সন্তোষ সেন
২৮ মে, ২০২৫: সুইজারল্যান্ডের ভ্যালাইস ক্যান্টনের ব্লাটেন (Blatten) গ্রামে একটি ভয়াবহ হিমবাহ ধসের ঘটনা ঘটে। আল্পস পর্বতমালায় সাম্প্রতিক সময়ের অন্যতম মারাত্মক প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে এটিকে বিবেচনা করা হচ্ছে। কারণ, এই হিমবাহ ধসের ফলে একটি গ্রাম সুইজারল্যান্ডের মানচিত্র থেকে হারিয়ে গেল। হ্যাঁ, গ্রামটি নেই হয়ে গেছে।
ঘটনা প্রবাহ : আল্পস পর্বতের বার্চ হিমবাহের
একটি বিশাল অংশ ধসে পড়ায় ২ কিমি দীর্ঘ, ২০০ মিটার প্রশস্ত এবং ২০০ মিটার গভীর এলাকা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। ঘটনার সময় একটি ৩.১ মাত্রার ভূমিকম্পের সমতুল্য কম্পন রেকর্ড করা হয়। ফলাফল? গ্রামটির ৯০ শতাংশ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
হিমবাহে ফাটল দেখা দেওয়ার পর ১৯ মে প্রশাসনের পক্ষ থেকে গ্রামটিকে সম্পূর্ণভাবে খালি করে দেওয়া হয়। পাহাড়ের কোলে ছবির মতো সাজানো নৈসর্গিক ব্লাটেন গ্রামের ৩০০ জন বাসিন্দা এবং গবাদি পশুদের নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া সম্ভব হয় ঠিকই। কিন্তু প্রকৃতির রুদ্ররোষে উদ্ধার অভিযান ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয়েছে।
পাহাড় থেকে ধসে পড়া বরফ, কাদা ও পাথরের কারণে লোনজা নদী সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ হয়ে একটি অস্থায়ী হ্রদের জন্ম দিয়েছে। ছিল রুমাল হয়ে গেল বেড়াল! নাকি জীবনের স্পন্দন সহ একটি সুন্দর ছোট আস্ত নদী ছিল, পাল্টে গেল একটি ভয়ানক হ্রদে! যে হ্রদে প্রতি ঘণ্টায় ৮০ সেন্টিমিটার হারে বরফগলা জল জমা হচ্ছে। মানে বিগত চার দিনে হ্রদের জলস্তর তিন মিটারের বেশি বেড়ে গেছে। এতে নিচু এলাকার গ্রামগুলিতে বন্যার প্রবল আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। গাম্পেল ও স্টেগ গ্রামগুলি থেকে মানুষজনকে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
এ কি নেহাতই প্রাকৃতিক দূর্যোগ?
কেন এইসব দুর্যোগ দুর্বিপাক বাড়ছে প্রতিদিন বিশ্বের কোন না কোন প্রান্তে? দেশ বিদেশের এক বড় অংশের বিজ্ঞানীরা বলছেন –ধসের পিছনের মূল কারণ হল অপরিমিত হারে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার, তথাকথিত অব-উন্নয়ন, অপরিকল্পিত নগরায়ন এবং এসবের ফলস্বরূপ বিশ্বজুড়ে তাপমাত্রার বৃদ্ধি ও
জলবায়ুর পরিবর্তন। তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে আল্পস পর্বতমালার হিমবাহও গলছে অতি দ্রুত হারে। পারমাফ্রস্ট (শুকনো বরফের স্তূপ) দুর্বল হয়ে পড়ছে, যা পাহাড়ের স্থিতিশীলতা হ্রাস করছে। সুইজারল্যান্ডে ২০২২ সালে হিমবাহের আয়তন ছিল ৬%। অথচ ২০২৩ সালে তা ৪% হ্রাস পেয়ে এখন তলানিতে ঠেকেছে।বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন যে, গ্রীনহাউস গ্যাস নির্গমন এই হারে চলতে থাকলে শতাব্দীর শেষে আল্পসের অধিকাংশ হিমবাহ বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে।
