মৃদুলা মুখার্জি
সংগঠন হিসেবে RSS ১৯২৫-১৯৪৭ সালের পুরো সময়কালে ব্রিটিশবিরোধী কোনো আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেনি।
বিদ্রূপাত্মক সত্য
যেসব রাজনৈতিক শক্তি আজ নিজেদের সবচেয়ে উগ্র জাতীয়তাবাদী বলে দাবি করে, এটা সত্যিই বিদ্রূপাত্মক যে, তারা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে ভারতের স্বাধীনতার প্রকৃত সংগ্রামের সময় কোনো ভূমিকাই রাখেনি। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (RSS) মতাদর্শী ও প্রধান এম.এস. গোলওয়ালকর তো এতদূর পর্যন্ত বলেছিলেন যে ব্রিটিশবিরোধী জাতীয়তাবাদ ছিল প্রতিক্রিয়াশীল :
“আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদের তত্ত্ব এবং সাধারণ বিপদের তত্ত্ব (প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যুদ্ধ বা অন্যান্য সংকটকালীন পরিস্থিতিতে এই তত্ত্ব সমাজে সংহতি ও পারস্পরিক দায়বদ্ধতার গুরুত্ব তুলে ধরে– অনুবাদক) । যা আমাদের জাতির সাধারণ ধারণার ভিত্তি তৈরি করেছিল, তা আমাদের প্রকৃত হিন্দু জাতীয়তার ইতিবাচক ও অনুপ্রেরণাদায়ক বিষয়বস্তু থেকে বঞ্চিত করেছে এবং অনেকটাই ‘স্বাধীনতা আন্দোলন’কে কার্যত ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে পরিণত করেছে। ব্রিটিশবিরোধিতাকে দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদের সমতুল্য করা হয়েছিল। এই প্রতিক্রিয়াশীল দৃষ্টিভঙ্গি স্বাধীনতা আন্দোলনের সমগ্র গতিপথ, তার নেতৃবৃন্দ এবং সাধারণ মানুষের ওপর বিপর্যয়কর প্রভাব ফেলেছে।” (Bunch of Thoughts, পৃ. ১৫২-৫৩)
প্রকৃত ঘটনাবলী
১৯২৫ সালে ডাক্তার কে.বি. হেডগেওয়ার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন RSS যা হিন্দু মহাসভা, জনসংঘ এবং পরবর্তীতে ভারতীয় জনতা পার্টিকে (BJP) সাংগঠনিক ও মতাদর্শগত শক্তি জুগিয়েছিল। ১৯২৫ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত পুরো সময়কালে এটি কংগ্রেস, অন্য কোনো দল বা গোষ্ঠী দ্বারা শুরু করা কোনো প্রচার কর্মসূচি অথবা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেনি।
তারা নিজেরাও ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে কোনো আন্দোলন শুরু করেনি, যেমনটা আকালি দল ১৯২০-২৫ সালে গুরুদ্বার সংস্কারের জন্য করেছিল। বিপ্লবীদের মতো তারা ব্রিটিশ কর্মকর্তাদের হত্যার মতো ‘কর্মকাণ্ড’তেও জড়ায়নি অথবা গদর বিপ্লবীদের মতো সেনাবাহিনী ও অভিবাসীদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টিতেও লিপ্ত হয়নি। এটাই সেই সংগঠন যা আবার জাতীয়তাবাদকে তার আদর্শ বলে দাবি করে।
জাতীয়তাবাদী হওয়ার ছদ্মবেশ কিন্তু প্রকৃত আন্দোলন থেকে দূরে থাকা
এই রহস্য অবশ্য খুব সহজেই সমাধান হয়ে যায়, যদি আমরা বুঝতে পারি যে এর মূল আদর্শ হলো একটি সাম্প্রদায়িক ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ যাকে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম সাম্প্রদায়িকতা কিন্তু ভারতীয় জাতীয়তাবাদ নয় বলে অভিহিত করেছিল । তাই এর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল মুসলিম আধিপত্যের কথিত হুমকির বিরুদ্ধে হিন্দু সমাজকে সংহত করা।
