হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে ট্রাম্প প্রশাসনের দ্বন্দ্ব: কোন্ শিক্ষা হাজির করছে?

তথ্য বলছে, মার্কিনী বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে বিদেশ থেকে পড়তে আসা ছাত্র-ছাত্রীদের সংখ্যা প্রায় ১২ লক্ষ, যার মধ্যে ভারতীয় ছাত্র-ছাত্রীদের সংখ্যাই ৩ লক্ষ ৩১ হাজার (প্রায় ২৮ শতাংশ)। উচ্চশিক্ষা থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত মোট সেবা খাতের উদ্বৃত্তের প্রায় ১৪ শতাংশ। হার্ভাড-এর আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে প্রায় ৪৪ বিলিয়ন ডলার যোগ করে। যা আমেরিকার অর্থনীতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। পড়ুন বিস্তারিত

ট্রাম্প ও হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়

সন্তোষ সেন

মার্কিন প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিমত ডোনাল্ড ট্রাম্প একের পর নয়া নীতির ঘোষণা বা প্রয়োগ করে চলেছেন। ‘বেআইনি অভিবাসীদের’ হাতে পায়ে শিকল পরিয়ে দেশে দেশে ফেরত পাঠানো থেকে শুরু করে আমেরিকায় আমদানীকৃত পণ্যের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক বসানো। যদিও চীন সহ অন্যান্য দেশ থেকে প্রত্যাঘাত পেয়ে শুল্ক-যুদ্ধ আপতত রদ রাখতে বাধ্য হয়েছেন মিস্টার ট্রাম্প। অন্যদিকে ইউক্রেনের বিপুল খনিজ ভান্ডার দখলের চেষ্টা সহ গ্রিনল্যান্ডকে কিনে নেওয়া বা দখল করার বাসনা। ট্রাম্প সাহেব গাজা ভূখণ্ডকেও নিজের দখলে আনার জন্য উদগ্রীব।

এসব ছাপিয়ে এখন দেশের সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির বিরুদ্ধে তিনি কামান দেগেছেন। কলম্বিয়া সহ হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর যেন এবার বোমা বর্ষণ শুরু হয়েছে। উপরাষ্ট্রপতি জে ডি ভান্স উবাচ –“বিশ্ববিদ্যালয়গুলি হল গণশত্রু। আর স্বয়ং ট্রাম্প বলেছেন –“সকলেই জানে, হার্ভার্ড তার পথ হারিয়েছে। এখানে ঘৃণা ও মূর্খামির চাষ হয়। এদের ফেডারেল ফান্ড পাওয়া উচিত নয়।” হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও উচিত জবাব দিয়েছেন –“কোনও সরকার, তা যে পার্টিরই হোক না কেন, কখনই নির্দেশ দিয়ে বলতে পারে না যে, একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কী শিক্ষা দেবে।” যদিও ট্রাম্প প্রশাসন নির্বিকার।

ইতিমধ্যেই মার্কিন সরকারের ‘ডিপার্টমেন্ট অফ হোমল্যান্ড সিকিউরিটি (DHS)’এর সচিব স্পষ্টতই জানিয়ে দিয়েছেন –“মোট ২.৭ বিলিয়ন ডলারের যে DHS অনুদান হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় পেত, তা বন্ধ করে দেওয়া হবে। কারণ, তাঁদের মতে, এই অনুদানের অর্থে নাকি ‘আমেরিকার মূল্যবোধ ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়েছে’। এছাড়াও হার্ভার্ডের কাছে নির্দেশ পাঠানো হয়েছে, ২০১০ সাল থেকে তাদের ক্যাম্পাসে যে সমস্ত বিদেশি গবেষক, ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষক গবেষকরা পড়তে বা কাজে এসেছেন তাঁদের বর্তমান ঠিকানা সহ বিশদ তথ্যের তালিকা সরকারের কাছে জমা দিতে। নাহলে এতদিন হার্ভার্ড তাদের বিনিয়োগ ও সম্পত্তির উপর যে কর ছাড় পেত, সে সুযোগও প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে। যে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলিকে বলা হয় মুক্তচিন্তা ও উন্নত গবেষণার আঁতুড়ঘর। যারা বিদেশি মেধাকে মর্যাদা, সম্মান ও প্রচুর স্কলারশিপ দিয়ে দেশে শিক্ষার মানকে উন্নতির শিখরে পৌঁছে দিয়েছে। সেইসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ওপরও মিস্টার ট্রাম্প এন্ড কোম্পানি আজ খড়গহস্ত কেন?