ব্লাটেনের মেয়র বলেছেন, “আমরা আমাদের গ্রাম হারিয়েছি, কিন্তু আমাদের জীবন নয়।” তিনি পুনর্গঠনের প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন। সুইস সেনাবাহিনী উদ্ধার ও অবকাঠামো পুনর্গঠনে সহায়তা করছে। অর্থ, প্রশাসনিক তৎপরতা আর সামরিক ক্ষমতার সাহায্যে হারিয়ে যাওয়া গ্রামকে হয়তো বা আবার ফিরিয়ে আনা যাবে। কিন্তু অর্থের গর্বে দর্পি মানুষ, উন্নত মস্তিষ্কের দাবিদার হে মহামানব তুমি কি পারবে আর একটি হিমবাহ প্রকৃতিকে ফিরিয়ে দিতে? কোন্ ক্ষমতার ঐশ্বর্যে তুমি তৈরি করে দিতে পারবে একটি, মাত্র একটি পাহাড়, সমুদ্র বা ধ্বংস করে দেওয়া প্রাকৃতিক জঙ্গলকে? ফিরে আসি, আল্পস পর্বত সহ সামগ্রিক বাস্তুতন্ত্রের ক্ষেত্রে পার্মাফ্রস্টের অভূতপূর্ব প্রাকৃতিক অবদানের বিষয়ে।
পার্মাফ্রস্ট পরিবেশের এক জমাটবাঁধা সংকেত:
পার্মাফ্রস্ট মূলত পাথর, পাহাড় ধসের মাটি (মোরেইন) এবং বরফের সংমিশ্রণে তৈরি একটি ভূমিস্তর। যা বরফে আচ্ছাদিত প্রাকৃতিক প্রেক্ষাপটকে একত্রে ধরে রাখে। পার্মাফ্রস্ট শূন্য ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার নিচে হিমায়িত অবস্থায় হাজার লক্ষ বছর ধরে টিকে আছে। এটি পৃথিবীর প্রায় ১১% ভূমি জুড়ে বিস্তৃত এবং মুলত দেখা যায় আর্কটিক, সাব-আর্কটিক বিশেষ করে কানাডা ও রাশিয়ার মেরু অঞ্চলে এবং উচ্চ পর্বতশ্রেণিগুলিতে। সুইজারল্যান্ডের আল্পস পর্বতমালার ৩-৫% এলাকা পার্মাফ্রস্টে আবৃত। এটি থাকে মূলত ২,৬০০ মিটার বা তার ঊর্ধ্বের উচ্চতায়, ভূমির নিচে লুকিয়ে থাকা এই স্তর অনেক সময় চোখে পড়েনা, কিন্তু এর প্রভাব সর্বব্যাপী।
কিন্তু পৃথিবীবাসীর দুর্ভাগ্য, ধীরে ধীরে গলে যাচ্ছে শতাব্দীপ্রাচীন জমাটবাঁধা এই স্তর।
পার্মাফ্রস্টের গলন বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের গতি বাড়িয়ে দিতে সহায়ক। সুইজারল্যান্ড সহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে পার্মাফ্রস্ট নিয়ে গবেষণার অগ্রগতি আমাদের এই বাস্তবতা সম্পর্কে নতুন উপলব্ধি এনে দিচ্ছে।
সুইজারল্যান্ডে পার্মাফ্রস্ট গলার বর্তমান অবস্থা:
সুইস গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘Permafrost Monitoring Network’ গত ২০ বছর ধরে ৩০টি সাইটে পার্মাফ্রস্ট পর্যবেক্ষণ করছে। এই গবেষণায় ইউরোপের ৯টি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়। আর্কটিক বৃত্তের কাছের সভালবার্ড থেকে শুরু করে আল্পস এবং স্পেনের দক্ষিণাঞ্চলের সিয়েরা নেভাদা পর্বতমালা পর্যন্ত। গবেষণায় জানা গেছে, পার্মাফ্রস্টের তাপমাত্রা পৌঁছেছে রেকর্ড উচ্চতায়। ফলে বরফের স্তরের পুরুত্ব এবং পাথর-গ্লেসিয়ার অতীতের চেয়ে অনেক বেশি গতিতে সরে সরে যাচ্ছে। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে ‘Nature’ জার্নালে প্রকাশিত এক গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক গবেষণায় দেখা গেছে, গত ১০ বছরে ১০ মিটার গভীরতায় তাপমাত্রা এক ডিগ্রির বেশি বেড়ে গেছে। এরমধ্যে উচ্চতম এবং উত্তরাঞ্চলীয় এলাকায় উষ্ণতা বৃদ্ধির হার সর্বাধিক। ফলে ইউরোপের পার্বত্য অঞ্চলে পার্মাফ্রস্ট আগের তুলনায় অনেক বেশি এবং দ্রুতহারে গলছে। গবেষণার নেতৃত্ব দেন সুইস বিজ্ঞানী জ্যানেট নেটসলি। যিনি ডাভোসে অবস্থিত ‘ইনস্টিটিউট ফর স্নো অ্যান্ড অ্যাভালাঞ্চ রিসার্চ (SLF)’-এর গবেষক। নেটসলী বলেন –“পার্বত্য অঞ্চলের পার্মাফ্রস্টের উষ্ণতা বৃদ্ধির ঘটনা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এটি প্রতিটি অঞ্চল, গভীরতা ও সময়পর্ব জুড়েই দেখা যাচ্ছে।”
পার্মাফ্রস্ট অঞ্চলের তাপমাত্রা জলবায়ুর একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক। এটি শুধু প্রাকৃতিক দৃশ্যপটের রূপান্তরেই নয়, বরং পার্বত্য অঞ্চলের অবকাঠামো নির্মাণ ও ঢালের স্থায়িত্বের ওপরও প্রভাব ফেলে। তাই পার্মাফ্রস্টকে অনেকে ‘পর্বতের অদৃশ্য আঠা’ বলে থাকেন। কারণ এটি না থাকলে পাহাড়ের ঢাল গড়িয়ে ভূমিধসের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। গ্রীষ্মকালে পার্মাফ্রস্টের উপরের যে স্তরটি গলে যায় তাকে “সক্রিয় স্তর” বলা হয়। এর নিচের অংশেই মূল পার্মাফ্রস্ট অবস্থিত। সুইস আল্পস-এ এই নিম্ন স্তরের পুরুত্ব দশ মিটার থেকে কয়েকশো মিটার পর্যন্ত হতে পারে। আর মেরু অঞ্চলে এর গভীরতা পৌঁছাতে পারে ১.৭ কিলোমিটার পর্যন্ত।
গবেষণায় আরও দেখা যায়, ইউরোপের পার্বত্য অঞ্চলে পার্মাফ্রস্টের উষ্ণতা বৃদ্ধির গতি আর্কটিক অঞ্চলের সঙ্গে প্রায় সমানতালে চলছে। সবচেয়ে বেশি উষ্ণতা বৃদ্ধি লক্ষ্য করা গেছে উচ্চতম এবং উত্তরের অঞ্চলগুলিতে। একটি আকর্ষণীয় বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণ বলছে –বরফসমৃদ্ধ পার্মাফ্রস্টের তাপমাত্রা যখন শূন্যের কাছে পৌঁছায়, তখন গলনের গতি ধীর হয়ে যায়। কারণ তাপগতি বিদ্যার নিয়ম মেনে ৩৩৬ হাজার জুল তাপশক্তি শোষণ করতে পারলে শূন্য ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় মাত্র এক কেজি বরফ জলে পরিণত হতে পারে। কিন্তু ভূউষ্ণায়নের কারণে একবার বরফ গলে গেলে তাপমাত্রা দ্রুত বাড়তে থাকে। কারণ, সাদা শুকনো বরফ সূর্যের তাপকে সহজেই বিকিরিত করে ফিরিয়ে দিতে পারে। কিন্তু বরফগলা অস্বচ্ছ কালো জল তাপ অনেক বেশি করে শুষে নিয়ে হিমবাহের তাপমাত্রা বাড়িয়ে দেয়, যার ফলে বরফের গলন বাড়ে আরও বেশি করে।
