নতুন বিশ্বের উত্থান ও মার্কিন  ব্যবস্থার নাভিশ্বাস 

মার্কিন শুল্কনীতি নিয়ে ক্ষোভ তুঙ্গে। মিত্ররাও মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে, দেশজুড়ে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ছাঁটাই ঘিরে বিক্ষোভ তীব্র। প্রশ্ন উঠছে—এই নীতির বিকল্প কী?

অরূপ ঘোষ 

 ভূমিকা 

 মার্কিন শুল্কনীতি আজ সারা বিশ্বে সবচেয়ে সমালোচিত। তার কাছের মিত্ররাই তাকে ত্যাগ করে  শত্রু শিবিরে যাওয়ার কথা ভাবছে। তাই মার্কিন শুল্কনীতি তার বহিরঙ্গে যেমনি দগদগে ঘা তৈরি করছে, একইভাবে দেশের  অন্দরে ব্যাপক ছাঁটাই নীতি তার অন্তরঙ্গে নতুন এক বিরোধের জন্ম দিচ্ছে। যে মধ্যবিত্ত শ্রেণী মার্কিন দেশকে স্বর্গরাজ্য হিসেবে ভাবতো, তাদের কাছে মার্কিন দেশ এক ধাক্কায় নরকে পর্যবসিত হয়েছে, তারা আজ রাস্তায় নেমে এসেছে। তাহলে প্রশ্ন জাগে মার্কিন এই নীতির শূন্যস্থান কোন নীতির দ্বারা ভরাট হবে।

 ২০০৮ এর পর থেকেই মার্কিন দেশের সবচেয়ে বঞ্চিত, নিপীড়িত মানুষজন এই বিকল্প পথ তৈরি করার সংগ্রামে ব্যস্ত । সেই সংগ্রামী পথ আলোচনার আগে, মার্কিন শাসক শ্রেণীর পতনের চিত্রটিকে  সামনে আনা যাক।

 মার্কিন কদর্য অর্থনীতির বিকল্পে কী ধরনের রাজনীতি আজ উঠে আসছে 

গত ৫ ও ৬ই এপ্রিল সারা আমেরিকা জুড়ে প্রায় ১২০০ থেকে ১৪০০ স্থানে বিরাট বিরাট প্রতিবাদ দেখা যায়। প্রতিবাদে প্রায় দু’লক্ষের অধিক মানুষ রাস্তায় নেমে আসে।এই প্রতিবাদের কারণ ট্রাম্প ও এলেন মাক্স এর যুগলবন্দিতে মার্কিন দেশজুড়ে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সমাজ কল্যাণ খাতে যে বিভাগগুলি ছিল অর্থাৎ সরকারি স্কুল থেকে, সরকারি দফতর অব্দি তুলে দিচ্ছে মারকিন ফেডারেল সরকার, প্রায় দু-লক্ষের অধিক মানুষ কর্মচ্যুত হচ্ছে, এবং প্রান্তিক মানুষজনদের জন্য যেসব গণতান্ত্রিক সুযোগ-সুবিধা ছিল যেমন এলজিবিটিদের অধিকার, বিদেশি নাগরিক এবং কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের জন্য যেসব সুযোগ সুবিধা ছিল সেগুলিকে তুলে দিচ্ছে মার্কিন সরকার। সব থেকে আশ্চর্যের বিষয় যেসব রাজ্য থেকে ট্রাম্প দুদিন আগে বিপুল জনসমর্থন পেয়ে মার্কিন সর্বাধিনায়ক হয়েছেন, সেই সব রাজ্যেই প্রতিবাদের ঢেউ বেশি। এই ছাঁটাই পরিচালনা করা হচ্ছে এলেন  মাস্কের দপ্তর থেকে যার নাম দেয়া হয়েছে, DOGE – DEPARTMENT OF GOVERNMENT EFFICIENCY অর্থাৎ সরকারি দক্ষতা বাড়ানোর জন্যই এই ছাঁটাই। তাহলে প্রশ্ন জাগে,যে মার্কিন সরকার এতদিন ধরে পৃথিবীব্যাপী রাজ করে গেল যে উচ্চমানের সরকারি দক্ষতার সাথে, সেই সরকার আজ অদক্ষ হয়ে গেল কী করে। শুধুমাত্র এই দু লাখ মানুষের জন্য, আর প্রান্তিক মানুষদের গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য! 

