সন্তোষ সেন
হিকিকোমোরি হলো একটি জাপানি শব্দ। ইংরেজি পরিভাষায় যাকে বলা হয়: সোশ্যাল উইথড্রয়াল। আর বাংলায় তর্জমা করলে দাঁড়ায়: সমাজ থেকে নিজেকে সম্পূর্ণ গুটিয়ে নিয়ে কর্মহীন অবস্থায় একাকীত্বকে সঙ্গী করে গৃহবন্দী হয়ে নির্জনবাস। বর্তমানে এই গভীর ও ভয়াবহ সামাজিক অসুখে আক্রান্ত জাপানের কম করে ১৫ লক্ষ কর্মক্ষম মানুষ। জাপানে এই সামাজিক ব্যাধির প্রকোপ সাম্প্রতিক হলেও এই শব্দবন্ধটি প্রথম চয়ন করেন জাপানি মনস্তত্ত্ববিদ তামাকি সাইতো, তাঁর ‘সোশ্যাল উইথড্রয়াল –অ্যাডোলেসেন্স উইদাউট এন্ড’ (১৯৯৮) নামক এক বিখ্যাত বইয়ে। তাঁর কথা অনুসারে, অন্তত ছয় মাস ধরে কোনো মানুষ যদি সমাজের প্রতি অনাগ্রহ ও বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েন, কারোর সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে না চান এবং অবসাদ ও হতাশায় ভুগে নিজেকে সমাজ থেকে সম্পূর্ণভাবে গুটিয়ে নিয়ে কাজে অক্ষম ও গৃহবন্দী হয়ে পড়েন – তখন তাকে বলে হিকিকোমোরি।
জাপানে এই ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হলো কেন?
আমরা আগেই বলেছি অন্তত ১৫ লক্ষ মানুষ এই সামাজিক ব্যাধিতে আক্রান্ত। অর্থাৎ, এই বিশাল সংখ্যক মানুষ তীব্র উৎকণ্ঠা, অবসাদ ও হতাশার শিকার হয়ে সোশ্যাল ফোবিয়া বা সামাজিক ভয়কে সঙ্গী করে এই উপসর্গে ভুগছেন। এঁদের প্রায় সকলেই ঘরবন্দী হয়ে বসে আছেন, যাকে বলা হয় ‘শাট-ইন’। ১০ থেকে ৬৯ বছর বয়সের এমন নির্জনবাসিদের মধ্যে নিবিড় সমীক্ষা চালিয়ে ছিলেন জাপান সরকার। যার নির্যাস বেশ ভয়াবহ। তথ্য বলছে – আক্রান্ত পাঁচ ভাগের একভাগ, অর্থাৎ তিন লক্ষ মানুষের সমাজের প্রতি, মানুষের প্রতি চরম বীতস্পৃহার কারণ হলো: কোভিদ অতিমারির জেরে মানুষের সঙ্গে মেলামেশা, কথাবার্তা ও বন্ধুত্ব বজায় রাখতে না পারা, ভাবের আদান-প্রদান করতে না পারা, অর্থাৎ এককথায় মানুষের সঙ্গে মুখোমুখি যোগাযোগ হারিয়ে ফেলা। আক্রান্তদের মধ্যে প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ জানিয়েছেন – কাজ বজায় রাখতে না পারা বা কাজ চলে যাওয়াটাই তাঁদের এই মানসিক দুরবস্থার প্রধান কারণ। কুড়ি শতাংশ আবার জানিয়েছেন –”অতিমারির সময় আক্রান্ত মানুষের অসহায় অবস্থা, ঠিকঠাক চিকিৎসা না পাওয়া, অক্সিজেনের অভাবে ছটফট করা, অসংখ্য মানুষের মৃত্যুর মিছিলকে আমরা সহজে মানিয়ে নিতে পারিনি বলেই আমাদেরও আজ একাকীত্ব রোগে গ্রাস করেছে।” জাপানের ক্ষেত্রে আরও একটি বিষয় এই সমস্যাকে তীব্রতর করে তুলেছে বলেই আমাদের মনে হয়। তাহলো যন্ত্র ও প্রযুক্তির ওপর মানুষের নির্ভরতা অনেক বেড়ে গেছে বিশ্ব-যুদ্ধোত্তর পর্বে। গত শতকের নয়ের দশকে উদার আর্থিক নীতির কল্যাণে যা আরও বেগবান হয়েছে। তথ্য বলছে: ২০২২-২৭ এই পর্বে জাপানে অনলাইন বাণিজ্যের জগৎ (e-commerce market) বার্ষিক ১৪.