প্রীতিলতা বিশ্বাস
পরমাণু কার্যক্রম নিয়ে ইরান ও আমেরিকার মধ্যে আলোচনা চলাকালীন অবস্থাতেই ইজরায়েল ১৩ই জুন একতরফা ইরানের পরমানু কেন্দ্রের উপর হামলা চালায়। ইরানের সেনাপ্রধান ও প্রথম সারির একজন পরমাণুবিজ্ঞানী মারা যান। ইরানও এর জবাব দিতে কালক্ষেপ করেনি। বর্তমানে পূর্ণমাত্রার একটি যুদ্ধ চলছে ইরান ও ইজরায়েলের মধ্যে। ইজরায়েল ভীষণ চেষ্টা করছে আমেরিকাকে এই যুদ্ধের মধ্যে সরাসরি টেনে আনার। ট্রাম্প, ইরানকে হুমকি-ধমকি এবং ইজরায়েলকে প্রচ্ছন্ন মদতের মধ্যেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রেখেছিল প্রায় আট/নয় দিন। কিন্তু দশতম দিনে সরাসরি ইরানের তিনটি পরমাণু-কেন্দ্রে আঘাত হেনেছে আমেরিকা।
জি-৭ সামিট থেকে ট্রাম্প তড়িঘড়ি ফিরেছেন, তবে ফেরার আগে জি-৮ বা জি-৯ হয়ে ওঠার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছেন। আসলে ২০১৪ সালে জি-৮ থেকে রাশিয়াকে বাদ দেওয়া হয়। আজ রাশিয়া এবং চীন অনেক কাছাকাছি। ২০০৮র আর্থিক মন্দার পরে ২০০৯-য়ে তৈরি হওয়া ব্রিক্স ক্রমশ: জাল বিস্তার করছে মধ্যপ্রাচ্যে। এতখানি মাথাব্যথার মধ্যে আবার ট্রাম্প একটু নিঃসঙ্গতা বোধ করছেন। কারণ জি-৭ এর বাকি সদস্যরা এখনি কেউ যুদ্ধে নামতে রাজি নয়। ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধটা লাগিয়ে দিয়ে আমেরিকা এমনিতেই দেশগুলোকে রাশিয়ার জ্বালানী তেলের যোগান থেকে বঞ্চিত করেছে। আবার বেশি দামে নিজের তেল বিক্রিও করে ওদের। তাসত্ত্বেও সদস্য দেশগুলো বিবৃতির মাধ্যমে নিজেদের দ্বিচারিতাকে সুন্দর করে তুলে ধরেছে। গাজার পঞ্চাশ হাজারের বেশি মানুষ, যার প্রায় অর্ধেক শিশুক, তাদের হত্যা করাটা ছিল ইজরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার! এখন আগবাড়িয়ে ইরানকে আক্রমণ করাটাও নাকি তার আত্মরক্ষার অধিকার!
প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ছিল সরাসরি উপনিবেশ দখলের লড়াই। তখন রাষ্ট্রের শাসক ও মিলিটারির হাতে ধরা থাকত দড়ি টানাটানির দড়িটা। এখন ইলন মাস্ক আর ট্রাম্পের সোস্যাল মিডিয়ার বাক-বিতন্ডাই বলে দেয় দড়িটা আসলে কারা টান দিচ্ছে। এখনও আমেরিকার অস্ত্র-ব্যবসায়ীদের লবি যুদ্ধ করতে চায় আমেরিকার করদাতাদের টাকা আত্মসাৎ করে। আর এই অস্ত্র-লবির উপর নেতানিয়াহুর যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। কিন্তু আমেরিকা এবং পশ্চিমাদেশগুলোর সাধারণ মানুষ যুদ্ধের বিরুদ্ধে লাগাতার রাস্তায় নেমেছে গত দু’বছর ধরেই, এখনও তারা রাস্তায়ই।
