বঙ্কিম দত্ত
প্রজাতি সংরক্ষণের প্রশ্নে নারীর উৎপাদনশীল ভূমিকা নারীকে অনন্য করেছে অনন্তকাল ধরে। প্রজাতি সংরক্ষণ ও জীববৈচিত্র্য সম্ভব হয়েছে প্রকৃতি সংরক্ষণ ও বির্বতনের মাধ্যমে। সুদূর অতীত থেকেই এই মিথোজীবী সম্পর্কে নারী ও প্রকৃতি অন্বিষ্ঠ বিশেষভাবে। তাই প্রকৃতি সংরক্ষণে নারীদের রয়েছে অনন্য ভূমিকা। জীবনের উৎপাদন ও পুনরুৎপাদনের কাজে নারীকে সেকারণে প্রকৃতির প্রতিরূপ ভাবা হয়। অথচ প্রজাতি ও প্রকৃতি সংরক্ষণের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজের সহায়ক এই ভূমিকা থাকা সত্ত্বেও নারী অর্থনীতি, পরিবার ও সমাজের যুপকাষ্ঠে বলিপ্রদত্ত। সভ্যতার অতি প্রাচীনকাল থেকেই নারী-পুরুষের প্রাকৃতিক বিভিন্নতা (তৃতীয় লিঙ্গবিচারে প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য বলা বেশী শ্রেয়) পুরুষের আনুকূল্যে বৈষম্যে ও বিভেদে চুড়ান্ত রূপ নিয়েছে। শ্রমশোষণের পুঁজিবাদী ব্যবস্থা সবসময়ই চুড়ান্ত নিষ্পেষণমূলক। বর্তমানে পুঁজি সঞ্চয়নের সূচকীয় গতিবৃদ্ধি নারী ও প্রকৃতি শোষণে সমানভাবেই সক্রিয় ও সেই শোষণ স্বৈরতান্ত্রিক।
পুঁজিবাদ নারীকে মাতৃত্বের জন্য শাস্তিই যে দেয় তাতে সন্দেহ নেই, তবে এটা ঠিক নয় যে নারীরা সন্তান নিক তাপুঁজিবাদ চায় না। বিপরীতে, পুঁজিবাদের জন্য, মহিলারা ভবিষ্যত শ্রমিকদের ক্রমাগত উৎপাদনের অবৈতনিক উৎস। তবে, পুঁজিবাদ সন্তান ও পরিবারের জন্য নারীদের প্রতি মাতৃত্ব এবং ত্যাগের প্রশংসা করার ক্ষেত্রে , পিতৃতন্ত্রের উপরই নির্ভর করে। এইভাবে নারী-পুরুষের মধ্যেকার অপরাধমূলক বৈষম্যকে তারা চোখের আড়ালে রাখতে চায়।
‘জেন্ডার সোশ্যাল নর্মস ইনডেক্স’ (২০২৩)-এর নতুন তথ্য প্রকাশ করেছে রাষ্ট্রপুঞ্জ। সেখানে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষা- এমন নানা ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের অধিকারের বিষয়টি খতিয়ে দেখা হয়। বিশ্ব জনসংখ্যার ৮৫ শতাংশের অবস্থার উপর সমীক্ষার ভিত্তিতে তৈরী সেই সূচকে দেখা যাচ্ছে, বিশ্বজুড়ে মি-টু (Me too)-এর মতো জোরালো আন্দোলন সত্ত্বেও গত এক দশকে মহিলাদের প্রতি বৈষম্য কমেনি।
পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় নারীদের সন্তান উৎপাদন ও লালন-পালন এবং ভবিষ্যৎ শোষণের প্রয়োজনে আরও বেশি সংখ্যক শ্রমিক তৈরি করার জন্য পারিশ্রমিক না দেওয়াটা এই আর্থিক ব্যবস্থারই ‘সিগনেচার’।