৩ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাবে। ই-কমার্স সেক্টরে বিগত পাঁচ বছরের বৃদ্ধি পর্যালোচনা করেই এই প্রেডিকশন করা হয়েছে। অনলাইন বাণিজ্যের বাড়বাড়ন্ত সম্ভব হয়েছে উন্নত কম্পিউটার, মোবাইল পরিষেবার উপর নির্ভর করে মানুষের মধ্যে প্রযুক্তি নির্ভর কেনাকাটা এবং আর্থিক লেনদেনের আকাঙ্খা দ্রুত হারে বেড়ে যাওয়ার কারণেই। স্বাভাবিক ভাবেই সমাজ, বন্ধু-স্বজন, সমষ্টি থেকে বিচ্ছিন্ন মানুষ আরও একা হয়েছে, আত্মকেন্দ্রিক ব্যক্তি মানুষে পরিণত হয়েছে। সমাজ, অপর মানুষ, প্রকৃতি পরিবেশ সব কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন মানুষ নির্জন দ্বীপের ছোটো কুঠুরিতে আবদ্ধ হবে, এটাই তো স্বাভাবিক। এইসব কিছুর সুযোগ নিয়েই হিকিকোমোরির মতো ভয়ানক ব্যাধি জাঁকিয়ে বসেছে সমাজ জীবনে।
জাপানের রাজধানী টোকিও শহরের অন্যতম ব্যস্ত ওয়ার্ড এডোগাওয়া-তে প্রায় দশ হাজার মানুষের বাস, যাদের অনেকেই ভয়াবহ সামাজিক ব্যাধি হিকিকোমোরির শিকার। সমীক্ষা থেকে উঠে এসেছে আর এক ভয়ানক চিত্র। লকডাউনের কঠিন কঠোর অনুশাসনের ঘেরাটোপের পর আন-লক পর্বে স্কুল-কলেজে পঠন-পাঠন স্বাভাবিকভাবে চালু হলেও বেশ কিছু ছাত্র ছাত্রী ২০২১ সাল থেকে আর পড়াশোনার জগতে ফিরে আসেনি। আর একটি গুরুত্বপূর্ণ কাহিনীর দিকে এবার একটু দৃষ্টিপাত করা যাক। অতিমারি এবং লকডাউন চলাকালীন জাপান সরকার আশঙ্কা করেছিলেন যে, এরকম এক প্রতিকূল পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। এই পরিস্থিতি সামলানোর জন্যই ২০২১ সালের শেষ দিকে জাপান সরকারের মন্ত্রিসভায় এক নতুন পদ তৈরি করা হয় – “একাকিত্বের মন্ত্রী”। মন্ত্রীর পদটি অভিনব হলেও এই নতুন দপ্তরের কর্তাব্যক্তিদের আশঙ্কা –সমাজ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া, সম্পূর্ণ একাকী হয়ে যাওয়া এই নিঃসঙ্গ, বন্ধুহীন মানুষগুলি তীব্র অবসাদ ও হতাশার থেকে মুক্তি পেতে যেকোন সময় নিজেকে শেষ করে দিতে পারেন।

কী বার্তা বয়ে নিয়ে এল নতুন এই উপসর্গ
