বঙ্কিম দত্ত
ভূমিকা
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম ছিল গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ ও সামাজিক ন্যায়বিচারের আদর্শে উদ্বুদ্ধ এক দীর্ঘ লড়াই। এই সংগ্রামের অভিজ্ঞতা থেকেই গড়ে ওঠে ভারতের সংবিধান, যা ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ নির্বিশেষে নাগরিকের সমান অধিকার, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রনীতি এবং সমাজকল্যাণমূলক লক্ষ্যকে প্রতিষ্ঠিত করে। বিশ্বের অন্যতম দীর্ঘ লিখিত সংবিধান এদেশের, যার প্রস্তাবনা, অংশ (Parts), অধ্যায় (Articles) ও সূচি (Schedules) মিলিয়ে বিস্তৃত কাঠামো। We, the People of India… দিয়ে শুরু, জনগণের সার্বভৌমক্ষমতা যার লক্ষ্য। লক্ষ্য ন্যায়–সাম্য–স্বাধীনতা–ভ্রাতৃত্ব । রাষ্ট্রের স্বরূপ: Sovereign, Socialist, Secular, Democratic, Republic. সমতার অধিকার (আর্ট. 14–18), স্বাধীনতার অধিকার (আর্ট. 19–22), শোষণের বিরুদ্ধে (23–24), ধর্মীয় স্বাধীনতা (25–28), সাংস্কৃতিক–শিক্ষাগত অধিকার (29–30), সংবিধানিক প্রতিকার (32)— এই মৌলিক অধিকারগুলো সংবিধানে রয়েছে যাকে আম্বেদকর “সংবিধানের আত্মা” বলেছেন।
কিন্তু সংবিধানের এই দৃষ্টিভঙ্গি শুরু থেকেই অসুবিধায় ফেলেছে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আর.এস.এস)-কে, কারণ তাদের মূল আদর্শ হিন্দু জাতীয়তাবাদ, যাকে তারা “হিন্দু রাষ্ট্র” ধারণার মাধ্যমে প্রকাশ করে। ফলে ভারতীয় সংবিধান ও আর.এস.এস.-এর সম্পর্ক এক দীর্ঘ অস্বস্তি, দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের ইতিহাস বহন করে।সংবিধান বিষয়ে আর. এস. এস.-এর অস্বস্তির সবচেয়ে প্রকট দিকের একটি হলো তাদের মনুস্মৃতি-র প্রতি শ্রদ্ধা। আর. এস. এস.-এর মুখপত্র অর্গানাইজার (৩০ নভেম্বর, ১৯৪৯) এক সম্পাদকীয়তে লিখেছিল যে, ভারতবর্ষের কাছে যখন প্রাচীন আইনগ্রন্থ হিসাবে মনুস্মৃতি বিদ্যমান, তখন সংবিধান প্রণেতারা কেন পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলির সংবিধান অনুকরণ করলেন? এর সম্পূর্ণ বিপরীতে আম্বেদকর ১৯২৭ সালে প্রকাশ্যে মনুস্মৃতি দাহ করেন, কারণ তাঁর কাছে এটি জাতপাত নিপীড়নের প্রতীক। এই বৈপরীত্য কেবল মতাদর্শগত বিভেদ নয়, বরং সমতা-ভিত্তিক গণতন্ত্র এবং শ্রেণি-বিন্যস্ত ঐতিহ্যবাদ((hierarchical traditionalism)—এই দুই সভ্যতাগত শক্তির মধ্যে সংঘাতকে প্রতিফলিত করে। আর.এস.এস.-এর আদর্শে শ্রেণিবিন্যস্ত ঐতিহ্যবাদ প্রধানত তিনভাবে প্রকাশিত:
১. জাতিভিত্তিক বিভাজন ও মনুস্মৃতি-নির্ভর নৈতিকতা ২. হিন্দু সাংস্কৃতিক আধিপত্যের প্রচার ৩. পুরুষতান্ত্রিক মূল্যবোধের পুনরুজ্জীবন।
আর এস এস-এর অবস্থান হলো জাতিভিত্তিক শ্রেণি-ব্যবস্থার প্রতি আসক্তি। আর.এস.এস. “হিন্দু জাতি” ধারণাকে কেন্দ্রে রেখেছে, যা ভারতের বৈচিত্র্যময় জাতিগত, ভাষাগত ও ধর্মীয় বাস্তবতার সঙ্গে সংঘর্ষপূর্ণ। এই হিন্দুত্ববাদ মূলত ব্রাহ্মণ্যবাদী সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের আধিপত্যকে স্বাভাবিক বলে ধরে নেয়। এর ফলে মুসলমান, খ্রিস্টান, এবং দলিত-আদিবাসী সংস্কৃতি সবই প্রান্তিক হয়ে পড়ে। এটি শ্রেণিবিন্যস্ত ঐতিহ্যবাদের সাংস্কৃতিক রূপ। আর.এস.এস.-এর ভাবনায় “গৃহিণী” এবং “জননী”- নারীর আদর্শ ভূমিকা। নারীর স্বাধীনতা, সমানাধিকার বা লিঙ্গ-নিরপেক্ষ অধিকারকে তারা পাশ্চাত্য প্রভাব বলে ছোট করে। তাদের এই লিঙ্গভিত্তিক শ্রেণিবিন্যাসে সমাজে নারীর অধীনতা স্বাভাবিক হিসাবে গ্রাহ্য।