ইজরায়েল হল আমেরিকা আর বৃটেনের এক অবৈধ সন্তান যাকে মধ্যপ্রাচ্যে জন্ম দেওয়া হয়েছে সারা পৃথিবীর প্রায় ৪০-৪৫ শতাংশ তেলের ভান্ডারের উপর কর্তৃত্ব রাখার জন্য। সৌদি আরবের সঙ্গে পেট্রো-ডলার চুক্তির মারফত আমেরিকা একটা সময় সারা বিশ্বের উপরেই নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে। বিংশ শতকের শুরুতে মধ্যপ্রাচ্যে আরব জনগণের মধ্যে ঐক্য ও স্বায়ত্ত্বশাসনের আকাঙ্ক্ষা থেকে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন সংগঠিত হয়, যা আরব জাতীয়তাবাদ নামে পরিচিত। ইজরায়েল রাষ্ট্রের জন্ম ও প্যালেস্টাইন সমস্যা ধর্মনিরপেক্ষ আরব জাতীয়তাবাদকে ইসলামিক জাতীয়তাবাদে পরিণত করে। সদ্য স্বাধীন হওয়া রাষ্ট্রগুলিকে রাশিয়ার প্রভাব থেকে দূরে রাখতে এবং অস্থিতিশীলতাকে স্থায়ী রূপ দিতে আমেরিকা এবং ইজরায়েল মিলে বিভিন্ন সন্ত্রাসী উগ্রপন্থী দলের জন্ম দেয় মধ্যপ্রাচ্যে, যা আমেরিকা-ইউরোপের অস্ত্র ব্যবসাকে শক্তিশালী করে। এরপরেও সাতটি দেশের কোথাও সার্বভৌমত্বকে ভাঙতে বা কোথাও প্রাকৃতিক সম্পদ লুঠের জন্য জনগণের সরকার ভেঙে নিজেদের পছন্দ মতো লোক বসানোর পরিকল্পনা হয়। সাদ্দাম, গদ্দাফি যার বলি হন। এরমধ্যে সপ্তম দেশটি হল ইরান। এবার ইরানের পালা এসেছে।
পাহাড় দিয়ে ঘেরা ইরানের ভৌগোলিক অবস্থান এমনই যে এটি পূর্ব-পশ্চিম এবং উত্তর-দক্ষিণকে সংযুক্ত করে, সাতটি দেশের সঙ্গে সীমানা ভাগ করে। কাস্পিয়ান সাগর দিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে যুক্ত। ইরানের নিয়ন্ত্রণে থাকা গাল্ফ উপসাগরের প্রাণকেন্দ্র হরমুজ প্রণালী দিয়ে সারা বিশ্বের প্রতিদিনের জ্বালানী তেলের ২০ শতাংশ পরিবাহিত হয়। এটি বিশ্বের অর্থনৈতিক ধমনীর মতো। আমেরিকার হামলার পর প্রত্যুত্তর হিসাবে ইরান তা বন্ধ করে দিতে চাইছে। ইরান, চীনের তেলের প্রধান যোগানদার। ইরানকে হাতের মুঠোয় আনা গেলে ইয়েমেনের হুতি, হিজবুল্লাহ, হামাস এদেরও নিয়ন্ত্রণে এনে ফেলা সম্ভব। হুতি নিয়ন্ত্রণে আসলে রেড-সি এবং সুয়েজ ক্যানেল দিয়ে বাণিজ্য অনেক সহজ হবে। অর্থাৎ ইরানকে কব্জা করতে পারলে মধ্যপ্রাচ্যের ব-কলম সাম্রাজ্যটা ভালো ভাবে গোছানো হয়। চীন-রাশিয়ার ব্রিক্স সম্প্রসারণকেও আটকানো সম্ভব হয়। এরকম একটি অঞ্চলে আমেরিকার আধিপত্য প্রতিষ্ঠা হলে তা চীন-রাশিয়ার জন্যও একেবারে সুবিধাজনক হবে না। চীন-রাশিয়া তাই পক্ষ নিতে বাধ্য হয়েছে।
ইরান কী করে লড়ছে? ইরান বিগত চল্লিশ বছর ধরে আমেরিকা ও পশ্চিম ইউরোপের নিষেধাজ্ঞার মধ্যে একটু একটু করে নিজেকে গড়ে তুলেছে। ইরানে শিক্ষার হার ৯০ শতাংশ। মেয়েরা শিক্ষার হারে সামান্য হলেও এগিয়ে আছে। রিসার্চ এন্ড ডেভালপমেন্টে চলতি বছরের বাজেট জিডিপির ৪ শতাংশ, যা আমেরিকা এবং চীনের থেকে বেশি। খাদ্য উৎপাদনে প্রায় স্বনির্ভর। প্রায় ২৫০০ বছরের একটি লিখিত ইতিহাস আছে ইরানের। শিল্প, সাহিত্য সংস্কৃতি মানুষের মধ্যে একটি স্বাভাবিক বন্ধন গড়ে তোলে। সমস্যা আছে। বামপন্থী মুক্তচিন্তার মানুষরা হয় মৃত্যুদন্ড পেয়েছে নয়তো দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। ইরাক, আফগানিস্তানের যুদ্ধে গৃহহীন অনেক মানুষ আশ্রয় পেয়েছে