প্রীতিলতা বিশ্বাস
যে ৮ই মার্চকে আমরা আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসাবে জানি, ১৯৭৫-র আগে সেই দিনটি চিহ্নিত হত আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী নারী দিবস হিসাবে। উনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধেই সস্তা শ্রমিক হিসাবে নারীরা জুড়ে যেতে বাধ্য হয় বিভিন্ন উৎপাদন শিল্পের সঙ্গে। এর মধ্যে বস্ত্রশিল্প ছিল প্রধান। ১৮৫৭ প্রথম নিউইর্য়কে নারীরা তাদের নিদারুণ শোষণের বিরুদ্ধে সরব হন। বিংশ শতকের প্রথম দশকে চিকাগো, নিউইর্য়কে নারীরা পথে নেমে বিক্ষোভ দেখান। ১৯১১-র মার্চে সারা ইউরোপ জুড়ে প্রায় এক মিলিয়ন নারী শ্রমিক পথে নামেন কাজের উপযুক্ত পরিবেশ ও মজুরী বৃদ্ধির দাবীতে। তার ৬ দিনের মধ্যেই নিউ ইয়র্কের বস্ত্র কারখানায় আগুন লেগে মারা যান বেশ কিছু নারী শ্রমিক। ৮-ই মার্চ ১৯১৭, রাশিয়ার শ্রমজীবী মেয়েরা রাস্তায় নেমে আসেন কর্মক্ষেত্রে বঞ্চনা ও যুদ্ধের জন্য তৈরী হওয়া খাদ্য সঙ্কটের প্রতিবাদে, যা নভেম্বর বিপ্লবের প্রস্তুতির একটি অংশ হিসাবে বিবেচিত হয়। এরপর ১৯২১ সালে কমিউনিস্ট নারীদের সম্মেলনে ৮ই মার্চ দিনটিকে আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী নারী দিবস হিসাবে ঘোষণা করা হয়।
১৯৭৫-এ ‘ইউ এন ও’ শ্রমজীবী শব্দটি বাদ দিয়ে ৮ই মার্চকে শুধু আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসাবে ঘোষণা করে। নারীর লিঙ্গগত বৈষম্য এবং নিপীড়নের মাত্রা তার শ্রেণীগত অবস্থানের নিরিখে ভিন্ন ভিন্ন রূপে দেখা দেয়। তাই শ্রমজীবী নারীদের আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে উঠে আসা দিনটিকে সাধারণ ভাবে নারীদের লিঙ্গগত লড়াই এ নামিয়ে আনা এবং সাম্প্রতিক কালে তাকে ‘হ্যাপি উইমেনস ডে’ তে পরিণত করা আসলে নারী আন্দোলনকেই উদ্দেশ্যহীন করে দেয় সুকৌশলে।
তবে ১৯৭৯ সালে এই দিনটিকে হাতিয়ার করেই ইরানের নারীরা বাধ্যতামূলক হিজাব আইনের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদে সামিল হন। ১৯৭৭-৭৮ এর আর্থিক সঙ্কটের সময় ইরানের পাহেলবি বংশের মহম্মদ রেজা শাহের স্বৈরশাসনের অবসান চেয়ে পথে নামেন সর্বস্তরের মানুষ। নারীদের অংশগ্রহণ ছিল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। যদিও রেজা শাহর আমল ছিল নারীদের জন্য উদারনৈতিক সংস্কারের যুগ। নারীশিক্ষার প্রসার, কর্মশক্তিতে নারীদের অংশগ্রহণ, পরিবার সংক্রান্ত আইনে মহিলাদের রক্ষাকবচ প্রদান, নারীদের ভোটাধিকার প্রদান, বিচারক হিসাবে নিয়োগ —সব মিলিয়ে ইরানে নারীদের বিকাশের যুগ। কিন্তু আমেরিকা, ব্রিটেনের মদতে রেজা শাহর শাসন ছিল ইরানে পাশ্চাত্যের অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক আগ্রাসন। পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম খনিজ তেলের ভান্ডার ইরান থেকে জ্বালানি তেলের সহজ গন্তব্য ছিল আমেরিকা, ব্রিটেন। পরিবর্তে ইরানের বাজার ভর্তি হয়ে যেত ওদের দেশের ভোগ্যপণ্যে। এইসব ভোগ্যপণ্যের জন্য বাজারকে পুরোনো গিল্ড ব্যবস্থার বদলে আমলাতান্ত্রিক তত্বাবধানে আধুনিক ‘মার্চেন্ট অব কমার্সে’ পরিণত করা হয়। খনিজ তেল বিক্রির টাকায় রাস্তা ও অন্যান্য অবকাঠামো তৈরী হতে থাকে। কৃষির শিল্পায়ন হবার ফলে গ্রামের বাড়তি শ্রমিক শহরের নির্মানশিল্পে জুটে যায়। সস্তা শ্রমিক হিসাবে কাজের জগতে অনুপ্রবেশ ঘটে নারীর। আর স্বামী ও স্ত্রীর দুইজনের উপার্জনের মাধ্যমে একটি মধ্যবিত্ত শ্রেণী তৈরী হয় ভোগ্যপণ্যের উপভোক্তা হিসাবে।

সাম্রাজ্যবাদী শক্তির এরকম পরোক্ষ শোষণের জন্য ছিল উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া আধুনিক ব্যবস্থা, যার আড়ালে নির্মমভাবে বিরুদ্ধ মতের কণ্ঠরোধ করার বন্দোবস্ত হিসাবে ছিল গুপ্ত পুলিশ বাহিনী সাবাক। ১৯৭৭-৭৮ -এর আর্থিক সঙ্কটে যে ব্যবস্থা আর ধরে রাখা গেল না। শিয়াপন্থী উলেমারা, বনিকগোষ্ঠী, বামপন্থীরা, বড়জমিদার, নারীরা সকলেই সামিল প্রতিবাদে। গ্রামাঞ্চলে মোল্লারাই ধর্মীয় বিষয়গুলি দেখভাল করত, আর বড় জমিদাররা তাদের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নিত। তাই সাধারন কৃষকের সঙ্গে মোল্লাদের একধরনের শ্রেণীগত বৈরীতা তৈরী হতো। কিন্তু শহরে শ্রমিক হিসাবে কাজ করতে আসা গ্রামের মানুষ বিভিন্ন ধরনের সাহায্য পেত উলেমাদের কাছ থেকে। এই সূত্র ধরেই ক্রমে গ্রামেও শিয়াপন্থী উলেমাদের সমর্থন তৈরী হয়। নারীদের মধ্যে শিক্ষিত উদারপন্থী, ধর্মনিরপেক্ষ থেকে ধর্মীয় সংস্কারে বিশ্বাসী সকলেই বিপ্লবে অংশগ্রহণ করে। রেজা শাহর বিরুদ্ধে প্রতিবাদে হিজাব প্রতীকে পরিণত হয়েছিল কারণ তিনি আইন করে হিজাব নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। তাই উদারপন্থী ধর্মনিরপেক্ষ নারীরাও স্বেচ্ছাই চাদর বা হিজাব পরে নিত। কম বয়সী মেয়েরা হাতে অস্ত্র তুলে নেয় পুলিশ, মিলিটারির মোকাবিলা করার জন্য।
প্রায় বছর খানেকের লড়াই এর পর আয়াতোল্লা খোমেইনির নেতৃত্বে ১৯৭৯-র ফেব্রুয়ারীতে ইরান ইসলামিক রিপাবলিকে পরিণত হয়। রিপাবলিক হবার কারণে ইরানে জনগনের ভোটে নির্বাচিত হন প্রেসিডেন্ট এবং মন্ত্রীসভা বা মজলিসের অন্যান্য সদস্যরা। ১২ সদস্যের একটি গার্ডিয়ান কাউন্সিল আছে যার মধ্যে ৬ জন উলেমা সরাসরি সর্বোচ্চ নেতৃত্ব (ধর্মীয় গুরু) দ্বারা নির্বাচিত হন। বাকি ৬ জন প্রধান বিচারপতির দ্বারা মনোনীত হবার পর মজলিসের সদস্যদের দ্বারা নির্বাচিত হন। প্রধান বিচারপতি নির্বাচিত হন সর্বোচ্চ নেতৃত্ব দ্বারা। সর্বোচ্চ নেতৃত্বই সামরিক বিভাগের প্রধান। খুব সংক্ষেপে এটাই মোটামুটি ইরানের শাসনতন্ত্রের কাঠামো।
বিপ্লব সম্পন্ন হবার পরেই ৭ই মার্চ ১৯৭৯ নারীদের হিজাব পরাকে বাধ্যতামূলক করা হয় ইরানে। পরের দিন আন্তর্জাতিক নারী দিবস। সকালেই ইরানের বিভিন্ন শহরে নারীরা পথে নামেন বাধ্যতামূলক হিজাব আইনের প্রতিবাদে। মিছিলের পরিধি দেখে উলেমারা সাময়িক ভাবে পিছু হটেন। এরপর ক্রমে ক্রমে হিজাবকে চাপিয়ে দেবার প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। প্রথমে সরকারি দফ্তরে চাকুরি রতাদের উপর, তারপরে কোনো বিল্ডিং এ ঢোকার সময় লেখা থাকত—হিজাব ছাড়া প্রবেশ নিষেধ। তারপর ছাত্রীদের জন্য হিজাব পরা বাধ্যতামূলক হয়। শেষপর্যন্ত ১৯৮৩-এ মুসলিম, অমুসলিম সকলের জন্যই হিজাব বাধ্যতামূলক করা হয়। বিচারক পদ থেকে মহিলাদের সরিয়ে দেওয়া হলো। যেসব ধর্মনিরপেক্ষ নারী কর্মক্ষেত্রে হিজাব পরতে চাইলেন না, তাঁদের চাকরি গেল। ২৪০০০ নারী চাকরী হারালেন। এছাড়াও মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৮ থেকে কমিয়ে ১৩ করে দেওয়া হলো। নারীর জীবনের দাম আর্থিক মূল্যে পুরুষের জীবনের অর্ধেক ধার্য করা হলো। রাজনৈতিক বিপ্লবে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করলেও নারীরা চুড়ান্ত রূপে লিঙ্গ বৈষম্যের শিকার হলেন। হিজাব একটি রাজনৈতিক বিষয়ে পরিণত হলো। মুসলিম নারীর ব্যক্তিস্বাতন্ত্রকে অস্বীকার করে তার উপর সামজিক সামগ্রিকতা এবং ধর্মীয় নৈতিকতাকে বহন করার দায়িত্ব চাপিয়ে দেওয়া হলো। এই বিপ্লবে উচ্চবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্ত নারীরা তাঁদের স্বাধিকারের জন্য লড়লেও মধ্যবিত্ত নারীরা শিক্ষা ও জনজীবনে অংশগ্রহণ করতে চেয়েছিলেন শুধু। আর নিম্নবিত্ত নারীরা স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা, পরিচ্ছন্ন পরিবেশ, কিছুটা আর্থিক সুবিধা চেয়েছিলেন মাত্র। নারীদের শ্রেণীগত বৈষম্য তাঁদের লিঙ্গগত পরাজয়ের মধ্যে দিয়ে প্রতিফলিত হল।
২০০৮-এ স্পেনে সর্বপ্রথম ইসলামিক নারীবাদী সংগঠনগুলির আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ইরানের যুক্তিবাদী বুদ্ধিজীবী পুরুষেরা নারীদের এই ধরনের চিন্তার শরিক হন। বলা হয় ইসলাম চিন্তার স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে, তাই নারীরা কী পরবে, কী করবে এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবার স্বাধীনতা তাদের থাকা উচিত।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে আন্তর্জাতিক ফিন্যান্স পুঁজির যে যাত্রা শুরু হয় আমেরিকার আধিপত্যে, ইরানের ইসলামিক বিপ্লব ছিল তার বিরুদ্ধে। স্বার্থহানি হতেই আমেরিকা ইরানের বিরুদ্ধে নানা ধরনের বাণিজ্যিক অবরোধ চাপায় এবং ইরাককে সমরাস্ত্র দিয়ে ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জুড়ে দেয়। ইরানের তখন যুদ্ধ করার জন্য ছিল কেবল মানব সম্পদ। ১৯৮০ সালে ইরানের তরুন-তরুনীরা এমনকি কিশোর-কিশোরীরাও কোরান হাতে করে ঝাঁপিয়ে পড়ল ইরাক-ইরান যুদ্ধে। ইরানের সীমান্তে ইরাক যে মাইন পেতে রাখত ইরানের এই তরুন কিশোরের দল সেখানে গিয়ে নিজেদের জীবন দিয়ে মাইন ফাটিয়ে দিত। তারপর ইরানের সেনা বাহিনী