 আমেরিকাকে বিশ্ব দরবারে উচ্চ অবস্থানে (মেক আমেরিকা গ্রেট এগেন) নিয়ে যাওয়ার স্লোগান তুলে উঠে পড়ে লাগল কলাম্বিয়া সহ উত্তর-পূর্ব প্রদেশের বেশকিছু নামজাদা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর। এইসব বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনোর মান অত্যন্ত উচ্চমানের। তবুও হাভার্ডের সাথে ট্রাম্প প্রশাসনের দ্বন্দ্ব বিশ্ববাসীকে হতবাক করেছে। সাধারণ আমেরিকাবাসী সহ শিল্প মহলের অনেক কর্তা ব্যক্তিরাও অসন্তুষ্ট, বিরক্ত এবং বিক্ষুব্ধ। হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ের রিসার্চ স্কলার বা উন্নত দক্ষতার গবেষক বৃন্দ ক্যান্সার প্রতিরোধের গবেষণা, মহাকাশ সংক্রান্ত গবেষণা, এবং তথ্য প্রযুক্তি সহ বিজ্ঞান গবেষণার প্রায় সব জগতে তাঁদের গুরুত্বপূর্ণ কর্মযজ্ঞের মধ্য দিয়ে আমেরিকার সম্মান, প্রতিপত্তি, বৈভব ও অর্থনীতিকে সুউচ্চ  অবস্থানে নিয়ে গেছেন। আমেরিকার সামরিক শিল্পের ক্ষেত্রেও বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান আছে। বিজ্ঞান প্রযুক্তির বিকাশের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে কর্পোরেট জগৎ ফুলেফেঁপে উঠেছে ঠিকই। কিন্তু এক্ষেত্রে তাদের সর্বদা ঋণী থাকতে হবে স্কলার, গবেষক ও বিজ্ঞানীদের অপরিসীম অবদানের কাছে। তবুও কলম্বিয়া সহ হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর মার্কিন প্রশাসনের এত রাগ, ঘৃণা কেন? তাঁদের অভিযোগ এই যে, এইসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আসা বিদেশের ছাত্র-ছাত্রীরা বাম মনোভাবাপন্ন। আমেরিকার আর্থিক নীতি, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে পড়ুয়া,গবেষক, শিক্ষকরা এক জোট হয়ে মিটিং মিছিল, সভা সমিতি করে। বিশেষ করে বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে ‘ব্ল্যাক লাইভ ম্যাটার্স’ আন্দোলন এবং ইসরাইলের ঘৃণ্য সামরিক অভিযানের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বিপর্যস্ত বিধ্বস্ত প্যালেস্তানীয়দের পক্ষে অবস্থান নেওয়া ট্রাম্পের শিরঃপীড়ার অন্যতম কারণ। মুক্ত চিন্তা, স্বাধীন মতামত, বহুত্ববাদ, বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য, স্বাধীনতা, অন্যের বিপদে সহযোগিতা সহমর্মিতার মতো বিষয়গুলো কী করে সহ্য করবেন চরম দুর্নীতিগ্রস্ত, স্বৈরাচারী, প্রভাব প্রতিপতিশালী ধনকুবের ট্রাম্প সাহেব?

তথ্য বলছে, মার্কিনী বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে বিদেশ থেকে পড়তে আসা ছাত্র-ছাত্রীদের সংখ্যা প্রায় ১২ লক্ষ, যার মধ্যে ভারতীয় ছাত্র-ছাত্রীদের সংখ্যাই ৩ লক্ষ ৩১ হাজার (প্রায় ২৮ শতাংশ)। উচ্চশিক্ষা থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত মোট সেবা খাতের উদ্বৃত্তের প্রায় ১৪ শতাংশ। হার্ভাড-এর আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে প্রায় ৪৪ বিলিয়ন ডলার যোগ করে। যা আমেরিকার অর্থনীতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

