এই রায়কে কেন্দ্র করে গঙ্গা-যমুনা দিয়ে অনেক জল (আইনের) গড়িয়ে যাওয়ার পর ২০১৯ সালে সর্বোচ্চ আদালত শেষ পর্যন্ত সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে আসেন। প্রয়োজনমতো যথেষ্ট পরিমাণে সবুজ বাজির উৎপাদনের সম্মতি দেন মহামান্য আদালত। এবং এই সবুজ বাজি যাতে বাজারে চাহিদামত পাওয়া যায় তা নিশ্চিত করতে নির্দেশ দেন CSIR (Council for Scientific and Industrial Research) নামক সংস্থাকে। এরপরই ‘সিএস আই আর’ সবুজ বাজির উৎপাদন, মজুদ ও বিক্রির জন্য ২৩০ টি কোম্পানির সাথে চুক্তিপত্রে সই করেন। এই ইতিহাসকে সাক্ষী রেখে এবার দেখা যাক এই নতুন ধরনের বাজিকে কেন বলা হচ্ছে গ্রীন, এই বাজি উৎপাদনে মালমশলার কী কী পরিবর্তন সাধন করা হল এবং সর্বোপরি সবুজ বাজি বাস্তবে কতটা পরিবেশবান্ধব।

বাজারে বিক্রি হচ্ছে তথাকথিত সবুজ বাজি।

কেন বলা হচ্ছে সবুজ বাজি:

এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে প্রথমে বাজির রাসায়নিক পরিবর্তনের দিকে চোখ ফেরানো যাক। এতদিন ধরে চলে আসা বাজির রাসায়নিক চরিত্রে কিছুটা পরিবর্তন ঘটানোর নির্দেশ দেওয়া হয় সুপ্রিম কোর্টের রায়ে। বলা হল –দূষণ ও শব্দের প্রাবল্য বা তীব্রতা কমানোর লক্ষ্যে এই নতুন কিসিমের বাজিতে বেরিয়াম, আর্সেনিক, সালফার, ইত্যাদি ক্ষতিকর ও বিষাক্ত রাসায়নিক উপাদান ব্যবহার করা যাবে না। লাভ কি হবে? সিএসআইআর’ এর দাবি –এর ফলে বাজি পোড়ানো জনিত বায়ুদূষণ ৩০-৩৫ শতাংশ কম হবে। তাদের আরো দাবি এই যে, প্রচলিত বাজির শব্দ-প্রাবল্য থাকে ১৬০ ডেসিবেলের মতো। কিন্তু সবুজ বা গ্রীন বাজির ক্ষেত্রে তা কমে ১১০ থেকে ১২৫ ডেসিবেলের মধ্যে থাকবে। তাহলে এটা বুঝে নিতে অসুবিধা হয়না যে, সিএসআইআর’ এর দাবি যথার্থ বলে ধরে নিলেও আলোচিত সবুজ বাজি কিন্তু কোনভাবেই দূষণহীন নয়। দূষণ ঘটবেই, বড়জোর তা তিরিশ শতাংশের মতো কম হবে। এই আর কি। এবং বাজি পোড়ানোর পর দূষিত বায়ু মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলবে ঠিক আগের মতই। অর্থাৎ গুণগত কোন পরিবর্তন সাধিত হল না। যা হল তা কেবল মাত্রায় বা পরিমাণে কিছুটা হেরফের।

বাস্তবে কতটুকু কী হল?

