শঙ্খদীপ ভট্টাচার্য
‘‘At the birth of modernity, the relationship between literature and science was very close and was perhaps perfectly exemplified in the figure of the writer Bernardin de Saint-Pierre, who wrote one of the earliest of bestsellers, Paul et Virginie.Saint-Pierre regarded himself as primarily a naturalist and saw no conflict between his calling as writer and men of science.’’
—–Amitava Ghosh
বিজ্ঞানী এবং শিল্পী সকলেই রক্তমাংসের মানুষ। বিজ্ঞানীর কাজ প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের বস্তুগত সম্পর্কের বহির্জগতকে বদলানো। অন্যজনের কাজ মানুষের সঙ্গে মানুষের বিষয়ীগত সম্পর্কের অন্তর্জগতকে। বহির্জগত সম্পর্কে বিজ্ঞানী তাঁর নিজের চেতনায় দ্বন্দ্ব আবিষ্কার করেন এবং সেই দ্বন্দ্বেরই সমাধান ঘটান সূত্রের আকারে যাকে আমরা বলতে পারি বৈজ্ঞানিক প্রকাশ। অন্যদিকে শিল্পীও এই দ্বন্দ্ব দেখেন তাঁর নিজস্ব চেতনায়। এই দ্বন্দ্ব তাঁর অন্তর্জগতে। প্রকৃতির মধ্যে সে তাঁর নিজের অস্তিত্ব সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল হয়। নিজেকে সে চিনতে পারে। এই ক্রমশ চিনতে পারা ও উন্মোচনের মধ্যে দিয়ে উন্নত থেকে আরও উন্নত আকাঙ্ক্ষার মুখোমুখি হয় তাঁর জীবন। কর্তব্যরত এক ঘেয়ে বাস্তব জীবনের সঙ্গে উন্নত জীবনের আকাঙ্ক্ষার মধ্যে যে অন্তর্দ্বন্দ্ব তারই মীমাংসা সে ঘটাতে চায় শিল্পে, সাহিত্যে। তাই আকাঙ্ক্ষিত ও বাস্তব জীবনের বিরোধই হল সাহিত্য, শিল্প। এই বিরোধের সমাধান ঘটে শিল্পসৃষ্টিতে। ছবি, কবিতা, গল্প, উপন্যাস বা সিম্ফনির আকারে। এই সৃষ্টিশীল কাজের মধ্যে দিয়ে বিজ্ঞানী যেমন আমাদের জ্ঞান বাড়ানোর মধ্যে দিয়ে প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা বাড়িয়ে দেন ঠিক তেমনই শিল্পী আমাদের সমাজ ও প্রকৃতি চেতনাকে উচ্চ থেকে উচ্চতর স্তরে পৌঁছে দেন। দু’জনেরই আকাঙ্ক্ষা পৃথিবীকে বদলানো। একসময়ে এই আকাঙ্ক্ষায় ধরা পড়েছিল মানুষের ওড়ার ইচ্ছা, এমন কিছু যানের কল্পনা যা আকাশে পাড়ি দিতে পারে। এইসব প্রকাশ পেয়েছে প্রাচীন সাহিত্যে। এই আকাঙ্ক্ষাকেই বাস্তবায়িত করার কাজ করে বিজ্ঞান। অতএব বিজ্ঞান ও শিল্প কখনোই পরস্পর নিরপেক্ষ দুটি দিক নয়। মানুষের আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবায়িত করার জন্য বিজ্ঞানী পদার্থের পরিমাণগত (quantitative) দিকটিতে মন দেন। এক স্তরের নির্যাস থেকে অন্য স্তরে এগিয়ে যান এবং ক্রমশ বিশুদ্ধ গণিতের রাজ্যে ঢুকে পড়েন। এখানে বিশুদ্ধ চিন্তাই কাজ করে। প্রকৃতির বস্তুর এলাকা নয় এই জগত। সেকারণেই এই কাজটিও একটি নির্দিষ্ট শৈল্পিক গুণ অর্জন করে। কারণ এখানে বিজ্ঞানী শ্রমের মধ্যে দিয়ে তাঁর মননে আকাঙ্ক্ষার জন্ম দেন। ঠিক যেমন একজন শিল্পী বিষয়ীগত বাস্তবতার উদ্ঘাটনে পদার্থের গুণগত (qualitative) দিকটিকে দেখেন এবং এই দেখার মধ্যে দিয়ে ক্রমশ ভাষা থেকে কাব্য, কাব্য থেকে সঙ্গীত, এক বিশুদ্ধ শব্দ বা সুরের জগতে পা রাখেন।
বর্তমানের বিজ্ঞান গবেষণা আগের চেয়ে অনেক বেশি সুসংগঠিত সে বিষয়ে কোনও সন্দেহই নেই কিন্তু বস্তুত এই বিজ্ঞান পুঁজির সেবায় নিযুক্ত। বলা বাহুল্য, শিল্প সাহিত্যের অগ্রগতির জন্য আজকের শ্রম শিল্পী, সাহিত্যিকের একপেশে এবং তা ফেটিশ সংস্কৃতির দ্বারাই নির্ধারিত।
ওয়ার্ডসওয়ার্থ বলেছিলেন, ‘‘The World is too much with us’’ তিনি আরও বলেছিলেন, যে বিজ্ঞান এবং সভ্যতার জন্য প্রকৃতির সঙ্গে আমাদের তাল কেটে গেছে (‘‘out of tune’’)। তাঁর কথায়,
“ Little we see in nature that is ours;
We have given our hearts away, a sordid boon!’’
…………………………
‘‘Great God! I’d rather be
A Pagan suckled in a creed outworn
So might I, standing on this pleasant lea,
Have glimpses that would made me less forlorn;”
একজন বৈজ্ঞানিক, তিনি যদি মানব-প্রকৃতি সম্পর্ক সম্বন্ধে সচেতন একজন প্রকৃত বিজ্ঞানী না হয়ে থাকেন, তাঁর বৈজ্ঞানিক অন্বেষণ শুধুমাত্র পরিমাণগত অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানের মধ্যেই সীমিত থাকে তাহলে ওয়ার্ডস ওয়ার্থের ওপরের কথাগুলি তাঁর কাছে অর্থহীন প্রলাপ মনে হতে পারে।
প্রকৃত দৃষ্টিভঙ্গিতে ডারউইনের সমস্ত বইয়ের মধ্যে কাব্যিক এক স্রোত লক্ষ্য করা যায়। ডারউইনের প্রকৃতির সম্বন্ধে নিবিড় কৌতূহল তাঁর বৈজ্ঞানিক চিন্তার সঙ্গে একাত্ম হয়ে ছিল। তার প্রতিফলন পাওয়া যায়। ‘অরিজিন অফ স্পিসিস’ (Origin of Species) এবং ‘ডিসেন্ট অফ ম্যান’ বই দুটিতে। ডারউইনের গবেষণ ছিল জীবনকে ঘিরে। প্রকৃতির বিপুল ভাণ্ডারের মধ্যে যে জৈব ঐক্য (Organic Unity) তাঁরই অংশ হয়ে তিনি বিবর্তনের রহস্য উন্মোচন করেছিলেন। বহির্জগতের দ্বন্দ্বের মূর্ত বিশ্লেষণ করে সেই দ্বন্দ্বের সমাধান করাই ছিল তাঁর নিবিড় আকাঙ্ক্ষা। একইভাবে গ্যোয়েটেও তাঁর বৈজ্ঞানিক ও সাহিত্য সংক্রান্ত চিন্তায় কোনও বিরোধ খুঁজে পাননি। গ্যোয়েটের ছিল বিশ্বপ্রকৃতিকে জানবার দুর্বার আগ্রহ। এই অদম্য কৌতূহলের জন্যই পরবর্তীকালে বিজ্ঞান সম্পর্কে অনেক জরুরি বইপত্র তিনি লিখেছেন। রুডলফ স্টাইনারের (১৮৫১-১৯২৫) মতে কোনো কোনো দার্শনিক বিজ্ঞানকে যে তাঁদের জীবন সাধনার অন্যতম অঙ্গ করে নিয়েছেন তাঁর পিছনে গ্যোয়েটের সেই সমস্ত রচনার প্রেরণা বিপুল। তাঁর এক বন্ধু মিনারেলজি বিষয়ে তাঁর জ্ঞানের পিছনে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার কথা এভাবে বলেছেন, গাড়ি থেকে আচমকা নেমে গিয়ে গ্যোয়েটে পথের একটা পাথরকে নিয়ে প্রবলভাবে নাড়াচাড়া করতে শুরু করে দিলেন। তাঁকে বলতে শোনা গেল : ‘কী আশ্চর্য, তুই কী করে এখানে উড়ে এসে জুড়ে বসলি রে? মণিকবিদ্যা বিষয়ে আকাট মুখ্যু বলেই আমার কাছে বিষয়টা কেমন যেন হাস্যকর ঠেকল। কীভাবে যে এমন প্রকাণ্ড একজন পণ্ডিত মানুষ সামান্য একটা পাথর নিয়ে মেতে উঠতে পারে। আদপেই আমি সেটা ধরতে পারলাম না।’ জীবনকে তন্ন তন্ন করে জেনে নেওয়ার এই তাগিত দেখা যায় বিশ্বখ্যাত সাহিত্যিক হারমান মেলভিলের(Herman Melville)মধ্যে। সামুদ্রিক প্রাণীদের ব্যাপারে খুবই কৌতূহলী ছিলেন তিনি এবং তার প্রতিফলন পাওয়া যায় Moby Dick উপন্যাসে। আরও অনেক উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। যেমন তলস্তয়ের যুদ্ধ ও শান্তির (War and Peace) মধ্যে যে গণিত লুকিয়ে আছে বা অ্যালিস ইন ওয়ান্ডার ল্যান্ডের (Alice in Wondeland) মধ্যের রসায়ন।
প্রশ্ন ওঠে বিজ্ঞান ও শিল্পের মধ্যের সম্পর্কটা ঠিক কী? মানুষের আকাঙ্ক্ষায় সাহিত্য শিল্প বিজ্ঞান কীভাবে ধরা দেয়। প্রকৃতি মানুষ এবং তাদের মধ্যেকার সম্পর্কের মধ্যে সাহিত্য শিল্প ও বিজ্ঞান কীভাবে জড়িয়ে? মানুষের চেতনায় এদের সহাবস্থান কি আদৌ সম্ভব? আসলে মানুষের চেতনায় শিল্প সাহিত্য বিজ্ঞানের সহাবস্থানই মানুষকে সম্পূর্ণতা দেয়, তার অস্তিত্বকে করে তোলে প্রাকৃতিক ও তার আকাঙ্ক্ষার প্রকৃত উন্মোচন ঘটায়।
জন বারো (John Burroughs) তাঁর Science and Literature রচনায় চমৎকার বলেছিলেন,
‘‘The true poet and the true scientist are not estranged. They go forth into nature like two friends.’’
আজকের পৃথিবীর সঙ্কট গভীর। এই সঙ্কট শুধু জলবায়ুর সঙ্কট নয়, সঙ্কট আরও ব্যাপক, আরও গভীরে। এই সঙ্কট সংস্কৃতির, সঙ্কট আমাদের কল্পনায়, আমাদের আকাঙ্ক্ষায়। মানব সংস্কৃতি আজ বিপন্ন। কার্বন-অর্থনীতিতে মোড়া পণ্য সভ্যতায় মানুষের নতুন আকাঙ্ক্ষা প্রসঙ্গে অমিতাভ ঘোষ তাঁর গ্রেট দ্য ডিরেজমেন্ট (The Great Deragement) বইটিতে যথার্থই লিখেছেন, ‘সংস্কৃতি আকাঙ্ক্ষার জন্ম দেয়—গাড়ি ও যান্ত্রিক সরঞ্জামের প্রতি, বিশেষ ধরনের বাগান ও বাসস্থানের প্রতি, যেগুলি হল কার্বন অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি। একটি দ্রুতগামী মোটরযান আমাদের মধ্যে যে উত্তেজনার সৃষ্টি করে সেটা আমরা ধাতু বা রঙ ভালোবাসি বলে নয়, এর যন্ত্রবিদ্যা সম্পর্কে কোনো কোনো ভাসা ভাসা ধারণা থেকেও নয়। আমরা উত্তেজিত হয়ে পড়ি। কারণ ওই যন্ত্রযানটি আমাদের মনে উসকে তোলে একটি রাস্তার ইমেজ। যা এক অনাবিল নিসর্গের ওপর দিয়ে তীরের মতো ছুটেছে; আমাদের মনে ভিড় করে আসে উদ্দাম মুক্তি আর চুলে হাওয়ার খেলা; আমরা যেন দেখতে পাই জেমস ডিন আর পিটার ফন্ডা ধেয়ে চলেছেন দিগন্তের দিকে, আমাদের মনে পড়ে যায় জাক কেরুয়াক আর ভ্লাদিমির নবোকভের লেখাও।’ (অনুবাদ, পরিমল ভট্টাচার্য)
আজকের বিজ্ঞান কার্যকারণহীন। অন্যদিকে সাহিত্যে প্রকৃতি বিপর্যয়ের বিশেষ কোনও স্থান নেই। অথচ একথা আমরা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে এসেছি যে পৃথিবীকে সঙ্কট মুক্ত করতে শিল্প, সাহিত্য বিজ্ঞানের কোনও বিকল্পই হয় না এবং সেকারণেই জ্ঞানের ভিত্তিটিকেও হতে হবে প্রচণ্ড মজবুত। খেয়াল রাখতে হবে কোনরকম অহং বোধের তাড়নায় শিল্পী সাহিত্যিক বিজ্ঞানীরা নিজেদের সীমিত অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানকে চূড়ান্ত মনে না করে। সকলকেই বুঝতে হবে জ্ঞানের দ্বান্দ্বিক সম্পর্কে তাঁদের কাজ হল মানুষ ও প্রকৃতির গতিশীল সম্পর্ককে নির্ধারণ করা এবং আগামী পৃথিবীকে মানুষ এবং অন্যান্য জীবকুলের বাসযোগ্য করে তোলা। অতএব দরকার সমাজকে পরিবর্তন করার জ্ঞান এবং প্রকৃতি বিষয়ক জ্ঞানের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করা। শ্রম বিভাজনের কাটা গণ্ডিতে এতদিন যে জ্ঞানের জগত বন্দী হয়ে আছে তার থেকে মানুষকে মুক্ত করা। এই কাজে শিল্প ও বিজ্ঞানের মধ্যে মেলবন্ধন ঘটানো এক অপরিহার্য কাজ। এই কাজ বাস্তবায়িত হলে মানুষ হয়ে উঠবে প্রাকৃতিক। তার মধ্যে যে প্রাকৃতিক সত্ত্বা অন্তর্নিহিত যা সে প্রকৃতি থেকেই পেয়েছে তারই পরিপূর্ণ উন্মোচন ঘটবে। বিশ্বজনীন জৈব ঐক্য (Universal Organic Unity) সম্পর্কিত সামগ্রিক জ্ঞানের বিকাশের মধ্যে দিয়েই গড়ে উঠবে আগামীর মানব সংস্কৃতি।
শিল্পীর কল্পনায় উন্মোচিত হবে তাঁর আকাঙ্ক্ষিত পৃথিবী। সাহিত্যে উঠে আসবে মানুষ প্রকৃতির সম্পর্ক ও সঙ্কট। গান, নাটক এবং সমস্ত ধরনের শৈল্পিক শাখাগুলিতে ফুটে উঠবে আজকের পৃথিবীর দ্বন্দ্বগুলি। শিল্পির সৃষ্টিকাজ তীব্র অভিঘাত তৈরি করবে বিজ্ঞানীর চেতনায়। প্রকৃতিকে মানুষের বসবাসযোগ্য করার কাজে সে তাঁর জ্ঞানের রাজ্যে হানা দেবে। শিল্পীর আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবায়িত করার আকাঙ্ক্ষায় সেও হয়ে উঠবে প্রচণ্ড বিভোর।
তথ্যসূত্র :
১. The Great Derangement, Amitava Ghosh, Penguin books, 2016
২. Footnote, J. Burroughs, Science and culture
লেখক পরিচিতি
লেখক পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। ছোটগল্পের পাশাপাশি সমাজ ও বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধ লিখে থাকেন।
মেইল আই ডি- bhattacharya.sankhadeep@gmail.com