ওষুধ শিল্প বনাম জনস্বাস্থ্য

পোস্টটি দেখেছেন: 33 প্রীতিলতা বিশ্বাস সর্দি, কাশি, সামান্য জ্বর, অথবা এলার্জি ইত্যাদি অসুবিধার জন্য প্রায়শই মানুষ ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়াই ওষুধের দোকান থেকে দোকানদারের পরামর্শ মত ওষুধ কিনে খেয়েই চালিয়ে দেন। আজকের অতিমারির আবহে বিষয়টা বেড়েছে বই কমে নি। দোকানদাররা এসব ক্ষেত্রে যে ওষুধগুলো সাধারণত দিয়ে থাকেন তাকে সংক্ষেপে এফডিসি ড্রাগ বলা হয়। যার পুরো কথা […]

ওষুধ শিল্প

প্রীতিলতা বিশ্বাস

সর্দি, কাশি, সামান্য জ্বর, অথবা এলার্জি ইত্যাদি অসুবিধার জন্য প্রায়শই মানুষ ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়াই ওষুধের দোকান থেকে দোকানদারের পরামর্শ মত ওষুধ কিনে খেয়েই চালিয়ে দেন। আজকের অতিমারির আবহে বিষয়টা বেড়েছে বই কমে নি। দোকানদাররা এসব ক্ষেত্রে যে ওষুধগুলো সাধারণত দিয়ে থাকেন তাকে সংক্ষেপে এফডিসি ড্রাগ বলা হয়। যার পুরো কথা হল, ফিক্সড ডোজ কম্বিনেশন ড্রাগ বা ঔষধ। অর্থাৎ দুই বা ততোধিক সক্রিয় ওষুধের নির্দিষ্ট মাত্রার মিশ্রন থেকে তৈরি একটি ককটেল ওষুধ, যা কিনা একাধিক উপসর্গকে একসাথে উপশম করতে সক্ষম বলে দাবি করা হয়। কিন্ত এর পিছনে কোন নির্দিষ্ট বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা নেই। 2013 সালের একটি সরকারি নির্দেশিকা অনুসারে এইডস, টিবি, ম্যালেরিয়া এই তিন ক্ষেত্রে এফডিসি ড্রাগের অনুমতি দেওয়া হয়। ভারতে ওষুধ শিল্পের ঘরোয়া বাজারের পরিমান টাকার অংকে এক লক্ষ কোটির ওপর, যার শতকরা 50 ভাগ দখল করে আছে এই মিশ্র ওষুধ। মজার কথা হল এরকম অনেক মিশ্র ওষুধ  বাজারে চলছে যেগুলির ড্রাগ কন্ট্রোলার জেনারেল অব ইন্ডিয়ার কোন  ছাড়পত্রই নেই। 2014 সালের 16ই সেপ্টেম্বর “ইউনিয়ন হেল্থ মিনিস্ট্রি” একটি কমিটি গঠন করে এই সকল ছাড়পত্র বিহীন ওষুধগুলির যোগ্যতা এবং জনস্বাস্থ্যের পক্ষে কতটা নিরাপদ তা খতিয়ে দেখবার জন্য। এই কমিটির চেয়ারম্যান প্রফেসর সি কে কোকাতে’র নাম অনুসারে এটি কোকাতে কমিটি হিসাবেই পরিচিত। 2016 সালের মার্চে কোকাতে কমিটির রিপোর্ট অনুসারে অবৈজ্ঞানিক এবং ক্ষতিকারক 344 এফডিসি ড্রাগকে বাতিল ঘোষণা করে, যা কিনা হিমশৈলের চূড়ামাত্র।

