ট্রাম্পের নীতিহীনতা ও ভারত সরকারের প্রতিক্রিয়া: একটি বিশ্লেষণ

আন্তর্জাতিক আইনের বাইরে গিয়ে ভারতে রপ্তানির উপর উচ্চ শুল্ক বসিয়েছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের  বর্তমান এই রাষ্ট্রপতি। ট্রাম্পের শুল্কনীতির মূল লক্ষ্য হল মার্কিন বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনা, যা আবার  ভারতের জন্য ক্ষতিকারক হতে পারে। মার্কিন রপ্তানি বাড়াতে ভারতকে তার বাজার খুলে দিতে হবে, যা ভারতীয় উৎপাদকদের জন্য বিপদের এক সংকেত।

ট্রাম্প

বঙ্কিম দত্ত

আমেরিকার রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প  অতি সম্প্রতি অভিবাসী ভারতীয়দের হাতকড়া বেঁধে অপমানজনক ও অমানবিকভাবে দেশে ফেরত পাঠিয়েছেন । সম্প্রতিক যুদ্ধের সময়ও ভারতের বিরুদ্ধে কটূক্তি করেছেন, যুদ্ধবিরতির জন্য  ভারতকে বাধ্য করেছেন ট্রাম্প। আন্তর্জাতিক আইনের বাইরে গিয়ে ভারতে রপ্তানির উপর উচ্চ শুল্ক বসিয়েছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের  বর্তমান এই রাষ্ট্রপতি। ট্রাম্পের শুল্কনীতির মূল লক্ষ্য হল মার্কিন বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনা, যা আবার  ভারতের জন্য ক্ষতিকারক হতে পারে। মার্কিন রপ্তানি বাড়াতে ভারতকে তার বাজার খুলে দিতে হবে, যা ভারতীয় উৎপাদকদের জন্য বিপদের এক সংকেত।ভারতীয় কর্তৃপক্ষ যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাণিজ্য উদ্বৃত্ত (trade surplus) কমাতে চাইছে এবং এজন্য অন্যান্য দেশ থেকে আমদানিকৃত পণ্য, যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানির পরিকল্পনা করছে। ভারতের বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয় “ভারতীয় শিল্পের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে এমন ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করতে উৎসাহিত করেছে, যেখানে চীন বা অন্যান্য দেশ থেকে আমদানিকৃত পণ্যগুলো যুক্তরাষ্ট্র থেকে আনা যেতে পারে”। কৃষিখাতে মার্কিন ভর্তুকিপ্রাপ্ত পণ্য আমদানি করলে লক্ষ লক্ষ কৃষকের জীবিকা হুমকির মুখে পড়বে তাতে কোন সন্দেহ নেই।

কোনও কড়া ব্যবস্থা নেওয়া দূরে থাক, ভারত সরকার  এই বিষয়গুলিতে ট্রাম্পের সমালোচনাও করেনি ; শুধু বলেছে যে তারা মার্কিন পদক্ষেপগুলি “পর্যালোচনা করছে” এবং একটি দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তির জন্য আমেরিকার সঙ্গে আলোচনা চলছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে একটি গুরুত্বপূর্ণ মিত্র হিসেবে দেখে।কোয়াড (QUAD)-এর মাধ্যমে (যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, জাপান, অস্ট্রেলিয়া) চীনের প্রভাব মোকাবিলায় সহযোগিতা বাড়ছে। ফলে অন্যদিকে   ভারত-চীন সম্পর্কের টানাপোড়েন এতে বাড়ছে ।

