বাসুদেব মুখোপাধ্যায়
স্বীকার করতেই হবে কবিতা হল যে কোনো সময়কালের সামগ্রিক ভাবময়তার নির্যাস। একমাত্র কবিতার মধ্য দিয়েই সমসাময়িক সময় ও অবস্থাকে সর্বাপেক্ষা গভীরভাবে ফুটিয়ে তোলা সম্ভব হয়। সম্প্রতি নেটের দৌলতে কিছু আধুনিক চীনা কবিতা পড়ার সুযোগ হয়েছিল, অবশ্যই ইংরাজি অনুবাদে। এর একটির স্বচ্ছন্দ অনুবাদ করে দিলাম। কবির নাম Xu Lizhi এবং কবিতাটি China Labor Bulletin পত্রিকা থেকে পাওয়া। কবিতাটির সাল তারিখ হল সেপ্টেম্বর 17, 2013.
আমি অনন্যোপায় তাই রক্তের কথা বলি!
মৃদুমন্দ হাওয়ায় দোলা ফুলের কথা বলতে আমি ভালোবাসি
ভালোবাসি চন্দ্রালোকে আলোকিত তুষারশুভ্র পাহাড়ের কথা বলতে,
ভালো লাগে সাম্রাজ্যের ইতিহাসের আলোচনা করতে,
মদিরার আবেশ ধরানো কবিতার কথা বলতে ভালোবাসি
কিন্তু বাস্তব অবস্থা আমাকে রক্তের কথা বলতে বলে।
দেশলাই বাকসের আয়তনের ভাড়া কুঠুরিতে রক্ত গড়িয়ে পড়ে
সংকীর্ণ, ঘিঞ্জি যেখানে বছরে কখনও সূর্যের আলো ঢোকে না,
সেখান থেকে খেদিয়ে বার করে দেওয়া যুবক-যুবতীরা যখন
পথে ঘোরা নারীর সঙ্গে মিশে যায় যাদের বর রয়েছে দূরে,
সিচুয়ানে ঝুনঝুনি বিক্রি করছে, হয়তো
তখন বৃদ্ধা নারী হেনানে ফুটপাত দখলের লড়াইয়ে নেমেছে,
আর আমি সারা রাত জেগে একটা কবিতা লিখছি।
যখন সারাদিন উদরপূর্তির জন্য দৌড়েছি
এখন আমি এদের সবার কথা, আমাদের কথা বলছি
যারা পিঁপড়ের মতো শুধু প্রাণটুকু নিয়ে সাঁতরে চলেছে
যাদের কাজের রাস্তায় ফোঁটা ফোঁটা রক্ত ঝরছে।
রক্তের কথা বলছি যখন আকাশ ভেঙে পড়ছে
রক্তের কথা বলছি যখন সমস্ত মুখ আমার ঘনারুণ।
কাজে যাই হোক না কেন অন্তত রাষ্ট্রীয় প্রচারে চিনের গণপ্রজাতন্ত্র আমাদের জানাতে চায় যে তাঁরা মার্কসীয় সমাজতন্ত্রর অনুশীলন করে। এই অনুশীলনের সারাৎসার হল সর্বসমতাবাদী আর্থসামাজিক ব্যবস্থাকে প্রতিষ্ঠিত করা। আমরা বলতেই পারি, মার্কসের সমগ্র জীবনভাবনার সারাৎসার হল এই ধরনের পূর্বানুমান যে একদিন পৃথিবীতে শ্রমিকশ্রেণীর একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু তা এখনও বিশ্বব্যাপী বাস্তবায়িত হওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। এব্যাপারে আমরা একটু গভীরভাবে পর্যালোচনা করতে পারি। আমরা আলোচনা করে দেখতে পারি কেন শ্রমিকশ্রেণী দেশে দেশে নিজেকে মুক্ত করতে ব্যর্থ হচ্ছে। কেননা সমগ্র মানবজাতির মুক্তি তো দূর অস্ত, শ্রমিকশ্রেণী তাদের নিজেদের কল-কারখানার শোষণ-অত্যাচার থেকে আজও নিজেদের মুক্ত করতে