 এই নিষিদ্ধ ওষুধের বাজারজাত মূল্য প্রায় 2500 কোটি টাকা এবং এর অভিঘাত গিয়ে পড়ে অন্তত 6000 ব্র্যান্ডের উপর। সঙ্গে সঙ্গে ফাইজার, প্রোক্টার অ্যান্ড গ্যাম্বেল, অ্যাবট, গ্লিনমার্ক, সানোফি, ওকহার্ট, সিপ্লা, লুপিন ইত্যদি ওষুধ কোম্পানি দিল্লী হাইকোর্টে এই রায়ের উপর স্টে-অর্ডার চেয়ে আবেদন করে। দিল্লী হাইকোর্টে প্রায় 450টি কেস হয় এই সংক্রান্ত। 2016র ডিসেম্বরে দিল্লী হাইকোর্ট এই নিষেধাজ্ঞাকে বাতিল করে এই বলে– “এই সিদ্ধান্ত নেবার সময় ড্রাগস টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজারি বোর্ড বা ড্রাগস কনসালটেটিভ কমিটির সঙ্গে কোন আলোচনা করা হয় নি, যা ড্রাগস অ্যান্ড কসমেটিক অ্যাক্টের উল্লঙ্ঘন”। হেল্থ অ্যান্ড মিনিস্ট্রি এই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয় 2017 সালের ডিসেম্বরে। বন্ধুরা নিশ্চয় ভাবছেন সুপ্রিম কোর্ট কী রায় দিল, ঐ 344 টি ওষুধ বাতিল হলো কিনা? আমাদের বিচার ব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রতা তো সুবিদিত। চলতি বছরের 19শে এপ্রিল থেকে আবার শুনানি শুরু হয়েছে। আর ওষুধগুলো? উৎপাদিত হয়ে বাজারজাত হবার হার হয়ত একটু কমলেও কমতে পারে! সঠিক তথ্য জানা নেই। তবে দিল্লী হাইকোর্ট যে ওষুধগুলির উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয় তার কয়েকটি হলো—ফাইজারের কোরেক্স কাফ সিরাপ, গ্ল্যাকসোর পিরিটন এক্সপেকটোরেন্ট এবং ক্রোসিন কোল্ড, গ্লেনমার্কের এসকোরিল, এবং এলেক্সী কাফ সিরাপ, অ্যাবোটের ফেনসিডিল কাফ সিরাপ এবং অ্যালেম্বিকের গ্লাইকোডিন কাফ সিরাপ।

মানুষের শরীর- স্বাস্থ্যের পরোয়া না করে এরকম মিশ্র ওষুধ উৎপাদন ও বিপণন হবার কারণগুলো ঠিক কী ধরণের সেটা বোঝা দরকার। জনস্বাস্থ্য অভিযানের জাতীয় আহ্বায়ক অমিত সেনগুপ্তের মতে—একক উপাদান-নির্ভর ঔষধগুলি সরকারের মূল্য নিয়ন্ত্রন প্রকল্পের অধীনে পড়ে। কিন্তু এই মিশ্র ঔষধগুলি মিশ্র হবার কারণে সেই আইনের ফাঁক দিয়ে গলে যায়। যার অর্থ অনিয়ন্ত্রিত লাভের মুখ দেখা। আর ওষুধ কোম্পানিগুলি পরষ্পরের সঙ্গে পাল্লা দেবার জন্য নিত্য নতুন কম্বিনেশন বাজারে হাজির করে নিজেদের ওষুধের বিশিষ্টতা প্রমানের উদ্দেশ্যে এবং কিছুদিনের জন্য বাজারে ওষুধটির একচেটিয়া আধিপত্য টিকিয়ে রাখার জন্য। আর ওষুধের প্রচার ও প্রসার কীভাবে হয়ে থাকে সে বিষয়ে আমাদের সকলেরই একটু আধটু ধারণা আছে। ডাক্তাররাও এই শৃঙ্খলের একটা অংশ হয়ে পড়েন ক্রমশ।

ক্রেতা কেন কেনেন? প্রথমত তার অজ্ঞতা, দ্বিতীয়ত বিভিন্ন উপসর্গের জন্য একটি ওষুধ পেলে তার অর্থ সাশ্রয় হয় খানিকটা। আর ঐ যে শুরুতেই বললাম বেশিরভাগ সময় রোগ নির্ণয় হয় হাতুড়ে জ্ঞানের ভিত্তিতে (চাইলেও উপায় নেই। যে দেশে 1456 জনে একজন ডাক্তার তাও আবার মোটামুটি শরাঞ্চলে সেখানে হাতুড়ে ছাড়া উপায় কী!)। তাই নির্দিষ্ট ওষুধের পরিবর্তে মিশ্র ওষুধ দিয়ে একূল ওকূল রাখার একটা প্রবনতা থাকে। আসলে এক্ষেত্রে অসুস্থতার কারণ ও তার নিরাময়ের উপায়ের মধ্যে যে একটি কার্য-কারণ সম্পর্ক বিদ্যমান, সেটিকেই অস্বীকার করা হয়। রোগীর স্বাস্থ্য কিংবা তার সুস্থতার চেয়েও ওষুধ শিল্পের শ্রীবৃদ্ধিই এর একমাত্র লক্ষ্য।