এর প্রতিষ্ঠাতা হেডগেওয়ার(কেশব বলিরাম) RSS প্রতিষ্ঠার আগে, আসলে নাগপুরে কংগ্রেসের একজন মধ্যম স্তরের নেতা ছিলেন এবং অসহযোগ আন্দোলনে জেলেও গিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি ছিলেন ডাক্তার বি.এস. মুনজের (বালকৃষ্ণ শিবরামন) একনিষ্ঠ অনুসারী, যিনি ছিলেন একজন হিন্দু মহাসভা নেতা(সভাপতিও ছিলেন, RSS প্রতিষ্ঠার সঙ্গে যুক্তও ছিলেন–অনুবাদক)। মুনজে ইতালি সফর ও মুসোলিনির সাথে সাক্ষাৎ করা ছাড়াও ইতালীয় ফ্যাসিবাদী প্রতিষ্ঠানবিষয়ে অধ্যয়ন করেছিলেন ও তাদের দ্বারা অত্যন্ত প্রভাবিত ছিলেন।
এটাও বিশ্বাস করা হয় যে তিনি ভি.ডি. সাভারকরের হিন্দুত্ব দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন যা ১৯২৩ সালে প্রকাশিত হয়েছিল যদিও এর আগে থেকেই তা জানা ছিল। সাভারকর হিন্দুত্ব মতাদর্শের মূল বিষয়গুলো যেভাবে তুলে ধরেছিলেন তাতে ভারত এমন একটি ভূমি যা হিন্দুদের পুণ্যভূমি ও পিতৃভূমি। এইভাবে মুসলিম, খ্রিস্টান এবং অন্যান্যদের ভারতীয় জাতির অংশ হওয়া থেকে বাদ দিয়েছিলেন।
সাইমন কমিশন বিরোধী আন্দোলন এবং RSS-এর অনুপস্থিতি
RSS প্রতিষ্ঠার দুই বছর পর সাইমন কমিশন বিরোধী প্রতিবাদ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে কিন্তু RSS-কে কোথাও দেখা যায়নি। একটু পরে, ১৯২৯ সালের ডিসেম্বরে, জওহরলাল নেহরু রাষ্ট্রপতি হিসেবে লাহোরে কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন এবং পূর্ণ-স্বাধীনতাকে লক্ষ্য হিসেবে ঘোষণা করেন। কংগ্রেস ২৬ জানুয়ারি ১৯৩০ কে স্বাধীনতা দিবস হিসেবে পালন করার সিদ্ধান্ত নেয় যেখানে প্রতিটি শহর ও গ্রামে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হবে এবং উপস্থিত সবাই জাতীয় অঙ্গীকার গ্রহণ করবেন।
হেডগেওয়ার দাবি করেছিলেন যে যেহেতু RSS পূর্ণ- স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে তাই স্বাধীনতা দিবস পালন করা উচিত কিন্তু তারা ভগোয়া ঝান্ডা (ভাগোয়া অর্থাৎ গৈরিক পতাকা হলো সেই ঐতিহ্যবাদী-হিন্দুধর্মনির্ভর প্রকল্পের চিহ্ন, যা ভারতের সংবিধানিক গণতন্ত্রের ধর্মনিরপেক্ষ বহুত্ববাদী চরিত্রের সঙ্গে মূলগতভাবে বিপরীত—অনুবাদক) উত্তোলন করবে, তেরঙ্গা জাতীয় পতাকা নয় । এটি ছিল RSS পদ্ধতির একটি নিখুঁত উদাহরণ, জাতীয়তাবাদী হওয়ার ছাপ দেওয়া কিন্তু প্রকৃত জাতীয় আন্দোলন থেকে দূরে থাকা।
একইভাবে, যখন সেই বছর পরে ‘সিভিল ডিসঅবিডিয়েন্স’ আন্দোলন শুরু হয়, হেডগেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন যে তিনি ব্যক্তিগতভাবে যোগ দেবেন কিন্তু সংগঠন হিসেবে RSS দূরে থাকবে। সেই অনুযায়ী, তিনি RSS-এর প্রধান পদ থেকে পদত্যাগ করলেন। তিনি তার জাতীয়তাবাদী পরিচয় অক্ষুণ্ণ রাখতে জেলে গেলেন যা তার সরকারি জীবনীকারের মতে, জেলখানায় কংগ্রেস কর্মীদের RSS-এ আকৃষ্ট করার জন্যও।