অনুদান বন্ধ ও কর ছাড় রদের হুমকির পাশাপাশি মার্কিন প্রশাসন বিদেশী পড়ুয়াদের ভিসা বাতিলের পথে হাঁটছে। গত কয়েক সপ্তাহে ১৬০টি কলেজ ইউনিভার্সিটির হাজার খানেক বিদেশি পড়ুয়ার ভিসা প্র্যতাহার করেছে আমেরিকা। কেড়ে নেওয়া হয়েছে পড়ুয়া হিসেবে আমেরিকায় থাকার অধিকার। পাশাপাশি আমেরিকায় বরাবরের জন্য নিষিদ্ধ করা হচ্ছে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় আন্দোলনের নামা বিদেশি পড়ুয়াদের।

অথচ এতকাল ধরে মুক্ত বাণিজ্য এবং অবাধ প্রতিযোগিতার ধ্বজা উড়িয়ে নিজেদের ম্যানুফ্যাকচারিং ও তথ্য প্রযুক্তির সুবিশাল কর্মযজ্ঞকে ফুলেফেঁপে ওঠা কাল্পনিক পুঁজির (fictitious capital) জোরে মূলত চীন, ভিয়েতনাম, তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়া ও ভারতে তাদের উদ্বৃত্ত পণ্য রপ্তানি করে এসেছে। এবং এই দেশগুলোর অঢেল প্রাকৃতিক সম্পদ,   সস্তা শ্রম ও শ্রম আইনের দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে শিল্প হাব ও বাজার গড়ে আমেরিকার কর্পোরেট বাহিনীর মুনাফা বৃদ্ধি পাহাড় প্রমাণ করেছে। কিন্তু বর্তমানে চীন ম্যানুফ্যাকচারিং থেকে সার্ভিস সেক্টর, তথ্য প্রযুক্তি থেকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (বিশেষ করে বিশ্ববাসীর কাছে সহজলভ্য ডিপসেক নামক চ্যাট জিপিটি), যোগাযোগ প্রযুক্তি থেকে পরিকাঠামো: সবক্ষেত্রেই আমেরিকাকে ছাপিয়ে দ্বিমেরু বিশ্ব বাণিজ্যের ভরকেন্দ্র হয়ে উঠছে। ‘মেইড ইন চায়না’ ট্যাগ লাগানো পণ্য সামগ্রীতে আমেরিকার বাজার আজ ছয়লাপ। আর এর সাথে যুক্ত হয়েছে এখনও চলতে থাকা দু দুটো বড় মাপের যুদ্ধ। যার ফলে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা হিসেবে ডলার ভয়ানক বিপদে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছে মার্কিন প্রশাসন।

ডি-ডলারাইজেশনের হাত ধরে চীনের মুদ্রা ইউয়ান এবং রাশিয়ার রুবেলের মাধ্যমে বিশ্ব বাণিজ্য আদান প্রদান গতি পেয়েছে। এখন আবার ঘাড়ের ওপর নিঃশ্বাস ফেলছে অন্যান্য দেশের সাথে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ব্রিকস গোষ্ঠীভুক্ত দেশগুলোর নতুন মুদ্রা আনার পরিকল্পনা। আমেরিকার অর্থনীতি আজ বাস্তবিক অর্থেই টালমাটাল। ফলে আমেরিকার শিল্প-মহল ও ট্রাম্প প্রশাসন বেজায় আশঙ্কিত। এই আশঙ্কা থেকেই বিপুল কর্পোরেট ফান্ডিং’এর মদতে উদগ্র জাতীয়তাবাদ ও অন্ধ দেশপ্রেমের জিগির তুলে ট্রাম্পের নির্বাচনী জয়। এই পথ ধরেই বিচার করতে হবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনতা হরণের জন্য অর্থনৈতিক অবরোধের বিষয়টিকে।

