সন্তোষ সেন
কলকাতা সহ বিভিন্ন মেট্রো শহরে জিম করতে যাওয়া মাসলম্যানদের অনেকেই ট্রেনারের কাছে জানতে চাইছে, ব্রেস্ট মিল্ক কোথায় কিভাবে কিনতে পাওয়া যায়? কী কাজে লাগবে মাতৃদুগ্ধ? তাদের ধারণা ব্রেস্ট মিল্ক খেলে দারুন মাসল গ্রোথ হয়। কারণ এতে একটি বিশেষ ধরনের প্রোটিন আছে। কেমন চলছে এর বাজার? ভারতীয় জিমাররা হিউম্যান মিল্ক-এর খোঁজখবর সদ্য শুরু করলেও, এক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে ‘পুঁজির স্বর্গদ্বার’ ট্রাম্পের দেশ আমেরিকা। সেখানকার বেশ কয়েকটি প্রদেশে হিউম্যান মিল্কের রমরমা ব্যবসা চলছে। হ্যাঁ ব্যবসাই চলছে মাতৃদুগ্ধ নিয়েও। মূলত বডিবিল্ডার ও জিমে নিয়মিত যাওয়া তরুণদের একাংশ শক্তপোক্ত পেশি গঠনের জন্য মাতৃদুগ্ধ পান করছেন। কিভাবে চলছে এই ব্যবসা? যাঁরা সদ্য মা হয়েছেন, তাঁদের অনেকেই অনলাইনে নিজেদের বুকের দুধ বিক্রি করছেন। আর ই-কমার্স মার্কেট বা সরাসরি মায়েদের থেকে তা কিনছেন ‘জিম-ব্রো’ রা।
বিজ্ঞানীরা কী বলছেন? বিশিষ্ট শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ অপূর্ব ঘোষ –“যে ধারণার ভিত্তিতে মাতৃদুগ্ধ খাওয়ার এই ট্রেন্ড, তার কোন বিজ্ঞানসম্মত ভিত্তি নেই। আমরা প্রকৃতিকে অস্বীকার করতে পারি না। মায়ের বুকের দুধ তার সন্তানের জন্যই তৈরি হয়”। চিকিৎসক দীপেন্দ্র সরকার –“এই বিষয়টি অবশ্যই বন্ধ হওয়া দরকার। এমনকি এই নিয়ে কোন গবেষণাকেও উৎসাহ দেওয়া উচিত নয়”। ব্রেস্ট মিল্ক পান করলে মাসল গ্রো করবে এমন ধারণাকে পুরোপুরি নস্যাৎ করে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ কুনাল সুদ বলছেন –“মানুষের ব্রেস্ট মিল্কের প্রায় ৮৮ শতাংশ জল। আর ১০০ মিলিলিটার মাতৃদুগ্ধে প্রোটিন থাকে মাত্র ১.৫ গ্রাম, অন্যদিকে গরুর দুধে থাকে ৭.৯ গ্রাম প্রোটিন”।
মায়ের বুকের দুধে মাসল গ্রোথের ধারণা সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক, অনৈতিক এবং প্রকৃতির নিয়মের বিরুদ্ধে হলেও কিভাবে শুরু হল এই ট্রেন্ড? আমেরিকা সহ কয়েকটি দেশে (এমন কি আমাদের মতো দেশেও) এই প্রবণতা ছড়িয়ে পড়ার পিছনে প্রধান কালপিট একটি ওয়েব সিরিজ –‘দ্যা বয়েজ’। এই সিরিজ আনা হয় পুঁজিকে টিকিয়ে রাখার অন্যতম পিলার অ্যামাজন গ্রুপের প্রাইম ভিডিওতে। এই সিরিজের সুপার হিরো ‘হোমল্যান্ডার’ নিজেকে ইমোশনালি ও ফিজিক্যালি ফিট রাখতে হিউম্যান ব্রেস্ট মিল্ক পান করতেন। এটাকে লুফে নিল পুঁজির আরেক পিলার সোশ্যাল মিডিয়া। ইনস্টাগ্রাম ও টিকটক এই বিষয়টিকে শেষ পর্যন্ত আমেরিকা সহ আরও বেশ কিছু দেশের তরুণ প্রজন্মের কাছে ট্রেন্ড করে ফেলল মিথ্যার বেসাতি করে। ফলে নানান দেশেই মাতৃদুগ্ধ পানের যেন হিড়িক পড়ে গেছে। মূলত অ্যামাজন, eBay-এর মতো অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলো কেনাবেচা করছে ব্রেস্ট মিল্ক। লুকিয়ে চুরিয়ে বেআইনি ও অস্বাস্থ্যকর ভাবে বিক্রির রিপোর্টও কিছু কিছু পাওয়া যাচ্ছে। পচাগলা পুঁজিবাদী সমাজে সবই সম্ভব। বাজারের এমনই মহিমা যে,