 কেন মার্কিন দেশ আজ অদক্ষ হয়ে উঠছে 

এর কারণ লুকিয়ে আছে ছাঁটাই করা মানুষদের জন্য নয়। আসল কারণ হচ্ছে এতদিন ধরে মার্কিন দেশ যে জালিয়াতি এক অর্থনৈতিক পরিকল্পনা নিয়ে চলছিল সেইটি আজ তার জালিয়াতি করার দক্ষতা হারিয়েছে।

 কী সেই জালিয়াতি 

মার্কিন দেশ এতদিন ধরে এই জালিয়াতিকে এক আধিপত্যকারী জোরের সাহায্যে ধামা চাপা দিয়ে রেখেছিল,আজ তা সামনে উঠে আসছে। ১৯৭০ সালে মার্কিন অর্থনীতি stagflation এ আটকে গেলে, মার্কিন দেশ ব্রেটেন উডস ব্যবস্থার ফিক্সড এক্সচেঞ্জ রেট ভেঙে দেয়। অর্থাৎ এক আউন্স সোনা সমান ৩৫ ডলার।তার থেকেই শুধু বেরিয়ে এল না একেবারে সোনার সাথে বিচ্ছিন্ন করে দিল ডলারকে। অর্থাৎ ডলারের ডিমেটেরিয়ালাইজেশন হলো, আর সারা বিশ্বব্যাপী প্রচার করতে শুরু করল মার্কসের মূল্য তত্ত্বের আজ কোন দরকার নেই, সেটা আজ অকেজো। এর ফলে মার্কিন অর্থনীতি কার্যত এক আধুনিক পাঞ্জি স্কিমে পরিণত হয়, ছোট করে বললে  আমাদের দেশে নারোদা, সারদার মতো ঘটনায় যা ঘটেছে। যখনই সবাই টাকা তুলতে গেল দেখা গেল এর ভুয়া অবস্থান : এই তোলা অর্থের সাথে কোন উৎপাদন ব্যবস্থার সংযোগ নেই, ফলে এই পুঁজির কোন বৃদ্ধি নেই। একজনের অর্থ আরেক জনকে দিয়ে এই ব্যবস্থা টিকে ছিল,কিন্তু যখনই অধিক পরিমাণ অর্থ মানুষ তুলতে গেল, তখনই ধরা পড়ে গেল এর জালিয়াতি।

 মার্কিন দেশ এই জালিয়াতিকে কীভাবে ম্যানেজ করে চলছিল 

 এই জালিয়াতি সামনে আসেনি মার্কিন এক আধিপত্যকামী ব্যবস্থার জন্য।  আজ সেই ব্যবস্থার পতন ঘটেছে কীভাবে দেখা যাক। তেল সাম্রাজ্যের উপর মার্কিন দেশ এক একতরফা নিয়ম চালু রেখেছিল। খনিজ তেল কোন দেশ ডলার ছাড়া কিনতে পারবে না। পাশাপাশি মার্কিন দেশ তার ব্যাংকে সোনা না রেখে নিজের সুবিধামতো ডলার ছাপিয়ে গেছে। অথচ  মার্কিন বন্ড উচ্চ দামে বাজারে বেচেছে। তাহলে মার্কিন বন্ড কীভাবে ডলারের সাথে লেনদেন হলো? এটাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় রহস্য। কিন্তু এই রহস্য সামনে আসেনি তার কারণ  কোন দেশ ডলার ছাড়া খনিজ তেল কেনাবেচা করতে পারবে না। ফলে অন্য দেশ তার মুদ্রা সার্বভৌমত্ব হারিয়েছে আর ডলার তার আধিপত্য রেখেছে। ফলে মার্কিন দেশের সংকট অন্য দেশের ঘাড়ে রপ্তানি হয়ে গেছে। 

