নারী আজও তার প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি থেকে বঞ্চিত

ভারতের বিস্তীর্ণ পূর্ব উপকূলের অনেকটাই তামিলনাড়ুর অন্তর্গত। সেখানে মৎসজীবীদের মধ্যে যখন কেন্দ্রিয় বড় বড় বন্দরে ট্রলারে বা যন্ত্রচালিত জাহাজে মাছ ধরা ও নিলাম পরিচালিত হয়, নারী শ্রমিকরা পুরুষদের তুলনায় পিছিয়ে পড়েন । মেয়েরা এখানে অংশগ্রহণ করতে পারে না।

প্রীতিলতা বিশ্বাস

জাতীয় পরিসংখ্যান বলছে কৃষি ও খাদ্য ব্যবস্থা অর্থাৎ কৃষিকাজ, পশুপালন ও মৎসচাষ বেতনভুক্ত বা অবৈতনিক নারী শ্রমের উপর নির্ভরশীল। অথচ এই ক্ষেত্রগুলি এমনভাবে নিয়ন্ত্রিত হয় যে নারীর উৎপাদনশীলতা বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে উৎপাদনশীল সম্পদ যেমন কৃষিজমির মালিকানা না থাকায় সে নথিভুক্ত কৃষক হিসাবে সরকারী সহায়তা থেকে বঞ্চিত হয়। নারীদের প্রযুক্তির ব্যবহার সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ দেবার এবং নেবার ক্ষেত্রে অনীহা দেখতে পাওয়া যায়। বিভিন্ন কাজের সময়সীমা এমনভাবে আরোপিত হয় যে এই ক্ষেত্রগুলিতে কাজ করা বহু নারী সেই দাবি পূরণ করতে পারেন না। ফলত তারা ফসল কাটার পর ঝাড়াই, মাড়াই, ধান সেদ্ধ, ধান শুকানো, ঢেঁকিতে ধান ছাটা, মুড়ি ভাজা ইত্যাদি স্বল্প মজুরির বা বিনা মজুরির প্রক্রিয়াকরণের কাজেই সীমাবদ্ধ থাকতে বাধ্য হয়। কৃষিভিত্তিক পরিবারগুলো মহিলাদের  করা এই কাজগুলোতে তাদের শ্রমলাঘবের জন্য সামান্য প্রযুক্তি প্রয়োগের ক্ষেত্রেও এগিয়ে আসে না বা আসতে পারে না। তাই স্বল্প-মজুরির কাজগুলো শ্রমনিবিড় ও কষ্টকর হলেও মহিলারা সেখান থেকে বেরোতে পারেন না এবং নিশ্চিতরূপেই সিদ্ধান্তগ্রহণের ক্ষেত্রে থেকে তারা থেকে যায় ব্রাত্য।

ভারতের বিস্তীর্ণ পূর্ব উপকূলের অনেকটাই তামিলনাড়ুর অন্তর্গত। সেখানে মৎসজীবীদের মধ্যে যখন কেন্দ্রিয় বড় বড় বন্দরে ট্রলারে বা যন্ত্রচালিত জাহাজে মাছ ধরা ও নিলাম পরিচালিত হয়, নারী শ্রমিকরা পুরুষদের তুলনায় পিছিয়ে পড়েন । মেয়েরা এখানে অংশগ্রহণ করতে পারে না। প্রথমত বন্দরগুলো জেলে পরিবারগুলোর বাসস্থান থেকে দূরে, দ্বিতীয়ত মাছের প্রাপ্যতা ; সেই অনুসারে তার বাজারদরের সম্ভাব্যতা ইত্যাদি সংক্রান্ত তথ্যের সঙ্গে তাদের তৎক্ষণাৎ পরিচিত হওয়ার ক্ষেত্রে প্রযুক্তি ব্যবহারে অক্ষমতা একটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায় । তাই বাড়ির কাছাকাছি বসে খুচরো বিক্রি, মাছ শুকানো, প্রক্রিয়াজাতকরণ ইত্যাদি শ্রমসাধ্য এবং স্বল্প আয়ের কাজের  মধ্যে মেয়েদের সীমাবদ্ধ থাকতে হয়। ক্রমশ উৎপাদনশীলতার ক্ষেত্রে প্রান্তিক হয়ে পড়ে মেয়েরা।