এমন প্রমাণও রয়েছে যে হেডগেওয়ার ক্রমবর্ধমানভাবে ব্রিটিশদের বিরোধিতা করতে কম ইচ্ছুক ছিলেন এবং এমনকি তাদের শাসনকে “প্রভিডেন্সের কাজ” বলে বর্ণনা করেছিলেন ; ১৯৩৯ সালে কংগ্রেসের সভাপতিত্ব থেকে সবেমাত্র পদত্যাগ করা সুভাষচন্দ্র বসুর সাথে দেখা করতে তার অস্বীকৃতির সাথে তা সামঞ্জস্যপূর্ণ ।
১৯৩৯ সালের এপ্রিলে সুভাষচন্দ্র বসু গোপাল মুখুন্দ হুদ্দার নামের এক ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করেন, যিনি RSS প্রতিষ্ঠাতা হেডগেওয়ারের পুরানো সহকর্মী ছিলেন। বসুর অনুরোধ ছিল—তিনি যেন হেডগেওয়ারের সঙ্গে একটি সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করেন।
হুদ্দার এই অনুরোধ জানাতে দেনোলি যান, যেখানে হেডগেওয়ার একজন ধনী সঙ্গীর সঙ্গে ছিলেন। পরে হুদ্দার জানান যে “ডক্টর সাহেব”—যেমন করে হেডগেওয়ারকে সবাই সম্বোধন করতেন—সুস্থই ছিলেন; কারণ তিনি তখন কয়েকজন তরুণ ভক্তের সঙ্গে হাসি-আড্ডায় মেতে ছিলেন। তবু তিনি অসুস্থতার অজুহাতে সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গে দেখা করতে অস্বীকার করেন।
স্বাভাবিকভাবেই, হিন্দুত্ববাদী নেতাদের জাতীয়তাবাদী ভূমিকা নতুন করে পুনর্গঠনের যে প্রচেষ্টা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চলছে, তাতে এই ঘটনার কোনো উল্লেখ পাওয়া যায় না।
সুভাষচন্দ্র বসু হিন্দু মহাসভার সমালোচনা করেছিলেন
এর পরিবর্তে, ১৯৪০ সালে বোম্বেতে হিন্দু মহাসভার তৎকালীন সভাপতি ভি.ডি. সাভারকার এবং সুভাষ বসুর মধ্যে একটি কথিত বৈঠক নিয়ে সম্প্রতি অনেক হাইপ তৈরি হয়েছে। দাবি করা হয় যে সাভারকারই বসুকে পরামর্শ দিয়েছিলেন ভারত ছেড়ে অক্ষশক্তির কাছে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সাহায্যের জন্য যেতে এবং সাম্প্রতিককালীন ভায্যে তা এই যে সাভারকার ছিলেন বসুর (এবং ভগৎ সিং ও ক্ষুদিরাম বসুর) অনুপ্রেরণা।
এই দাবিগুলো সম্প্রতি বসু ও বিপ্লবীদের পরিবারের সদস্যরা এবং অন্যান্য মন্তব্যকারীরা দৃঢ়ভাবে চ্যালেঞ্জ করেছেন, যারা হিন্দু মহাসভা এবং এর সাথে সাভারকারের সংযোগ নিয়ে বসু কতটা সমালোচনামূলক ছিলেন তা দেখানোর জন্য অধ্যায় ও নানা উদ্ধৃতি উল্লেখ করেছেন।
সত্য যা তা হলো ১৯৪০ সালের জুলাইয়ে তার গ্রেপ্তারের একটু আগে, বসু সত্যিই সাভারকার এবং জিন্নাহর সাথে দেখা করেছিলেন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য একটি যৌথ ফ্রন্ট তৈরি করার প্রচেষ্টায়, কিন্তু তার স্মৃতিকথায় (The Story of My Struggle, Part 2) তিনি লিখেছেন যে জিন্নাহ “তখন শুধু চিন্তা করছিলেন কীভাবে ব্রিটিশদের সাহায্যে তার পাকিস্তানের পরিকল্পনা (ভারত বিভাগ) বাস্তবায়ন করা যায়” এবং সাভারকার মনে হচ্ছিল “আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে উদাসীন এবং শুধু চিন্তা করছিলেন কীভাবে হিন্দুরা ভারতে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে প্রবেশ করে সামরিক প্রশিক্ষণ পেতে পারে”।