ইরানে, মোসাদ যাদের ফাঁদে ফেলে কাজে লাগায়। তাদেরই কয়েকজনের ফাঁসি হয়েছে ইজরায়েল আক্রমণ করার দুদিনের মধ্যে। আর ইরানের নারীদের হিজাব-বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে বোধহয় পশ্চিমা মিডিয়ার দৌলতে আমরা সকলেই পরিচিত। তবুও ইসলামিক জাতীয়তাবাদ দেশটিতে আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী একটি জনমত গড়ে তুলতে পেরেছে। ইরান এই যুদ্ধ শুধু নিজের জন্য লড়ছে না। ইরান লড়ছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে সমগ্র মুসলিম সমাজের সঙ্গে হওয়া অন্যায়ের বিরুদ্ধে, লড়ছে গাজায় মৃত প্রতিটি শিশুর জন্য। বিপুল জনসমর্থনের সঙ্গে ইরানের মিসাইল গবেষণা, চীনের অস্ত্র এবং রাশিয়ার প্রযুক্তি-সাহায্য এই যুদ্ধের অন্যতম হাতিয়ার। চীন যে আমেরিকা বা পশ্চিম ইউরোপের থেকে উন্নত মিসাইল বানাতে সক্ষম হয়েছে তার প্রমাণ ইজরায়েলের এফ৩৫ এবং ভারতের রাফাল ভূপতিত হওয়া। অস্ত্রের বাজারে চীনের উত্থান দেখিয়ে দেয় বৃহৎ শক্তি হিসাবে তার বিকশিত হওয়া শুধু সময়ের অপেক্ষা।
এই চীনকে আটকাতে মরিয়া আমেরিকা। মরিয়া আরও একটি কারণে। আগামীদিনের জ্বালানী হতে চলা বিরল খনিজের মজুত ভান্ডার হিসাবে চীন আছে সবার উপরে। আর ব্রিক্সের সদস্য দেশগুলির সুবাদে বিশ্বের প্রায় ৭০ শতাংশ বিরল খনিজের উপর চীনের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। তাই চীনকে আটকাতে যেমন ইরানে আধিপত্য বিস্তার করা দরকার তেমনি মায়ানমার, বাংলাদেশের চট্টগ্রাম, ভারতের সেভেন সিস্টারস দিয়ে চীনকে ঘেরাটা দরকার। সেই লক্ষ্যে কাজও এগোচ্ছে। চীনও বেল্ট এন্ড রোড ইনিসিয়েটিভ নিয়ে বিকল্প বাণিজ্য পথ নির্মাণ করছে। আমেরিকার নিয়ন্ত্রণ থাকা মালাক্কা প্রণালীকে এড়ানোর জন্য রাখাইন এবং হাম্বানটোটা বন্দরকে বিকল্প হিসাবে ভাবছে। অর্থাৎ প্রকৃত লড়াইটা আমেরিকা আর চীনের ভিতরে। তাহলে ইজরায়েল কেন হঠাৎ ইরানের উপর ঝাঁপাতে গেল?
সেটা বোঝার জন্য মধ্যপ্রাচ্যে ট্রাম্পের শেষ পরিক্রমণটা যদি দেখি তাহলে দেখব ট্রাম্প মধ্যপ্রাচ্যে কয়েকদিন ধরে ঘুরে বেড়ালেন কিন্তু নেতিনেয়াহুর সঙ্গে দেখা পর্যন্ত করলেন না। ইরানের সঙ্গে পরমাণু কার্যক্রম নিয়ে কথা-বার্তা এগোচ্ছিল। আমেরিকার ডিএনআই তুলসী গ্যাবার্ড বলেও দেন যে ইরান এখনও পরমাণু বোমা তৈরি থেকে অনেকটা দূরে। যদি এই ডিলটা হয়েই যেত তাহলে এমন হতেই পারত যে, ইজরায়েলকে আমেরিকার আর বিশেষ প্রয়োজন হত না মধ্যপ্রাচ্য সামলানোর জন্য। তখন মধ্যপ্রাচ্য ইজরায়েলের জন্য মোটেই আর নিরাপদ থাকবে না। আর খনিজ তেলের উপর নির্ভরতা গোটা বিশ্বকেই ক্রমশ কমিয়ে আনতে হবে। বরং মধ্যপ্রাচ্যকে আগামীদিনে ভালো ডোমেস্টিক বাজার হিসাবে দেখা যেতে পারে। তখন অস্ত্র ব্যবসার কেন্দ্রটা ঘুরে আসবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দিকে। অস্ত্র ব্যবসা মানে অস্ত্রের প্রয়োগ। ভেবে দেখলে প্রায় ৭০-৭৫ বছর ধরে পুঁজিবাদের অভিশাপটা মধ্যপ্রাচ্যের মানুষ বুক পেতে নিচ্ছে। এরপর হয়তো আমাদের পালা আসবে।