বাস্তব বড় নির্মম। ‘চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনী’ –এই আপ্তবাক্যকে সঠিক প্রমাণ করে এমনকি তথাকথিত গ্রীন বাজিতেও বেরিয়াম পাওয়া গেছে। হিন্দুস্তান টাইমস ডটকম (২৩.১০.২২) থেকে জানা যাচ্ছে –এই বছরের বাজি বাজার থেকে ১৭ রকমের জনপ্রিয় বাজির নমুনা সংগ্রহ করেন ‘আওয়াজ ফাউন্ডেশন’ নামে একটি এনজিও। এই বাজিগুলির রাসায়নিক বিশ্লেষণের জন্য তারা শহরের এক স্বাধীন ও নিরপেক্ষ সংস্থার ল্যাবে পাঠান। বিশ্লেষণের পর যা জানা গেল তা পিলে চমকে দেওয়ার মতো। ১৭টির মধ্যে ১২ টি নমুনাতেই বিষাক্ত ধাতু বেরিয়ামের উপস্থিতি পাওয়া গেছে উল্লেখযোগ্য মাত্রায়। আসলে বেরিয়াম দহনের পর সবুজ রং তৈরি করে এবং বাজির স্থায়িত্ব (shelf-life) বাড়িয়ে দেয়। কি মজা! সবুজ রঙ দেখলেই আপনি সবুজ বাজি বলে আনন্দে মেতে উঠবেন। আর আপনার চারপাশের শিশু ও বয়স্কদের শরীর বিষাক্ত ধোঁয়ায় আক্রান্ত হবে। আরো উদ্বেগের বিষয় হল –রাসায়নিক বিশ্লেষণ থেকে জানা গেছে যে, এই বছরের বাজির বেশ কয়েকটি নমুনাতেই আর্সেনিক, সালফার এবং ক্লোরিন পাওয়া গেছে। যদিও সবুজ বাজিতে এইসব বিষাক্ত রাসায়নিকগুলো ব্যবহার না করারই নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল সুপ্রিম কোর্টের রায়ে। কাকস্য পরিবেদন! একেই বলে গ্রীন ওয়াশিং। আর বাজারের স্বার্থে মানুষকে বোকা বানানোর গল্প শুনবেন? এইবছরের বাজির কোন প্যাকেটেই ব্যারিয়ামের উপস্থিতির কোন উল্লেখ নেই (যদিও ২০১১ সালে বাজির প্যাকেটে বেরিয়াম এর উল্লেখ থাকত)। সুপ্রিমকোর্ট, পরিবেশ কর্মী, বিজ্ঞানী সহ আপামর জনগণকে ধোঁকা দেওয়ার কি নির্লজ্জ প্রচেষ্টা। বিজ্ঞানীরা কি বলছেন? এই বিষাক্ত বেরিয়াম খাদ্যশৃঙ্খলে ঢুকে পেটে ব্যথা, বমি, ডায়রিয়া, এমনকি কোন কোন ক্ষেত্রে ‘hypokalaemia’ (অর্থাৎ শরীরে পটাশিয়ামের ঘাটতি) রোগে আক্রান্ত হয়ে মানুষ মৃত্যুর দিকে ধীর পায়ে এগিয়ে যেতে পারে।

এই বছরের তথাকথিত সবুজ বাজির ক্ষেত্রে বায়ুদূষণের পাশাপাশি শব্দ দূষণও সহনসীমার ওপরেই থাকল। বিজ্ঞানের অতি সাধারণ তত্বের থেকে আমরা জানি –খুব বেশি হলে ৬০ ডেসিবেল (বাইরে থাকাকালীন) প্রাবল্যের শব্দ মানুষের কাছে সহনশীল। কিন্তু লক্ষ্য করুন, গ্রীন বাজির প্রাবল্য ১২৫ ডেসিবেলের আশেপাশে। বিজ্ঞানীদের দাবি –অনেকটা সময় ধরে এই মাত্রায় শব্দের সংস্পর্শে এলে মানুষের কান স্বাভাবিকভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হবে, যার প্রভাব পড়বে মানুষের মস্তিষ্কে, বাড়বে উচ্চরক্তচাপ ও হাইপারটেনশনের সমস্যা, যা শেষ পর্যন্ত বাড়িয়ে দেয় হৃদযন্ত্রের সমস্যাকে। সাম্প্রতিক গবেষণা /  সমীক্ষা থেকে জানা যাচ্ছে –দীর্ঘক্ষণ উচ্চ তীব্রতার শব্দ আমাদের কর্ণকুহরে প্রবেশ করলে, তা মস্তিষ্কের ক্ষতির পাশাপাশি মানসিক অবসাদ ও হতাশার জন্ম দেয়, মানুষ হয়ে পড়ে বিষাদগ্রস্ত।