ফলাফল কী? প্রয়োজন নেই এমন রাসায়নিক দেহে প্রবেশ করছে, যা নানান রকম পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। দেহ ঔষধ-প্রতিরোধী হয়ে উঠতে পারে, মানে নির্দিষ্ট ওষুধ দিয়েও তখন আর কাজ হবে না।

এই ঔষধ-প্রতিরোধী হয়ে ওঠা নিয়ে ওষুধ শিল্পের আরও ভয়ঙ্কর একটি দিক হল– যথেচ্ছ অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার। এবার আসবো সেই প্রসঙ্গে। 1928 সালে স্কটল্যান্ডে আলেকজান্ডার ফ্লেমিং পেনিসিলিয়াম নোটেটাম নামক ছত্রাক থেকে পেনিসিলিন আবিষ্কার করেন, যা ব্যাকটেরিয়া মারতে সক্ষম। তারপরে 1940 সালে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির দুজন বিজ্ঞানী, হাওয়ার্ড ফ্লোরি এবং আর্নেস্ট চেইন এই পেনিসিলিনের ঔষধি গুন প্রমাণ করে দেখান। প্রাথমিক ভাবে পেনিসিলিন ওষুধ উৎপাদন সম্ভব হয়। ইতিমধ্যে আমেরিকার বোস্টন শহরে কিছু মানুষের ত্বকে সট্যাফাইলোকক্কাসের সংক্রমন হয়। যে সংক্রমনের চিকিৎসায় পেনিসিলিন ব্যবহার করে অভূতপূর্ব ফল পাওয়া যায়। এরপর আমেরিকার সরকার সক্রিয় ভূমিকা পালন করে যাতে ওষুধ হিসাবে পেনিসিলিন উৎপাদন সম্ভব হয় এবং সেই ওষুধ সরাসরি কাজে লাগানো হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আহত মিত্রশক্তির সৈন্যদের উপর।

ওষুধ শিল্পে প্রকৃতপক্ষে যুগান্তর ঘটে 1945’র পর থেকে। আমেরিকা পেনিসিলিনের উপর থেকে সব রকমের নিষেধাজ্ঞা তুলে দিয়ে সাধারণের জন্য প্রেসক্রিপশন ড্রাগ হিসাবে বিক্রয়যোগ্য করে। ব্রিটেনে 1946’র জুন থেকে সাধারণের জন্য পেনিসিলিন বিক্রয়যোগ্য করা হয়। ঔষধ শিল্প অ্যান্টিবায়োটিকের যুগে পা রাখল। এই শিল্পে বিনিয়োগ এবং লাভ দুই-ই ক্রমাগত বেড়েছে এরপর ধেকে।

 1948 সালে আমেরিকার অ্যান্টিবায়োটিক উৎপাদন ছিল 2.4 মিলিয়ন পাউন্ড, 1956 সালে তা হয় 3 মিলিয়ন পাউন্ড। ওষুধ কোম্পানিগুলির নিজস্ব পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলে বাজারে এসেছে স্ট্রেপ্টোমাইসিন, ক্লোরামফেনিকল, ক্লোরটেট্রাসাইক্লিন, অ্যাসিটেট্রাসাইক্লিন এবং আরো কিছু অ্যান্টিবায়োটিক। কিন্তু 1960 থেকেই চিত্রটি বদলে যেতে থাকে। ব্যাকটেরিয়া যত ওষুধ-প্রতিরোধী হয়ে উঠতে থাকে, বিভিন্ন অ্যান্টিবায়োটিক তত বাতিল হতে থাকে। ক্রমশ বড় বড় ওষুধ কোম্পানি অ্যান্টিবায়োটিকের গবেষণা এবং উৎপাদন প্রায় বন্ধ করে দিতে শুরু করে। কারণ খরচের তুলনায় লাভ হচ্ছে সামান্য।