অর্থ-পুঁজির নতুন জামানায় ব্যাংক ও রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ মদত ও সহযোগিতায় ফুলেফেঁপে ওঠা কাল্পনিক পুঁজি (ফিকটিশাস ক্যাপিটাল) কে বাস্তবের জমিতে নব নব ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করে রিয়েল করার মরিয়া প্রচেষ্টায় প্রকৃতি পরিবেশের বিনষ্টি চলছে সীমাহীনভাবে। বৃহৎ অরণ্য, সবুজ বনানীকে সাফ করে দেওয়ায় বন্যপ্রাণ তাদের প্রাকৃতিক আবাসস্থল (natural habitats) ছেড়ে বেরিয়ে মানব সমাজের সংস্পর্শে আসছে অনেক বেশি করে। যার ফলে এইসব বন্যপ্রাণের (বাদুড়,প্যাঙ্গোলিন বা অন্য কিছু ) শরীরে বাসা বেঁধে থাকা ভাইরাসের দলও মানবজমিনে নতুন করে আশ্রয় গাড়ছে। শুধুমাত্র প্রবল বায়ুদূষণের কারণেই প্রতি বছর মারা পড়ছেন লক্ষ লক্ষ মানুষ। বিশ্ব উষ্ণায়ন এবং জলবায়ু পরিবর্তন এক ভয়ানক সংকেত বয়ে নিয়ে এসেছে মানব সভ্যতার কাছে। আজ মানব সভ্যতার অস্তিত্বই প্রশ্নচিহ্নের মুখে দাঁড়িয়ে গেছে। এর হাত ধরে কোভিড অতিমারির সময় প্রয়োজনীয় ‘শারীরিক দূরত্বের’ বিধিনিষেধ সরকার, প্রশাসন ও কর্পোরেটের চক্রান্তে পাল্টে গেল ‘সামাজিক দূরত্বের’ কুটিল আবর্তে। পণ্য-সর্বস্ব ভোগবাদী আত্মকেন্দ্রিক মানুষ দ্বারা ব্যাপৃত সমাজে আগের থেকেই টিকে থাকা ফাটল (রিফ্ট) আরও চওড়া হলো সামাজিক দূরত্ব ও গৃহবন্দিত্বের বাজারি অনুশাসনে। এর ফলে যা হবার, তাই হলো।
প্রাকৃতিক ও প্রজাতিসত্তার কারণে মানুষ আদতে ছিল সমাজবদ্ধ জীব –যূথবদ্ধ গোষ্ঠি মানুষ। এই কৌম্য সমাজকে ভেঙে টুকরো করে দেওয়া হলো পুঁজির বাজারকে আরও প্রসারিত করার স্বার্থেই। চিড় ধরে থাকা ফাটল গভীর গর্তে পরিণত হলো কোভিড অতিমারির অজুহাতে জারি করা বাধ্যতামূলক লকডাউন পরিস্থিতিকে সঙ্গী করে। কর্পোরেটের সেবাদাস সরকার, আর সরকার চালিত প্রশাসন তো চাইবেই – মানুষ তার সমস্ত সামাজিকতা, আত্মীয়তা, অপরের সঙ্গে যোগাযোগ-বন্ধুত্ব- সহমর্মিতা-সহযোগিতা ছিন্নভিন্ন করে আত্মকেন্দ্রিক ব্যক্তি মানুষে পরিণত হোক। একদিকে মানুষে মানুষে নানান ধরনের বিভেদ- বিভাজন জারি রাখা এবং অন্যদিকে মানুষকে অপর থেকে, সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে গৃহবন্দী ব্যক্তি মানুষে পরিণত করতে পারলে কর্পোরেটের স্বার্থে একের পর এক কালাকানুনকে সমাজে প্রোথিত করা যায় সহজেই। তাই এই ভয়াবহ নিঃসঙ্গতার চিত্র জাপান ছাড়িয়ে আজ দেশে দেশে পরিব্যাপ্ত হয়ে পড়েছে। তাকে হিকিকোমোরি, নিঃসঙ্গতা, নির্জন নিভৃত একাকী যাপন – সে যে নামেই ডাকা হোক না কেন।