ভারতীয় সংবিধান ধর্মনিরপেক্ষতা, সাম্য, বৈষম্যবিরোধ এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের আদর্শে গঠিত। আর.এস.এস.-এর চিন্তাধারায় এই আধুনিকতাকে বিরক্তিকর এবং তা “প্রাচীন শাস্ত্রসম্মত সমাজ” ফেরত আনার স্বপ্ন লালন করে। এসবের অর্থ হলো সমতার গণতন্ত্র বনাম শ্রেণিবিন্যস্ত ঐতিহ্যবাদ—এই দ্বন্দ্ব আজও সক্রিয়।
সংবিধানের দর্শন বনাম আর.এস.এস-এর আদর্শ
সংবিধান প্রণেতাদের দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্টতই বহুত্ববাদী ও অন্তর্ভুক্তিমূলক। বি.আর. আম্বেদকর, জওহরলাল নেহেরু, মৌলানা আজাদ, রাজেন্দ্র প্রসাদ প্রমুখ নেতারা রাষ্ট্রকে একাধারে গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ এবং সমাজতান্ত্রিক চরিত্র দেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু আর.এস.এস., যার আদর্শ গ্রন্থ এম.এস. গোলওয়ালকরের “We, or Our Nationhood Defined” (১৯৩৯)-এ যেভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, তা মুসলমান ও খ্রিস্টানদের প্রতি তীব্র অবিশ্বাসে ভরা। গোলওয়ালকার মতে, ভারতবর্ষে “হিন্দু” ছাড়া অন্য কোনো জাতি রাষ্ট্রগঠনের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ভূমিকায় থাকতে পারে না।
অতএব, সংবিধান যেখানে নাগরিকত্বকে ধর্মনিরপেক্ষ ভিত্তিতে সংজ্ঞায়িত করে, আর.এস.এস.-এর মতাদর্শ সেখানে একচেটিয়া হিন্দু জাতীয়তার ভিত্তিতে রাষ্ট্রচর্চা করতে চায়।
আর.এস.এস. ও সংবিধান রচনায় বিরোধী অবস্থান
১৯৪৯ সালে যখন ভারতীয় সংবিধান কার্যকর হয়, তখন থেকেই আর.এস.এস. তার সমালোচনায় সরব হয়। গোলওয়ালকর ও তার উত্তরসূরিরা দাবি করেন যে ভারতীয় সংবিধান “বিদেশি” (পশ্চিমি) ধারণা থেকে ধার করা, এতে ভারতীয় সংস্কৃতির মৌলিক চেতনা প্রতিফলিত হয়নি। তাদের মতে, প্রকৃত সংবিধান হওয়া উচিত ছিল মনুস্মৃতি-র উপর ভিত্তি করে।
আর.এস.এস.-এর প্রচারযন্ত্র (প্রচারক, শাখা শিক্ষা, পুস্তিকা) বারবার দাবি করেছে যে বর্তমান সংবিধান হিন্দু সমাজের ঐতিহ্যকে যথাযথ গুরুত্ব দেয়নি। এই অবস্থান থেকেই তারা ধারাবাহিকভাবে সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ বৈশিষ্ট্যের বিরুদ্ধে “hatred campaign” চালায়।
‘Hatred Campaign’ এবং সংবিধান
আর.এস.এস.-এর কার্যকলাপ লক্ষ্য করলে দেখা যায়, তাদের ঘৃণার রাজনীতি মূলত দুটি দিকে কাজ করে:
১. সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়ানো – মুসলমানদের ‘বিদেশি’, ‘অবিশ্বস্ত’ প্রমাণ করার চেষ্টা, খ্রিস্টান মিশনারিদের প্রতি সন্দেহ সৃষ্টি। উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশসহ বিভিন্ন রাজ্যে আন্তঃধর্মীয় বিবাহ নিয়ন্ত্রণের নামে মুসলিম সম্প্রদায়ের উপর আক্রমণ, মব লিঞ্চিং ও গোরক্ষা রাজনীতি ও খিষ্ট্রান ধর্মপ্রচারকদের উপর আক্রমণ দেখা যাচ্ছে।
২. সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র আক্রমণ করা – সংবিধান যে সকল ধর্মকে সমান মর্যাদা দিয়েছে, সেটিকে “অতিরিক্ত তোষণনীতি” বলে তুলে ধরা। আরএসএস প্রচার করে যে এই বিশেষাধিকার সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের “অধিকার হ্রাস করছে”।
ধর্মনিরপেক্ষতার বিরুদ্ধে প্রচারকার্যে “Secular” শব্দটিকে আরএসএস “অপশব্দ” হিসেবে চিত্রিত করে, এবং দাবি করে যে এটি “পাশ্চাত্য ষড়যন্ত্র।”