আসুন তাহলে একটু জেনে নিই অ্যান্টিবায়োটিক আমাদের দেহে ঠিক কীভাবে কাজ করে আর ব্যাকটেরিয়ার ওষুধ-প্রতিরোধী হয়ে ওঠা বলতে কী বোঝানো হয়। প্রতিটি মানুষের দেহে 10 ট্রিলিয়ন মানব কোষ থাকে আর এর দশ গুন মানে 100 ট্রিলিয়ন অনুজীবানু থাকে। আমাদের মুখগহ্বর, ত্বকে বিশেষত অন্ত্রে লক্ষ লক্ষ অনুজীবানু বা ব্যাকটেরিয়ার কলোনি আছে, যেগুলি আবার একটি আর একটির থেকে পৃথক। যাদের সঙ্গে মানুষ মিথোজীবিতার সম্পর্কে বাঁচে। হাজার হাজার বছরের বিবর্তনের ফলে মানুষের দেহে গড়ে উঠেছে এই কলোনি গুলি, যে অনুজীবানুগুলির মাধ্যমেই প্রতিটি মানুষ তার চারিপাশের প্রকৃতি এবং পরিবেশের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হয়ে জীবন যাপন করে। তাই এদের মানুষের বন্ধু অনুজীবানু বলা যেতে পারে। মাত্র 100টি প্রজাতির অনুজীবানু মানুষের ক্ষতি করে। এদের কোন একটির দ্বারা আক্রান্ত হলে মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিক ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া মারে, এবং তার বংশবৃদ্ধি রোধ করে। কিন্তু এর প্রয়োগ সঠিক এবং উপযুক্ত মাত্রায় না হলে, ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়াটি না মরে ঐ ওষুধটির বিরুদ্ধে প্রতিরোধী হয়ে পরিবেশে অবস্থান করে। পরে অপর কোন ব্যাক্তির দেহেও উক্ত অ্যান্টিবায়োটিকটি প্রতিরোধী হয়ে ওঠা ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে কাজ করে না, যদিও তিনি আগে কখনো ঐ অষুধ গ্রহণ করেন নি। এছাড়াও ব্যাকটেরিয়া জিন আদান-প্রদানের মাধ্যমে যে সকল ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধী নয় তাদেরকেও প্রতিরোধী করে তোলে। যারা পশু খামার চালান তারা ব্যবসায়িক কারণেই পশু-খাবারে অল্প অ্যান্টিবায়োটিক মিশিয়ে দেন। আর অল্প পরিমানে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যাকটেরিয়ার জিন আদান-প্রদান ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। ফলে প্রথমে পশুদের দেহে প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া তৈরী হয়, সেখান থেকে মানুষের দেহে স্থানান্তরিত হয়। পশুপাখির বর্জ থেকে এই প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া মেশে মাটি এবং জলে। ডাঃ স্ট্যুয়ার্ট ব্ল্যাক লেভির অ্যান্টিবায়োটিক প্যারাডক্স নামক তত্ত্ব বলছে—যে