মেঘদূত, মৌসুমি বায়ু ও সবুজ প্রযুক্তি

পোস্টটি দেখেছেন: 49 শঙ্খদীপ ভট্টাচার্য “প্রভাবে হয় যার পৃথিবী উর্বর এবং ভরে ওঠে শিলীন্ধ্রে। শ্রবণ-রমণীয় তোমার সেই নাদ শুনবে চঞ্চল মরাল দল, মানস-উৎসুক, পাথেয়রূপে নেয় মৃণাল কিশলয় খন্ড— আকাশপথে সখা, আকৈলাস ওরা হবে তোমার সহযাত্রী।” মেঘদূতের একটি অংশের এই চমৎকার অনুবাদটি করেছিলেন বুদ্ধদেব বসু। গদ্যে মানেটা দাঁড়ায়, বর্ষার জলের ধারা মাটিতে পড়লে মাটির মধ্যের পুষ্টি […]

monsoon

শঙ্খদীপ ভট্টাচার্য

“প্রভাবে হয় যার পৃথিবী উর্বর এবং ভরে ওঠে শিলীন্ধ্রে।

শ্রবণ-রমণীয় তোমার সেই নাদ শুনবে চঞ্চল মরাল দল,

মানস-উৎসুক, পাথেয়রূপে নেয় মৃণাল কিশলয় খন্ড—

আকাশপথে সখা, আকৈলাস ওরা হবে তোমার সহযাত্রী।”

মেঘদূতের একটি অংশের এই চমৎকার অনুবাদটি করেছিলেন বুদ্ধদেব বসু। গদ্যে মানেটা দাঁড়ায়, বর্ষার জলের ধারা মাটিতে পড়লে মাটির মধ্যের পুষ্টি পদার্থগুলি দ্রবীভূত হয়ে বিস্তৃত হয়ে যায়, গাছাপালা তা সহজেই আহরণ করতে পারে। এর ফলে ভূমি উর্বর হয়। বৃষ্টিতে শিলীন্ধ্র যাকে আমরা ব্যাঙের ছাতা বলে জানি তা গজিয়ে ওঠে। এর মানে আগামী হেমন্তে ফসল খুব ভালো হবে। কালিদাসের এই মহার্ঘ্য কথাগুলি নেহাৎ কাব্যিকতায় থেমে থাকেনি। এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখা আছে।

মহান লেখকেরা তাঁদের সৎ সাহিত্যে আগামীর মানুষের জন্য মননশীলতার রসদ রেখে যান। কালিদাস সে যুগের শ্রেষ্ঠ কবি তো বটেই, সেইসঙ্গে তাঁর রচনায় উৎকৃষ্ট কাব্যময়তার পরিধি ছাড়িয়ে পরিবেশ ও বিজ্ঞান ভাবনার স্পষ্ট আভাস ও ইঙ্গিত দেখা যায়। অন্যতম উল্লেখযোগ্য উদাহরণ মেঘদূত কাব্যগ্রন্থটি।

দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর যাত্রাপথের এমন কাব্যময় বর্ণনা বিশ্বসাহিত্যে আর দুটি নেই। দেখার মতো বিষয়টি হল এই কাব্যিক বিবরণ এক মুহুর্তের জন্যেও তার বৈজ্ঞানিক ঐশ্বর্য হারায় না। উজ্জ্বয়িনী ছুঁয়ে যাওয়া রামগিরি থেকে অলকা পর্যন্ত মেঘের যে গতিপথ তার সঙ্গে আজকের আষাঢ় শ্রাবণের দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর গতিপথের সম্পূর্ণ মিল পাওয়া যায়। বর্তমান ভারতের প্রামাণ্য আবহাওয়ার মানচিত্রের সঙ্গে মেঘদূতে বর্ণিত মেঘের গতিপথের কোনও তফাৎ নেই। মেঘের সঞ্চারণ পথে বর্ষার জলে প্রকৃতির নতুন ভাবে সেজে ওঠা, পশু পাখির আচরণ বদলে যাওয়া, জীবনের ধারা বজায় রাখার তাগিদে তাদের উথালপাতাল আকাঙ্ক্ষা, সমগ্র বাস্তুতন্ত্র জুড়ে জড় ও জীবকুলের পারস্পরিক সৌহার্দ্য এই সবই তো বর্তমান ইকোলজির মুখ্য আলোচনার বিষয়। পূর্বমেঘের নয় ও এগারো সংখ্যক শ্লোকে ঋতু বদলে যাওয়ার সঙ্গে প্রকৃতির পরিবর্তন ও তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে পাখিদের আচরণের বৈচিত্র্য ও তাদের গতিবিধি(Bird behaviour and bird migration) কী অতুলনীয় দক্ষতার সঙ্গেই না তুলে ধরা হয়েছে! মৌসুমি বায়ু, যার প্রভাবে ভারতে বর্ষা হয়, কেরল তামিলনাড়ু পেরিয়ে বঙ্গোপসাগরের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে হিমালয়ের পূর্বভাগে উত্তর পূর্ব ভারতের পর্বতাঞ্চলে জমা হয়। দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু বঙ্গোপসাগর থেকে প্রচুর জলীয় বাষ্প সংগ্রহ করে উত্তর পূর্ব ভারতের সানুদেশে ঘনীভূত হওয়ার কারণেই উত্তর পূর্ব ভারত, আসাম, মেঘালয়, পশ্চিমবঙ্গ, বিহার ঝাড়খণ্ড ও ওড়িশায় ব্যাপক হারে বৃষ্টি হয়। বর্ষার জল পেয়ে ভূমি কর্ষণযোগ্য হয়। এই বৃষ্টির জোরেই তো চাষাবাদ। কৃষকের জীবনধারণে নিরন্তর ভরসা যুগিয়ে এসেছে এই মৌসুমি বায়ু। কৃষকবধূরা ভালোবাসার চোখে প্রকৃতির এই চেহারাকে বরণ করে নেয়। ভারতের কৃষি আজও বর্ষার ওপরেই টিকে আছে। কৃষক পরিবারের অন্নসংস্থান, তাদের ভালো থাকা পুরোপুরি বর্ষানির্ভর। সেকারণেই তো কৃষকবধূর মুখের আনাচকানাচ আনন্দে টইটম্বুর। বর্ষা এসে গিয়েছে, আগামীর দিনগুলোয় সোনার ফসলে ভরে উঠবে ধানখেত।

মেঘদূত টীকা অংশে বুদ্ধদেব বসু লিখেছেন, মেঘ যেন শ্রান্ত পুরুষ, তার নায়িকা পৃথিবী; পৃথিবীর স্তন তার বিশ্রামস্থল। ঋতুসংহারের ২/২ শ্লোকে মেঘকে বলা হয়েছে, ‘সগর্ভপ্রমদাস্তনপ্রভঃ’—শরৎকালে পৃথিবী শস্যবতী হবে।

শিল্প সাহিত্য রচনার মধ্যে নিহিত শ্রম বস্তুত মানুষের শ্রমের বিবর্তনে উন্নত জগতের শ্রম। কালিদাসের গাঢ় অন্তর্দৃষ্টি, প্রকৃতির সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য ভাবে মননকে জুড়ে অমোঘ সাহিত্য সৃষ্টি সেই শ্রমেরই প্রতিফলন। প্রকৃতির সঙ্গে নিরন্তর কথোপকথন চালিয়ে বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য টিকিয়ে রাখার এক অনন্য উপাদান পাওয়া যায় কালিদাসের রচনাগুলিতে।  মৌসুমি বায়ুর গতিপথের বিবরণের মধ্যে দিয়ে মেঘদূতের মূল উপজীব্য হয়ে ওঠে Reproduction of life। সাহিত্য ও বিজ্ঞানের অনন্যসাধারণ মেলবন্ধন ঘটে এইখানেই। কবির কল্পনামণীষায় যে ছবি ফুটে উঠছে তাকে বাস্তবায়িত করার লক্ষ্যই তো হওয়া উচিৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির। অথচ ঠিক তার বিপরীতমুখী স্রোতে কূটবুদ্ধি প্রসূত পরিকল্পনায় ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির জগতকে।

মেঘদূতের পরিবেশ আজকের পৃথিবী অনেক আগেই হারিয়েছে। বিপর্যস্ত প্রকৃতিকে বাঁচানোর নামে সবুজ প্রযুক্তির রমরমা গোটা বিশ্ব জুড়ে। তারই একটি শাখা হল জিও ইঞ্জিনিয়ারিং। এর অন্তর্গত বর্তমানে “stratospheric aerosol injection’ নামে পরিচিত এক পদ্ধতির প্রয়োগ পৃথিবীর hydrological cycle-টি তছনছ করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে।  ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে মৌসুমি বায়ু। ফলত হারিয়ে যেতে পারে বর্ষাঋতুটি। মেঘদূতে দু’ধরনের ঋতুপাখির উল্লেখ আছে। বলাকা ও চাতক। বলাকা হল স্ত্রীবক। এরা অনেকটা Heron জাতীয় পাখি। সাধারণত এরা একা থাকে কিন্তু বর্ষায় দল বেঁধে বলয়ের আকারে আকাশে উড়ে যায়। বর্ষাকালই এদের গর্ভসঞ্চারের সময়। চাতক বা ফটিকজল যাকে ইংরেজিতে বলা হয় Pied crested cuckoo। এদের আদি নিবাস আফ্রিকায়। রবিন যেমন বসন্তের তেমনই এরাই নাকি বর্ষার দূত। এই পাখি মে জুন মাসের কোনও এক সময়ে ভারতে আসে ও অক্টোবরে ফিরে যায়। প্রবাদ আছে, এরা নাকি বৃষ্টির জল ছাড়া অন্য জল পান করে না। জিও ইঞ্জিনিয়ারিং কি আদৌ ভাবে এই ঋতুবিহঙ্গদের কথা! বর্ষা হারিয়ে গেলে সজল মেঘের অভাবে শুকিয়ে যাবে কৃষকবধূর নবজলধারায় ভিজে ওঠা মন। ভারতের বর্ষানির্ভর কৃষিব্যবস্থায় বিশৃঙ্খলা দেখা দিলে  ভারতের বিপুল সংখ্যক কৃষক পরিবার ঘোর সঙ্কটে পড়বে। এখানেই শেষ নয়। গবেষণা বলছে, সালোকসংশ্লেষ প্রক্রিয়াটি পর্যন্ত সরাসরি প্রভাবিত হয়ে পৃথিবীর অধিকাংশ এলাকায় শস্য উৎপাদন পুরোপুরি স্তব্ধ হয়ে যেতে পারে। তাছাড়াও বায়ুমণ্ডলে সালফার কণার আধিক্য ওজোন স্তর নিঃশেষ করতে পারে, ডেকে আনতে পারে আচমকা অ্যাসিড বৃষ্টি। স্বভাবতই এই সর্বনাশা প্রযুক্তি যজ্ঞের মূল লক্ষ্য নতুন বাজার তৈরি করে পুঁজিবাদকে সুরক্ষিত রাখা। বলা বাহুল্য, এর গতিপথ মৌসুমি বায়ুর গতিপথের মতো প্রকৃতিজাত নয়। কালিদাসের মহৎ সৃষ্টিকে আত্মস্থ করে আশা রাখা যায় যে আজকের সাহিত্যে ধরা দেবে এই গভীর সঙ্কট, লেখকের শব্দের মূর্চ্ছনায় আবারও ধরা দেবে মানুষ ও প্রকৃতির সহাবস্থানের কথা, সৃষ্টির মূল উপজীব্য হয়ে উঠবে Reproduction of life। এই শিল্প-সাহিত্যের হাত ধরেই বিজ্ঞান প্রযুক্তি ঠিক খুঁজে নেবে মৌসুমি বায়ুর প্রাণে ভরা মনোরম গতিপথ।

তথ্যসূত্র:
১) প্রাচীন ভারতে পরিবেশ চিন্তা – শুভেন্দু গুপ্ত, সাহিত্য সংসদ, জানুয়ারি, ২০১২
২) বসু, বুদ্ধদেব: মেঘদূত, টীকা, এম. সি.সরকার অ্যান্ড সন্স, ১৯৬৮

4 thoughts on “মেঘদূত, মৌসুমি বায়ু ও সবুজ প্রযুক্তি”

  1. সুন্দর হয়েছে। ভাল ভাবনা। ধন্যবাদ শঙ্খদীপ। চাতক নিয়ে আরও একটা আকর্ষণীয় তথ্য আছে। পাখিগুলো যখন আফ্রিকা থেকে পরিযান করে একই সময় গঙ্গাফড়িং জাতীয় এক ধরনের প্রাণীও আফ্রিকা ছাড়তে থাকে। সারা পথে এই পতঙ্গগুলোই হয় চাতকের খাদ্য। গাছ লাগানো নিয়ে সুপরিকল্পিত চিন্তার অভাব রয়েছে। এ কথা বিশেষজ্ঞরা বলছেন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top