 এর সাথে যুক্ত হয়েছে অন্য আর এক জালিয়াতি– ডেরিভেটিভ নামক স্সেকুলেটিভ ক্যাপিটাল এর বাড় বাড়ন্ত। আগে যে শেয়ার সার্টিফিকেট ছিল সেটা কারখানার মালিকানার একটি কাগজ, অতএব এই কাগজটা ফাঁকা নয়। কিন্তু ডেরিভেটিভ হচ্ছে পরের মাসে কুড়ি তারিখের পর তেলের দাম বা কোন পণ্যের দাম কতটা হবে তার উপরে ফাটকা। সেই একই রকম সোনাহীন ডলার আর সম্পদহীন শেয়ার সার্টিফিকেট। কিন্তু সারা বিশ্বের অন্যান্য দেশ এটা মেনে নিয়েছিল কেন?  তার মূল কারণ মার্কিন দেশ সমস্ত দেশকে সুযোগ দিয়েছিল তার দেশে পণ্য বিক্রি করার।  এর মধ্যে দিয়ে মার্কিন দেশ থেকে ডলার বেরিয়ে গিয়ে কারেন্ট একাউন্ট ডেফিসিট  হওয়ার কথা।  কিন্তু তা যে হতো না  তার কারণ এই ডেরিভেটিভের মতো উচ্চ লাভজনক ফিনান্সিয়াল টুলগুলি। সারা বিশ্বের মধ্যবিত্ত শ্রেণি যারা শেয়ার কেনাবেচা করে তারা তাদের অর্থ মার্কিন শেয়ার বাজারে খাটিয়েছে, ফলে মার্কিন দেশে ক্যাপিটাল অ্যাকাউন্ট সারপ্লাস হয়েছে। আর যদিও নাও হয় নিজের ইচ্ছামতন ডলার ছাপানো তার সুযোগও ছিল।  তৃতীয় কারণটি হল মার্কিন প্রযুক্তির আধিপত্য। ক্লাউড মেকানিজম এর মতন এক বিশাল হার্ডওয়ারকে জন্ম দিয়ে সারা বিশ্বের তথ্যকে মার্কিন দেশ সঞ্চয় করেছে। এর সাথে এনডিভিয়ার মতন এআই প্রযুক্তিকে যুক্ত করে,এক ধরনের প্লাটফর্ম ক্যাপিটালিজিমের জন্ম দিয়েছে গাফামের ( গুগুল, আমাজন,ফেসবুক,অ্যাপেল ও মাইক্রোসফট) মধ্য দিয়ে–নিজ দেশের উৎপাদনকে টুকরো টুকরো করে আউটসোর্স করে দিয়েছে সারা বিশ্বে। এইবার তথ্যের সাহায্যে ইধারকা মাল উধার করে সারা বিশ্বের মুনাফার একটা বড় অংশকে তার দেশে টেনে নিচ্ছে। ফলে নিজে দেশ এক উৎপাদনহীন দেশে পরিণত হয়েছে। এই পরিকল্পনাই আসল কালপ্রিট, ওই দেশের শ্রমিক বা সরকারি কর্মচারীরা নয়।

 এই ব্যবস্থার ভাঙ্গন কীভাবে শুরু হলো 

 চিন , রাশিয়া ব্রিক্স গঠন করে  পাল্টা এক ব্যাংকিং ব্যবস্থার জন্ম দিয়েছে। যেখানে মার্কিন অধিপত্য নেই,একের পর এক দেশ মার্কিন ব্যবস্থার বাইরে এই ব্যাংকিং ব্যবস্থায় প্রবেশ করছে। দ্বিতীয়তঃ তৈল বাজারে মার্কিন আধিপত্যকে অস্বীকার করে রাশিয়া, চিন  পাল্টা এক ব্যবস্থার জন্ম দিয়েছে, যেখানে নিজ দেশের মুদ্রায় তেল কেনা যায়।  ফলে প্রত্যেকটি দেশ তার মুদ্রা সার্বভৌমত্ব ফিরে পাচ্ছে। তৃতীয়ত চিন ‘ক্লাউড’ এর মতন এক ব্যবস্থার জন্ম দিয়ে পাল্টা এক তথ্য ভান্ডার গঠন করেছে, পাশাপাশি এনভিডিয়ার বিকল্প ডিপসিক নামে এক এ.আই প্রযুক্তির উদ্ভাবন  করেছে। ফলে ডলার আজ সংকটে। এই সংকট থেকে পরিত্রাণ পেতে মার্কিন দেশ তাদের এই মধ্যবিত্ত সমাজের উপর আক্রমণ নামিয়ে আনছে। আগেই আউটসোর্সিং এর মধ্যে দিয়ে মার্কিন শ্রমিক শ্রেণীকে চরম দারিদ্র্যে  নামিয়ে এনেছে। এখন এই মধ্যবিত্ত সমাজেরও রেহাই নেই। মার্কিন এই জালিয়াতি ব্যবস্থার ভেতর দিয়ে যে ইলন মাস্করা মুনাফার পাহাড় গড়েছে, তারাই দোষী। কিন্তু বলির পাঁঠা করা হচ্ছে দেশের শ্রমিক ও মধ্যবিত্ত মানুষকে।

