অনিরুদ্ধ দত্ত
ভোট এক্সপ্রেস চলা শুরু:
রাম মন্দিরের নির্মাণ শুরুর সময়কাল অবশেষে সমাগত হ’লো । ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে ৫ই আগষ্ট ২০২০, ভারতের প্রধানমন্ত্রী রামমন্দির নির্মাণকাজের সূচনা করলেন নিজে উপস্থিত থেকে । প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু ভাকরা নাঙ্গাল বাঁধ উদ্বোধনে ৮ই জুলাই ১৯৫৪ সালে বলেছিলেন— “এইসব কাজকে (ভাকরা নাঙ্গাল বাঁধ নির্মাণ প্রসঙ্গে) আমি মন্দির এবং ধর্মস্থানের মতো পবিত্র বলে গণ্য করি এবং আমি যখন এই সব কাজ দর্শন করি, তখন মনের মধ্যে বেশি করে ধর্মভাব অনুভব করি।” ১৯ শে জানুয়ারি ২০০১ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ি বেঙ্গালুরুতে ইনফোসিস ক্যাম্পাসে বলেন —-“আমার মতে অর্থনীতিতে ভারতের মন্দির হল আইটি পার্ক এবং সফটওয়ার সংস্থার ক্যাম্পাস।” স্পষ্টতই উল্লেখিত প্রধানমন্ত্রীরা তাদের কালের নিরিখে মন্তব্যগুলি করে ছিলেন। ১৯৫৪ সালে ভারত বৃহত্ শিল্প স্থাপনের পথে হাঁটা শুরু করছে সরকারী ব্যবস্থাপনায় । পরিকল্পনাভিত্তিক অর্থনীতির পথে গড়ে উঠতে চলেছে একাধিক ভারী ও বুনিয়াদি শিল্পকারখানা । ২০০১ এর আগে- পরে ভারত অর্থনীতির বিশ্বায়ন যাত্রায় জোর পদক্ষেপে সামিল। আই টি শিল্পসংস্থাগুলি তখন এদেশমুখী। আর অর্থনীতির বিশ্বভ্রমণে www.com সেই অর্থনীতির ভ্যালু-এডিং চেনের হাতিয়ার। হিন্দুরাষ্ট্রের শ্লোগান তখনো বাবরি মসজিদের ধ্বংসের নীচে লালিত হচ্ছে, মেন পলিটিক্যাল এজেন্ডা হয়ে ওঠেনি। ২০২০ তে এখনকার প্রধানমন্ত্রী সরাসরি রামমন্দিরকে প্রতিষ্ঠা দিলেন এবং তুলনার উল্টো রাস্তায় হাঁটলেন। মন্দির প্রতিষ্ঠাকে তুলনা করলেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের তুল্য-মূল্যে। রাম মন্দির নির্মাণ আর ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামকে দাঁড়িপাল্লার দু’দিকের পাত্রে রেখে সমান সমান দেখালেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী ।
স্বাধীনতা আন্দোলনে ধর্ম:
ভারতের স্বাধীনতার জন্য লড়াই ছিল ধর্মনিরপেক্ষভাবে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসকদের বিরুদ্ধে ভারতীয় জনগণের লড়াই। এর জন্য কষ্টবরণ করেছেন, জীবন দিয়েছেন নারী পুরুষ নির্বিশেষে বিভিন্ন জাত, ধর্ম ও শ্রেণির মানুষ যা বিশেষভাবে উল্লেখ্য।
দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং রামমন্দির নির্মাণকল্পে কাদের ও কী ভূমিকা তা ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসের অঙ্গ যা অসম্পূর্ণ হলেও অজ্ঞাত নয় । এর সঙ্গে হিন্দুধর্মের অতিব্যবহারের কার্য-কারণ সম্পর্ক জুড়ে নেওয়াটা চিত্রকে চালচিত্রের বর্ণময়তা দেবে।
বর্ণবাদী হিন্দুত্ব:
যে হিন্দু ধর্মের কথা প্রধানমন্ত্রীর দল এবং রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের পরিচালকরা বলে চলেছেন ক্রমাগত, সনাতন হিন্দুধর্মের যে চিত্রকল্প তাঁরা তুলে ধরছেন বারবার তা সম্পূর্ণভাবে মনুবাদী।
ধর্মের পদবাচ্য হয়ে এখানে আছে চতুবর্ণভিত্তিক জাতপাত ব্যবস্থা, নারী অবদমন, দলিত নির্যাতন। সুপ্রাচীন হিন্দুধর্মের অন্য সমস্ত ধারাগুলিকে অস্বীকার করে (সিমলা স্ট্রীট প্রয়োজন মতো থাকলেও, দক্ষিনেশ্বর তাই নেই) ধর্মীয় সংস্কৃতিনির্ভর নানা যাপনের ধারায় অভ্যস্ত হিন্দুসমাজকে, হিন্দুধর্মের বিভিন্ন ধারা- উপধারাকে (সেক্ট) এক ঝান্ডার নীচে আনার চেষ্টার প্রয়োজনেই এই রাজপতি রাম, রামমন্দির, রামরাষ্ট্র। এক ঢিলে অনেক পাখী মরে না হয়ত কিন্তু উড়িয়ে তো দেওয়া যায়! গোবলয়ের ধর্মীয় সংস্কৃতি সারা দেশে চাপিয়ে দেওয়ার প্রধান বাধা ভারতের দক্ষিণদেশ। সেখানে শৈবধর্মের প্রাবল্য। এই ভাবধারায় প্রধান চরিত্র শিব। তিনি ক্ষত্রিয় নন, বেশবাস অগোছালো, জীবনযাপন সাদামাটা। তিনি বীর নন, যুদ্ধংদেহী ভাব একদমই নেই আর কেমন যেন ঘরের মানুষ। প্রকৃতির কাছাকাছি তার অবস্থান। নিজেই মহেশ্বর, শ্বশুরালয় হিমালয়। আবার স্ত্রীর অসম্মানে মেদিনী কাঁপানো নটরাজ তিনি। ফলে রাজনৈতিক আইকন হয়ে ওঠার যোগ্য নন। হাফ-প্যান্ট, লাঠিসোটা, তরবারি, গদা, শারীরিক কসরত, লেফট-রাইট বড্ডই যেন বেমানান শিবের অনুষঙ্গে। মথুরা তনয় নিয়েও কথা উঠেছিল মাঝেমধ্যে , কাজ বেশীদূর এগোয় নি। যদিও যুদ্ধক্ষেত্রে তার উপস্থিতি ছিল কিন্তু তা প্রধানত দার্শনিক হিসাবে, একটা তীরও কারো বুক লক্ষ্য করে তিনি ছোঁড়েন নি। বরং পরম প্রেমময় হিসাবে তিনি পূজ্য। তিনি প্রেমের প্রতীক, তার প্রেমলীলা সংগীতময়। তার প্রেমগাঁথা কাব্যের সম্পদ। অতএব তিনিও আইকন হিসাবে গ্রাহ্য নন।
অর্থাৎ রাম মন্দির পরিকল্পনাটি একটি বিশেষিত ধর্মের লেজ ধরে রাজনীতির বৈতরণী পার হওয়ার কড়ি জোগাড়। তাতে সমাজ ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয় হোক, সংখ্যাগরিষ্ঠতার যোগান থাকলেই হবে।
মৌনতাই সম্মতি:
ভারতের প্রধানমন্ত্রী জানেন রামমন্দির নির্মাণের জন্য আত্মবলিদানের কাজকে, আপামর জনসাধারণের অংশগ্রহণের প্রতীক স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে তুলনা করলেও খুব বেশি প্রতিবাদ এ নিয়ে জমা পড়বে না। কারণ ভোটযুদ্ধে পরাজয়ের ভয় ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের আবেগের কাছে মাথা নোয়াবে। হয়েছেও তাই। রামমন্দির নির্মাণে এক ধর্মনিরপেক্ষ দেশের প্রধানের উপস্থিতি আর স্বাধীনতা সংগ্রামের অবমূল্যায়ণের বিরোধিতাকে একই সঙ্গে দলীয় কর্মসূচির কার্পেটের তলায় চালান করে দিয়েছেন বেশীরভাগ দলই।
ধর্ম ও অর্থনীতি:
আজ চিন্তার প্রধান বিষয় এই যে বিশ্বজুড়ে পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থাটি হাবুডুবু খাচ্ছে করোনা নামক ভাইরাসের অথৈ সমুদ্রে। আর এই ব্যবস্থা অক্সিজেন চাইছে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় বদান্যতার আই সি সি ইউ- তে। তাই করোনার সোস্যাল ডিস্টেনসিং আর লকডাউনের লৌহ-ঘেরাটোপে চলছে ছাঁটাই, ডিসইনভেস্টমেন্ট, বেসরকারীকরণ, প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ, পরিবেশ ধ্বংস। কর্পোরেটদের আহ্বান করে বার্তা দেওয়া হচ্ছে যথেচ্ছচারের– পরিবেশ বিধি ও শ্রম আইন লঘু করার মধ্যে দিয়ে রোগলক্ষণ প্রকাশ পাচ্ছে। আমেরিকান ডলার সাম্রাজ্যকে প্রানবায়ু জোগাতে চিনদেশের বিদেশি কর্পোরেট সংস্থাগুলিকে স্থান করে দিতে চাইছে দেশের সরকার। শিক্ষাব্যবস্থার আমূল সংস্কারের তড়িঘড়ি উদ্যোগের লক্ষ্যই তাই। মনে রাখতে হবে এই আকালেও অনলাইন এডুকেশন সংস্থাগুলি প্রভূত লাভের মুখ দেখেছে এবং তাদের শেয়ারের দাম উর্দ্ধমুখী।
হাতে রইল পেন্সিল:
অর্থনীতি মরণকামড় দেবে। জীবন পশুর ন্যায় অতিবাহিত হবে। আর এই অবস্থাকে স্বয়ম্ভরতা অর্জন, দেশপ্রেম, প্রতিবেশী দেশের ষড়যন্ত্র, বিধর্মীর সন্ত্রাস, ধর্মীয় বিধান ইত্যাদি যখন যেমন-তখন তেমন বলে প্রচারমাধ্যম আর রাজনৈতিক – আধারাজনৈতিক দলগুলি শুধু নয়, সামাজিক জীবনে হস্তক্ষেপ করবে ধর্মীয় দলগুলিও। ধর্মীয় দর্শনের অঙ্গশোভা হবে পুরাণের অতিকথা, আধুনিক হতে চেয়ে তাকেই বিজ্ঞান বলে জনগণকে বোকা বানানো চলবে। গণেশ জানান দেবে প্রাচীন ভারতের শল্য চিকিৎসার স্বর্ণযুগের, পুষ্পক রথ মহাকাশযান, কৌরব- শতপুত্র টেষ্টটিউব বেবীর….। গরুর চোনা ও গোমল রসায়নবিদ্যার খাপে ঢুকে জীবাণুনাশক ‘গোনাইল’ হয়ে বাজারে বিকোবে। অলৌকিক অতিন্দ্রিয় ভাবধারা বিজ্ঞানকে চোখ রাঙাবে রাস্তা ছেড়ে নামার জন্য। ক্ষমতার বৃত্ত সম্পূর্ণ করার প্রয়োজনে ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র যার উল্লেখ রয়েছে সংবিধানে তাও যে সংশোধিত করা হতে পারে, এই আশঙ্কা অমূলক নয়। স্বাধীনতা আন্দোলনকে দাঁড়িপাল্লায় চাপানোর এটাও একটা কারণ।
শেষ নাহি যার….
অসীম সংখ্যক মানুষই “শুধু দুটি অন্ন খুঁটি কোন মতে কষ্টক্লিষ্ট প্রান”। তবু স্বপ্ন থেকেই যায়। ঈশ্বর মানুষের সমস্ত স্বপ্নের নির্যাস দিয়ে গড়া এক কাল্পনিক ইচ্ছাপূরণ। তার কাছেই আত্মসমর্পণ। তাকে ঘিরেই যাপন। এই কল্পনা বিমূর্ত হয়েও পিছনে ফেলে দেয় মূর্ত বাস্তবকে। রোজনামতার যন্ত্রনার থেকে দেয় সাময়িক অবসতা। শুধু বিজ্ঞানের প্রচার এই বিমূর্ততা ভাঙার কাজে আজ আর, বিমূর্ত অর্থের এই সর্বময়তার যুগে, সম্পূর্ণ কার্যকরী হয়ে ওঠার কাজে অক্ষম। যে আর্থিক ব্যবস্থা পৌনঃপুণিক লাভের গতিকে বাড়িয়ে চলাটাকেই মোক্ষ করেছে অর্থ সে ব্যবস্থায় ঈশ্বরপ্রতিম। বিজ্ঞান যে একটি সামাজিক উৎপাদন প্রক্রিয়া তা আজ অনেক স্পষ্ট। উত্পাদন- ভোগ- বন্টনের সমীকরণ তাকে পথ দেখায় যা সমাজকে পৌঁছে দেয় এক পণ্যমোহবদ্ধতায়। মূল্যের বিমূর্ত জগত অর্থকে ঈশ্বরের জায়গায় প্রতিস্থাপিত করে। তাই বিজ্ঞানের আকাঙ্খিত মূর্ত জগৎ মরীচিকা বলে মনে হয়। অর্থনীতির এই জগতকে আপসাইড ডাউন অর্থাৎ ঝুঁটি ধরে না উল্টাতে পারলে জীবন পদ্মপাতায় জল।