শঙ্খদীপ ভট্টাচার্য
জল আলো বাতাস মাটি এমন আরও অনেক কিছুর সম্মেলনে যেভাবে একটি বীজ আস্তে আস্তে বনস্পতি হয়ে ওঠে ঠিক তেমনই একটি ভ্রূণ মাতৃজঠরে প্রত্যহ তিলে তিলে স্ফীত হয়ে পূর্নাঙ্গ শিশুর চেহারা নেয়। নারীর শরীরেই যেন প্রকৃতির প্রতিফলন, প্রকৃতির মতোই সে প্রাণের প্রতিপালক। এই অর্থে নারীর সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্ক অনন্যসাধারণ। নারী ও প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যে এক মহৎ সৌহার্দ্য গড়ে ওঠে। জন্ম হয় নারীবাদের এক নতুন ধারার। নাম ইকোফেমিনিসম। বাংলা করলে দাঁড়ায় পরিবেশ নারীবাদ।
ইকোফেমিনিসম ও ইকোক্রিটিসিজমের আলোয় শকুন্তলা
ফরাসি নারীবাদী লেখক ফ্রাসোয়াঁ দ্যুবন (Françoise d’Eaubonne) ১৯৭৪ সালে প্রথম ইকোফেমিনিস্ম শব্দটি তার Le Féminisme ou la Mort (নারীবাদ নাকি মৃত্যু) গ্রন্থে ব্যবহার করেন। এই বইটির মূল উপজীব্য মূলত নারীর ও প্রকৃতির ওপর মানুষের আধিপত্য বিষয়ক মতবাদ। প্রকৃতির সঙ্গে নারীর একাত্মতা ও ঘনিষ্ঠতা পরিবেশ মূল্যায়নের অন্যতম এক দিক। নারীর ওপর পুরুষের ও প্রকৃতির ওপর মানুষের আধিপত্য বিস্তারের মধ্যে যে যোগসূত্র তা এই মতবাদকে সামনে আনলে স্পষ্ট ফুটে ওঠে। সৃষ্টির একেবারে প্রথম থেকেই নারীরা প্রকৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে বলেই ইকোফেমিনিসমের জন্ম।অথচ পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থায় নারীর সঙ্গে প্রকৃতির এই আকাঙ্ক্ষিত সম্পর্কটিই বিপর্যস্ত। প্রকৃতি-কেন্দ্রিক সংস্কৃতির জায়গায় প্রশ্রয় পেয়ে এসেছে এক পণ্য-কেন্দ্রিক ফেটিশ (fetish) সংস্কৃতি। এর ঘেরাটোপে নারী, শিশু, দরিদ্র, বর্ণবৈষম্যের শিকার মানবগোষ্ঠী ইত্যাদির মতোই প্রাকৃতিক নানান উপাদান যেমন, বায়ুমণ্ডল, স্থলভাগ, জলসম্পদ এবং প্রাণীজগৎ অবদমিত ও শোষিত হয়ে চলেছে । ইকোফেমিনিস্টদের মতে এই প্রকৃতিবিমুখ অবস্থা থেকে মুক্তির একমাত্র পথ হল পরিবেশ নারীবাদ। এই মতবাদের যথাযথ প্রয়োগেই পরিবেশ সংরক্ষণ ঘটানো সম্ভব হবে। নারীর মন মমতায় পরিপূর্ণ। আন্তরিক যত্ন ও তন্নিষ্ঠ লালনের কথা উঠলে পুরুষ নয়, নারীর কথাই আমাদের মনে আসে। নারীর এই গুণেই সমাজ সঠিক পথে পরিবেশ সংরক্ষণ ও প্রাকৃতিক সম্পদের প্রতি যত্নবান হবে। নারী যেমন নিজের সংসারকে স্নেহ, সহযোগিতা ও সহমর্মিতা দিয়ে আগলে রাখে, সেভাবেই প্রাকৃতিক পরিবেশকে সুরক্ষিত রাখা সম্ভব হবে।

এই পরিপ্রেক্ষিতেই সমকালীন সাহিত্যে এক নতুন তত্ত্বের জন্ম হয়। ১৯৭৮ সালে উইলিয়াম রুখার্ট সেই তত্ত্বের নাম দেন ইকোক্রিটিসিজম। প্রকৃতির প্রতি গাঢ় অন্তরঙ্গতা, মানুষ ও প্রকৃতির নিবিড় সম্পর্ক সম্বন্ধে সচেতনতাই হল ইকোক্রিটিসিজমের মূল কথা। চেরিল গ্লটফেল্টির মতে নদ-নদী-মরুভূমি-পর্বত-শহর-প্রযুক্তি-মানবশরীর-সংস্কৃতি সব কিছুই এর অর্ন্তগত। ইকোক্রিটিকরা প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্য বিশেষ করে কালিদাসের শকুন্তলা নাটকটিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। কালিদাস বলতে চেয়েছেন মানুষ প্রকৃতির কাছাকাছি যতক্ষণ থাকে ততক্ষণ সে সুখে থাকে, প্রকৃতিবিযুক্ত হলে তার মানসিক সংকট সৃষ্টি হয়। কণ্বের তপোবনে মানুষ আর মানবেতর প্রাণীরা নির্বিবাদে বাস করে। অন্যদিকে রাজা দুষ্মন্ত অরণ্যের কেউ নন। প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর স্বেচ্ছাচারিতার আনন্দে এক হরিণের দিকে তির নিক্ষেপ করতে গেলে তপস্বী তাঁকে বলেন: মহারাজ, আশ্রমমৃগ বধ করবেন না—রবীন্দ্রনাথের ভাষায়: মৃদু এ মৃগদেহে মেরো না শর/ আগুন দেবে কেহে ফুলের পর। কতদিন আগের তপস্বীর এই কাতর অনুরোধ ইকোফেনিস্ট, ইকোক্রিটিক তো বটেই, তাছাড়াও সমগ্র পরিবেশসচেতন মানুষের মনের গভীরতম অঞ্চলের কথা। মানবেতর প্রাণীরাও যে কোনও না কোনওভাবে প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করে