আমাদের দেশে দুই আড়াই বছরের দমবন্ধ করা পরিস্থিতিতে কত ছাত্র ছাত্রী স্কুল-কলেজ ছুট হয়ে পড়াশোনার জগৎ থেকে বিদায় নিল চিরতরে তার ইয়ত্তা নেই। কত মানুষ আগের কাজ হারিয়ে অ্যাপ নির্ভর মার্কেটিং ও সার্ভিসিং সেক্টরে অতি অল্প মজুরিতে ১২-১৪ ঘণ্টার পরিশ্রমের গিগ ওয়ার্কার হিসেবে নাম লেখালেন, তারও কোন হিসেব-নিকেশ নেই। সমাজ-বিচ্ছিন্ন কত শত মানুষ চরম অবসাদ ও হতাশার গভীর অন্ধকারে তলিয়ে গেলেন, তার হিসেবেই বা কে রাখে। যদিও এখনও কিছুটা মাত্রায় টিকে থাকা ভারতের ‘পরোপকারী সংস্কৃতি’, অর্থাৎ অপরের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়ার কিছু মানুষজন স্বল্প সংখ্যায় হলেও আছেন বলেই হয়তো হিকিকোমোরির মতোনিঃসঙ্গতা রোগ আমাদের সমাজকে এখনও সেভাবে গ্রাস করতে পারেনি। যদিও ভারতীয় উপমহাদেশের ক্রমবর্ধমান আর্থিক বৈষম্য এবং রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার লক্ষ্যে ধর্ম বর্ণ জাতপাতের নামে মানুষের মধ্যে বিভেদ-বিভাজনের উপর ভর করে আমরাও সেই ক্রান্তিকালের দিকেই নিশ্চিতরূপে এগিয়ে চলেছি। কর্মক্ষেত্রে অন্যদের সাথে আড্ডা ইয়ার্কি, টিফিন ভাগ করে খাওয়া, বন্ধুত্ব, সহকর্মীর বিপদে পাশে দাঁড়ানো: এইসব ঐতিহ্য- সংস্কৃতিও জাদুঘরে স্থান পেতে চলেছে ‘Work from home’ নামক নয়া আর্থিক বন্দোবস্তের সুদূরপ্রসারী চক্রান্তে। সব সমাজের মূল মন্ত্র হয়ে উঠেছে – “মানুষকে ভাঙো, টুকরো করো, সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে একা ব্যক্তি মানুষে পরিণত করো।” ফলে সব দেশেই আত্মীয়-বন্ধু-স্বজন বিচ্ছিন্ন নিঃসঙ্গ, অবসাদগ্রস্ত, হতাশ একাকী মানুষের সংখ্যা উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে। বাড়িতে বসে কাজ, দোকান বাজার, ব্যাংকে না গিয়ে স্মার্টফোনে আঙ্গুলের স্পর্শে অর্ডার করা নানান কিসিমের খাদ্য ও পন্য সম্ভার বাড়িতে বসেই পেয়ে যাওয়া এবং অর্থ লেনদেন করা সম্ভব হওয়ার কারণে উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তের একাংশের মধ্যে এই ধরনের সমস্যা আরও তীব্র হচ্ছে বলেই আমাদের মনে হয়।

মানুষের শ্রম – প্রকৃতির পরিবর্তন ও ভালোলাগার মধ্যে সম্পর্ক
কর্মক্ষম মানুষ তো তাঁর সব ভালোলাগা ভালোবাসাকে সঙ্গী করে কায়িক ও মানসিক শ্রমের জগতে যুক্ত থাকতেই চাইবেন। তাহলে শ্রমের সঙ্গে তাঁর বিচ্ছেদ ঘটছে কেন, কেন সে সমাজ সংসার বিমুখ হয়ে একাকীত্বে ভুগছে? আসলে বর্তমান পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থায় শ্রমের জগতে সে আর নিজের সেল্ফকে রিয়েলাইজ করতে পারছে না। শ্রমের জগতে এই সেল্ফকে realise করা মানে কি? প্রকৃতিকে পরিবর্তন করে ও শ্রম ব্যবহার করে উৎপাদন প্রক্রিয়ায়, প্রকৃতিকে পরিবর্তন করার থেকেও মানুষ নিজেকে পরিবর্তন করে অনেক বেশি। আর এই পরিবর্তন তার মধ্যে আরও higher desire বা উচ্চাকাঙ্ক্ষা তৈরী করে। তার ফলে সে প্রকৃতিকে আরও গভীরে জানা-বোঝা, তথা রিয়েলাইজ করার প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়।