কৃষিকাজে ট্রাক্টর, মাছ ধরার ট্রলার ইত্যাদি প্রযুক্তিগুলো যেন পৌরুষের প্রতীক । মেয়েদের প্রযুক্তির প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং নেওয়ার ক্ষেত্রে সব থেকে বড় বাধা তাদের উপর থাকা মানব সমাজের পুনরুৎপাদনের দায়িত্ব এবং পারিবারে দেয় শ্রমের দায়ভার। নারী পরিবারে প্রাথমিক শুশ্রুষা প্রদানকারী। সন্তানের জন্ম দেওয়া, তাকে প্রতিপালন করা, বয়স্ক ও অসুস্থ সদস্যের দেখভাল করা তার প্রাথমিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। নারীকে প্রযুক্তির প্রশিক্ষণ দিতে গেলে তার স্বল্প আয়টুকু হাতছাড়া হয় ও সেই সঙ্গে পরিবারের শুশ্রুষার কাজে যে ব্যাঘাত সৃষ্টি হয় তা পরিবার অভিযোজিত করে নিতে চায় না। সব দিক বিবেচনা করলে মহিলাদের জন্য প্রযুক্তি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা পরিবারের জন্য স্বাভাবিকের থেকে বেশি ব্যয়সাপেক্ষ হয়ে যায়। এছাড়াও প্রযুক্তির একটি পুঁজি চরিত্র আছে, যে পুঁজি চরিত্র লিঙ্গ বৈষম্যকে কমানোর পরিবর্তে বাড়িয়ে দেয়। প্রযুক্তি মানেই উৎপাদনে উদ্বৃত্ত বাড়ানো, সেই সঙ্গে পণ্যের বাজারদর কমিয়ে প্রতিযোগিতায় এগোনো। এই লক্ষ্যের সঙ্গে নারীর পরিবারে দেয় বিনা পারিশ্রমিকের শ্রমকে খাপ খাওয়ানো যায় না। অথচ প্রশিক্ষণ পেলে তারা যে যথেষ্ট সাফল্য অর্জন করতে পারে তা প্রমাণ করে দিয়েছে চেন্নাইয়ের এম এস স্বামীনাথন ইন্সস্টিটিউট। তারা মৎসজীবী মেয়েদের ট্যাব, মোবাইলের ব্যবহার, ইন্টারনেটের ব্যবহার, ডিজিটাল পেমেন্ট, ফোনে হেল্পলাইনের সুবিধা নেওয়া, অডিও পরামর্শের সুবিধা বিষয়ে প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তি দিয়ে সাহায্য করে। ট্রাক্টর কিংবা ট্রলারের মতো প্রযুক্তির সঙ্গে এই প্রযুক্তির প্রভেদ হল—এটা সহজেই লিঙ্গ বৈষম্যকে অতিক্রম করতে সাহায্য করে। বাস্তবে এই প্রশিক্ষণ পাওয়ার পর দেখা যায় কাডালুর, নাগাপাট্টিনাম, রামানাথাপুরম ইত্যাদি জায়গায় মৎসজীবী মহিলারা উপার্জনের ক্ষেত্রে তাদের প্রান্তিক অবস্থান থেকে এগিয়ে এসেছে এবং সিদ্ধান্তগ্রহণের ক্ষেত্রেও অংশগ্রহণে  সক্ষম হচ্ছে।

উপরের উদাহরণগুলোতে আমরা দেখলাম কায়িক শ্রমের ক্ষেত্রে ইন্টারনেটের প্রযুক্তি লিঙ্গ বৈষম্যকে অতিক্রম করতে সাহায্য করছে। সবক্ষেত্রে অবশ্য এটা হওয়া সম্ভব নয়। প্রযুক্তির পুঁজি চরিত্রই প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। যা আমরা দেখতে পাই অ্যাপ নির্ভর ডেলিভারি এবং রাইডিং পরিষেবা ক্ষেত্রে। এই কাজের ঝুঁকি, কায়িক শ্রমের সক্ষমতা, প্রযুক্তি ব্যবহারের দক্ষতা নারীকে এই ক্ষেত্রগুলিতে প্রায় প্রবেশ করতে দেয় না, পরিবর্তে পুরুষের শ্রমকে নিদারুণ ভাবে শোষণ করে।