সে কথা সকল মানুষের মনে গেঁথে যাওয়া উচিত। দুষ্মন্তের আচরণ এবং পরবর্তীকালে শকুন্তলাকে প্রত্যাখ্যানের মধ্যে দিয়ে একদিকে যেমন প্রতিফলিত হয় প্রকৃতির ওপর তাঁর খবরদারির উল্লাস এবং এই উল্লাসের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে তাঁর পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতা। কণ্ব শকুন্তলাকে পতিগৃহে পাঠানোর সময় তপোবন তরুদের সম্বোধন করে বলেন, হে সন্নিহিত তরুগণ! যিনি তোমাদের জলসেচন না করে কদাচ জলপান করতেন না, ভূষণপ্রিয়া হয়েও কদাচ যিনি তোমাদের পল্লবভঙ্গ করতেন না, তোমাদের কুসুমপ্রসবের সময় উপস্থিত হলে যাঁর আনন্দের সীমা থাকত না, সেই শকুন্তলা আজ পতিগৃহে যাচ্ছেন, তোমরা সকলে অনুমোদন করো। এই উক্তি থেকে শকুন্তলার সঙ্গে অরণ্য ও বৃক্ষলতার অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক স্পষ্ট ফুটে ওঠে।দেখা যায় যে ন্যাচারাল হ্যাবিটাট (Natural habitat) ছেড়ে দুষ্মন্তের রাজসভায় আসায় শকুন্তলা বিচ্ছিন্নতা বোধ করছেন, অস্থির হয়ে উঠছেন। প্রকৃতি বিচ্ছিন্ন শকুন্তলার এই যন্ত্রণা আজকের জলবায়ু সঙ্কটের কবলে পড়া সকল মানুষের বিপন্নতার সঙ্গে যেন এক হয়ে যায়। শকুন্তলা ফিরে আসেন প্রকৃতির মধ্যে। শান্ত হয় তাঁর মন। এই আশ্রমেই দুষ্মন্তের সঙ্গে তাঁর পুর্নমিলন হয়। এই মিলন নিছক নরনারীর মিলন নয়, বস্তুত তাঁদের আকাঙ্ক্ষার সমলয়ন, নারী পুরুষের মধ্যের প্রাকৃতিক সম্পর্কের পুনরুদ্ধার, প্রকৃতির কোলে তাঁদের পুনরুজ্জীবনকেই বোঝায়।
ইকোফেমিনিসম ও বস্তুবাদ
প্রসঙ্গত ইগালিটারিয়ান কম্যুনিজমের সমালোচনা করে নারী পুরুষের সম্পর্ক নিয়ে কার্ল মার্কসের বক্তব্য বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মার্কসের কথায়, “ From the character of this relationship follows how much man as a species-being, as man, has come to be himself and to comprehend himself; the relation of man to woman is the most natural relation of human being to human being. It therefore reveals the extent to which man’s natural behaviour has become human, or the extent to which the human essence in him has become a natural essence—the extent to which his human nature has come to be natural to him”। মানবিক সম্পর্কগুলির মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রাকৃতিক সম্পর্কটির গভীরে পৌঁছে আমরা দেখি যে আগামী প্রজন্মকে জন্ম দেওয়া ও গড়ে তোলার ক্ষেত্রে পুরুষের ভূমিকা শুধুমাত্র শুক্রাণু দ্বারা ডিম্বাণুকে নিষিক্ত করা। তারপরেই প্রকৃতি দখল নেয় হবু সন্তান ও মায়ের শরীরের এই সৃষ্টিকে সুরক্ষিত রাখতে। মাতৃজঠর হয়ে ওঠে জটিল এক প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার পবিত্র আধার। কোটি কোটি মাইক্রোবস (microbes) বাইরে থেকে মাতৃগর্ভে প্রবেশ করে নিষিক্ত ডিম্বাণুকে ঘিরে ফেলে। এরা সমস্ত ক্ষতিকারক জীবাণুর থেকে আগলে রাখে ডিম্বাণুকে। এই সময়ে নারীকে প্রকৃতির থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখার চেয়ে জঘন্য কাজ আর বুঝি কিছু হয় না। পুঁজিবাদী পিতৃতান্ত্রিক পরিবেশে গর্ভাবস্থায় নারীকে এমনই সব শারীরিক ও মানসিক অবস্থার মধ্যে দিয়ে যেতে হয় যা প্রকৃতি অনুমোদন করে না।। শ্রেণির তারতম্যে এই অপব্যবহারের চরিত্র আলাদা হলেও নারীকে শোষনের শিকার হতেই হয়। জন্ম নেয় অবিকশিত রোগসম্পন্ন শিশুর।
বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে ইকোফেমিনিস্ট ক্যারোলাইন মারচেন্ট(Carolyn Merchant) যথার্থই বলেছেন, “Social ecofeminism advocates the liberation of women through overturning economic and social hierarchies that turn all aspects of life into a market society that today even invades the womb”.