ভারত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে Apache হেলিকপ্টার, P-8I পোসাইডন নৌবিমান, S-400 মিসাইল সিস্টেম ইত্যাদি উন্নত অস্ত্রশস্ত্র ক্রয় করছে । দুই দেশ লজিস্টিক্স এক্সচেঞ্জ অ্যাগ্রিমেন্ট (LEMOA) এবং কমিউনিকেশন কম্প্যাটিবিলিটি অ্যান্ড সিকিউরিটি অ্যাগ্রিমেন্ট (COMCASA)-এর মতো চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এই চুক্তি ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে স্বাক্ষরিত একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরক্ষা চুক্তি, যা দুই দেশের মধ্যে সামরিক যোগাযোগ ও প্রযুক্তি সহযোগিতাকে সুদৃঢ় করে।COMCASA শুধু একটি চুক্তি নয়, এটি ২১শ শতকের ভারত-মার্কিন জোটের রূপান্তরকারী অধ্যায় । ২০১৮ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ভারতের তৎকালীন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী নির্মলা সীতারামন এবং মার্কিন প্রতিরক্ষা সচিব জেমস ম্যাটিস-এর মধ্যে স্বাক্ষরিত হয় এই চুক্তি। যৌথ সামরিক অনুশীলন যেমন, মালাবার নৌ মহড়া, যুদ্ধ মহড়াও  নিয়মিত হচ্ছে। কিছু বিশ্লেষক মনে করেন, এই চুক্তি ভারতের সামরিক স্বাধীনতা সীমিত করতে পারে, কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ডেটা অ্যাক্সেস ও ব্যবহারে শর্ত আরোপ করতে পারে। যেমন, যদি ভারত রাশিয়া বা ইরানের সাথে কোনো যৌথ মহড়া চালায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ডেটা শেয়ারিং বন্ধ করে দিতে পারে। সমর-বিশেষজ্ঞদের মতে এই চুক্তি দেশের সার্বভৌমত্ব ও রাশিয়ার সাথে সম্পর্কের মতো সংবেদনশীল বিষয়গুলিকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিচ্ছে।

যিনি ভারতের ইতিহাস ও রাজনৈতিক-অর্থনীতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল  নয়, ট্রাম্পের কর্মকাণ্ডের প্রতি ভারত সরকারের নরম প্রতিক্রিয়া তার কাছে  রহস্যজনক মনে হতে পারে। অথচ ট্রাম্প বারবারই ভারতকে দু’দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্কের  ক্ষেত্রে “অত্যাধিক  রকমের নিয়মভঙ্গকারী” বলে আখ্যায়িত করে থাকেন।  মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতের সাথে আলোচনার টেবিলে ভারত সম্পর্কে তীব্র সমালোচনামূলক মন্তব্য করতে দ্বিধা করে না । 

সাম্প্রতিককালে ভারতের এই নমনীয়তা বেশী রকমের ব্যতিক্রমী। ভারতের শাসকগোষ্ঠী এই মুহূর্তে অর্থনীতির দিক দিয়ে ও কৌশলগতভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আরও কাছাকাছি আসার চেষ্টা করছে যা এযাবত স্পষ্ট ভারতের বিদেশ-নীতিতে উল্টোরথের টান। ভারতের শাসকশ্রেণি ট্রাম্পের পদক্ষেপের নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে চিন্তিত নয়; বরং তারা মনে করছে, ট্রাম্পের নীতির ফলে ভারত লাভবান হতে পারে, কারণ চীন বা অন্যান্য দেশের তুলনায় ভারতকে কম চাঁদমারি করা হচ্ছে। অ্যাপেলের আইফোনের মতো পণ্য রপ্তানি বাড়ার সম্ভাবনা ও শেয়ার বাজারের উল্লম্ফন নিয়ে ভারতীয় মিডিয়া  আশাবাদ ছড়াচ্ছে।