একসময় সন্তানদের মায়ের দুধের বদনাম করে বৃহৎ কোম্পানির অবৈজ্ঞানিক কৌটোর দুধ বেশি দামে গেলায়, আবার এখন মাহাত্ম্য প্রচার করে সেই দুধ নিয়ে বাণিজ্য করে।
আমেরিকার ‘ভাইস’ পত্রিকার সাম্প্রতিক রিপোর্ট বলছে, অনেক নতুন মা এখন বুকের দুধ বিক্রি করে মাসে কয়েক হাজার ডলার আয় করছেন। বিশেষ করে সন্তান প্রসবের পর প্রথম পাঁচ দিন মায়ের দুধে যে কোলোস্ট্রাম নিঃসরণ হয়, তার চাহিদাই সবচেয়ে বেশি। সন্তানের পুষ্টি, বেড়ে ওঠা, ও রোগ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে কোলোস্ট্রাম সহ মায়ের দুধের অপরিহার্য ভূমিকা সম্পর্কে আলোচনায় আসা যাক।
সন্তান জন্মের ক্ষেত্রে পুরুষের শুক্রাণু শুধুমাত্র নারীর ডিম্বাণু নিষিক্ত করার কাজে লাগে। পুরুষের এইটুকু ভূমিকার পর সন্তানের জন্ম ও বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে পুরোটাই নারীদের অপরিসীম অবদান। আর এই প্রক্রিয়ায় যোগ্য সঙ্গত করে প্রকৃতির নিজস্ব নিয়ম। বিজ্ঞান বলছে, একটি মানুষের শরীরে ৩৯ ট্রিলিয়ন উপকারী ব্যাকটেরিয়া থাকে। এই কোটি কোটি অনুজীব মানুষের নাক কান মুখ দিয়ে অন্ত্রে প্রবেশ করে। এর একটা অংশ নিয়ে গড়ে ওঠে প্লেসেন্টাল মাইক্রোবায়োম। নারীর গর্ভে অমরার (placenta) জলীয় স্তরে ভ্রূণ ভেসে থাকে, যাকে পুষ্টির যোগান ও সমস্ত রকমের সুরক্ষা দেয় প্লেসেন্টাল মাইক্রোবায়োম। সন্তান ভুমিষ্ট হওয়ার প্রক্রিয়ায় এইসব উপকারি বন্ধু ব্যাকটেরিয়ার দল বাসা বাঁধে মায়ের স্তনে। তৈরি হয় প্রকৃতির অত্যন্ত মূল্যবান সম্পদ কোলোস্ট্রাম (colostrum), যার উপকার বলে শেষ করা যায় না।
আরও পড়ুন: স্বাধীনতা সংগ্রামে RSS ও হিন্দু মহাসভার কোনো ভূমিকা ছিল না
প্রথমত: সদ্যোজাতদের পেটে জমা হয় প্রচুর পরিমাণ বিলিরুবিন। সদ্যোজাতকে মায়ের বুকের প্রথম দুধ খাওয়ালে এইসব উপজাত শিশুর মলের (meconium) সাথে বেরিয়ে যায়। দ্বিতীয়ত: প্রোটিন ও পুষ্টির যোগান দেওয়ার পাশাপাশি কোলোস্ট্রাম বাচ্চাদের শরীরে প্রতিষেধক ও অ্যান্টিবায়োটিক তৈরি করে, যা একটি শিশুর সুস্থ-সবল ভাবে বেড়ে ওঠার প্রধান কারিগর। কম ওজনের নবজাতককে কোলোস্ট্রাম খাওয়ালে তার ওজন বৃদ্ধিতেও প্রভূত সাহায্য করে। আর শিশুদের ছয় মাস ধরে শুধুমাত্র মায়ের দুধ খাইয়ে গেলে তাদের পুষ্টি- বৃদ্ধি ও শারীরিক গঠন তৈরিতে যে অসাধ্য সাধন করে তা পাঠকদের কমবেশি জানা।