অর্থাৎ, আমাদের চারপাশে যে নৈসর্গিক প্রকৃতি তার সব রূপ রস গন্ধ, তার সবকিছু নিয়ে হাজির, সেই প্রকৃতিই হলো আমাদের পরিবর্ধিত বৃহৎ শরীর (extended body)। পৃথিবীতে মানব সভ্যতা টিকে থাকার মূল চাবিকাঠি হলো এই প্রকৃতি পরিবেশ। এই প্রকৃতিকে গভীরে জানা বোঝার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এবং প্রকৃতিকে সুস্থভাবে টিকিয়ে রাখার প্রশ্নটি মানুষের দৈনন্দিন কাজ ও শ্রমের সাথে যত বেশি করে সম্পৃক্ত হয়, ঠিক সেই মাত্রাতেই মানুষও তার নিজের মনের গহীনে লুকিয়ে থাকা গভীর স্পন্দনগুলিকে জাগিয়ে তুলতে পারে, যা বয়ে নিয়ে আসে অনাবিল আনন্দ ও ভালোলাগা ভালোবাসার অনুভূতি। এই কারনেই সুন্দর সুর, ছবি, কবিতা ও শিল্প সাহিত্যের জন্ম হয়। যার হাত ধরে মানুষের মনন বিকশিত হতে থাকে। জন্ম হয় বিজ্ঞানের অমূল্য সব তত্ত্ব।
কিন্তুু যারা শ্রম করে না, অর্থাৎ যারা প্রকৃতির পরিবর্তন ও উৎপাদন প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত নয়, পুঁজির নিজস্ব নিয়মে তারাই হয়ে ওঠে উৎপাদিত সম্পদের ভাগিদার তথা মালিক। তাদের এই চুরি করা সম্পদকে উত্তরোত্তর বাড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার বাসনা চরিতার্থ করতেই মানুষকে শ্রম করতে হয়। ফলে শ্রম হয়ে যায় বাধ্যতামূলক। ভালোলাগা ভালোবাসা রহিত শ্রম করতে করতে সে ক্লান্ত অবসন্ন হয়ে পড়ে। নিজের সেল্ফ ও ডিজায়ার থেকে বিছিন্ন হয়ে এই মানুষ আর বেঁচে থাকার কোনো অর্থ খুঁজে পায়না। একাকিত্ব ও নির্জনবাসই তার সর্বক্ষণের সঙ্গী হয়ে ওঠে। শ্রমের জগৎ থেকে বিচ্ছিন্নতা, অবসাদ, ক্লান্তি, হতাশা – এসবই চলছে বিশ্বজুড়ে নানান রূপে, নানান নামে।
উপসংহারের পরিবর্তে
দমবন্ধ করা একাকীত্বের জীবন থেকে মুক্তি পেতে হলে সমাজবদ্ধ জীব হিসেবে আমাদের সামাজিক ভূমিকাকে সামনে আনতে হবে। যার বেশ কিছু নজির আমরা দেখেছি পাড়ায় মহল্লায় অতিমারির সময়ে। রক্ত মাংসে গড়া নিজের শরীরের ক্ষুদ্র পরিসর থেকে বেরিয়ে একদিকে যেমন ব্যাথিত, পীড়িত মানুষের কাছে সহযোগিতা-সহমর্মিতা-বন্ধুত্বের হাতটা বাড়িয়ে দিতে হবে আরো লম্বা করে। অন্যদিকে পাহাড়- পর্বত, নদী-নালা, বিল-জলাভূমি, গাছপালা, সবুজ অরণ্য, এমনকি পোকামাকড় সহ ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অণুজীব: যেসব নিয়েই আমাদের বেঁচে থাকা, সেই বৃহৎ জগৎটাকে চিনতে হবে। তার রূপ রস সৌন্দর্য উপভোগ করে স্ব-শরীরের ক্ষুদ্র গণ্ডিকে টপকাতে হবে। আমাদের এই সুবৃহৎ শরীর তথা ‘এক্সটেন্ডেড বডি’কে সুস্থভাবে টিকিয়ে রাখার সমস্ত পদক্ষেপ, উদ্যোগের সাথে নিজেদের বেশি করে জড়িয়ে নিতে হবে।