সাভারকার তার বন্দিত্বের সময় পর্দার আড়াল থেকে রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় ছিলেন তা এই সত্যে প্রমাণিত যে ১৯৩৭ সালে বিধিনিষেধ থেকে মুক্তি পাওয়ার মুহূর্তে তিনি হিন্দু মহাসভার সভাপতি হয়েছিলেন এবং অসুস্থতা তাকে দায়িত্ব ছাড়তে বাধ্য না করা পর্যন্ত ছয় বছর সেই পদে ছিলেন। মনে রাখতে হবে যে সাভারকারকে আন্দামান এবং পরে ইয়েরভাদা কারাগার থেকে শুধুমাত্র এই শর্তে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল যে তিনি কোনো ব্রিটিশবিরোধী কার্যকলাপে জড়িত হবেন না এবং তিনি সেই প্রতিশ্রুতি রাখতে খুবই আগ্রহী ছিলেন।
সাভারকারের দ্বি-জাতি তত্ত্বের প্রকাশ
তাকে তার ভরণপোষণের জন্য এমনকি একটি ভাতা দেওয়া হয়েছিল। হিন্দু মহাসভার দায়িত্বভার গ্রহণ করার সাথে সাথে সাভারকার দ্বি-জাতি তত্ত্ব প্রকাশে কোনো সময় নষ্ট করেননি। তিনি বলেছিলেন, হিন্দু ও মুসলমানরা দুটি পৃথক জাতি, জিন্নাহকে পূর্বাভাষ দিয়ে যিনি শীঘ্রই সে পথই অনুসরণ করেছিলেন। হিন্দু মহাসভায় তার সভাপতির ভাষণগুলো মুসলিম-বিরোধী, কংগ্রেস-বিরোধী এবং গান্ধী-বিরোধী বক্তব্যে বিষাক্ত ছিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হিন্দু মহাসভা ও RSS-এর অবস্থানকে তীব্র ফোকাসে নিয়ে আসে। প্রদেশে কংগ্রেস মন্ত্রিসভাগুলো ভারতীয় রাজনৈতিক মতামতের সাথে কোনো পরামর্শ ছাড়াই ভারতকে যুদ্ধে ব্রিটিশদের পক্ষে অংশগ্রহণকারী ঘোষণা করার প্রতিবাদে পদত্যাগ করে। অবিলম্বে, সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলো শূন্যস্থান পূরণ করতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মুসলিম লীগ তার আনুগত্যশীল চরিত্রের সত্য থেকে সরকার গঠনে সহযোগিতার প্রস্তাব দেয়।
পিছিয়ে না থেকে, সাভারকার, তখন হিন্দু মহাসভার সভাপতি, ১৯৩৯ সালের অক্টোবরে ভাইসরয়কে বলেন যে হিন্দু এবং ব্রিটিশদের বন্ধু হওয়া উচিত এবং প্রস্তাব দেন যে কংগ্রেস মন্ত্রিসভা পদত্যাগ করলে হিন্দু মহাসভা কংগ্রেসের স্থলাভিষিক্ত হবে। (লিনলিথগো, ভাইসরয়, জেটল্যান্ড, স্টেট সেক্রেটারি, ৭ অক্টোবর ১৯৩৯, জেটল্যান্ড পেপারস, খণ্ড ১৮, রিল নং ৬)
মহাসভার সভাপতি হিসেবে সাভারকার হিন্দুদের আবেদন করেছিলেন ‘ব্রিটিশ সরকারের সমস্ত যুদ্ধ-প্রচেষ্টায় অংশগ্রহণ করতে’ এবং “কিছু মূর্খদের” কথা না শুনতে যারা এই নীতিকে ‘সাম্রাজ্যবাদের সাথে সহযোগিতা’ বলে “নিন্দা” করে। তিনি হিন্দুদের সেনাবাহিনীতে যোগ দিতেও পরামর্শ দিয়েছিলেন। এটি তার “হিন্দুত্বকে সামরিকীকরণ” স্লোগানের সাথে এবং সেনাবাহিনীতে মুসলমানদের ওজন কমানোর লক্ষ্যের সাথে খাপ খায় ।
এই নীতি অনুসরণ করে, হিন্দু মহাসভা তখন সরকারে যোগ দিতে এগিয়ে যায়, প্রায়শই মুসলিম লীগের সাথে জোটে।
আরও পড়ুন: ভারতীয় সংবিধান ও আর.এস.এস-এর সমস্যা
মুসলিম লীগের সাথে জোট সরকার গঠনে হিন্দু মহাসভার কোনো দ্বিধা ছিল না
