আধুনিকতার উন্মেষ এবং প্রকৃতির বিচ্ছিন্নতা

পোস্টটি দেখেছেন: 72 কোহেই   সাইতো [লেখক জন্মে ও কর্মে জাপানি। শিক্ষা জার্মানি-তে। ২০১৬-তে তিনি জার্মান ভাষায় একটি বই লেখেন। ২০১৮-তে তা’ ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। বই-টির নাম :  Karl Marx’s  Ecosocialism : Capitalism, Nature and the Unfinished Critique of Political Economy. লেখক MEGA(3) প্রকল্পের IV/18 খন্ডের অনুবাদ কর্মেও যুক্ত আছেন। বইটির ১ম অংশের ১ম অনুচ্ছেদ, পৃ. […]

কোহেই   সাইতো

[লেখক জন্মে ও কর্মে জাপানি। শিক্ষা জার্মানি-তে। ২০১৬-তে তিনি জার্মান ভাষায় একটি বই লেখেন। ২০১৮-তে তা’ ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। বই-টির নাম :  Karl Marx’s  Ecosocialism : Capitalism, Nature and the Unfinished Critique of Political Economy. লেখক MEGA(3) প্রকল্পের IV/18 খন্ডের অনুবাদ কর্মেও যুক্ত আছেন। বইটির ১ম অংশের ১ম অনুচ্ছেদ, পৃ. ২৫-২৭ : Alienation of Nature as the Emergence of the Modern -এর এটি  একটি অক্ষম অনুবাদ প্রয়াস, যাতে পাঠক মূল গ্রন্থটি সংগ্রহে উৎসাহিত হন।]

ইয়েনি ফন হ্বেস্টফালেন-এর সঙ্গে বিয়ের পর মার্কস ১৮৪৩-এর শরতে প্যারিসে আসেন এবং তখনই প্রথম গভীর ভাবে রাজনৈতিক অর্থনীতি অধ্যয়ন করতে শুরু করেন। এই গবেষণাকালে তিনি বেশ কয়েকটি খেরোর খাতায় (সিরিজ অব নোটবুকস) তাঁর পর্যবেক্ষণ, সংক্ষিপ্ত নোট  লিখে রেখেছিলেন; এখন সেগুলিকেই প্যারিস নোটবুকস  নামে উল্লেখ করা হয়। সেই সময় মার্কস ইংরাজি পড়তে পারতেন না। তাঁকে এডম স্মিথ ও  ডেভিড রিকার্ডো-র উল্লেখযোগ্য রচনাবলীর ফরাসি অনুবাদ পড়তে হয়েছিল। বুঝেছিলেন, আরো বেশি রাজনৈতিক-অর্থনীতির পাঠ নিতে হবে। এই কারণেই জীবদ্দশায় তিনি এই নোটবইগুলির কোনও অংশ প্রকাশ করেননি; নিজের প্রয়োজনের জন্য সংরক্ষণ করেছিলেন(1)। ১৮৪৪-এর মে থেকে আগস্ট মাসের মধ্যে লেখা এই নোটবইগুলির একটি অংশ বিংশ শতাব্দীতে দি ইকোনমিক এন্ড ফিলোসফিক ম্যানুস্ক্রিপ্ট   নামে প্রকাশিত হয়, যা ছিলো এক বড় প্রমাদ। আসলে সেগুলি আদৌ কোনো পান্ডুলিপি (ম্যানুস্ক্রিপট) ছিল না। বিশেষ কিছু মার্ক্সিস্ট ব্যক্তিত্বকে বইটি আকৃষ্ট করলেও প্রকাশনাটি বেশ বিতর্ক তৈরী করে। সেই মানবতাবাদী মার্ক্সিস্টরা এই বইতে তরুণ মার্কসের চিন্তায় সম্পূর্ণ অন্য একটি দর্শন আবিষ্কার করলেন, যা পুঁজি  গ্রন্থে তাঁর অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ-এর দর্শন থেকে আলাদা। এই সূত্র ধরেই তাঁরা দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ সম্পর্কে সোভিয়েত পার্টির বদ্ধমুল ধারনার বিরোধীতা করতেন(2)। তরুণ মার্কসকে স্তালিনীয় সন্ত্রাস থেকে রক্ষা করার ক্ষেত্রে তাঁরা কিছুটা সফল হয়েছিলেন, এবং মার্কসীয় আলাপ-আলোচনায় মানবিকতাবাদ একটি প্রবণতা হিসেবে দেখা দিয়েছিল। (লেখক হয়তো এখানে মার্কসের অগ্রন্থিত লেখা গুলির দিকে ইঙ্গিত করছেন।) তবে এটা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে (মার্কসের) এই মানবতাবাদী ব্যাখ্যা এক বিশেষ  রাজনৈতিক-ঐতিহাসিক পরিস্থিতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত, এবং এতে মার্কসের অভীপ্সা তাঁদের নিজস্ব স্বার্থের দ্বারা খর্বিত হয়েছিল। আজ “বাস্তবে বিদ্যমান সমাজতন্ত্র”-এর পতনের পরে, নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে, অধুনা প্রাপ্ত ভাষাতাত্ত্বিক তথ্যের ভিত্তিতে প্যারিস নোটবইগুলির বিশ্লেষণ দরকার, যাতে মার্কসের তত্ত্বের বিকাশধারায় তাঁর নোটবইগুলির গুরুত্ব মর্জিমাফিক রাজনৈতিক স্বার্থ আরোপের বদলে ঠিকঠাক প্রাসঙ্গিকতায় বুঝে নেওয়া যায়।