“আপন হতে বাইরে দাঁড়া” – কবির এই ভাষ্যকে আত্মস্থ করে ব্যক্তি মানুষের অতি ছোট পরিসর থেকে বেরিয়ে বিপুলা বিশাল প্রকৃতির কোলে আত্মসমর্পণ করতে পারলেই যূথবদ্ধতার, সহমর্মিতার, সহযোগিতার, বন্ধুত্বের, কৌম্য জীবনের আস্বাদন পাওয়া যাবে। প্রকৃতি এবং প্রকৃতির সন্তান, অথচ প্রকৃতি-বিচ্ছিন্ন মানব প্রজাতিকে সুস্থ সবল সতেজ করে গড়ে তোলার কাজটা শুরু হোক না এভাবেই।
তথ্যসূত্রঃ
Biggest Marketing Trends in Japan (digitalmarketingforasia.com)
লেখক পরিচিতি:
বিজ্ঞান শিক্ষক, বিজ্ঞান ও পরিবেশ আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক।
যোগাযোগ:
বিষয়টা অর্থাৎ সমাজ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া —-এই সমস্যাটা মনে হয় একেবারে নতুন নয়।হিকিকোমোরি বা সোসাল উইথড্রয়াল শুধু তীব্রতর হয়েছে।ইং ভাষায় alienation কথাটা কয়েক দশক আগেই শুনেছি।যূথবদ্ধতার পক্ষে সওয়ালও শোনা গেছে।দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়কালের কথা উল্লিখিত হয়েছে লেখাটায়।সঠিক ভাবেই হয়েছে।ঐ সময় মানুষের অবলম্বন বা ভরসার জায়গাটা নড়ে যায়।ঈশ্বরে আস্থা আর আগের মতো থাকে না। জন্ম নেয়absurd রচনা(মূলত নাটক)(এরকমই তো পড়েছি)।
পড়াশুনার চাপে বা অন্য কারণে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে আত্মহত্যার ব্যাধির খবর আগেও দেখেছি।….তবে অবশ্যই covid পরে অনেকগুণ বেড়ে গেছে যে সমস্যাটা সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।উল্লিখিত গবেষক লেখক(দ্বয়?)সেইটাই বিশ্লেষণ সমাধানের চেষ্টা করেছেন বল মনে হয়।
এতক্ষণ কী বললাম? আসলে কিছুই নতুন বললাম না।
সন্তোষ সেন কে অভিনন্দন ,এই আধুনিক বিষয় নিয়ে ভাবা ও লেখার জন্য।তাঁর এই আলোড়নে আলোড়িত হয়ে উঠুক সকলে। সমর্থন অবশ্যই করছি এমন সৎ প্রয়াসকে।কে বলতে পারে ছোট্ট স্ফূলিঙ্গেই বৃহৎ কোনো অগ্ন্যুৎপাত ঘটাবে না !!!
প্রথমেই আপনার মতো একনিষ্ঠ পাঠককে আমাদের তরফে একরাশ অভিনন্দন। আপনার মূল্যবান মতামতের জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ। আপনার পাঠ প্রতিক্রিয়ার সাথে লেখক সম্পূর্ণ সহমত। আমাদের সাথে থাকুন। এই দুঃসহ সময়ে গভীর অন্ধকারে পথ চিরে এইভাবেই
সকলে মিলে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি।