করোনার অভিঘাত ও পরিযায়ী শ্রমিক

পোস্টটি দেখেছেন: 48 নির্ম্মলেন্দু নাথ  করোনার করাল গ্রাস: ভারতে করোনা আক্রান্তের ঘটনা প্রথম ধরা পড়ে ৩১ জানুয়ারী ২০২০। আর করোনাতে প্রথম মৃত্যুর ঘটনা ঘটে ১৩ মার্চ ২০২০। জানুয়ারি মাসের শেষদিন থেকে শুরু করলে আগস্টের ২১ তারিখ পর্যন্ত ভারতে করোনাতে সংক্রামিতের সংখ্যা ৩০,৮০,৪৮৩ এবং মৃত্যুর সংখ্যা হল ৫৬,৭০৬। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে সংক্রমিত ব্যক্তির সংখ্যা ১৩৮৮৭০ এবং মৃত্যুর […]

corona and migrant labour

নির্ম্মলেন্দু নাথ

 করোনার করাল গ্রাস:

ভারতে করোনা আক্রান্তের ঘটনা প্রথম ধরা পড়ে ৩১ জানুয়ারী ২০২০। আর করোনাতে প্রথম মৃত্যুর ঘটনা ঘটে ১৩ মার্চ ২০২০। জানুয়ারি মাসের শেষদিন থেকে শুরু করলে আগস্টের ২১ তারিখ পর্যন্ত ভারতে করোনাতে সংক্রামিতের সংখ্যা ৩০,৮০,৪৮৩ এবং মৃত্যুর সংখ্যা হল ৫৬,৭০৬। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে সংক্রমিত ব্যক্তির সংখ্যা ১৩৮৮৭০ এবং মৃত্যুর সংখ্যা ৫২৩৩ (কোমরবিডিটি সমেত)।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য ভারতের ক্ষেত্রে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা প্রথম ১০ লক্ষে পৌঁছতে সময় নিয়েছিল ১৩৮ দিন। ১০ লক্ষ থেকে ২০ লক্ষে পৌঁছায় ২১ দিনে। ২০ লক্ষ থেকে ৩০ লক্ষে পৌঁছায় মাত্র ১৬ দিনে (টাইমস অফ ইন্ডিয়া)। উপরের তথ্য থেকে  করোণা অতিমারীর  দীর্ঘ সময় জুড়ে ব্যাপ্তি, সংক্রমনের গভীরতা এবং মারণ ক্ষমতা সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যায় যা চতুর্দশ শতকের মধ্যভাগে ইউরোপের প্লেগ ও বিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকে পৃথিবীজুড়ে ইনফ্লুয়েঞ্জার সঙ্গে তুলনীয়।

 জানুয়ারির শেষ থেকে আগষ্টের শেষ পর্যন্ত সময় সীমাকে তিনটি পর্বে ভাগ করা যায়– লকডাউন পূর্ব অবস্থা, লকডাউন অবস্থা এবং লকডাউন শিথিল করার অবস্থা। প্রথম অবস্থার সময়সীমা হ’লো ৩১ জানুয়ারি থেকে ২২ মার্চ, দ্বিতীয় অবস্থা হল ২৪ মার্চ থেকে ৩১ মে আর তৃতীয় অবস্থা হল ১জুন থেকে পরবর্তী সময়।

পরিযায়ী শ্রমিকদের চালচিত্র:

পরিযায়ী শ্রমিকের বিষয়টা সামনে আসে এপ্রিল মাসের ২০ তারিখের পর যখন লক- ডাউন ব্যবস্থাতে ‘ছাড়’ দেওয়া শুরু হয়। এখানে একটা কথা বলা দরকার অর্থনীতি হলো একটা প্রবাহ। লকডাউন এর অর্থ হল এই প্রবাহ রুদ্ধ করা। নদীতে আড়াআড়িভাবে বাঁধ দিলে নদীর প্রবাহ যেমন রুদ্ধ হয়, নদীর উপরের দিকের জলরাশি যেমন স্ফীত হয়ে ওঠে, তেমনই এই লকডাউন এর ফলে অর্থনীতি অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে এবং অবরুদ্ধ অর্থনীতিতে আটকা পড়া কর্মহীন মানুষ বিশেষত ‘ভিনদেশী’  শ্রমিক তখন

যে কোন উপায়ে ঘরে ফিরতে চায়। করোনার অভিঘাতে চাকুরিচ্যুত শ্রমিকের ঘরে ফেরার অভিযান সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছায় মে-জুন মাসে, যখন গোটা উপমহাদেশ তীব্র তাপপ্রবাহে অস্থির। প্রসঙ্গত  বলা দরকার সমুদ্রের মধ্যে যেমন নদী আছে অর্থাৎ স্রোত আছে তেমন শ্রমিকের ঘরে ফেরার এই প্রবাহেরও কয়েকটা নির্দিষ্ট রুট আছে যাকে ‘মাইগ্রেশন করিডোর’ বলে। এই মাইগ্রেশন করিডোরগুলো হল ‘বিমারু’ রাজ্য (বিহার, রাজস্থান,উত্তর প্রদেশ) থেকে দিল্লী, গুজরাট, মহারাষ্ট্র ও হরিয়ানা এবং পশ্চিমবঙ্গ ও উড়িষ্যা থেকে কর্ণাটক, গুজরাট প্রভৃতি। এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে তাই দেখা যায় কাতারে কাতারে মানুষ দিল্লী গুজরাট মহারাষ্ট্র হরিয়ানা থেকে বিহার, উত্তরপ্রদেশ ফিরছে। মধুনিকা আয়ার (২০২০) হিসাব করে দেখিয়েছেন ১মে থেকে ৩ জুন ২০২০  এর মধ্যে ৫৮ লক্ষ লোক, ৪১৯৭ টি শ্রমিক স্পেশাল ট্রেনে গুজরাট ও মহারাষ্ট্র থেকে বিহার উত্তরপ্রদেশ ফিরেছে এবং প্রায় ৪১ লক্ষ লোক সড়ক পরিবহনে ঘরে ফিরেছে অর্থাৎ প্রায় ১ কোটি কর্মচ্যুত মানুষ লকডাউন এর জেরে ঘরে ফিরেছে। এটা হল আন্তর্রাজ্য শ্রমিক চলাচল। এর সাথে অন্তঃরাজ্য শ্রমিক চলাচলের বিষয়টা যোগ করলে সংখ্যাটা কী হবে তা নিয়ে  নির্ভরযোগ্য তথ্য নেই। প্রসঙ্গত বলা দরকার ২০১১ এর জনগণনায় দেখা গেছে অন্তঃরাজ্য চলাচলকারি মানুষের সংখ্যা হ’লো ৩৯.৬ কোটি এবং আন্তঃরাজ্য চলাচলকারি  শ্রমিকের সংখ্য হল ৫.৪ কোটি।

এখন আন্তঃরাজ্যের ক্ষেত্রে যদি ৫.৪ কোটি মানুষের মধ্যে ১কোটি মানুষ অর্থাৎ একপঞ্চমাংশ মানুষ ঘরে ফেরার চেষ্টা করে তাহলে ৩৯.৬ কোটির একপঞ্চমাংশ অর্থাৎ ৮ কোটি মানুষ একই রাজ্যের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ফিরেছে বলে মনে করা যেতে পারে। লকডাউনে জেরে প্রায় 9 কোটি মানুষ যা ভারতের মোট জনসংখ্যার ১৩% মানুষ কর্মচ্যুত হয়ে ঘরে ফিরেছে। প্রসঙ্গত বলা দরকার হিসাবটা অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন এর হিসাব এর সাথে মিলে যায়।

       এখন বিষয়টা হচ্ছে এই বিপুল সংখ্যক মানুষ যারা অপেক্ষাকৃত কম শ্রমকুশল কাজে নিয়োজিত যেমন নির্মাণ- কাজ, নুনের ভাটা, ইটভাটা, কার্পেট শিল্প, বিভিন্ন ধরনের বাগিচা তে কাজ, শহরের ফেরিওয়ালা -রিক্সাওয়ালা, ঠিকে ঝি -চাকর এর কাজ ইত্যাদি তারা ভারতীয় নাগরিক হিসাবে কতটা সমাদৃত হলো তা জানা দরকার।

কোর্টের রায় ও সরকারের ভাবনা:

যখন করোনার অভিঘাতে পরিযায়ী শ্রমিকের ঢ্ল তখন মহামান্য সুপ্রীম কোর্ট এই সম্পর্কে পরপর কতগুলো নির্দেশ সংশ্লিষ্ট সরকারকে দেয়। এগুলোর মধ্যে ২৮ মে ও ৫ জুনের নির্দেশিকা উল্লেখযোগ্য। ২৮ মে এর নির্দেশিকাতে চারটি বিষয় স্পষ্ট ভাবে বলা হয় হল।  ১) ঘরে ফেরা পরিযায়ী শ্রমিকদের কাছ থেকে যেন ভাড়া না নেওয়া হয় ২) যেন বিনামূল্যে খাদ্য দেওয়া হয় ৩) সমস্ত পরিযায়ী শ্রমিকদের যেন নাম ঠিকানা নথিভূক্ত করা হয় আর ৪) পরিযায়ী শ্রমিকদের যেন বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছানো হয় ও সবরকম স্বাস্থ্য পরিষেবা দেওয়া হয়। ৫ জুনের নির্দেশিকাতে শ্রমিকদের নাম-ঠিকানা নথিবদ্ধ করার উপর জোর দেওয়া হয় এবং আটকে পড়া সমস্ত পরিযায়ী শ্রমিকের যানবাহনে পরিষেবা নিশ্চিত করার ওপর জোর দেওয়া হয়।

উপরোক্ত নির্দেশসমূহের মধ্যে সরকারি তরফে দ্বিতীয়টিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয় এবং সিদ্ধান্ত নেয়া হয় সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রতিটি পরিযায়ী শ্রমিক পরিবারের সদস্যরা মাসে ৫ কেজি করে দানাশস্য ও ১ কেজি করে চানা/ ডাল পাবে। এছাড়া স্বগৃহে ফেরার পর তাদের ১০০ দিনের কাজে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। এ প্রসঙ্গে বলা দরকার পরিযায়ী শ্রমিকদের হাতে ‘নগদ টাকা’ দেওয়ার বিষয়টা প্রত্যাখ্যাত হয়। করোনা অতিমারীর যা অবস্থা তা  সেপ্টেম্বরে মিটবে বলে আশা কম। তারপর এইসব পরিযায়ী শ্রমিকদের অবস্থা কী হবে তা ভবিষ্যতে বলবে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top