অ্যান্টিবায়োটিক যত বেশি ব্যবহৃত হয় তার বিরুদ্ধে ব্যাকটেরিয়া তত বেশি প্রতিরোধী হয়ে ওঠে। পরিবেশকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে আমরা যে যে ধরণের সলিউশন ব্যবহার করি তার প্রত্যেকটিতে আছে অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল রাসায়নিক। অর্থাৎ ক্ষতি কোন ব্যাক্তি বিশেষের নয়, ক্ষতি সমগ্র কমিউনিটির এবং সেই সঙ্গে বাস্তুতন্ত্রের। উল্টে অ্যান্টিবায়োটিক আমাদের দেহের উপকারি ব্যাকটেরিয়া মেরে ফেলে, যা পুনরুৎপাদনে অনেক সময় লাগে, কখনো কখনো আবার তা স্থায়ীভাবে অবলুপ্ত হয়। যেহেতু আমরা প্রত্যেকেই এই অনুজীবানুদের মাধ্যমে পরিবশের বাস্তুতন্ত্রের একটি বিপাকীয় শৃঙ্খলে বাস করি তাই এই ধরনের অনুজীবানুদের অবলুপ্তি বাস্তুতন্ত্রে বিপাকীয় ফাটল তৈরি করে, যার বিরুপ প্রতিক্রিয়া হয় মানুষের জীবনে। সাইন্টিফিক অ্যামেরিকান জার্নালে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধ থেকে জানতে পারছি—গ্যাসট্রিক হেলিকোব্যাকটর ফাইলোরি নামক ব্যাকটেরিয়াটি আমেরিকা ও অনেক উন্নত দেশে প্রায় বিলুপ্তির পথে। এর ফলে গ্যাসট্রিক ক্যানসারের প্রবনতা কমে এসেছে উক্ত জনগোষ্ঠীর মধ্যে কিন্তু বিপরীতে হরমোন নিয়ন্ত্রন এবং রক্তের পিএইচ মাত্রার উপর এর বিরূপ প্রতিক্রিয়ার ফলে অল্প বয়সের স্থূলতা এবং টাইপ-টু ডায়াবেটিক প্রায় মহামারীর আকার ধারণ করেছে। অতএব বন্ধুরা বুঝতে পারছেন তো, অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহারে কতটা সতর্কতা অবলম্বন করা উচিৎ। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ওষুধ কোম্পানিগুলির অ্যান্টিবায়োটিক উৎপাদন করে মুনাফা করার তাগিদে অ্যান্টিবায়োটিক নিয়ন্ত্রনহীনভাবে খোলা বাজারে  বিক্রি হচ্ছে। যে বিষয়ে আলেকজান্ডার ফ্লেমিং তার নোবেল প্রাইজ বিজয়ের বক্তৃতায় সতর্ক করেছিলেন, তা কোনদিন মানা হয়নি। হিসাব বলছে এই ব্যাকটেরিয়া ওষুধ-প্রতিরোধী হয়ে ওঠার কারনে প্রতি বছর 7 লক্ষ মানুষ মারা যায়। 2050 নাগাদ হিসাবটি বছরে 10 মিলিয়ান হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বর্তমানের অতিমারি ওষুধ কোম্পানিগুলোর সামনে ভ্যাকসিনের এক নতুন বাজার উন্মুক্ত করেছে। বিভিন্ন দেশের সরকার এই ভ্যাক্সিন ফ্রীতে দিলেও আম জনতার ট্যাক্সের টাকা যাচ্ছে ওষুধ কোম্পানিগুলির ঘরে।