লড়াই করত। শেষপর্যন্ত ইরান যুদ্ধে জয়লাভ করে। আমেরিকা ইরানকে সন্ত্রাসবাদের আতুর ঘর আখ্যা দেয়। ২০১৩ সাল নাগাদ ইরানের পরমানু গবেষণা নিয়ে আমেরিকা তথা পশ্চিমা দুনিয়ার সঙ্গে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। ইরান ডিল নামে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ইরান ও ছ’টি দেশের মধ্যে যা ইরানের পরমানু গবেষণাকে কিছুটা দীর্ঘায়িত করে এবং ইরানের বিরুদ্ধে থাকা আর্থিক অবরোধকে কিছুটা নমনীয় করে। কিন্ত ২০১৮ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প হঠাৎই এই চুক্তি বাতিল করে এবং অর্থনৈতিক অবরোধকে আরও শক্ত করে। এই ধরনের অবরোধ আসলে একটি দেশের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক যুদ্ধ। এর ফলে ইরানের তেল রপ্তানী কমে যায়, চিকিৎসা সংক্রান্ত ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস আমদানী থমকে যায়। বিদেশে থাকা ইরানের সম্পত্তি ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। ফলে ইরানে তেলের দাম সাংঘাতিক রকম বেড়ে যায়। এরপর ছিল প্যানডেমিক। মুদ্রাস্ফীতি প্রায় ৪৫-৫০ শতাংশের মধ্যে ঘোরাফেরা করে। বেকারত্ব ২৮ শতাংশ। ফলে ইরানের মানুষ সর্বোচ্চ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে পথে নামে গনতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার দাবীতে। ২০১৯-২০ তে এই বিক্ষোভে প্রায় ১৫০০ মানুষ সামরিক বাহিনীর হাতে নিহত হয়। ইরানের শাসক এই বিক্ষোভ দমন করে শক্ত হাতে।
আমেরিকার হয়ত প্রত্যাশা ভিন্ন ছিল। ইতিমধ্যে ২০২০ সালে আমেরিকার মদতে ইরাকের সামরিক তৎপরতায় নিহত হন ইরানের সামরিক বিভাগের একজন গুরুত্বপূর্ণ জেনারেল। ইরান এর জবাবে ভুলবশ:ত ইউক্রেনের যাত্রীবাহী বিমান ধ্বংস করে ফেলে। ফলে আমোরিকার অর্থনৈতিক অবরোধ আরও কঠিন হয়। এই রকম একটি রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে ২০২১ এ ইরানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয়। সেই প্রসঙ্গে একটু পরে আসছি। এই সময়ে সামাজিক পরিবর্তনগুলো কেমন ছিল সেটা একটু দেখে নেব।
পরিপ্রশ্নে আরও পড়ুন:
জাতীয় বিজ্ঞান দিবস: আজকের তাৎপর্য
১৯৮৯ এ খোমেইনির মৃত্যু এবং ১৯৯৭-এ ইসলামি রিফর্মিস্ট লবির খতামি প্রেসিডেন্ট হবার পরে সামাজিক জীবনে বেশ কিছু পরিবর্তন আসে। হিজাব সম্পর্কে কিছুটা শিথিল দৃষ্টিভঙ্গি দেখা যায়। নারী শিক্ষাকে কখনোই গুরুত্বহীন করা হয়নি। বরং ইরানে নারী শিক্ষার হার পুরুষের তুলনায় বেশি। স্টেটিস্টার হিসাব অনুসারে ২০২০ সালে শিক্ষিত নারী ছিল ৮৫.৫ শতাংশ এবং পুরুষ ৮০.৮ শতাংশ। বিবাহের বয়স কমিয়ে ১৩ করা হলেও নারী শিক্ষার হার বেড়েছে ইরানে। এর একটা কারণ সম্ভবতঃ ইরাক-ইরান যুদ্ধের পরে জনসংখ্যা দ্বিগুন হয়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে নেওয়া পদক্ষেপ। এই সময় ইরানের ফার্টিলিটি রেট ছিল ৬.৪। আগামী দিনের অর্থনৈতিক সঙ্কটকে আন্দাজ করে এক্ষেত্রে শাসনতন্ত্র উলেমাদের জনসংযোগকে কাজে লাগায়। উলেমাদের পরামর্শে ইরানে জনসংখ্যাবৃদ্ধির হার কমতে শুরু করে। তবে বর্তমানে তা আবার চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ এখন ফারটিলিটি রেট ১.৬ যা একটি জনগোষ্ঠীর টেকসই মাত্রার নিচে।