এখান থেকেই প্রমাণ হয় সন্তানের সঙ্গে নারীর ও প্রকৃতির গভীর যোগাযোগ। শুধু তাই নয় সন্তান ভূমিষ্ট হওয়ার আগেই মাতৃ স্তনে মাইক্রোবস বাসা বাধে, যাতে ভূমিষ্ট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই স্তন পানের মাধ্যমে শিশুর অন্ত্রে এই গাট মাইক্রোবায়োটা(gut microbiota) দুধের আগে পৌঁছে যায়। পরে এই গাট মাইক্রোবায়োটা অন্ত্রের সঙ্গে শিশুর মস্তিষ্কের যোগসূত্র ঘটায় ভেগাস স্নায়ুতন্ত্রের মাধ্যমে। অথচ এই সময়ে মায়ের দুধের সঙ্গে শিশুর পেটে জায়গা করে নিচ্ছে প্লাস্টিকের আণুবীক্ষণিক কণা। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে স্নায়ুর স্বাভাবিক প্রকৃতিজাত কার্যকলাপ। আমরা কিন্তু জানতেই পারছি না। পুঁজিবাদ ও পিতৃতন্ত্রের যোগসাজশ এই অপ্রিয় সত্যকে আড়ালে রেখে দেয় লুমপেন ফেটিশ সংস্কৃতির কৃত্রিম আলোর মোড়কে।

পুঁজিবাদকে যে কোনও মূল্যে টিকিয়ে রাখতে প্রাকৃতিক সম্পদের লাগামছাড়া ব্যবহারের হালের অভূতপূর্ব নারকীয় উল্লাসের খেসারত দিতে হচ্ছে পৃথিবীকে। করোনাকালে লবেজান মানুষের আকুতি অলিতে গলিতে। প্রকৃতির প্রত্যাঘাত এমনই হয়। অন্যদিকে হলিউডের পিতৃতান্ত্রিক পরিবেশকে চ্যালেঞ্জ করেছেন সেখানকার নারীরা। মিটু আন্দোলন থেকে হালের সবরিমালা প্রতিবাদ নারীদের তরফ থেকেই এক প্রত্যাঘাত। প্রকৃতি ও নারীর ওপর ব্যাক্তিগত মালিকানা কায়েম করে নিপীড়ন যেন সমার্থক হয়ে উঠছে।
ইকোফেমিনিসমের ভিত্তি হিসেবে প্রকৃতির ওপর মানুষের এই নিপীড়ন ও তার সঙ্গে নারীর ওপর পুরুষতন্ত্রের আধিপত্যের যে সাজুয্য তা আজকের জলবায়ু সঙ্কটের নিরিখে এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মতবাদ। এই সাযুজ্য ক্ষতিগ্রস্ত প্রকৃতি ও নারী-পুরুষ সম্পর্কের প্রাকৃতিক দিকটির পুনরুদ্ধারের মধ্যেও। সুস্থ জীবন বজায় রাখতে প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের নিরন্তর কথোপকথন এবং স্বাভাবিক সম্পর্ক বজায় রাখতে নারী-পুরুষ আকাঙ্ক্ষার সমলয়নের মধ্যেও দেখা যায় এই সাযুজ্য। সমকালীন প্রেক্ষাপটে নারী ও প্রকৃতিকে তাদের আকাঙ্ক্ষিত বাস্তবতায় প্রতিষ্ঠা করতে ইকোফেমিনিসম এক মজবুত হাতিয়ার।
তথ্যসূত্র :
১. Economic and Philosophic Manuscripts of 1844, Karl Marx, Aakar Books Classics, 2016
২. Merchant, Carolyn (2005). “Ecofeminism”. Radical Ecology. Routledge. pp. 193–221.
লেখক পরিচিতি
লেখক পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। ছোটগল্পের পাশাপাশি সমাজ ও বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধ লিখে থাকেন।
মেইল আই ডি- bhattacharya.sankhadeep@gmail.com






বেশ বলিষ্ঠ লেখা…. নারী ও প্রকৃতি তাদের আলাদা করে কোন সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করতে হবে কেন বলুন তো … কেন তাদের সহজভাবে গ্রহণ করতে পারি না আমরা… কেন এত অত্যাচার…. কিছু দিন আগে ঘটে যাওয়া নৃশংস ঘটনায় মন বড় ভারাক্রান্ত ।