প্রকৃতির এইসব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্বাভাবিক নিয়মের বিরুদ্ধেই দাঁড়িয়ে যাচ্ছে পুঁজি। যার কুফল ভোগ করতে হচ্ছে শিশু, মহিলা, সহ সমগ্র মানব প্রজাতিকে। নব্য উদার অর্থনীতির যুগে ব্যাঙ্ক-পুঁজি ও রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ মদতে ফাইন্যান্স ক্যাপিটাল আজ ফুলেফেঁপে এক কাল্পনিক অর্থ-পুঁজিতে পরিণত হয়েছে। যা টিকে আছে নব নব ক্ষেত্রে পুঁজির বিনিয়োগ, বাজার, ব্যবসা ও আরও মুনাফা এই দুষ্ট চক্রের মধ্য দিয়ে। মৃতপ্রায় পুঁজিকে অক্সিজেন জোগাতেই নারীর শরীর ও মনকে পণ্যে পরিণত করা হয়েছে। নারীর নিজস্ব মাতৃগর্ভকেও ‘সারোগেটিভ মাদার’ কনসেপ্টের মধ্য দিয়ে বাজারে বিক্রি করতে প্রলুব্ধ করা হচ্ছে। এই বাজারও চলছে রমরমিয়ে। যার ক্রেতা মূলত অর্থবান পুরুষ সমাজ।
পুঁজির নির্মম খেলায় শেষ পর্যন্ত শিশুর গ্রাস, মায়ের বুকের দুধকেও বাজারে বিক্রি করা শুরু হয়েছে। প্রাকৃতিক সম্বল ও শ্রম দিয়ে তৈরি করা প্রতিটি সামগ্রীর ব্যবহার মূল্যকে পরিণত করা হচ্ছে বিনিময় মূল্য বা এক্সচেঞ্জ ভ্যালুতে। হে পেশীবহুল বডিবিল্ডার বাবু বিবি গণ, তোমাদের তো অর্থের অভাব নেই। খাও না বাপু যতখুশি অ্যানিমাল প্রোটিন, উদ্ভিজ প্রোটিন, বা নামীদামী ফার্মা কোম্পানির সাজিয়ে দেওয়া হরেক রকম সাপ্লিমেন্ট ফুড। প্রকৃতির অপূর্ব দান কোলোস্ট্রাম ও মায়ের বুকের দুধকেও পণ্যে পরিণত করার অধিকার কে দিয়েছে তোমাদের? হায়রে পুঁজি! কী নির্মম নিষ্ঠুর ভাবে আজ টিকিয়ে রাখতে হচ্ছে তোমার অস্তিত্বকে।
শক্তপোক্ত মাসল তৈরি করার নামে মাতৃদুগ্ধের বাজারীকরণ অবিলম্বে বন্ধ না করতে পারলে, আমাদের মতো দেশের এক বড় অংশের গরীব মায়েরা সংসার চালানোর জন্য বাধ্য হবেন বাজারের কাছে আত্মসমর্পণ করতে। এমনিতেই বিভিন্ন দেশের এক বিরাট সংখ্যক শিশু ক্ষুধা ও পুষ্টিহীনতায় ভোগে। আর নতুন এই প্রবণতা বাড়তে থাকলে পর্যাপ্ত পরিমাণে মায়ের বুকের দুধ না পেয়ে এক অসুস্থ, অশক্ত, পঙ্গু প্রজন্ম তৈরি হবে। মনে রাখতে হবে, প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়ম ও ছন্দের বিরুদ্ধে গেলে, তার ফল হবে ভয়ঙ্কর বিষময়। মায়ের বুকের দুধের এক এবং একমাত্র অধিকারী সন্তান। লোভী স্বার্থপর মানুষ, পুঁজি, বাজার কারোরই কোন অধিকার নেয় শিশুদের জন্য সৃষ্ট প্রকৃতির অমোঘ অপূর্ব দানের উপর। পয়সা দিয়ে সবকিছু কেনা যায় না, এটা বিস্মৃত হওয়া মানে ভয়াবহ বিপর্যয়কে সাদরে বরণ করে নেওয়া।
তথ্যসূত্র: এই সময় পত্রিকা, ২৭.১০.২৫