পারেনি। পৃথিবীর কোনো দেশে এমনটি ঘটতে দেখা যাচ্ছে না। এমনকি চিনের মতো তথাকথিত ‘সমাজতান্ত্রিক’ দেশেও নয়। যদিও মাও বার বার সর্বসমতাবাদী রাজনীতির কথা বলতেন এবং চিন গণপ্রজাতন্ত্রে তিনটি ক্ষেত্রে যে অনেক পরিমাণে বৈষম্য, অসাম্য রয়েছে তা তিনিও স্বীকার করে নিয়েছিলেন। তাই তিনি বলতেন, চিনের সমাজতন্ত্রর কাজ হল এই তিনটি ক্ষেত্রের বৈষম্য ঘুচিয়ে দেওয়া যথা গ্রাম বনাম শহর, কায়িক শ্রম বনাম মানসিক শ্রম, নারী বনাম পুরুষ। শেষ অব্দি মাও, আলবেনিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির একদল প্রতিনিধিদের কাছে কার্যত স্বীকার করে নিয়েছিলেন, তাঁদের পরাজয় নিশ্চিত! মাও যে ভবিষ্যৎদ্রষ্টা ছিলেন এর সব থেকে বড় প্রমাণ শ্রমিকদের লেখা ঐ কবিতাগুলি।
আজও সেখানে এই সমস্ত ক্ষেত্রগুলিতে যথেষ্ট বৈষম্য রয়েছে তা সেখানকার শ্রমিকশ্রেণীর প্রতিনিধিত্বকারী পত্রিকা ‘China Labor Bulletin’-এর বিভিন্ন লেখায় ছত্রে ছত্রে স্বীকার করা রয়েছে। এমনকি কোথাও অবস্থা এমনই খারাপ যে তা চরম পিছিয়ে পড়া দেশগুলির থেকেও খারাপ। এই পত্রিকার লেখাগুলি পড়লে যে কেউ অনুমান করতে পারবেন সে দেশে জীবনযাপনের এই ধরনের দুর্বিষহ অবস্থার বিরুদ্ধে সব থেকে বেশি সরব হয়েছেন শ্রমিকরা, যারা অত্যন্ত খারাপ অবস্থার মধ্যে পড়ে এমন পশুর মতো জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন। এই নির্যাতিত শ্রমিকরাই হলেন এই অবস্থার খাঁটি কন্ঠস্বর। তারা এই বুলেটিনে কবিতা থেকে শুরু করে এই বিষয়ের ওপর অসংখ্য মর্মস্পর্শী লেখা লিখেছেন। যে কেউ অনুভব করবেন এই লেখাগুলির মাধ্যমে তারা মুখ থুবড়ে পড়া তথাকথিত সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির ওপর মৌলিক ধরনের কিছু প্রশ্ন উত্থাপিত করেছেন। এই ধরনের কল-কারাখানাতে শ্রমিকদের কাজ করে কী লাভ যদি ঐসব কল-কারখানা সামগ্রিকভাবে অপমৃত্যু ফাঁদ হয়! যদি ঐ কারখানায় শ্রমিকদের প্রতিনিয়ত রক্তপাত ঘটতে থাকে! ঐ কারখানা যদি শ্রমিকদের আত্মহত্যায় প্ররোচিত করে?
নেটে পাওয়া যায়, তাই ঐ পত্রিকার অসংখ্য ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লেখাপত্র পড়ে পাঠক- পাঠিকারা এই ভয়ংকর, মর্মবিদারক তথ্য যাচাই করে নিতে পারেন। বর্তমান চিনের আর্থসামাজিক-সাংস্কৃতিক অবস্থা সম্পর্কে নিজেদের মতামত গঠন করতে পারেন।
তথ্যসূত্র:
https://clb.org.hk/content/migrant-workers-and-their-children
লেখক পরিচিতি:
মন- চিকিৎসক ও প্রাবন্ধিক।