প্রকৃতপক্ষে, হিন্দু মহাসভা নেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি বাংলা সরকারে মন্ত্রী ছিলেন (ফজলুল হকের নেতৃত্বে পরিচালিত) যিনি ১৯৪০ সালে মুসলিম লীগ অধিবেশনে পাকিস্তান প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন—১৯৪২ সালে, সেই সময়ে, ব্রিটিশরা কংগ্রেস ভারত ছাড়ো আন্দোলন শুরু করলে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের নিষ্ঠুরভাবে দমন করেছিল। আন্দোলনের পূর্বাভাস দিয়ে, মুখার্জি বাংলার গভর্নরকে লিখেছিলেন যে “কংগ্রেস দ্বারা শুরু করা যে কোনো ব্যাপক আন্দোলন… যে কোনো সরকার দ্বারা প্রতিরোধ করতে হবে” এবং এটি নিশ্চিত করা উচিত “যে কংগ্রেসের সর্বোত্তম প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, এই আন্দোলন প্রদেশে শিকড় গাড়তে ব্যর্থ হবে” (শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জিকে ইতালীয় অধ্যাপক জিউসেপ্পে তুচ্চি, যিনি শান্তিনিকেতন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতেন এবং বাঙালি ছাত্র ও শিক্ষকদের মধ্যে ফ্যাসিবাদী ধারণা ছড়ানোর প্রধান মাধ্যম ছিলেন, তিনি কলকাতায় “আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী” হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন। Casolari, In The Shadow of the Swastika, পৃ. ১৬)।
যুদ্ধের সময় সিন্ধু এবং উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে মুসলিম লীগের সাথে জোট সরকার গঠনেও হিন্দু মহাসভার কোনো দ্বিধা ছিল না যদিও লীগ ইতিমধ্যে ১৯৪০ সালে পাকিস্তানকে তার লক্ষ্য হিসেবে ঘোষণা করেছিল।
প্রকৃতপক্ষে, যখন হিন্দু মহাসভা সিন্ধুতে জোট সরকারের অংশ ছিল, সিন্ধু বিধানসভা জি.এম. সৈয়েদের প্রস্তাবিত একটি প্রস্তাব পাস করে যে “ভারতের মুসলমানরা একটি পৃথক জাতি”। হিন্দু মহাসভা এর বিরুদ্ধে ভোট দিয়ে ভাবমূর্তি বজায় রেখেছিল, কিন্তু সরকার ছেড়ে যাওয়ার মতো অসন্তুষ্ট তারা ছিল না!
আগ্রহজনকভাবে, লীগ এবং মহাসভা উভয়ই কংগ্রেসকে তাদের প্রধান শত্রু হিসেবে দেখেছিল এবং ব্রিটিশদের বন্ধু হতে ইচ্ছুক ছিল – একই সময়ে জাতীয়তাবাদী হওয়ার দাবি করছিল, প্রথমটি মুসলিম জাতীয়তাবাদ এবং পরবর্তীটি হিন্দু জাতীয়তাবাদকেই সমর্থন করে!
তবে সত্যটি থেকে যায় যে, তাদের দাবি সত্ত্বেও, ঔপনিবেশিক ভারতের নির্দিষ্ট প্রেক্ষাপটে, যখন প্রধান জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম ছিল ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সমস্ত ভারতীয়দের, তাদের ক্ষেত্রে যা কেবলমাত্র সাম্প্রদায়িক এবং আনুগত্য হিসেবেই চিহ্নিত করা যেতে পারে। এটি অন্য বিষয় হলেও উল্লেখযোগ্য যে এই সমস্ত আনুগত্য তাদের নির্বাচনী সাফল্য এনে দিতে পারেনি এবং তারা ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে পরাজয়ের মুখোমুখি হয়েছিল, সমস্ত প্রদেশ মিলিয়ে মাত্র তিনটি আসন জিতেছিল(১৯৫১-৫২ সালের প্রথম সাধারণ নির্বাচনেও, সমস্ত হিন্দু সাম্প্রদায়িক দল ৪৮৯ আসনের সংসদে মাত্র ১০টি আসন জিতেছিল)! সম্ভবত এই সম্পূর্ণ রাজনৈতিক প্রান্তিককরণ, হিন্দুসহ ভারতীয় জনগণ দ্বারা এই প্রত্যাখ্যানই, মরিয়া এবং কাপুরুষতার মতো কাজের দিকে তাদের পরিচালিত করেছিল যা মহাত্মার হত্যাকাণ্ডের মূর্ত প্রকাশে স্পষ্ট।