সবুজ বাজির বাজার:

বর্তমানে ‘সিএসআইআর’ র অনুমতি সাপেক্ষে নির্দিষ্ট ওই ২৩০ টি কোম্পানিই সবুজ বাজি তৈরি ও বাজারজাত করতে পারে। পাশাপাশি

 পিইএসও (Petroleum and Explosives Safety Organisation) কে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বাজির গুণমান যাচাই করার জন্য। অর্থাৎ আর্সেনিক, মারকিউরি বা পারদ, বেরিয়াম, ইত্যাদি বাদ দিয়ে বাজি তৈরি হয়েছে কিনা এবং উৎপাদিত বাজি নির্ধারিত শব্দসীমার (১১০-১২৫ ডেসিবেল) মধ্যে থাকছে কিনা, তা যাচাই করে সার্টিফিকেট প্রদান করা। নতুন কিসিমের এই সবুজ বাজির প্যাকেটে একটি ‘গ্রীন লোগো’ ও কুইক রেসপন্স কোডিং সিস্টেম (QR Code) দাগিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। ক্রেতা চাইলে এই কোড স্ক্যান করে বাজিটি সত্যি সবুজ কিনা তা যাচাই করে নিতে পারেন। ‘সি এস আই আর’ কর্তৃপক্ষের নজরদারিতে হাতেগোনা কয়েকটি কোম্পানিই বর্তমানে গ্রীন বাজি তৈরি করতে পারে। এর ফলে স্বভাবতই শহরের অলিতে গলিতে, এমনকি মফস্বলের আনাচে-কানাচে এতদিন ধরে চালু থাকা বাজি কারখানাগুলোর নাভিশ্বাস উঠে গেছে। কিন্তু দেশের বিপুল বেকার বাহিনীর চাকরি না থাকা এবং এই মাগ্গি গণ্ডার বাজারে স্বল্প আয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খাওয়া মানুষজন তো চাইবেনই তাদের এতদিনের রোজগারের উৎস চালু রাখতে। তাই আইনের কড়াকড়ি (?) থাকলেও লুকিয়ে-চুরিয়ে পুরনো বাজি তৈরি ও তার ব্যবসা চলছে রমরমিয়েই। আর এই বাজির দাম সবুজ বাজির তুলনায় কিছুটা কম হওয়ার কারণে তার বিক্রিবাটা চলছে সমস্ত নজরদারি বা প্রশাসনিক তৎপরতাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে। অন্যদিকে গ্রীন বাজিও যে দূষণ মুক্ত নয় এবং তা শব্দদূষণ তৈরিতেও খুব একটা পিছিয়ে নেই, তা আমরা আগেই আলোচনা করেছি। আসলে যেকোন কৃত্রিম রাসায়নিকের ব্যবহারই মানুষ ও পরিবেশের পক্ষে ক্ষতিকর, তা বুঝতে বিজ্ঞানী হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না।