এখন কেউ যদি ১৮৪৪-এর নোটবই থেকে মার্ক্সের একটি পরিপূর্ণ বিকশিত বাস্তুসংস্থান-ভাবনা (ইকোলজি) আবিষ্কার করতে চান, তা’ হবে নেহাতই অকার্যকর, এবং মার্কসের অভিপ্রায়ের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ। যাইহোক, একটি সাম্যবাদী সমাজের প্রধান করণীয় হিসেবে মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যে এক সচেতন ‘ঐক্য’ পুনঃস্থাপনের এই ধারণাটির একেবারে গোড়ার দিকের স্বীকৃতি মার্কসের নোটবইগুলিতে তর্কাতীত ভাবেই চিহ্নিত করা যায়। মার্কস যদি পরবর্তী কালে পুঁজি  গ্রন্থে, প্রকৃতি-পরিবেশ ধ্বংস-কে পুঁজিবাদের অন্তর্নিহিত অসঙ্গতি হিসেবে চিহ্নিত করে থাকতে পারেন – যা তাঁর বাস্তুসংস্থানগত সমালোচনা – তা’ অংশত সম্ভব হয়েছিল প্রকৃতি-মানুষ সম্পর্কের অভ্যন্তরে বিদ্যমান বিচ্ছেদের বিষয়ে তাঁর পূর্ব-লব্ধ অন্তর্দৃষ্টির জন্য। এটাই  হয়েছে। যদিও, পরবর্তী কালে রাজনৈতিক-অর্থনীতি বিশ্লষণের নিজস্ব পদ্ধতি ও ত্বত্ত্বায়নে পৌঁছতে মার্কস দীর্ঘ সময় ধরে প্রচুর পরিমাণে অর্থনীতি, ইতিহাস ও প্রকৃতি-বিজ্ঞান পাঠে নিমগ্ন ছিলেন, যা তাঁকে ১৮৪৪-এর থেকে অনেক বেশী পরিশীলিত এক পদ্ধতি-তন্ত্রে পৌঁছে দিয়েছিল। নবীন মার্কস ভবিষ্যৎ পৃথিবীতে মানবতা ও প্রকৃতির মধ্যে সার্বিক ঐক্যের যে সন্ধান লিপিবদ্ধ করবেন তার স্ফুরণ ঘটেছিল এই পর্বেই। সে সূত্রায়ন টি ছিল:মানবতাবাদ = প্রকৃতিবাদ। পরবর্তী কালে তাঁর তত্ত্বে বিভিন্ন সংযোজন-বিয়োজন ঘটালেও প্রকৃতি-মানব সম্পর্কের এই ভিত্তি থেকে তিনি সরে যান নি।

মানবতাবাদী মার্কসবিজ্ঞানবাদী মার্কস – এই বিতর্কের আলোতে মার্কসের বিচ্ছিন্নতা সম্পর্কে দর্শনকে বিচার করার বিপরীতে, মানবতাবাদ  = প্রকৃতিবাদ এই  মর্মবস্তুর উপর নজর রেখে চলতি অধ্যায়ে আমি প্যারিস নোটবইগুলির গুরুত্ব  –  মার্কস যে পদ্ধতিতে রাজনৈতিক-অর্থনীতির সমালোচনা করেছিলেন সেই ধারায় – পুনর্নির্মাণ করবো। মার্কসের মতে, উৎপাদক এবং তাদের উৎপাদনের বিষয়গত অবস্থাগুলোর উপরেই  দাঁড়িয়ে থাকে আধুনিক পুঁজি-ভিত্তিক উৎপাদনের প্রকৃত (কাঠামোগত) বিচ্ছিন্নতা। মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যে আদিম ঐক্যের এই ঐতিহাসিক  ফাটল (বিচ্ছেদ)-এর জন্যই উৎপাদকরা উৎপাদন-প্রক্রিয়াকে ও উৎপাদনের পারিপার্শ্বিক অবস্থাকে সম্পর্কহীন বাহ্যিক ধর্ম হিসেবে দেখে। মার্কসের দাবী অনুযায়ী এই আদিম সম্পর্কটির ভাঙনই আধুনিক সমাজের কাঠামোটি (paradigm) নির্দিষ্ট করে, যেটি অধিকাংশ অর্থনীতিবিদের দৃষ্টিকোণ থেকে ভিন্ন। সে জন্যই অধিকাংশ অর্থনীতিবিদ বিদ্যমান সামাজিক সম্পর্কগুলিকে স্বাভাবিক ও স্বতঃসিদ্ধ হিসাবে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন।