 “নতুন ভারত“-এর স্বপ্ন ভেঙে যাচ্ছে 

গত কয়েক বছরে ভারতের একটি আত্মবিশ্বাসী, স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতির ছবি তুলে ধরার চেষ্টা করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্কর পশ্চিমাদেশেগুলির শ্রোতাদের সামনে ভারতের স্বার্থ রক্ষায় কঠোর ভাষায় কথা বলেছেন। ভারতকে “বহুপাক্ষিক বিশ্বের উদীয়মান শক্তি” যা NATO-র মতো জোটে যোগ দেবে না এই হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে, জোরের সঙ্গে অর্থনীতিতে “আত্মনির্ভর ভারত” (Atmanirbhar Bharat) এর কথা বলা হয়েছে, রুপিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা হিসেবে প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। ভারতের শিল্পপতি আদানি মার্কিন ধনকুবের জর্জ সোরোস, মার্কিন ইক্যুইটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিন্ডেনবার্গ এবং মার্কিন বিচার বিভাগের সমস্ত আক্রমণ প্রতিহত করে প্রায় অক্ষত অবস্থায় উতরে যান। যুক্তরাষ্ট্রের বারংবার মৌখিক ভর্ৎসনার পরও ভারত রাশিয়া থেকে ব্যাপক হারে তেল আমদানি অব্যাহত রাখে। ভারতের রিজার্ভ ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া (RBI), রুপিতে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের একটি পদ্ধতি চালু করে এবং ২০২১ সালে ঘোষণা করেন : “ভবিষ্যতের দিকে তাকালে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা হিসেবে ভারতীয় রুপি-র উত্থান অনিবার্য”।

আমাদের দেশের মানুষকে জানানো হয়েছিল, সময় এখন ভারতের।  ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল ২০২৩ সালে প্রাধানমন্ত্রী মোদির সাক্ষাৎকার নেয়।  “বিশ্ব রাজনীতিতে ভারতের  ভূমিকা থেকে শুরু করে বিশ্ব- অর্থনীতিতে তার অবদান—এই দেশটির সময় এসে গেছে” এই ছিল সাক্ষাৎকারের  সামগ্রিক বার্তা। কিছুই ভারতের উত্থান থামাতে পারবে না, বলেছিলেন এস. জয়শঙ্কর: “আজ ভারত বিশ্বের মধ্যে তার স্থান নিচ্ছে এবং তা এমন কিছুর জন্য, যার জন্য সমস্ত ভারতীয়র গর্বিত হওয়া উচিত…। এটা খুবই পরিষ্কার, ভারতের উত্থান অপ্রতিরোধ্য।”

ভারতের শীর্ষস্থানীয় পুঁজিপতিরাও একমত হয়েছেন যে, এখন ভারতের সময়। মুকেশ অম্বানি বলেছিলেন, “নতুন ভারতের উত্থান নিয়ে আমি অত্যন্ত আশাবাদী এবং আত্মবিশ্বাসী। আমি দেখতে পাচ্ছি ভারতের আত্মা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি জাগ্রত… একটিই কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়: ভারতের সময় এসে গেছে।”  শিল্পপতি গৌতম আদানিও একমত: “একটি গণতন্ত্রের সময় এসে গেলে তাকে আর কেউ থামাতে পারে না, আর ভারতের সময় এসে গেছে।” শুধু সময় নয়, আনন্দ মাহিন্দ্রা ঘোষণা করলেন, “এটি ভারতের শতক হতে পারে।” মার্কিন পরামর্শদাতা সংস্থা ম্যাকিন্সে নিশ্চিত করে বলেছে, “এটি শুধু ভারতের দশকই নয়, বরং ভারতের শতক হবে।” লন্ডনভিত্তিক সেন্টার ফর ইকনমিক্স অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চ আমাদের জানিয়েছে, শতকের শেষে ভারত হবে “বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনৈতিক সুপারপাওয়ার”—একটি পূর্বাভাস যার সত্যতা যাচাই করা যাবে আজ থেকে ৭৫ বছর পরে।