আবার মানসিক শ্রমের দক্ষ শ্রমিক হিসাবে আইটির কাজ নারীকে লিঙ্গ বৈষম্য অতিক্রম করতে সাহায্য করেছে। এক্ষেত্রে তার দক্ষতা পূর্ণ বিকশিত হবার ক্ষেত্রে প্রধান বাধা পিতৃতন্ত্র। অফিসের কাজের পাশাপাশি পরিবারে তার দায়িত্ব সম্পূর্ণ পালন করার জন্য তার গড় শ্রম সময় অনেক গুন বেড়ে যায়। স্থায়ী চাকরি থাকলেও পরিবারে পরিষেবা দেওয়া এবং তার ব্যবস্থাপনার সকল দায়িত্ব নারীর কাঁধেই থাকে। নারীরা বাইরে কাজের জগতে পা রাখার অনুমতি পায় সন্তান ও বাড়ির দায়িত্ব পালনের অনুচ্চারিত অঙ্গীকারের ভিত্তিতে। এক্ষেত্রে উচ্চবিত্ত পরিবারে মেশিনের ব্যবহার মেয়েদের শ্রম এবং সময় কিঞ্চিৎ লাঘব করলেও দায়িত্বের বাধ্যবাধকতা থেকে তাকে রেহাই দিতে পারে না। অতিরিক্ত পরিশ্রম মানে বিশ্রামের ঘাটতি। ResMed নামক একটি সংস্থার করা সমীক্ষা বলছে মেয়েরা পুরুষদের তুলনায় অনেক কম সময় ঘুমানোর সুযোগ পায়। ঘুমের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত থাকে শরীরের হরমোন নিঃসরণ এবং আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। হরমোন নিঃসরণের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত নারীর দেহে মানব প্রজাতির পুনরুৎপাদনের বিষয়টি। যেহেতু মাতৃদেহে সন্তানের বৃদ্ধি সম্পূর্ণ একটি প্রকৃতিক প্রক্রিয়া তাই এখানে মায়ের সুস্থতা যেমন প্রয়োজন তেমনি তার পরিবেশের সুস্থতাও সমান জরুরি । নারীর সুস্থতা এবং প্রকৃতি-পরিবেশের সুস্থতার সঙ্গে পিতৃতন্ত্র ও তাকে রক্ষাকারী পুঁজিবাদের সরাসরি বিরোধ আজ  প্রকট । ভারতে প্রায়শই শিশুর মায়েরা চাকরি ছাড়তে বাধ্য হয়। কারণ সরকারি, বেসরকারি বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ মুনাফার হার কমিয়ে, বাচ্চা দেখাশোনা করার জন্য ক্রেশের বন্দোবস্ত করে না।

দীর্ঘ সময় সন্তানকে গর্ভে ধারন করে, সদ্যজাতকে মাতৃদুগ্ধ পান করিয়ে, এবং পরবর্তীতে তাকে পূর্ণ বয়স্ক হিসাবে গড়ে তুলে নারী, সমাজের জন্য একটি অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করে। এই দায়িত্বটি সামাজিক দায়িত্ব হলেও সমাজ এর দায়ভার সম্পূর্ণ নারীর উপরেই চাপিয়ে দেয়। নারী তার ব্যক্তিগত বিকাশের ইচ্ছা অনিচ্ছাকে যূপকাষ্ঠে বলি দিয়ে দায়িত্ব পালন করে। গৃহশ্রমের ক্ষেত্রে প্রযুক্তি তাকে সামান্য সাহায্য করে মাত্র, কিন্তু তাকে দায়িত্বের বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্ত করতে পারে না। সামাজিকীকরণ ব্যতীত যান্ত্রিকীকরণ নারীমুক্তি আনতে পারে না। আবার সামাজিক শ্রমের জগতে প্রযুক্তি শ্রমভার লাঘব বা সহজ করার থেকেও বেশি প্রধান্য দেয় উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি ও প্রতিযোগিতায় অগ্রসরতাকে। দিনের শেষে প্রযুক্তির এই উদ্দেশ্য উৎপাদন ও পুনরুৎপাদনের দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে চলা নারীকে আরও বেশি শোষণের শৃঙ্খলে জড়িয়ে নেয়। প্রযুক্তি যে সমাজে বিকাশের হাতিয়ার সেই সমাজ দাঁড়য়ে আছে ব্যক্তিমালিকানার উপর। আর ব্যক্তিমালিকানার উত্থান হয়েছে মাতৃকেন্দ্রিক সমাজের ভাঙনের মধ্যে দিয়ে, যে সমাজে নারীরা গৃহকর্তার অধীনে দাস-দাসি, গবাদি পশু নিয়ে তৈরি পরিবারের একজন অবলা জীব। সন্তানের জন্ম দেওয়া যার প্রাথমিক কাজ। সিদ্ধান্ত গ্রহণের জায়গা থেকে সে অনেক দূরে। ব্যক্তিমালিকানার ভিত যত গভীরে প্রথিত হয়েছে নারীর সামাজিক অবস্থার তত অবনতি হয়েছে। পুঁজিবাদ তাই পারেনা নারীর শ্রম লাঘবের প্রযুক্তিকে বাজারে নিয়ে আসতে। পারে না নারীকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জায়গায় ফিরিয়ে আনতে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top