নারীরা গড়ে প্রতিদিন 7.2 ঘন্টা গৃহস্থালির কাজে ব্যয় করে, এবং যেহেতু তারা এক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক কর্মশক্তির অংশ নয়, অর্থনৈতিক পরিমাপ বা নীতি তাদের বিবেচনায় রাখে না। বরং এটা বছরের পর বছর ধরে জানা যে, একই কাজের জন্য নারী শ্রমিকদের, তাদের পুরুষ সহযোগীদের তুলনায় কম বেতন দেওয়া হয় এবং বিশ্বব্যাপী (খোদ মার্কিন দেশের ২০২১ সালের তথ্য অনুযায়ী, বছরভর কাজের চুক্তিতে পুরুষরা ১ ডলার বেতন পেলে মহিলারা পেয়েছেন ৮৪ সেন্ট। আর চুক্তিহীন কাজের ক্ষেত্রে মহিলারা পেয়েছেন ৭৭ সেন্ট, কৃষ্ণাঙ্গ মহিলার ক্ষেত্রে যা আরো কম, ৫৪ সেন্ট মাত্র। অর্থাৎ মহিলাদের প্রাপ্তি বেড়েছে ঠিকই কিন্তু বৈষম্য মোছেনি)। কম বেতনের চাকরিতেই নারীদের বড়ো অংশ নিয়োজিত।
একটি উদাহরণ – দক্ষিণ এশিয়া এবং ল্যাটিন আমেরিকার প্রায় তিন-চতুর্থাংশ কৃষি-শ্রমিক নারী। যদিও আমরা যখন কৃষকদের কথা চিন্তা করি তখন আমাদের মস্তিষ্কে পুরুষদের মুখই ভিড় করে আসে।
নারীদের ক্ষেত্রে বেগার শ্রম শব্দটি সাধারণত যত্নের কাজের (caregiving) সঙ্গে জড়িত – শিশু, বয়স্ক, অসুস্থ এবং পরিবারের যত্ন: এগুলোর বেশিরভাগই “মহিলাদের কাজ” হিসাবে বিবেচিত হয়। বেশিরভাগ যত্নের কাজের জন্য, পুঁজিবাদ কোন পারিশ্রমিক প্রদান করে না; পরিবর্তে, “পেমেন্ট” হিসাবে বরাদ্দ হয় নারীর “মাতৃ-প্রকৃতির” প্রশংসা। শ্রমিক শ্রেণীর সদস্য হিসাবে যেটুকু অধিকার তাও লঙ্ঘিত হয় এইভাবে। ‘আন্তর্জাতিক সমান বেতন দিবস’ 2022-এ জাতিসংঘ একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যা নিশ্চিত করে যে “নারীরা পুরুষদের তুলনায় কমপক্ষে 2.5 গুণ বেশি অবৈতনিক কাজ করে।”
2018 সালে, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (ILO)-র রিপোর্ট ‘কেয়ার ওয়ার্ক এবং কেয়ার জবস ফর দ্য ফিউচার অফ ডিসেন্ট’ জানাচ্ছে – এই অবৈতনিক যত্ন এবং গার্হস্থ্য কাজের মূল্য বিশ্বের মোট জিডিপি-এর 9% অর্থাৎ 11 ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার।
64টি দেশে সংগৃহীত সময়-ব্যবহারের সমীক্ষার উপর ভিত্তি করে দেখা গেছে যে প্রতিদিন 16.4 বিলিয়ন ঘন্টা অবৈতনিক পরিচর্যা কাজে ব্যয় করা হয়। এই অবৈতনিক পরিচর্যা কাজের মোট ঘন্টার 76.2 শতাংশ মহিলাদের দ্বারা সম্পাদিত ৷ অন্যভাবে বললে, সারা বিশ্বে মহিলাদের দৈনিক অবৈতনিক পরিচর্যার কাজ হলো 1.5 বিলিয়নেরও বেশি মহিলাকে বিনা বেতনে দিনে আট ঘন্টা কাজ করার সমতুল্য (সূত্র : Tricontinental: Institute for Social Research )।
“আমাদের বিশ্লেষণ ইঙ্গিত দেয় যে অর্থনীতিতে অবৈতনিক মহিলাদের মোট অবদান প্রায় 22.7 লক্ষ কোটি টাকা (গ্রামীণ: 14.7 লক্ষ কোটি টাকা এবং শহুরে: 8.0 লক্ষ কোটি টাকা) যা ভারতের জিডিপির প্রায় 7.5 শতাংশ,” জানাচ্ছে স্টেট ব্যাঙ্কের একটি সাম্প্রতিক (2023) প্রতিবেদন। মহিলাদের, বিশেষ করে, তাদের 20 – 30 বছর বয়সের সময়, ‘সন্তানের জন্য যত্নের সঙ্গে পেশাগত কাজের ভারসাম্য বজায় রাখা’-র দ্বন্দ্বে পেশা ত্যাগ করতে হয় বা শ্রম-সময় কমাতে হয়। তারা পরে কাজ ফিরে পেতে চাইলে, ঐ সময়কালীন বেতন বৃদ্ধি এবং পদোন্নতি যা তাদের পুরুষ সহযোগীরা পায়, তা থেকে বঞ্চিত হয় এবং এইভাবে একই কাজ করা পুরুষদের তুলনায় এই নারীরা তাদের বাকি কর্মজীবন জুড়ে কম মজুরি পায়। এটি বিশেষত ছোট বা কোনো স্থায়ী কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা নেই, এমন চাকরির ক্ষেত্রে প্রধানত সত্য এবং প্রায় 90% মহিলা এই ধরনের কাজই করে, বলা ভালো যে করতে বাধ্য হয়৷
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (ILO), তার সমান পারিশ্রমিক দেওয়ার আহ্বানটি জানিয়েছে 1951 সালের কনভেনশনে –”সমান মূল্যের কাজের জন্য পুরুষ ও মহিলা শ্রমিকদের সমান পারিশ্রমিক”। অথচ রূঢ় বাস্তব হলো, 70 বছরেরও বেশি সময় পার ক’রেও মজুরির লিঙ্গভিত্তিক এই অসমতা বেশিরভাগই ক্ষেত্রেই চলছে, এমনকি তা অস্বীকৃতই থাকছে।
“শ্রমের লিঙ্গ বিভাজন, গার্হস্থ্য ক্ষেত্রে নারীর কাজের স্বাভাবিকীকরণ (Naturalisation) এবং উৎপাদনশীল কাজের তুলনায় প্রজনন কাজের অব-মূল্যায়নকে চ্যালেঞ্জ করুন,” শ্লোগান তুলছে World March for Women (WMW)। ওয়ার্ল্ড মার্চ ফর উইমেন হল একটি আন্তর্জাতিক নারীবাদী আন্দোলন যা লিঙ্গ সমতার পক্ষে প্রচার করে এবং মহিলাদের প্রতি বৈষম্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া এবং তাদের প্রতি সহিংসতা হ্রাস করার কাজে তদারকি করে। সমাধান হিসাবে WMW এর বক্তব্য –গার্হস্থ্য এবং পরিচর্যা কাজের পুনর্গঠন, যাতে এই কাজের দায়িত্ব একটি পরিবার বা সম্প্রদায়ের পুরুষ ও মহিলাদের মধ্যে সমানভাবে ভাগ করা হয়।
এটি বাস্তবে পরিণত হওয়ার জন্য, সংস্থাটি সামাজিক উৎপাদন (যেমন ক্রেজ, যৌথ লন্ড্রি এবং রেস্তোরাঁ, বয়স্কদের যত্ন ইত্যাদি) সমর্থনের জন্য প্রয়োজনীয় নীতিগুলি প্রনয়ণ ও গ্রহণের দাবি করে। সেইসঙ্গে বেতন ছাঁটাই ছাড়াই কাজের সময় কমানোটাও তাদের অন্যতম দাবী।
এই সমস্যাগুলির সমাধানের লক্ষ্যে WMW পুঁজিবাদী অর্থনীতিকে “নারীবাদী অর্থনীতি” দ্বারা প্রতিস্থাপন করার আহ্বান জানায়, যা “নারীবাদী বৈশিষ্ট্য সহ সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি” হিসাবে বিবেচিত হতে পারে বলে এই আন্তর্জাতিক উদ্যোগটি মনে করে। শ্রমিক শ্রেণীর সহায়তার জন্য এই নারীবাদী উদ্যোগটি সামাজিকভাবে বিপ্লবী কিছু ভূমিকা নেবার আহ্বান জানিয়ে নানা আন্তর্জাতিক প্রতিবাদী মঞ্চে ভূমিকা নেয়।
গার্হস্থ্য কাজে (বেগার-শ্রম) নারীদের প্রাধান্যকারী ভূমিকা এবং প্রচলিত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে তাদের প্রান্তিক অবস্থান একটি পরিসংখ্যাননিষ্ঠ তথ্য। এই কারণে বিভিন্ন দেশের সরকারই অর্থনৈতিক উৎপাদন এবং অর্থনৈতিক নীতির পরিধির বাইরে রাখে নারীদের অবদানকে। বেগার শ্রম, পুঁজিবাদী অর্থনীতিজাত কম মজুরি এবং হীন ও আদিম পেশাগ্রহণের বাধ্যবাধকতা এই ত্রহ্যস্পর্শযোগের ভারকেন্দ্রে এদেশে রয়েছে মনুবাদী সংস্কৃতি, যা নারীদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসাবে দেখে ও গৃহকর্মে সুনিপুণা হবার জন্য গৃহবন্দী রাখতে চায়।
অবস্থার অচলতার নিষ্পেষণ যত চেপে বসছে নারীদের উপর, সমাজের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ ততই নীরবতা ও নিষ্ক্রিয়তাকে অধিকতর শ্রেয় মনে করছে; আসলে শংকরাচার্য প্রণীত মায়াবাদেরই প্রতিফলন এসব। যদি এমনটাই চলতে থাকে তবে নারী ও প্রকৃতির অন্তর্জলি যাত্রায় পুরুষের শরিক থেকে শিকার হওয়াটা স্বল্প সময়ের অপেক্ষা।
সমাজ ও অর্থনীতিতে নারীদের হীন অবস্থানকে সভ্যতার সংকট হিসাবে আর কবে আমরা দেখবো!
‘রাত কত হইল?’
উত্তর মেলে না।
পুনশ্চ : “প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের যে প্রাকৃতিক সম্পর্ক, তাই নির্ধারণ করে পুরুষের সঙ্গে নারীর সম্পর্ক কীভাবে রয়েছে। সেই সম্পর্কই মানব সমাজের বিকাশের মাপকাঠি। নারীকে যদি ব্যক্তিগত সম্পত্তি হিসাবে না ভেবে প্রাকৃতিক সৃষ্টি হিসাবে ধরা হয়, তাহলেই পুরুষ-নারীর সম্পর্ক প্রাকৃতিক হয় এবং প্রকৃতির সঙ্গে মানবসমাজের সম্পর্কও প্রাকৃতিক হয়” (একুশ শতকের মার্কসবাদ—অরূপকুমার ঘোষ)
তথ্যসূত্র :
1.The Print-এ প্রকাশিত একাধিক প্রবন্ধ
2. Saheli Chowdhury-এর প্রবন্ধ:
Proletariat of the Proletariat: Women’s Unpaid (Janata weekly, 4/6/2023)
খুব প্রাসঙ্গিক লেখা….. তথ্যপূর্ণ