এই লেখা তৈরীর (২৫.১২.২২) আগের দুই রাত থেকেই দরজা-জানলায় খিল এঁটেও লেখকের হৃদস্পন্দন বেড়ে গেছে চারপাশের শব্দদানবের তাণ্ডবে। আর রবিবার রাতে তো দেশে অকাল দেওয়ালি হয়ে গেল ক্রিকেটে পাকিস্তানকে হারিয়ে অপার স্বর্গীয় আনন্দ উদযাপনের ঠেলায়। পরিবেশ বিজ্ঞানীদের হিসেব অনুযায়ী প্রতি বছরের মতো এবারও ‘দিওয়ালি ধামাকা’ শেষে বাতাসে ভাসমান ধূলিকণার পরিমাণ বেড়ে যাবে কয়েকগুণ, যা বায়ুদূষণ ও মানুষের স্বাস্থ্য সমস্যাকে ত্বরান্বিত করবে। তথ্য বলছে –কালীপূজার পর কলকাতা ও হাওড়ার বাতাসে সিসার পরিমাণ বাড়ে যথাক্রমে ১১ ও ১৫ গুণ, সাথে ক্যাডমিয়াম, তামা এবং অ্যালুমিনিয়ামের পরিমাণও বেড়ে যায় বহগুন। বিশেষজ্ঞদের মতে –বাতাসে ভাসমান ধূলিকণার সহনসীমা ১০০ মাইক্রোগ্রাম। অথচ কালীপূজার সময় তা বেড়ে দাঁড়ায় ৭১১ মাইক্রোগ্রামের কাছাকাছি। নিশ্চিন্তে বলা যায় –এবারেও আগেকার চালু ও হাল ফ্যাশনের সবুজ বাজির বিস্ফোরণ এইসব বিপদজ্জনক সংখ্যায় খুব একটা হেরফের ঘটাবে না।

এখনো পর্যন্ত যে খবর পাওয়া যাচ্ছে, তা আমাদের উদ্বেগ ও আশঙ্কাকে যথেষ্ট বাড়িয়ে দেওয়ার মতো। করোনা সংক্রমণ ও লকডাউনের কারণে দুই বছর পর আনন্দে গা ভাসাতে বাজির বাজারে প্রচুর মানুষ ভিড় করছেন, বিক্রিবাটার পরিমাণও ঊর্ধ্বগামী। ২৩ অক্টোবর সন্ধ্যে থেকেই আকাশ বাতাস উচ্চকিত দড়াম-দড়াম, চড়াম-চড়াম শব্দে। পিলে চমকানো এই তাণ্ডব চলেছে প্রায় সারারাত ধরে। সরকার-প্রশাসন- পুলিশ-মন্ত্রী-সান্ত্রী-বিধায়ক, নেতা নেত্রী সবাই কী ‘মায়ের আরাধনায়’ ব্যস্ত, নাকি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন? ওদের তো আবার ভোট বৈতরণী পার হতে হয়। তাই দিল্লিতে সব ধরনের বাজি বিক্রি নিষিদ্ধ হলে মায়া কান্না জুড়ে দেন বিজেপির নেতা নেত্রীরা। যদিও দিল্লিতে বাজি ফেটেছে দেদার, আগের বছরগুলোর তুলনায় কোন অংশেই তা কম ছিল না।

এবারে বাজি নিঃসৃত ধোঁয়া ও শব্দের তাণ্ডব কেমন ছিল দেখা যাক। দূরদর্শনের পর্দা ও ২৫ তারিখের দৈনিক সংবাদপত্রের রিপোর্টিং সংক্ষেপে তুলে ধরছি। সোমবার (২৪.১২) সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নামতেই প্রবল শব্দে মানুষ ও পশুপাখিকে সচকিত করে দেদার ফাটতে থাকে বাজি। আদালতের নির্দেশ ছিল, শুধুমাত্র সবুজ বাজিই পোড়ানো যাবে রাত আটটা থেকে দশটা। কিন্তু অত্যুৎসাহী বাজিপ্রেমীরা না মেনেছেন শব্দমাত্রা, না মেনেছেন সময়। বাস্তবে রাত দশটার পরই তাণ্ডব বেড়েছে অনেক বেশি। এই তাণ্ডব কলকাতা, হাওড়া ছাড়িয়ে শহরতলী এবং মফস্বলে অঞ্চলেও সমান গতিতে পাল্লা দিয়েছে। বাজিপ্রেমীদের নিশানা থেকে বাদ যায় নি খাতায়-কলমে নিশব্দ এলাকা হাসপাতাল ও শিক্ষাঙ্গন চত্ত্বরও। বলাই বাহুল্য, শব্দের নিরিখে সেই বাজি সবুজ, লাল, না নীল – তা টের পাওয়ার কোন উপায় ছিল না। কারণ, তার শব্দমাত্রা ৯০ ডেসিবেলের অনেক ওপরেই ছিল। পশ্চিমবঙ্গ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের রেকর্ড বলছে –শহরের বিভিন্ন প্রান্তে বেলা দেড়টা নাগাদ শব্দমাত্রা যা ছিল, তা রাত নয়টায় বেড়েছে অনেকখানি। যদিও ঘূর্ণিঝড়ের সৌজন্যে সারাদিনই মেঘলা আকাশ ও ঝিরিঝিরি আবার কোথাও বা ভারী বৃষ্টির কারণে বাতাসে ভাসমান ধূলিকণা সেভাবে দূষণ ছড়াতে পারে নি।