 মার্কিন দেশের অন্দরেই নতুন ব্যবস্থার উদ্ভাবন 

 Cooperation  Jackson : ৯০ দশকের পর থেকেই মার্কিন দেশ তার শিল্পগুলিকে ন্যূনতম মজুরির দেশে আউটসোর্স করে দেয়, ফলে তার দেশীয় শ্রমিকরা ভবঘুরতে পরিণত হয়। এরপরে ব্যাপক শ্রমিকের কাজ যায় কোভিড  সময়ে, এছাড়া মার্কিন বর্ণবিদ্বেষী রাজনীতির দৌলতে শহর থেকে প্রচুর কৃষ্ণাঙ্গ এদের শ্রমিকদের উচ্ছেদ করা হয়। এই সময়ে এদের কাছে কো-অপারেশন জ্যাকসন বাঁচার লড়াই হিসেবে উঠে আসে। মিসিসিপি অঞ্চল ভিত্তিক কোঅপারেশন জ্যাকসন এক বিপ্লবী প্রকল্প। এই বিপ্লবী প্রকল্পের বিরুদ্ধে মার্কিন দেশের শাসকশ্রেণী প্রতিরোধ গড়ে তুলতে  ব্যর্থ হচ্ছে, তার মূল কারণ মার্কিন বাজার অর্থনীতিতে এই সকল প্রান্তিক মানুষের কোন স্থান নেই। ফলে তারা বাঁচার মরিয়া প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন, শুধু তাই নয় এ.আই এর ফলে কাজ যাওয়ার কারণে এই দলে মানুষের সংখ্যা দিনের পর দিন বাড়ছে। ব্যক্তি মালিকানার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সমষ্টিগত মালিকানাধীনে প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করে এক ধরনের উৎপাদন ব্যবস্থার জন্ম দেওয়া হয়েছে। সেখানে সমতা,সহযোগিতা, শ্রমিক গণতন্ত্র এবং পরিবেশগত স্থায়িত্বের উপর ভিত্তি করে একটি রেডিক্যাল সামাজিক সংগঠন তৈরী করার প্রচেষ্টা নেওয়া হয়েছে। এর লক্ষ্য জীবন যাপনের উপযুক্ত মজুরির মাধ্যমে কাজ প্রদান, জাতিগত অন্যান্য বৈষম্য দূর করা এবং সম্প্রদায়ের গণসাধারণের সম্পদ নির্ণয় করা। কর্পোরেটের দাস আজকের সমাজ মাধ্যম এইসব ঘটনাগুলিকে প্রচারে আনেনা। তাই আমাদের মতন জনসাধারণকেই এর প্রচারের দায়িত্ব নিতে হবে। এ.আই এর দাপটে দিনের পর দিন চাকরি যাচ্ছে এবং পরিবেশেরও ক্ষত দিনের পর দিন এমনই বেড়ে উঠছে, যে পৃথিবী বসবাসের অযোগ্য হচ্ছে।এইখানে দাঁড়িয়েই কোঅপারেশন জ্যাকসান মানুষের বেঁচে থাকার পথ হিসাবে উঠে আসছে। 

 আমেরিকান মহাদেশে প্রকৃতি কেন্দ্রিক জীবন ধারণের এই মডেল বাস্তবতা লাভ করছে। ফলে লাখো অবরোধ করেও কিউবাকে উৎখাত করা যাচ্ছে না, বলিভিয়া ও ভেনিজুয়েলাতেও এই ধরনের প্রকৃতি কেন্দ্রিক জীবন ধারণের ভাবনাচিন্তা বিকশিত হচ্ছে। সমস্ত ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলির মধ্যে মার্কিন আধিপত্যের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধতা দূঢ হচ্ছে।

 ফলে মার্কিন দেশের মধ্যে প্রকৃতিবান্ধব মানুষের সহযোগিতার মডেল কোঅপারেশন জ্যাকসনের সাথে,মার্কিন দেশের বাহিরের এই সকল দেশের প্রকৃতিবান্ধব মডেল নতুন এক ধরনের ঐক্যবদ্ধতা তৈরি করছে মার্কিন দেশের শাসক শ্রেণীর বিরুদ্ধে। দৃঢ় হচ্ছে ইকোসোসালিজম –  এর ধারণা, উদ্ভব হচ্ছে প্রকৃত সমাজতন্ত্রের জন্য লড়াই, ফলে পুঁজিবাদ বনাম সমাজতন্ত্র এই দ্বন্দ্ব আবার উঠে আসছে পৃথিবীব্যাপী। নতুন ধরনের এই সমাজতন্ত্রই আজ কর্পোরেট পৃথিবীর বিরুদ্ধে নতুন সজীব পৃথিবী গঠনের কাজ হিসেবে উঠে আসছে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top