বাবরি মসজিদ ভাঙা থেকে শুরু করে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (CAA) ও জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (NRC) পর্যন্ত আর.এস.এস. ও তাদের সহযোগী সংগঠনগুলি স্পষ্টভাবে দেখিয়েছে যে তারা সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতা ও নাগরিক সমতার ধারণার সঙ্গে বিরোধে রয়েছে।
সমাজতান্ত্রিক ধারনার সঙ্গে আর.এস.এস.-এর বিরোধ
সংবিধানের প্রস্তাবনায় ১৯৭৬ সালে ‘সমাজতান্ত্রিক’ শব্দ যুক্ত করা হয়, যা রাষ্ট্রকে সামাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারের পথে চালিত করার প্রতিশ্রুতি বহন করে। সমাজতান্ত্রিক দর্শন রাষ্ট্রের দায়িত্বকে কেন্দ্র করে জনকল্যাণ, সমবণ্টন, শ্রমিক-কৃষকের অধিকার রক্ষা এবং ধনতান্ত্রিক বৈষম্য হ্রাসের দিকে দৃষ্টি দেয়।আলাদাভাবে উল্লেখিত হওয়ার(১৯৭৬) আগে থেকেই ভারতীয় সংবিধান (১৯৫০) গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতান্ত্রিক ন্যায়বিচার ও প্রজাতন্ত্রের মূলনীতিকে ধারণ করে।
কিন্তু আর.এস.এস.-এর দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন। তারা একদিকে রাষ্ট্রকে বাজারমুখী অর্থনীতির পক্ষে উন্মুক্ত করতে চায় (বিশেষত ১৯৯০-এর পর থেকে), অন্যদিকে সমাজতান্ত্রিক নীতি যেমন জমি সংস্কার, শ্রমিক সংগঠন, রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প ইত্যাদির বিরোধিতা করেছে। তাদের মতে, সমাজতন্ত্র “পাশ্চাত্য” ধারণা এবং ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে বেমানান।
এছাড়া, সমাজতান্ত্রিক দর্শন যখন বর্ণব্যবস্থাকে প্রশ্ন করে এবং শ্রেণি-সমতার দাবি তোলে, তখন আর.এস.এস. তার ঐতিহ্যবাদী অবস্থান থেকে স্পষ্টতই অস্বস্তিতে পড়ে। মনুস্মৃতি-র মতো শাস্ত্রে যেভাবে বর্ণভিত্তিক কর্তব্য নির্ধারিত হয়েছে, আর.এস.এস. তার সাংস্কৃতিক পরিসরে সেই ঐতিহ্যকে রক্ষা করতে চায়। ফলে সমতা-ভিত্তিক সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ভাবনার সঙ্গে তাদের মতাদর্শগত সংঘাত অবশ্যম্ভাবী।
উপসংহার
ভারতীয় সংবিধান কেবল একটি আইনপত্র নয়, এটি হলো স্বাধীনতা সংগ্রামের স্বপ্ন ও প্রতিশ্রুতির প্রতিফলন। এর মূল চেতনা গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতান্ত্রিক ন্যায়ের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। আর.এস.এস. এই দর্শনের সঙ্গে মৌলিকভাবে বিরোধী অবস্থানে রয়েছে, কারণ তাদের লক্ষ্য হলো একটি সাংস্কৃতিকভাবে সমজাতীয় হিন্দু রাষ্ট্র গঠন।
তাদের hatred campaign কেবল সংখ্যালঘুদের প্রতি নয়, সংবিধানের মূল দর্শনের প্রতিও। বিশেষত সমাজতান্ত্রিক ন্যায়ের ধারণা, যা শোষণহীন সমাজের স্বপ্ন বহন করে, তা আর.এস.এস.-এর ঐতিহ্যবাদী, বর্ণনির্ভর এবং বাজারপন্থী আদর্শের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে আসে।
বিজেপি ও তার আদর্শগত ভিত্তি আর.এস.এস একদিকে রাষ্ট্রকে ‘হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তাবাদ’-এর কাঠামোয় ঢেলে সাজাতে চাইছে, অন্যদিকে সমাজতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ মূল্যবোধকে ধীরে ধীরে দুর্বল করছে।
অতএব বলা যায়, ভারতীয় সংবিধানের ইতিহাস যতদিন থাকবে, ততদিন আর.এস.এস.-এর অস্বস্তি ও বিরোধও রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আলোচনার কেন্দ্রে থেকে যাবে।
পুনশ্চ : বিশ্ব-রাজনীতি ও অর্থনীতিতে আরএসএস-বিজেপি প্রাসঙ্গিক থাকার প্রয়োজনে উভয়ের হিন্দুত্ববাাদী অবস্থান পারস্পরিক দোষারোপে জড়িয়ে যাচ্ছে এই লক্ষণ মাঝে মধ্যেই দেখা যাচ্ছে।
আরও পড়ুন: আরএসএস বনাম সংবিধান