প্রকৃতির কারণে সোমবার কলকাতায় যেটুকু স্বস্তিদায়ক খবর ছিল, তা ভেঙে চুরমার করে দিল মঙ্গলবারের বাজির তাণ্ডব। মঙ্গলবার সন্ধ্যে থেকে গভীর রাত পর্যন্ত সশব্দ আইন ভাঙল কলকাতা ও তামাম শহরতলি। প্রশ্ন উঠছে –সবুজ বাজি, কিউ আর কোড, সচেনতামূলক প্রচার, পুলিশের নজরদারি –এত কিছুর পরও শব্দ জব্দ হল কই? আসলে সরষের মধ্যে ভূত থাকলে, এমনই ঘটবে বারেবারে। সোম-মঙ্গল দুই দিনই বাজির দোসর হয়েছে উচ্চস্বরে মাইক ও ডিজে বক্সের তাণ্ডব। বহু এলাকা থেকে অভিযোগ এসেছে –রাত বাড়তেই বাজির শব্দ কার্যত অসহ্য হয়ে উঠেছিল। পোষ্যরা আতঙ্কে বাড়ির মধ্যে ছোটাছুটি করে দেয়। এসবের ফল যা হল –মঙ্গলবার রাতে বাতাসের দূষণ – সূচক কোথাও দুইশ, কোথাও বা তিনশ পেরিয়ে গেল। আর রাজধানী দিল্লিতেও সমস্ত বাধানিষেধ হেলায় হারিয়ে বাজি পাগলদের তাণ্ডবে সকাল থেকেই দূষণ সূচক ছিল তিনশোর বেশি।

কালীপূজা-দীপাবলিতে গত কয়েক বছর ধরেই বায়ুদূষণের নিরিখে দিল্লির সাথে সমানে টক্কর দিয়েছে কলকাতা।

আর মানুষ ও প্রকৃতির ভালোর স্বার্থে বাজি কারখানাগুলো চিরতরে বন্ধ করে দিলে প্রচুর মানুষের অন্নসংস্থানে টান পড়বে এই যুক্তিও কিন্তু ঢোপে টেকে না। সরকার ও নীতিনির্ধারকরা সত্যিই যদি পরিবেশ বাঁচাতে চান, মানুষের হাতে কাজ ও পেটের ভাত এর  বন্দোবস্ত করতে চান, তাহলে এই সব ঠুনকো সমস্যার সমাধান করা সহজেই সম্ভব। কর্মসংস্থান ও জীবিকা নির্বাহের অনেক ক্ষেত্র আছে, তার জন্য মানুষ ও প্রকৃতি বিধ্বংসী  বাজি কারখানা চালু রাখার যুক্তি নেহাতই বাতুলতা। বিনষ্ট করে দেওয়া প্রকৃতি পরিবেশকে মেরামত করার লক্ষ্যে সঠিক যুক্তিযুক্ত ও বৈজ্ঞানিক পদক্ষেপের সার্বিক কর্মসূচি গ্রহণ করলে বাস্তবে প্রচুর মানুষের কর্মসংস্থান হওয়া সম্ভব। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিকাশকেও কাজে লাগাতে হবে এক্ষেত্রে। এই আলোচনা বিশদে অন্য সময় করার ইচ্ছে থাকল।

 সবুজ বাজি বনাম প্রকৃতি ভাবনা:

বাজি পোড়ানোকে কেন্দ্র করে বায়ুদূষণ ও ভাসমান ধূলিকণা এবং ভারী মৌলের বাড়বাড়ন্ত  মানুষের শরীর ও মনের অপরিসীম ক্ষতি নিয়ে অনেক আলোচনা বিভিন্ন পরিসরে বিভিন্ন মানুষ করে চলেছেন দীর্ঘদিন ধরেই, যদিও দিওয়ালি ও ছট পূজার পর এই আলোচনা অনেকটাই থিতিয়ে পড়ে। পুলিশ-প্রশাসন-কঠোর আইন- ধরপাকড় এর বজ্র আঁটুনি গলে নিষিদ্ধ বাজির কান ঝালাপালা করে দেওয়া আওয়াজে প্রাণ ওষ্ঠাগত হয় সাধারণ মানুষের। দুর্গাপূজা, বিশেষ করে মহালয়ার ভোরে এবং ঠাকুর ভাসানের সময়, দিওয়ালি, ছটপুজা –শুধু এসবই নয়, বিয়ে বাড়ি, এমনকি জন্মদিনের পার্টিতেও আলোর রোশনাই এবং উচ্চ কম্পাঙ্ক ও তীব্র প্রাবল্যের পিলেচমকানো চকোলেট বোম বা ডিজে নামক অসুরের ক্ষতিকর শব্দের তাণ্ডবে মানুষ সহ প্রাণীজগতের স্বাভাবিক জীবন আজ পদে পদে অতিষ্ঠ। আমরা মনে রাখি না যে, বায়ুদূষণের পর দ্বিতীয় সর্বাধিক অসুস্থতা ও মৃত্যুর কারণ শব্দদূষণ।

একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের দিকে এবার তাকানো যাক। বিজ্ঞান ও পরিবেশ আন্দোলনের কর্মী ও বিজ্ঞানীদের লাগাতর প্রচার ও হুঁশিয়ারির ফলে সমাজের একটা অংশের মানুষ অন্তত নিজেদের স্বাস্থ্যের কথা ভেবে আস্তে আস্তে বাজির বিপদ সম্পর্কে সচেতন হচ্ছিলেন, সেই অংশটির মুখের সামনে ‘সবুজ বাজির গাজর ‘ ঝুলিয়ে বিভ্রান্ত করা হল। বাজির উৎপাদন বা তার বাজার বন্ধের কোন প্রয়াস দেখা গেল না। অথচ বলা হল –সবুজ বাজি দূষণমুক্ত ও পরিবেশ বান্ধব। অতএব আর চিন্তার কী? তাই আমরা স্পষ্ট করে বলতে চাই –উচ্চবিত্ত ও সম্পন্ন মধ্যবিত্তের একটা বড় অংশের বাজারকে সুরক্ষিত করে রাখার জন্যই তাদের ভাবনাচিন্তা ও মনন জগতকে অপ্রাকৃত, অস্বাভাবিক করে দেওয়া হয়েছে। এই বাজারমুখী সংস্কৃতি আজ শহর ছাড়িয়ে মফস্বল ও গ্রামেও হানা দিয়েছে অবাধ গতিতে। তাই বাজারের বাইরে বেরিয়ে মানুষের ভাবনাচিন্তা প্রাকৃত না হওয়া পর্যন্ত এসব দূষণ ও পরিবেশ বিপর্যয় থেকে মুক্তি পাওয়াটা বেশ কষ্টসাধ্য কাজ। চামড়ার মধ্যে আবদ্ধ রক্তমাংসের ক্ষুদ্র শরীরকে বৃহৎ করে দেখাতে গিয়ে মানুষ হয়ে পড়েছে প্রকৃতি বিচ্ছিন্ন। প্রকৃতির রূপ রস গন্ধ, চারপাশে ছড়িয়ে থাকা পাহাড় নদী সমুদ্র, সবুজ বৃক্ষ থেকে তাদের যোগাযোগ আজ শত আলোকবর্ষ দূরে। মানুষের মগজে আজ কারফিউ। তাই সে ভাবতে পারেনা –নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করে প্রাণ প্রকৃতি পরিবেশ এবং নিজের শরীরের কী ভয়ানক ক্ষতিসাধন করে চলেছে। রাতে নিশ্চিন্তে নিদ্রা যাওয়া পাখির দল বা কুকুর-বেড়াল সহ প্রাণী জগতের কি ভয়ানক দশা হয় কৃত্রিম আলো ও বাজির তাণ্ডবে, এইসব ভাবনা তো অনেক দূরের। খাও পিও জিও সংস্কৃতিতে নিমজ্জিত ভোগবাদী মানুষ এমনকি তার প্রিয় সন্তান সন্ততি ও নাতিপুতিদের জন্য কোন ভয়ানক দূষিত পরিবেশ উপহার দিয়ে যাচ্ছে সেদিকেও তার বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই। তাই দিকে দিকে আওয়াজ উঠুক –প্রচলিত বাজি তো নয়ই, এমনকি বায়ুদূষণ ও শব্দদূষণের নিরিখে খুব একটা পিছিয়ে না থাকা তথাকথিত সবুজ বাজির উৎপাদন ও ব্যবহার নয়। অন্যের বিপদ ডেকে এনে, পশু পাখি সহ মানুষের জীবনকে ব্যতিব্যস্ত করে, দূষণ বহুগুণ বাড়িয়ে দেওয়ার বিনিময়ে আপনার মুহূর্তের কৃত্রিম আনন্দ উপভোগের ঘনঘটা কোন কাজের কথা নয়। বাঁচতে গেলে চারপাশের পরিবেশটাকে সুস্থ রাখুন, সকলকে ভালো রাখার কথা ভাবুন।