পৃথিবীর ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে পুঁজি সব সময় তার কেন্দ্র বদল করেছে। লাতিন আমেরিকা থেকে লুঠ করা স্পেনের সোনা বাণিজ্যের মাধ্যমে একটা সময় চলে গেছে ফ্রান্স আর বৃটেনে। ফ্রান্সে হয়েছে বুর্জোয়া বিপ্লব, বৃটেনে হয়েছে শিল্প বিপ্লব। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদের বিরোধকে কাজে লাগিয়ে বিপ্লব হয়েছে রাশিয়ায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্বের পর পুঁজি বৃটেন থেকে কেন্দ্র পরিবর্তন করে গেছে আমেরিকায়, এই পরিবর্তনপর্বকে কাজে লাগিয়ে বিপ্লব হয়েছে চীনে। এখন আবার একটা পরিবর্তন হতে চলেছে। চীন নতুন কেন্দ্র হিসাবে উঠে আসছে। ব্রিক্স তার নিজস্ব মুদ্রা চালু করার পথে। শক্তিশালী হবে ব্রিক্সভুক্ত সকল দেশের মুদ্রামান। ডলার পড়বে। আমেরিকার সেনেটের এক অংশের বিরোধিতা সত্ত্বেও ইজরায়েল সফল হয়েছে আমেরিকাকে যুদ্ধের ময়দানে সরাসরি টেনে আনতে। হয়তো বিশ্ব একটি দীর্ঘ এবং সর্বনাশা যুদ্ধের দিকেই এগোচ্ছে।
তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির রাজনৈতিক গতিপথ তাহলে কী হতে পারে বা হওয়া সম্ভব? পুঁজির গভীর সঙ্কট আমেরিকা, ইউরোপ এবং ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনীতির গতিপথে একধরনের ফ্যাসিবাদী প্রবণতার জন্ম দিয়েছে। এই ফ্যাসিবাদী প্রবণতাটা আগের ধ্রুপদী ফ্যাসিবাদ থেকে ভীষণ আলাদা। আমাদের দেশে দলিত, আদিবাসী ও শ্রমজীবী মুসলিম মানুষ অত্যাচারের নিশানায় যেখানে উচ্চবিত্ত মুসলিমের সঙ্গে হিন্দু বিজেপি নেতাদের সন্তানদের বৈবাহিক সম্পর্কও মঞ্জুর হয়ে যায়। ইউরোপ-আমেরিকায় শ্রমজীবী অভিবাসীর উপর আঘাত নেমে আসে কিন্তু হোয়াইট কলার ইন্টেলিজেন্ট অভিবাসী নিরাপদে থাকে। কারণ ইন্টেলিজেন্স এখন পুঁজি বৃদ্ধির হাতিয়ার। এই সব কিছু থেকে যে চিত্রটা পরিষ্কার হচ্ছে তা হল সারা দুনিয়ার শ্রমজীবী মানুষ বিপজ্জনক অবস্থায় আছে। আসলে প্রযুক্তির বিকাশ এমন এক পর্যায়ে চলে গেছে যে, এখন উৎপাদিকা শক্তির সামাজিক হয়ে ওঠার জন্য প্রয়োজন শুধু বিপ্লবী কবি সুকান্তর ছোট্ট একটা ‘দেশলাই কাঠি’। আমরা যদি প্রত্যেকে এক একটি দেশলাই কাঠি হয়ে এক সঙ্গে জ্বলে উঠতে পারি তবে পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের ধ্বংস অনিবার্য। আর এই দেশলাই কাঠি তৈরির পদ্ধতিটা বলে গেছেন মার্কস-এঙ্গেলস। কারিগরদের এগিয়ে আসতে হবে, আজকের প্রাসঙ্গিকতায় পদ্ধতিটাকে নতুন করে ভাবতে হবে, কাজে নামতে হবে, না হলে আগামীদিনে অশান্ত হয়ে উঠবে এই ভারতীয় উপমহাদেশ।
একটি দেশ আরেকটি দেশের সাথে সীমানা “ভাগ” করে কী করে??? বাংলাটা একটু ঠিক করে লিখুন আগে …