স্বভাবতই আর্থিক অনটনের কবলে আমেরিকার অনেক সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভয়ানক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। ইতিমধ্যেই বহু বিজ্ঞানী এবং গবেষককে তাদের কাজ অবিলম্বে বন্ধ করে দিতে বলা হয়েছে। স্বভাবতই বিভিন্ন জটিল রোগ এবং তার চিকিৎসা সংক্রান্ত গবেষণার কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা প্রবল। যার মধ্যে রয়েছে যক্ষা এবং স্নায়ুরোগ এএলএস-এর মতো অসুখ সংক্রান্ত গবেষণা, রয়েছে মানবদেহে রেডিয়েশনের প্রভাব সংক্রান্ত বহু পরীক্ষাও। আর্থিক অনুদান বন্ধ করে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুল, দ্যা স্কুল অফ পাবলিক হেলথ এবং আমেরিকার অজস্র হাসপাতাল ও পরীক্ষাগারে নিয়মিত হওয়া পরীক্ষা প্রকল্প ও গবেষণা বন্ধ হওয়ার মুখে। একই সঙ্গে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত গবেষক, শিক্ষাকর্মী এবং বৃত্তি পাওয়া পড়ুয়াদের আর্থিক সংস্থানও এখন বড়সড়ো প্রশ্নের মুখে। অন্যদিকে মার্চ মাসেই মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র নাসার ডিইআই বিভাগের ৯০০ জনকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করে বিভাগটি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে ট্রাম্পের নির্দেশে। শেষ পর্যন্ত এই বিভাগের শীর্ষ আধিকারিক নীলা রাজেন্দ্রও বরখাস্ত হলেন। ইনক্লুসিভ নয়, ট্রাম্প শুধু শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানদের স্বার্থ দেখছেন বলেই বিভিন্ন মহল থেকে অভিযোগ উঠছে।

আমেরিকার বৃহত্তর ছাত্র সমাজের ওপরই শুধু নয়, কর্পোরেট এবং সামরিক-শিল্প জোটের ওপরও ট্রাম্পের নীতির ভয়ংকর প্রভাব পড়বে। এখনো পর্যন্ত মিচিগান, টেক্সাস, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় আর্থিক অনুদান সংগ্রহ করতে পারলেও বাকি পাবলিক ইউনিভার্সিটিগুলো সরকারি অনুদানের উপর নির্ভরশীল এবং ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের জালে বন্দী। কিন্তু উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা ক্ষেত্রে আর্থিক অনুদান বন্ধ এবং অসহযোগিতার ক্ষেত্রে আমেরিকা কি সর্বপ্রথম? তথ্য বলছে অন্য কথা। মার্গারেট থ্যাচারের আমলে যুক্তরাজ্য সর্বপ্রথম এই কাজে ব্রতী হয়। আমাদের দেশেও উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে নানান বিধিনিষেধ, আর গবেষণা খাতে অনুদান বন্ধ বা ব্যাপক হারে কমানো শুরু হয়েছে এনডিএ জামনার প্রথম আমল থেকেই। বর্তমানে যা ক্রমবর্ধমান। 

অন্যদিকে অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, জার্মানি এবং স্ক্যান্ডিনাভিয়ান দেশগুলোর শিক্ষাক্ষেত্রে বাজেট বরাদ্দ এবং আর্থিক সহযোগিতা, অনুদান এখনও অনেকটাই বেশি। এক্ষেত্রে সবার উপরে রয়েছে চীন। দীর্ঘদিন ধরেই চীন সরকার উচ্চশিক্ষা এবং গবেষণা খাতে প্রচুর ব্যয়বরাদ্দ করে আসছে। এদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো জ্ঞানের আলোকশিখা জাগিয়ে রেখেছে। উচ্চশিক্ষার সমুজ্জ্বল নীতি চীনকে বিশ্বদরবারে সামনের সারিতে নিয়ে এসেছে।

তাহলে আমেরিকার ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কি ট্রাম্পের নয়া নয়া নীতিকে স্বনির্মিত ক্ষতি অর্থাৎ নিজেদের পায়ে কুড়ুল মারা বলে গণ্য করবে না?

আমেরিকার কর্পোরেট বাহিনী কি ট্রাম্পের পক্ষে?

হার্ভার্ডসহ শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কর্পোরেট দুনিয়ার জন্য দক্ষ ও উদ্ভাবনী কর্মীর প্রধান উৎস। বিদেশি ছাত্রদের ওপর নিষেধাজ্ঞা বা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওপর রাজনৈতিক চাপ দীর্ঘমেয়াদে কর্পোরেটদের প্রতিভা যোগানের পথ সংকুচিত করবে নিশ্চিত করেই। ফলে, অনেক কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান ট্রাম্পের শিক্ষা ও অভিবাসন নীতির বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছেন। 