কিন্তু ২০২৫ সালে ট্রাম্পের পদক্ষেপের মুখে এই দাবিগুলো ধূলিসাৎ হয়ে গেছে।   শেকল পরানো অবস্থায় ভারতীয় অভিবাসীদের, সামরিক বিমানে করে, অপমানজনক দেশান্তরের ভিডিও প্রকাশ করে মার্কিন সীমান্ত পুলিশ। বিদেশমন্ত্রী জয়শঙ্কর এটিকে “স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর” বলে উড়িয়ে দেন। ট্রাম্প BRICS দেশগুলিকে হুমকি দিয়েছেন, ডলারকে চ্যালেঞ্জ করলে ১০০-১৫০% শুল্ক বসানো হবে। জয়শঙ্কর লন্ডনে বলেছেন, “আমাদের ডলারকে প্রতিস্থাপনের কোনও ইচ্ছা নেই।” আবার ভারত মার্কিন পারমাণবিক রিয়্যাক্টর সরবরাহকারীদের দুর্ঘটনার দায়মুক্তি দিয়েছে, আমদানি শুল্ক কমিয়েছে।  ভারত আরেকটি একতরফা ছাড়  ‘গুগল ট্যাক্স’ আমেরিকার জন্য দেয় (গুগল ট্যাক্স একটি অপ্রত্যক্ষ কর, যা মূলত ডিজিটাল অর্থনীতিতে কর্মরত বহুজাতিক কোম্পানিগুলির যেমন গুগল, ফেসবুক, অ্যামাজন ইত্যাদি দ্বারা স্থানীয় দেশে আয়কর ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা রোধ করতে আরোপ করা হয়। এটি ডিজিটাল সার্ভিস ট্যাক্স (DST)বা ইক্যুয়ালাইজেশন লেভি নামেও পরিচিত)। কর ছিল মাত্র ৬ শতাংশ, আর তা আরোপিত হয়েছিল এমন বিদেশি কোম্পানিগুলোর উপর, যাদের ভারতে কোনও প্রত্যক্ষ উপস্থিতি নেই, কিন্তু যাদের ডিজিটাল বিজ্ঞাপন থেকে আয় হয় এবং যাদেরকে ভারতীয় ব্যবসায়ীরা অনলাইন বিজ্ঞাপনের জন্য এক লক্ষ কোটি টাকা (এক ট্রিলিয়ন টাকা) এর বেশি পরিমাণ অর্থ প্রদান করে। এই কর বাতিলের মূল সুবিধাভোগী হল বিশ্বজুড়ে প্রভাবশালী গুগল ও ফেসবুক (মেটা), যারা ভারতের অনলাইন বিজ্ঞাপন বাজারে প্রভাবশালী; বর্তমানে অনলাইন বিজ্ঞাপনই ভারতের বিজ্ঞাপন আয়ের সবচেয়ে বড় অংশ। যুক্তরাষ্ট্র এটিকে “বৈষম্যমূলক কর” বলে মনে করে।  এই ট্যাক্স বাতিল করার ঘটনা কোনও আলোচনার অংশ হিসেবে ঘটেনি, বরং এটি ছিল ভারত সরকারের একতরফা ছাড়—মার্কিন কর্পোরেশনগুলোর জন্য একপ্রকার নিখাদ উপহার।

উল্লেখ করা যেতে পারে যে গুগল ও ফেসবুক ট্রাম্পের উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক পৃষ্ঠপোষক হিসেবে পরিচিত; সেই প্রেক্ষিতে, ট্রাম্পের অনুগতদের প্রতি এমন উপহার ট্রাম্পের মন জয় করারই কৌশল।  কারণ তা সরাসরি ট্রাম্পের সমর্থক কোম্পানিগুলিকে উপকৃত করে।  

ভারতের  কেন্দ্রীয়  সরকারের  মতে, ট্রাম্পের নীতির সুবিধা হলো: 

১.রপ্তানির সুযোগ: চীন ও অন্যান্য প্রতিযোগীদের উপর উচ্চ শুল্কের কারণে ভারতীয় পণ্যের চাহিদা বাড়তে পারে। 

২.বিনিয়োগ বৃদ্ধি: বহুজাতিক কোম্পানিগুলি চীন ছেড়ে ভারতে উৎপাদন শুরু করতে পারে (যেমন অ্যাপল ইতিমধ্যেই আইফোন অ্যাসেম্বলি চীন থেকে ভারতে সরিয়ে নিয়েছে)। 

কিন্তু সমস্যা হলো: 

– মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চায় তার বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে, তাই ভারতকে আরও আমদানি করতে হবে। এর অর্থ ভারতীয় বাজার থেকে স্থানীয় উৎপাদকদের উৎখাত। 

– কৃষি খাতে আমদানি বাড়লে কৃষকদের উপর মারাত্মক প্রভাব পড়বে। 

– চীনের সাথে বাণিজ্য বিঘ্নিত হলে ওষুধশিল্পের মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতে সংকট দেখা দেবে। 