সারা বিশ্বে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বিপর্যয় যেভাবে সমস্ত রেকর্ড ভেঙে চরম থেকে চরমতর আকার ধারণ করেছে, সেখান থেকে বাঁচতে ও পরবর্তী প্রজন্মকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে এখনই জোট বাঁধুন। জল বায়ু মাটি দূষণ সহ সামগ্রিক পরিবেশ দূষণ রুখতে আসুন পথে নামি এখনই। নাহলে আর ভাবার সুযোগটুকুও পাওয়া যাবে না, কারণ মানব সভ্যতা এর মধ্যেই এক ‘অপরিবর্তনীয় জলবায়ু পরিবর্তন’ চক্রের মধ্যে পৌঁছে গেছে। মনে রাখতে হবে বুকভরা শুদ্ধ বাতাস, বিশুদ্ধ পানি, পাহাড় নদী সমুদ্র ও সবুজের অফুরন্ত নৈসর্গিক সৌন্দর্য নিয়ে বাসযোগ্য পৃথিবী রয়েছে একমাত্র একটাই। সাধু সাবধান। প্রকৃতি প্রেমিক সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো আমাদের বলিষ্ঠভাবে উচ্চারণ করতে হবে –”জীবনের সার্থকতা অর্থ উপার্জনে নয়, খ্যাতি প্রতিপত্তিতে নয়, লোকের মুখের সাধুবাদে নয়, ভোগে নয় –সে সার্থকতা শুধু আছে জীবনকে গভীর ভাবে উপলব্ধি করার ভেতরে, বিশ্বের রহস্যকে বুঝতে চেষ্টা করবার আনন্দের মধ্যে, শান্ত সন্ধ্যায় বসে এই অসীম সৌন্দর্য্যকে উপভোগ করায়”।

লেখক পরিচিতি:

বিজ্ঞান শিক্ষক। বিজ্ঞান ও পরিবেশ আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক।

যোগাযোগ: santoshsen66@dbankim1gmail-com

সন্তোষ সেনের অন্যান্য লেখা পড়তে এখানে ক্লিক করুন।

1 thought on “সবুজ বাজি আদতে কতটা পরিবেশ বান্ধব?”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top