বেশ কিছু বড় কোম্পানি, বিশেষ করে প্রযুক্তি এবং মিডিয়া খাতে, Diversity, Equity & Inclusion (DEI) নীতিকে সমর্থন করে থাকে। হার্ভার্ডের ওপর চাপ এই আদর্শের বিরুদ্ধে গেলে তারা নিজস্ব অবস্থান পরিষ্কার করতে পারে, যেমন আগেও ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ বা অভিবাসন ইস্যুতে করেছে। অন্যদিকে হার্ভার্ডসহ বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সামরিক গবেষণার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। ফলতঃ রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ সামরিক ক্ষেত্রের গবেষণা সহযোগিতাকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলতে পারে। তাই সামরিক-শিল্প জোট সাধারণত রিপাবলিকান প্রশাসনকে সমর্থন করলেও, বাস্তবিক চাহিদা যেমন প্রযুক্তিগত অগ্রগতি, গবেষণা, প্রতিভা উন্নয়ন, এসবের বিপক্ষে নেওয়া যেকোন পদক্ষেপকে উদ্বেগের চোখে দেখে।

গুগলের প্রাক্তন সিইও এরিক স্মিট বলেছেন, ট্রাম্পের গবেষণা খাতে বাজেট ছাঁটাই চীনের সঙ্গে সুপারইন্টেলিজেন্স প্রতিযোগিতায় যুক্তরাষ্ট্রকে পিছিয়ে দেবে। তিনি ট্রাম্পের নয়া নীতিগুলোকে “বিজ্ঞানের ওপর আক্রমণ” হিসেবে বর্ণনা করেছেন। বিভিন্ন কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ও অধ্যাপকরা জানাচ্ছেন –একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ দখলের চেষ্টা উচ্চশিক্ষার স্বাধিকারে অনৈতিক হস্তক্ষেপ। ট্রাম্পের নয়া নয়া নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গণ্ডি ছাড়িয়ে বহুদূর বিস্তৃত হয়েছে। এমনকি উচ্চশিক্ষার সমালোচক এবং ট্রাম্পপন্থীরাও বিশ্বাস করেন, ট্রাম্প এখানে চূড়ান্তভাবে বাড়াবাড়ি করছেন।

ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল–এর সম্পাদকীয় বোর্ড, যারা হার্ভার্ডের প্রতি বন্ধুসুলভ নয়, একটি সম্পাদকীয়তে ট্রাম্পের এই হস্তক্ষেপের কঠোর সমালোচনা করেছে, যার শিরোনাম ছিল “Trump Tries to Run Harvard”। সম্পাদকরা লিখেছেন, সরকারের এই নজিরবিহীন সিদ্ধান্ত অর্থাৎ একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে নিজেদের মতো করে, সরকারি কার্যক্রমের সমর্থনে গড়ে তোলার চেষ্টা কোনভাবেই সমর্থন যোগ্য নয়। হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে  ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত বা ঘোষণা সংবিধান অনুযায়ী তাঁর ক্ষমতার সীমা ছাড়িয়ে গেছে। এদিকে, হার্ভার্ডের আরেক নিয়মিত সমালোচক FIRE (যারা ক্যাম্পাসে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা মূল্যায়ন করে) ট্রাম্পের “অসংবিধানিক দাবি”-কে তীব্রভাবে নিন্দা জানিয়েছে এবং হার্ভার্ডকে দৃঢ় থাকার আহ্বান জানিয়েছে।

হার্ভার্ডের ওপর ট্রাম্পের আক্রমণ এবং হার্ভার্ডের প্রতিরোধ, মার্কিন জনমতেও পরিবর্তন এনেছে। Morning Consult–এর ১,১৪,০০০ মানুষের ওপর এক সমীক্ষায় প্রাপ্ত তথ্য –জানুয়ারিতে ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর থেকে হার্ভার্ডের জনপ্রিয়তা বেড়েছে। এবং ট্রাম্পের আক্রমণের ঠিক পরপরই হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্তনীদের অনুদান উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে গেছে। আমেরিকান নাগরিকদের মূল সুর —উচ্চশিক্ষার ওপর এমন ইচ্ছাকৃত আক্রমণ শুধু ক্যাম্পাসের বৌদ্ধিক সৃজনশীলতাকেই ক্ষতিগ্রস্ত করে না, বরং আমেরিকান সমাজে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিশেষ অবদানকেও দুর্বল করে। উচ্চশিক্ষা হল যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার অন্যতম প্রধান উৎস, সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধি, জ্ঞানার্জন এবং অর্থনৈতিক সাফল্যের চালিকা শক্তি। এই মতামতের ওপর দাঁড়িয়ে আমেরিকা জুড়েই বিক্ষোভ প্রতিবাদ সোচ্চারে সংগঠিত হচ্ছে।