 শ্রেণিগত স্বার্থ 

ভারতের শাসকশ্রেণি ঐতিহাসিকভাবে ব্যবসায়িক ও আমলাতান্ত্রিক স্বার্থে প্রভাবিত। তারা স্বাধীনতার পরও ঔপনিবেশিক কাঠামো ভাঙেনি, জমি সংস্কার বা গণমুখী শিল্পায়ন ঘটেনি। বড় পুঁজিপতিরা প্রায়শই   বিদেশি পুঁজির সাথে সহযোগিতা করে লাভবান হয়েছে, তাদের কৌশল হল মার্কিন জোটের সাথে যুক্ত হয়ে নিজেদের সম্পদ বৃদ্ধি করা, যদিও তা সাধারণ মানুষের জন্য ক্ষতিকর। 

শেষ কথা 

ভারতের শাসকগোষ্ঠীর এই নীতি দেশের জন্য অযৌক্তিক, কিন্তু তাদের শ্রেণিগত স্বার্থে যৌক্তিক। রপ্তানি নির্ভরতা বৃদ্ধির পরিবর্তে ভারতের আসল প্রয়োজন হল কৃষি সংস্কার, মজুরি বৃদ্ধি,  গণ ও পরিবেশমুখী শিল্পায়নের মাধ্যমে  দেশের আভ্যন্তরীণ  বাজারের প্রসার। কিন্তু এই পথে হাঁটার মতো রাজনৈতিক ইচ্ছা বা শ্রেণিশক্তি এখনও ভারতের ক্ষমতায় নেই।তবে আমেরিকা ও ইউরোপীয় দেশগুলি ‘China Plus One’(চীনের বিকল্প নয়, চীনের পাশাপাশি ‘সহনীয় বিকল্প’ তৈরি করা) কৌশল ভারত ও আমেরিকার পারস্পরিক সম্পর্কের নতুন ভিত্তি তৈরি করেছে। এটি কেবল অর্থনৈতিক নয়, বরং কৌশলগত ও প্রযুক্তিনির্ভর অংশীদারিত্বের ক্ষেত্রেও নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছে। ২১শ শতকের দ্বিতীয় দশকে এসে বাণিজ্য, প্রযুক্তি ও ভূরাজনৈতিক পরিসরে ভারত-আমেরিকা সম্পর্ক একটি নতুন মোড় নেয়। এই সম্পর্কের অন্যতম স্তম্ভ হলো আমেরিকার কর্পোরেট পুঁজির ভারত অভিমুখী স্রোত। Apple, Google, Amazon-এর মতো বহুজাতিক কর্পোরেশন এখন ভারতের শ্রমবাজার, উৎপাদন ক্ষমতা ও ক্রমবর্ধমান ডিজিটাল অর্থনীতিতে বিপুল বিনিয়োগ করছে। কিন্তু এই প্রক্রিয়া এক অর্থে ট্রাম্প প্রশাসনের “America First” অর্থনৈতিক দর্শনের সঙ্গে একটি মৌলিক দ্বন্দ্বও সৃষ্টি করে—যেখানে দেশীয় উৎপাদন ও চাকরিকে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। যদিও বাস্তবায়নে এখনও নানা চ্যালেঞ্জ আছে, তবু যুক্তরাষ্ট্রের কর্পোরেট মহল ভারতের উপর আস্থা রাখতে শুরু করেছে। ভবিষ্যতে এই সম্পর্ক বিশ্ব উৎপাদন চেইনের ভারসাম্য পরিবর্তনে মুখ্য ভূমিকা পালন করতে পারে বলে মনে করছে অর্থনৈতিক মহল।একাধিক প্রাকৃতিক সম্পদের ভান্ডার, বিপুল সস্তা শ্রমশক্তি, দ্রুত বর্ধনশীল মধ্যবিত্ত বাজার, তরুণ জনসংখ্যা ও ডিজিটাল সক্ষমতা—সবকটিই ভারতকে কর্পোরেটদের পছন্দের তালিকায় এগিয়ে রাখছে।প্রসঙ্গত বলা যায় আগামীদিনের বিদ্যুৎ  শক্তি উৎপাদনের প্রধান উৎস ‘বিরল মৃত্তিকা মৌল’-এর আকরিকে ভারত যথেষ্ট সমৃদ্ধ(চীন ও ব্রাজিলের পর তৃতীয় স্থানে)। এই  প্রেক্ষাপটে ভারতও নিজেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিকল্প হিসেবে তুলে ধরছে।