RSS ভারত ছাড়ো আন্দোলন থেকে দূরে ছিল
পূর্ববর্তী বড় গণ সংগ্রাম ১৯৩০-৩২ সালের ‘সিভিল ডিসঅবিডিয়েন্স’ আন্দোলন। RSS-তখনও এই প্রকৃত জাতীয়তাবাদী লড়াই ‘ভারত ছাড়ো আন্দোলন’ থেকে দূরে ছিল। তারা তাদের তরুণ উৎসাহী কর্মীদের আসন্ন বড় যুদ্ধের জন্য শক্তি সংরক্ষণ করতে পরামর্শ দিয়েছিল । এই তরুণ কর্মীদের অনেকেই জাতীয়তাবাদী বক্তব্যে বিশ্বাস করত যার জন্য তাদের প্রথমে RSS আকৃষ্ট করেছিল।
স্বরাষ্ট্র বিভাগের RSS-এর উপর তৈরী নোট রিপোর্ট করেছে যে, ‘কংগ্রেস বিশৃঙ্খলার সময় (১৯৪২) সংঘের সভাগুলোতে, বক্তারা সদস্যদের কংগ্রেস আন্দোলন থেকে দূরে থাকতে আহ্বান জানিয়েছিলেন এবং এই নির্দেশাবলী সাধারণত পালন করা হয়েছিল।’
বোম্বের স্বরাষ্ট্র সচিব এইচ.ভি.আর. আয়েঙ্গার ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৪ তারিখে উল্লেখ করেছিলেন যে ‘সংঘ নিজেকে খুব সতর্কতার সাথে আইনের মধ্যে রেখেছে এবং বিশেষ করে, ১৯৪২ সালের আগস্টে যে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছিল তাতে কোনো অংশ নেওয়া থেকে বিরত ছিল।’ (স্বরাষ্ট্র বিভাগ (রাজনৈতিক) কার্যবিবরণী, ফাইল ২৮/৮/৪২-পোল(I) এবং ফাইল ২৮/৩/৪৩-পোল(I))।
সুতরাং, চূড়ান্ত বিশ্লেষণে, আমরা বলতে বাধ্য যে সংগঠন হিসেবে, RSS, ১৯২৫-১৯৪৭ সাল পর্যন্ত তার অস্তিত্বের পুরো সময়কালে কোনো ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেনি।
কিন্তু ১৯৪৬ সালে সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি খারাপ দিকে মোড় নিলে এটি হঠাৎ জীবিত হয়ে ওঠে। স্পষ্টতই, এটি ছিল তাদের জন্য প্রকৃত যুদ্ধ যার জন্য তারা অপেক্ষা করছিল। সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়তে শুরু করলে হিন্দুদের “রক্ষক” হিসেবে আবির্ভূত হওয়া সহজ ছিল। স্বাধীনতা ও দেশ-বিভাগের আগে এবং অব্যবহিত পরে হিন্দু মহাসভা ও RSS নেতাদের বক্তৃতা এবং তাদের অনুসারীদের সংবাদপত্রে বিদ্বেষপূর্ণ বিষয়বস্তু লেখার যথেষ্ট তথ্যনিষ্ঠ প্রমাণ বিদ্যমান।
মহাত্মা গান্ধী ছিলেন প্রধান লক্ষ্য এবং মুসলমানদের তুষ্টিকারী হিসেবে তাদের দ্বারা নিন্দিত হয়েছিলেন। তেরঙ্গাকে ভারতের জাতীয় পতাকা হিসেবে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিল, ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট অর্গানাইজারে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির নিবন্ধসহ যেখানে বলা হয়েছিল যে ভগোয়া বা গেরুয়া পতাকাই একমাত্র সত্যিকারের পতাকা যা হিন্দুদের দ্বারা শ্রদ্ধার যোগ্য— “তিন শব্দটি নিজেই একটি মন্দ, এবং তিন রঙের পতাকা অবশ্যই একটি খুব খারাপ মানসিক প্রভাব সৃষ্টি করবে এবং একটি দেশের জন্য ক্ষতিকর”।