ট্রাম্প প্রশাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ আন্দোলন:

এই বছরের এপ্রিল মাস জুড়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রদেশে লক্ষ লক্ষ মানুষ বিক্ষোভ, মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশে সামিল হয়েছেন। মূল উদ্দেশ্য ট্রাম্প প্রশাসনের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং শিক্ষা জগতে নয়া নয়া নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো। ৫ই এপ্রিল আমেরিকার ৫০টি রাজ্যের ১২০০-এর বেশি অঞ্চলে চার লক্ষাধিক মানুষ অভূতপূর্ব ‘হ্যান্ডস অফ’ আন্দোলনে পথে নামলেন। অন্যদিকে উনিশে এপ্রিল ‘ন্যাশনাল ডে অফ অ্যাকশন’ নামে খ্যাত আন্দোলনে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরে সাতশটির মতো ইভেন্ট অনুষ্ঠিত হয়। মূল লক্ষ্য ট্রাম্পের নয়া নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো এবং গণতান্ত্রিক ও নাগরিক অধিকার সুরক্ষিত রাখা। আর একটি সাড়া জাগানো আন্দোলনের স্বাক্ষী হলেন আমেরিকাবাসী। যার পোশাকি নাম, “50501 মুভমেন্ট”। অর্থাৎ ৫০টি রাজ্য, ৫০টি প্রতিবাদ, ১ দিন ধরে –এই স্লোগানে প্রতিবাদ বিক্ষোভ সংগঠিত হয়। হিউস্টন, অস্টিন, ফোর্টওয়ার্থ এবং সান আন্তোনিওসহ টেক্সাসের বিভিন্ন শহরে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে আসেন। তাঁরা ট্রাম্প প্রশাসনের অভিবাসন নীতি, পরিবেশ সংরক্ষণে অনীহা এবং উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ওপর হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান।

আরও আছে। ২১ এপ্রিল “All Out on Earth Day” ক্যাম্পেইনের আওতায় পরিবেশবাদী ও গণতন্ত্রপন্থী সংগঠনগুলো ট্রাম্প প্রশাসনের পরিবেশ সংরক্ষণ নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে। নিউ ইয়র্ক, মিলওয়াকি এবং অন্যান্য শহরে মিছিল, পিকেটিং ও পরিচ্ছন্নতা অভিযান অনুষ্ঠিত হয়। জীবাশ্ম জ্বালানি শিল্পের সঙ্গে প্রশাসনের সম্পর্ক, পরিবেশ সংস্থাগুলোর বাজেট ছাঁটাই এবং নবায়নযোগ্য শক্তির জন্য তহবিল হ্রাসের বিরুদ্ধে জোরালো আওয়াজ ওঠে।

এছাড়াও হার্ভার্ডের বিশ্ববিদ্যালয়ের কর-মুক্ত মর্যাদা প্রত্যাহারের হুমকি দেওয়ার প্রতিবাদে  বার্কলেতে ব্যাপক বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের বাইরেও, বার্লিন, প্যারিস, লিসবন এবং লন্ডনে “Hands Off” আন্দোলনের সমর্থনে বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। এই বিক্ষোভগুলোতে ট্রাম্প প্রশাসনের নীতির বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক উদ্বেগ প্রকাশ পায়।

আমেরিকা সহ বিদেশের মাটিতেও ব্যাপক বিক্ষোভ সমাবেশ সংগঠিত হয়ে চলেছে। পাঠক লক্ষ্য করবেন যে, এই সমস্ত আন্দোলনগুলোতে মূল দাবিগুলো প্রায় এক। জনবিরোধী আইন বা নির্দেশ, গণতান্ত্রিক মুক্ত পরিসর বিনষ্ট করা, শিক্ষাক্ষেত্রে অনৈতিক হস্তক্ষেপ, অভিবাসন নীতির প্রবল বিরোধিতা করার পাশাপাশি প্রকৃতি পরিবেশ রক্ষা ও সংরক্ষণের দাবি সমান তালে সমসুরে উচ্চারিত হচ্ছে। এটাই কি মানবসভ্যতার

বেঁচে থাকার জিয়নকাঠি, প্রধান দাবী নয়? আমরা কি কিছু শিক্ষা গ্রহণ করতে পারিনা?

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top