 যদিও মার্কস তখনও পর্যন্ত লুডহ্বিগ ফয়ারবাখ-এর তত্ত্বে গভীর ভাবে প্রভাবিত। ফলত তিনি তাঁর ইতিহাস পর্যালোচনায় “মানব সত্তা” নামক একটি বিমূর্ত অনৈতিহাসিক বিষয়কে যুক্ত রাখতে চাইছেন। তার ওপর, তখনও তাঁর পুঁজিবাদী উৎপাদন পদ্ধতি-র সমালোচনার যুক্তি-কাঠামোটি পোক্ত হয়ে ওঠেনি। সে যাই হোক, মার্কস অচিরেই ফয়ারবাখ-এর দর্শনের সত্তা সম্পর্কীয় তত্ত্বের সীমাবদ্ধতা বুঝতে পারেন এবং থিসিস অন ফয়ারবাখ  ও জার্মান ভাবাদর্শ  বিষয়ক লেখাগুলিতে বিচ্ছিন্নতার বিমূর্ত সমালোচনাগুলি বাতিল করেন। এইভাবেই, ১৮৪৫ সালে, তিনি প্রকৃতি-বিজ্ঞানে তাঁর পরবর্তী অনুসন্ধানের তত্ত্বীয় ভিত্তিটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

লেখকের পাদটীকা :

  1. প্যারিস নোটবুকস বর্তমানে MEGA2-এর V/2 খন্ডে স্থান পেয়েছে, কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় ব্যতিক্রমী ভাবে Economic and Philosophic Manuscripts সংকলিত হয়েছে  I/2 খন্ডে! এতে মনেহয় যেন জার্মান সম্পাদকরা একে স্বতন্ত্র পাঠ-গুচ্ছ হিসাবেই গ্রাহ্য করেছেন। এমনতর বিভাজন মার্কসকে প্রণালীবদ্ধ রূপে বুঝতে সমস্যা করে। এই সংকলনটিকে “অরিজিনাল” ব‘লে ঘোষনা করাও সম্পাদকীয় নীতির বিরোধী।…  …কিছু পাঠ-কে “পান্ডুলিপি”  আবার অন্যকিছু পাঠ-কে “সারসংকলন” হিসেবে চিহ্নিত করাও বিভ্রান্তিকর। …
  2. Iring Detacher, Marx and Marxism (New York : Herder and Herder, 1971), 314.

অনুবাদকের সংযোজন :

MEGA(2) :  সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের সরকারি উদ্যোগে বহুদিন পর্যন্ত মার্কস-এঙ্গেলসের রচনা বলতে বোঝাতো ১৩-খন্ডের MECW (Marx Engels Collected Works)। ১৯২৪ থেকে ১৯৪০ পর্যন্ত কালপর্বে দাভিদ রিয়াজনেভ-এর তত্ত্বাবধানে এই সংকলন প্রকাশের কথা ভাবা হয়েছিল – এই উদ্যোগ-ই MEGA(1)। এই মুন্ডমাল (abbreviation)-টি ইংরেজী নয় : Marx-Engels-Gesamtausgabe, যে ভাবনার সলতে পাকানো শুরু ১৯১১ সালে ভিয়েনা  শহরে। স্তালিন আমলে রিয়াজনেভ অপসৃত হন, এবং MEGA উদ্যোগ স্তব্ধ হয়। ১৯৭২-সালে MEGA শুরু/পুনরুজ্জীবিত হয়, ১২৭ খন্ডের এক বৃহত্তর ভাবনায়।  একেই বলে MEGA(2)। এরই অংশ হিসেবে ৫০-খন্ডে MECW প্রকাশিত হয়।

সোভিয়েত ইউনিয়ন-এর পতনের পর ১৯৯৩ সালে শুরু হয়েছে : MEGA(3)। উদ্যোগে আছেন International Institute of Social History (Amsterdam), Friedrich Ebert Foundation (German), International Marx Engels Foundation (IMES), Berlin Brandenburg Academy of Sciences( BBAW)।  এরমধ্যে, IMES গঠিত হয়েছে IISH ও FEF-এর যৌথ উদ্যোগে।

MEGA(3) পরিকল্পনায় ১১৪-টি খন্ড থাকবে। আগ্রহী পাঠক স্বরান্তর পত্রিকার জুলাই-ডিসেম্বর ২০১৮ সংখ্যায় শোভনলাল দত্ত গুপ্ত-এর “একুশ শতকের মার্কস …  নতুন প্রশ্ন” প্রবন্ধটিতে MEGA প্রকল্প বিষয়ে বিস্তারিত জানতে পারবেন।

ইংরেজি থেকে অনুবাদ: দেবজিৎ চক্রবর্তী। পরিমার্জনা: পার্থ চট্টোপাধ্যায়।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top