ইতিমধ্যে ইসলামী দুনিয়ায় বেশ কিছু বিদূষী নারী কোরানের ভিন্ন ব্যাখ্যাকে উপস্থিত করেন। যার মাধ্যমে দেখানো হয় ইসলাম লিঙ্গ প্রসঙ্গে অনেক বেশি সমদর্শী। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য মরোক্কোর ফতিমা মারনিসি এবং পাকিস্তানের রিফাত হাসান। রিফাত হাসান বলেন আরবি শব্দ ‘বসার’ এবং ‘ইনসান’ শব্দের ব্যুৎপত্তি গত অর্থ: মানুষ কখনোই শুধু পুরুষ নয়। তাই কোরানে যা মানুষের উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে সবই নারী এবং পুরুষ উভয়ের জন্যই প্রযোজ্য। ২০০৮-এ স্পেনে সর্বপ্রথম ইসলামিক নারীবাদী সংগঠনগুলির আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ইরানের যুক্তিবাদী বুদ্ধিজীবী পুরুষেরা নারীদের এই ধরনের চিন্তার শরিক হন। বলা হয় ইসলাম চিন্তার স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে, তাই নারীরা কী পরবে, কী করবে এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবার স্বাধীনতা তাদের থাকা উচিত। ইরানে মহিলা আইনজীবী শিরিন এবাদি যাকে ইসলামিক বিপ্লবের পর বিচারকের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়, ইসলামিক আইনের সাহায্যেই উলেমাদের বিচারে স্ববিরোধিতাকে দেখিয়ে দিতে শুরু করেন। ইসলাম নারীকে বিবাহের ক্ষেত্রে একটি রক্ষাকবচ দেয় ‘মেহেরিয়া’ নামক চুক্তিপত্রের মাধ্যমে। এটা আপসে নির্ধারিত একটি চুক্তি যা সোনার কয়েনের সংখ্যা দিয়ে হিসাব করা হয়—এই সম্পদ বিবাহিত জীবনে যেকোনো সময় স্ত্রী পেতে পারেন, আর বিবাহ বিচ্ছেদের সময় এই অর্থ অনাদায়ে পুরুষটির জেল পর্যন্ত হতে পারে। বিবাহ বিচ্ছেদ সংক্রান্ত মামলাগুলিও তাই নারীর অধিকার আদায়ের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে ইরানে। ধর্মীয় পিতৃতান্ত্রিক ইরানে নারীরা প্রতিদিন তাদের অধিকার আন্দোলনে একটু একটু করে অগ্রসর হতে থাকে শিক্ষাকে হাতিয়ার করে। কর্ম জগতের প্রায় সর্বত্র তারা পা রাখে। শিক্ষা-স্বাস্থ্য, কৃষি, কল-কারখানা, অফিস-কাছারি এমনকি বিনোদনের জগতে পর্যন্ত নারী তার জায়গা করে নেয়। কর্ম জগতে লিঙ্গ পৃথকিকরনকে মানা হয় শুধুমাত্র মেয়েদের স্কুল-কলেজ, চিকিৎসায় মহিলা বিভাগ ইত্যাদির সাহায্যে। যেখানে নারীকে পুরুষের সঙ্গেই কাজ করতে হয় সেখানে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে নারীর বিশেষ কোনো ভূমিকা থাকে না। এই রকম সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতে থাকাকালীন ইরানের উপর আর্থিক ও সামরিক চাপ বাড়তে থাকে আমেরিকার আগ্রাসী বৈদেশিক নীতির কারণে।