এই চক্রব্যূহ থেকে বেরনোর একটিই রাস্তা। জনস্বাস্থ্য পরিষেবার বিকাশ সাধন। জনস্বাস্থ্য বলতে আমরা ঠিক কী বুঝবো? ইংরাজীতে একটি প্রবচন আছে—prevention is better than cure.  জনস্বাস্থ্য বলতে এই প্রিভেনশন অর্থাৎ অসুস্থ হওয়াটাকেই রোধ করার কথা বলা হয়। WHO এর সংজ্ঞা অনুসারে জনস্বাস্থ্য বা community health is : environmental ,social and economic resources to sustain emotional and physical well-being among people in ways that advances their aspirations and satisfy their needs in their unique environment.

স্বাস্থ্য পরিষেবাকে তিনটি স্তরে বা পর্যায়ে ভেঙে নিতে হবে। প্রথম স্তরে স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সকল অধিবাসীর নাম এবং স্বাস্থ্য সংক্রান্ত তথ্য নথিভূক্ত করতে হবে। এই স্তরে থাকা স্বাস্থ্যকর্মীরা স্থানীয় মানুষের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখবেন ও তাদের শারীরিক অবস্থার খোঁজ-খবর রাখবেন, যা মানুষের অসুস্থ হবার ঝুঁকিকে কমিয়ে রোগ-প্রতিরোধী হয়ে বাঁচতে সাহায্য করবে। দ্বিতীয় স্তরে হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকবে, যেখানে প্রাথমিক স্তরের স্বাস্থ্যকর্মীদের পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে প্রয়োজন অনুসারে মানুষের ক্লিনিকাল চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকবে। তৃতীয় বা শেষ স্তরে থাকবে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দ্বারা সঙ্কটাপন্ন রোগীর চিকিৎসা। প্রাথমিক স্তরের স্বাস্থ্যকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে কাজ করবেন পরিবেশকর্মীরা, যারা বাস্তুতন্ত্রের সুস্থতা নিয়ে কাজ করবেন। খোলা বাজারে ওষুধ বিক্রি নিষিদ্ধ করতে হবে। ওষুধ খেয়ে অসুস্থ হবার হাত থেকে মানুষকে বাঁচতে হবে। ব্যাথা-যন্ত্রনার জন্য মুঠোভরে পেন কিলার না খেয়ে যন্ত্রনাবিহীন, পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া বিহীন চিকিৎসা আকুপাংচার থেরাপিকে মানুষের মধ্যে জনপ্রিয় করে তুলতে হবে। চিকিৎসা হলো মানুষের জন্য সামাজিক পরিষেবা, তা কখনোই ওষুধ কোম্পানি বা বেসরকারি হাসপাতালের ব্যাবসার সামগ্রী হতে পারে না। আর জনস্বাস্থ্যের উন্নতি ব্যাতিরেকে একটি জাতি বা দেশের উন্নতি কখনো সম্ভব নয়।

তথ্যসূত্র:

https://www.scientificamerican.com/article/human-microbiome-change/

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Community_health

https://www.livemint.com/Industry/I3tznDsotKp1dd3GY30q8I/Expert-committee-set-up-to-review-344-banned-FDC-drugs.html?facet=amp

লেখক পরিচিতি:

বিজ্ঞানের ছাত্রী, গণিতে সহকারী শিক্ষিকা হিসেবে কাজ করেছেন এক দশকের উপর। বর্তমানে প্রবাসী এবং ইতিহাস ও সমাজ বিজ্ঞান বিষয়ে জানা বোঝায় আগ্রহী।

যোগাযোগ:

biswaspritilata2017@gmail.com

4 thoughts on “ওষুধ শিল্প বনাম জনস্বাস্থ্য”

  1. এলাকাভিত্তিক সার্ভে করে নেওয়া দরকার। সরকারি ভাবেই হোক অথবা বেসরকারি ভাবেই হোক। কতজন বিভিন্ন রোগে ভুগছে।বিশেষ করে ডায়াবেটিস রোগে কে কে ভুগছে। তারা নিয়মিত ওষুধ খাচ্ছে কিনা। মিষ্টি জাতীয় খাবার খাওয়া বন্ধ করেছে কিনা। করোনা আক্রান্ত হলে এই মানুষদের সমস্যা বেশি হয়। তাই আগে থেকেই প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিতে হবে। এছাড়া উচ্চ রক্ত চাপ রোগীদের দিকেও ধ্যান দিতে হবে। নুন এবং নুন সমৃদ্ধ খাবার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। কমিউনিটি লেভেলে এই দুই রোগের চিকিৎসা সম্ভব। এমন কি ওষুধ ছাড়াও সম্ভব, খাদ্যাভ্যাস পাল্টে এবং নিয়মিত ব্যায়াম করেও সম্ভব। প্রযুক্তির দৌলতে যে কেউ প্রেসার মাপা এবং রক্তে সুগার মাপতে পারবে। লোক দেখানো স্বাস্থ্য শিবির না করে নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার ব্যবস্থ্যা করলে অনেক রোগকেই আমরা আটকে দিতে পারি এলাকার মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে। ঠিক এইভাবেই এলাকাভিত্তিক সবুজায়ন এবং শিক্ষন কর্মসূচিও করা যায়।
    স্বাস্থ্য শিক্ষা পরিবেশ – এগুলো নিয়েই হোক আমাদের সমাবেশ।

  2. দেবাশিস বসু

    সব ঠিক আছে কিন্তু শেষের ওই আকুপাংচার তত্ত্বটি পাঞ্চ না করলে কি বিষয়টি দাঁড়াত না !

    1. Pritilata Biswas

      ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতা দিয়ে বুঝেছি বিষয়টি কতটা কার্যকরী। ইউ কে তে ন্যাশনাল হেল্থ স্কিমে অন্তর্ভুক্ত এই পদ্ধতি। ধন্যবাদ।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top