গবেষকরা সতর্ক করে বলছেন, বর্তমান হারে পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়তে থাকলে এই গলনের ধারা ভবিষ্যতেও চলমান থাকবে এবং অবশ্যই তা বাড়বে। অধ্যাপক নেটসলি জানান –“আমরা দেখতে পাচ্ছি ১০ মিটার গভীরতায় তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার বেশি এবং এর চেয়েও গভীর স্তরে অপেক্ষাকৃত কম। অর্থাৎ এই উষ্ণতা ভবিষ্যতে আরও গভীরে প্রবেশ করবে।” সুইজারল্যান্ডের পার্মাফ্রস্ট গলনের যেন কোন বিশ্রাম নেই। অবিরত শুধুই গলে যাওয়া।
সুইজারল্যান্ডের আল্পস পর্বতের সাম্প্রতিক ভয়াবহ ঘটনা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, পরিবেশের অদৃশ্য স্তরগুলোর প্রতিও আমাদের গভীর মনোযোগ দেওয়া জরুরি। পার্মাফ্রস্টের
গলন মানে শুধু বরফ গলে যাওয়া নয়, বরং এটি একটি বৈশ্বিক সংকেত। যে সংকেত আমাদের প্রতিমুহূর্তে জানান দিয়ে যায়, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এখন আর কেবল ভবিষ্যতের ভয় নয়, এটি ভয়ঙ্কর ঘটমান বর্তমান। হিমবাহ ও পার্মাফ্রস্টের গলন কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এটি বৈশ্বিক উষ্ণায়নের একটি অদৃশ্য এবং গভীর প্রভাব। ভবিষ্যতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সতর্কবার্তা। বরফ গলে যাওয়ার সাথে সাথে মুক্তি পাচ্ছে জমাটবাঁধা কার্বন, বরফের গভীর স্তরে হাজার লক্ষ বছর ধরে ঘুমিয়ে থাকা জীবন্ত ভয়ানক অণুজীবের দল জেগে উঠতে পারে যেকোন সময়। যার হাত ধরে অজানা, অচেনা জীবাণুঘটিত রোগ অসুখ বাড়ার আশঙ্কাও দেখা দিচ্ছে। তার সাথে বাড়ছে ভূমিধসের ঝুঁকি। সব মিলিয়ে একটি হিমবাহের মৃত্যু পর্বতমালার বাস্তুতন্ত্র, মানুষের জীবন যাপন ও নিরাপত্তার ওপর ভয়ানক হামলা।
একটি গ্রামের বিলুপ্তি শিখিয়ে দিয়ে গেল যে, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে অতি দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করাটা কতটা জরুরি নিজেদের বেঁচে থাকার স্বার্থেই। নোটে গাছগুলো এইভাবেই শুকিয়ে যায়। কিন্তু কদর্য কলঙ্কিত কলুষিত এই গল্পগুলো চলতে থাকে। চলতেই থাকে …। গল্পকথার সর্পিল পথ বেয়ে যদি চলে যাই আমাদের সাধের হিমালয়ের উচ্চশিখরে, তাহলেও সেই ধ্বংস ও মৃত্যুর নিরন্তর গল্পই পাব শুনতে। যদি আমরা আজ সতর্ক না হই, কাল হয়তো শুধুই নীরব ধ্বংস দেখার পালা। তাই, এই নিবন্ধটি শুধু একটি মর্মান্তিক ঘটনার প্রতিবেদন নয়, এটি একটি বৈশ্বিক মানবিক আহ্বান –আসুন প্রকৃতির গুরুত্বকে উপলব্ধি করি, তার সুরক্ষায় ধ্যান দিই। প্রকৃতির মেরামতিতে আসুন জোট বাঁধি।