ঘটনা পরম্পরাগতভাবে স্পষ্ট হচ্ছে যে পুঁজি বিনিয়োগ কেন্দ্রের আমেরিকা থেকে দেশান্তরী যাত্রা  পুঁজিবাদের ‘নিয়তি-নির্দ্দিষ্ট’। প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালে যেমন তা ইংল্যান্ড থেকে আমেরিকায় সরে গিয়েছিল, এখন তা চীন অভিসারী। এখানেই ভারতের অংশীদারত্বের আকাঙ্ক্ষা। যুক্তরাষ্ট্রের চীন+১ নীতি তার সহায়ক। আশা বা আশঙ্কা যাই বলা হোক না কেন একথা নিশ্চিত যে শ্রম আইন,  খণিজ আইন, বন আইন, জীববৈচিত্র্য আইন ও একাধিক পরিবেশ আইনের পরিবর্তন এই কারণে যাতে সংবিধানের আওতার মধ্যেই চুড়ান্তভাবে  শ্রম ও পরিবেশ শোষনের ফ্যাসিস্ট কায়দা রাষ্ট্র কর্পোরেট স্বার্থে চালাতে পারে।এর অতিরিক্ত জনতার ক্ষোভ-বিক্ষোভ সামাল দেওয়ার জন্য রইল রাষ্ট্র অনুসারী দল ও তার সামাজিক ও দার্শনিক উপাঙ্গগুলি। সর্বোপরি রইল হরেক কিসিমের বিভাজনের মতাদর্শ ও সামাজিক সম্মতি আদায়ের লক্ষ্যে কর্পোরেট নিয়ন্ত্রিত অক্লান্ত গণমাধ্যমগুলি।  কর্পোরেট আদানি-আম্বানি গোষ্ঠীর “ভারতের সময় এসে গেছে” ঘোষণা ‘সুপার প্রফিট’এর পুতিগন্ধময় একথা তো স্পষ্টই। আমজনতাকে চূড়ান্ত শোষনের এই কর্পোরেট আয়োজনে দেশীয় শরিকরা ‘ছোট বটে তবু তোমার জগতে’ আমাদেরও লাভ আছে বলে নেমে পড়ার জন্য প্রস্তুত।   যুদ্ধ, সন্ত্রাসবাদ পাকিয়ে তুলে আমেরিকা ও প্রধানত পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলো পুঁজির এই দেশান্তর আটকানোর চেষ্টা করছে। এই চেষ্টার ব্যর্থতাও ‘নিয়তি নির্দ্দিষ্ট’।তবে অবাধ প্রকৃতি লুন্ঠন, চূড়ান্ত শ্রম-শোষন আর কর্পোরেট সুপার প্রফিটের ত্রহ্যস্পর্শযোগে দেশের মানুষের কষ্ট বাড়বে বৈ কমবে না (উবের, সুইগি, জোমাটো ইত্যাদি তুলনীয়)। শ্রম ও প্রকৃতি শোষণের  এক ভয়ংকর আসন্ন আগামীর বিরুদ্ধে দেশে-দেশে নারী আন্দোলন, পরিবেশ আন্দোলন, লিঙ্গ সমতার আন্দোলন, বর্ণবিদ্বেষ বিরোধী আন্দোলন, আদিবাসী আন্দোলন ইত্যাদি  গড়ে উঠছে। কৃষক-শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধতা গড়ে উঠছে এইসব আন্দোলনের। বিভিন্ন দেশে সমাজতান্ত্রিক দিশায় পরিচালিত সরকার দেশ পরিচালনার দায়িত্বে ফিরছে। যোগাযোগের মাধ্যমগুলির ব্যবহারের সুযোগে আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী ঐক্য গড়ে উঠছে। আশ্বাস এখানেই।

সৌজন্য: রিসার্চ ইউনিট ফর পলিটিক্যাল ইকোনমি (RUPE)।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top