আমেরিকার বিরাগভাজন হবার পর থেকে গত ২৫ বছর চীনই ইরানের সবথেকে বড় বাণিজ্যিক সহযোগী। চীন ইরানের জ্বালানি তেলের সব থেকে বড় ক্রেতা। কিন্তু চীন তেল মুদ্রায় কেনে না, চীনের তৈরি পণ্যের বিনিময়ে তারা ইরান থেকে তেল কেনে। ফলে ইরানের বাজার সস্তার চীনা জিনিসে ভর্তি হয়ে যায়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় ইরানের নিজস্ব উৎপাদন শিল্পের বিকাশ। ইরান খনিজ তেলের দ্বিতীর বৃহত্তম ভান্ডার, সেই সঙ্গেই বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ ধাতু উল্লেখযোগ্য মাত্রায় সঞ্চিত আছে ইরানের ভূ-গর্ভে। ইরানের খনিজ সম্পদের সবটুকুই রাষ্ট্রায়ত্ব। তবুও বেকারত্বের হার ১১.৪ শতাংশ। সম্পদের নিরিখে ইরানের মানুষের মধ্যে বিভাজন ও বৈষম্য আজ ক্রমবর্ধমান। এছাড়াও প্রশাসনের অন্দরে দুর্নীতি মানুষকে হতাশ করে। যে হতাশার ছাপ পড়ে ব্যালট পেপারে। ২০২১-এর নির্বাচনে মাত্র ৪৮.৮ শতাংশ ভোটার ভোট দিতে আসেন যার মধ্যে ১২.৯ শতাংশ মানুষ ব্যালট পেপার খালি রেখে জমা দেন। কট্টরপন্থী এব্রাহিম রাইসি মোট প্রদত্ত ভোটের ৬২ শতাংশ পেয়ে প্রেসিডেন্ট পদে আসীন হয়েই ইসলামিক অনুশাসনের উপর জোর দেন। ২০২২ সাল থেকে প্রতি বছর ১২ই জুলাই তারিখটি হিজাব ও সতীত্বের দিন হিসাবে পালিত হবে বলে ঘোষণা করেন। ২০২২ সালে ঐ দিনটি প্রথম পালন করা হয় এবং রাস্তায় প্রচুর নীতি পুলিশ নামিয়ে হিজাব না-পরা মহিলাদের হেনস্তা করা হয়। একজন তরুণী লেখিকা এবং অভিনেত্রীকে ধরে কোথায় নিয়ে যাওয়া হয় কেউ জানতে পারে না। স্যোশাল মিডিয়ায় এই খবর ভাইরাল হওয়ার পর ৩০শে জুলাই সরকারী টিভি চ্যানেলে তাকে এনে তাকে দিয়ে ভুল স্বীকার করানো হয়। ঐ শিল্পীকে দেখে মানসিকভাবে সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত মনে হয় তার পরিজনদের। এরপর ১৬ই সেপ্টেম্বর ঘটে মাসা আমিনির ঘটনা যা স্ফুলিঙ্গের কাজ করে, জ্বলে ওঠে ইরানের নারী সমাজ। যে আন্দোলনের নানান চিত্র আমরা সংবাদ মাধ্যমে দেখেছি। ৪ ডিসেম্বর সরকার নীতি পুলিশ তুলে নেবার আগে পর্যন্ত হাজারের বেশি মানুষ গ্রেফতার হয়েছেন, সাড়ে চারশ মানুষ নিহত হয়েছেন যাদের অধিকাংশই নারী।
এখন প্রশ্ন হল রাইসি ৬২ শতাংশ ভোট পেয়েছেন মানে ইসলামি কট্টরপন্থাকেই আমেরিকার আগ্রাসন থেকে বাঁচার উপায় বলে মনে করেন বহু ইরানি। আর প্রশাসন ইসলামি সংস্কৃতি রক্ষার একমাত্র হতিয়ার করেছে নারীর হিজাবকেই। মজা হলো কোরানে হিজাব পরার কথা লেখা থাকলেও না-পরলে শাস্তির বিধান বলা নেই। সমাজে ক্রমবর্ধমান সম্পদের পার্থক্য ইসলামের নৈতিকতার বিরুদ্ধে যায় না, অথচ হিজাব না পরলেই নৈতিকতার স্খলন হয়। এ বিধান ইসলামের থেকেও অনেক বেশি পিতৃতন্ত্রের। কিংবা যেভাবে ১৯৮০ দশকে হিজাব পরতে না চাওয়া মহিলাদের কাজ থেকে বরখাস্ত করে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল সেই একই কায়দায় কিছু মহিলাকে কাজ থেকে সরিয়ে দিলে বেকারত্বের পরিসংখ্যান একটু হলেও কমবে। আর বিপদজনক ফার্টিলিটি রেট একটু হলেও বাড়তে পারে। বিবিসি কয়েকদিন আগে ইরানে মেয়েদের স্কুলে বিষাক্ত গ্যাস প্রয়োগের খবর প্রকাশ করে। অভিভাবকরা ইতিমধ্যেই স্কুল বন্ধ করে দেবার ষড়যন্ত্র বলে অভিযোগ করেছে। ইরান কি তাহলে বর্তমান রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সঙ্কট থেকে বাঁচার সহজ উপায় হিসাবে নারী বিকাশের পথ আটকে দিতে চাইছে? ভবিষ্যত দেবে এর উত্তর।
ইসলামিক ইরানে হিজাব আইন নারী স্বাধীনতায় রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ। আবার পৃথিবীর অন্যত্র ইসলাম বিরোধিতার লক্ষ্যবস্তু হিসাবে হিজাব নিষিদ্ধ করা হয় সমতাকে সামনে রেখে। যার উদাহরণ ফ্রান্স এবং ভারতের কর্নাটকে স্কুলের ড্রেসকোড। এই ক্ষেত্রেও রাষ্ট্র কর্তৃক শূলে চড়ানো হয় পোশাক নির্বাচনে নারীর স্বাধীনতাকে। এখনও বিভিন্ন দেশে গর্ভপাত নিষিদ্ধ, যা নারীর দেহের উপর রাষ্ট্রের সরাসরি কর্তৃত্বকে চিহ্নিত করে। স্বাধীনতাহীনতার এই নিপীড়নের পাশাপাশিই নারী শোষিত হয় পুঁজির বিকাশের হাতিয়ার হয়ে। পুঁজির শোষণের মেকানিজমই হলো ‘ স্বাধীনতা ‘ এবং ‘ ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ‘। শ্রমিকশ্রেণী আজ স্বনিযুক্ত গিগ কর্মচারী হিসাবে তার অনিশ্চিত জীবনে কাজের স্বাধীনতা খোঁজে। একইভাবে পুঁজির বিকাশের চোরাবালিতে নারী পণ্যে পরিণত হয়ে নিরাবরন হবার স্বাধীনতা ভোগ করে। নারীমুক্তির লড়াই তাই পুঁজি, রাষ্ট্র এবং পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে, যা প্রকৃতপক্ষে মানবমুক্তির দিশারী।
কীভাবে আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী নারী দিবস থেকে আজকের হ্যাপি উইমেন্স ডে এই বিবর্তনের ইতিহাসটা পড়ে সমৃদ্ধ হলাম আর ইরানে নারী দের শ্রেনী বৈষম্যের নিরিখে চাহিদার পার্থক্য তাদের আন্দোলনকে ব্যর্থতায় পর্যবসিত করেছিল এটাও একটা শিক্ষনীয় বিষয়।
লেখিকাকে অসংখ্য ধন্যবাদ ।
প্রথমে ধন্যবাদ জানাই আপনার সচেতন পাঠের জন্য। আমার মনে হয় নারীমুক্তির প্রশ্নে শ্রেণী এবং লিঙ্গ দুটি বিষয় খুব সচেতন প্রয়াস ছাড়া একই লক্ষ্যে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। যেমন ধরুন নারীর ভোটাধিকার অর্জন যদি লিঙ্গ গত জয় হয় তাহলে উচ্চবিত্ত নারীরা উচ্চবর্গের শাসন ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখতে চাইবেন বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। ব্যতিক্রমীদের এক্ষেত্রে বাদ রাখলাম। আবার অনেক সমাজে জাতি একটি পরিচয়। জাতিগত শোষণ নারীর ক্ষেত্রে একটি ভিন্ন মাত্রা নিয়ে প্রকাশিত হয়। সচেতন প্রয়াস ছাড়া এই প্রতিবন্ধকতা গুলো কাটিয়ে ওঠা সম্ভব নয়। আরও আলোচনা চলতে পারে। আমার সীমাবদ্ধ জ্ঞান থেকে এইটুকু আপাতত মনে হল। ভালো থাকবেন।