RSS ২০০২ সাল পর্যন্ত তেরঙ্গা উত্তোলন করেনি
সেই বিশ্বাস অনুসারে যে পর্যন্ত না BJP কেন্দ্রে ক্ষমতায় থাকার জন্য শক্তিশালী চাপ তাদের সেই অনুশীলন চালিয়ে যাওয়াটা বিব্রতকর করে তুলেছিল, RSS ২০০২ সাল পর্যন্ত তেরঙ্গা উত্তোলন করেনি।
ঔপনিবেশিক শাসন থেকে স্বাধীনতার জন্য কঠোর লড়াইয়ের দিকে ফিরে তাকালে, আমাদের সামনে যে বিস্তৃত দৃশ্যপট খুলে যায় তাতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে হিন্দু ও মুসলমানদের পাশাপাশি লড়াই করা ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহ, দাদাভাই নওরোজি ও তাঁর সমসাময়িকদের দ্বারা প্রদত্ত সম্পদ নিষ্কাশনের চিত্রকল্প তত্ত্ব যা ভারতীয় জাতীয়তাবাদের অর্থনৈতিক ভিত্তি স্থাপন করেছিল, স্বাধীনতা আন্দোলনের সদর দফতর হিসেবে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা, স্বদেশী আন্দোলন যা বাংলা, মহারাষ্ট্র ও পাঞ্জাবে মানুষদের রাস্তায় নিয়ে এসেছিল, মহাত্মা গান্ধীর আগমনের সাথে নাটকীয় পরিবর্তন, জালিয়ানওয়ালাবাগের ভয়াবহতা, গুরু কা বাগ মোর্চায় আকালি জাঠদের দৃঢ় অহিংসতা, বারদোলৌ কৃষকদের শান্ত বীরত্ব, লবণ সত্যাগ্রহে আইন- অবাধ্যতা, যারা করুণা প্রার্থনা করতে অস্বীকার করেছিলেন সেই ভগৎ সিং ও তাঁর সহযোগীদের ফাঁসির দড়িতে মৃত্যুর নিস্তব্ধতা, ভারত ছাড়োর উত্তেজক স্লোগান, আজাদ হিন্দ ফৌজ এবং লাল কেল্লার বিচার এবং ১৫ আগস্ট ১৯৪৭ মধ্যরাতে ভারতের ভাগ্যের সাথে সাক্ষাৎ।
এই বিশালতায়, কেউ বৃথাই খোঁজে, যাদের জাতীয়তাবাদী হওয়ার দাবি আজ সবচেয়ে জোরালো, তাদের কোনো উপস্থিতি। এই স্পষ্ট অনুপস্থিতি সত্ত্বেও হিন্দু সাম্প্রদায়িকতাবাদীদের পক্ষ থেকে স্বীকার করার সামান্যতম ঝোঁকও নেই যে স্বাধীনতার যে ৭৫তম বার্ষিকী ‘ঘরে ঘরে তেরঙ্গা’ দিয়ে উদযাপিত হয়েছিল, তা ছিল লক্ষ লক্ষ মানুষের অর্জন এবং তারা বর্তমান শাসক সমর্থনের লক্ষ্যে খুবই ভিন্ন একটি দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিল।
স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে দূরে থাকার অতীত ভুলের কোনো আত্ম-অনুসন্ধান, স্বীকারোক্তি এবং অনুশোচনা নেই এবং/অথবা সাম্প্রদায়িক পরিবেশ প্রচার করার কর্মের নিন্দা নেই যা শেষ পর্যন্ত তাদের মহাত্মার হত্যাকাণ্ডের দিকে পরিচালিত করেছিল। স্বীকৃতি নেই স্বাধীনতার পরে ৫৫ বছর ধরে তেরঙ্গা উত্তোলন করতে RSS-এর অক্ষমতার, যতক্ষণ না ১৯৯৮ সালে BJP কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার পরে এটি খুব বিব্রতকর হয়ে ওঠে।
➤ডঃ মৃদুলা মুখার্জি চার দশকেরও বেশি সময় ধরে JNU-তে ইতিহাসের অধ্যাপক ও গবেষক ছিলেন। তিনি সেন্টার ফর হিস্টোরিক্যাল স্টাডিজের চেয়ারপার্সন এবং স্কুল অফ সোশ্যাল সায়েন্সেস, JNU-এর ডিন ছিলেন। তিনি নেহরু মেমোরিয়াল মিউজিয়াম অ্যান্ড লাইব্রেরির পরিচালিকাও ছিলেন।
ইংরাজী ভাষায় লিখিত মূল লেখাটি The Wire -এ প্রকাশিত (২ অক্টোবর ২০২৫)
অনুবাদ : অনিরুদ্ধ দত্ত





