ছি: ছি:! এত্তা জঞ্জাল

কী করা যেতে পারে তা নিয়ে ভাবনার অন্ত নেই। শুধু বিজ্ঞানীরাই নন এই ভাবনায় সামিল সংবেদনশীল সর্বস্তরের মানুষ ও জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অনেক প্রতিষ্ঠান। তবে বিভিন্ন তরফের স্বার্থের বিভিন্নতাও ক্রমশ: স্পষ্ট হয়ে উঠছে।

বঙ্কিম দত্ত
[জনস্বার্থ ও পরিবেশ বিঘ্নকারী দেউচা -পাচামি কয়লাখনি প্রকল্প ও তার বিরুদ্ধে স্থানীয় আদিবাসী জনজাতিদের লড়াই আন্দোলনকে ঘিরে এই নিবন্ধটি ‘ নবান্ন ‘ পত্রিকার ফেব্রুয়ারি, ২০২২ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। লেখাটির গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে আমরা আমাদের ওয়েবসাইটে পুন:প্রকাশ করলাম – সম্পাদক মন্ডলী]

পৃথিবীর অন‍্যতম অধিবাসী মানুষ । প্রাণের বির্বতনের নিরীখে নবীনতম। প্রকৃতির এই নবীনতম বাসিন্দারা আজ প্রকৃতির কঠিনতম চ‍্যালেঞ্জের মুখোমুখি। এক আত্মঘাতী অভিযানে ইচ্ছা-অনিচ্ছায় সামিল মানব প্রজাতির প্রায় সমগ্র অংশ। জিডিপি কেন্দ্রিক উন্নয়ন সমুদ্রকে করেছে বিষবৎ , ভূমিকে করেছে ধর্ষিতা, পৃথিবীর আকাশকে ছেয়েছে গ্রিনহাউস গ্যাসে, সমুদ্রের জলস্তরকে বাড়িয়েছে, ভূগর্ভস্থ জলস্তরকে দিয়েছে নামিয়ে। একে চোখ বুজে এড়িয়ে যাবার উপায় নেই। আজ পৃথিবীতে উৎপাদন করতে গেলেই, পৃথিবীর সমস্তধরণের প্রাণের কাছেই পৃথিবী এমনভাবে বসবাসের আরো বেশি অযোগ্য হয়ে উঠবে যে অচিরেই বহু প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যাবে। নবীনতম প্রজাতিটির জন্য এই বিপন্নতা সর্বাধিক এমনই মত দিচ্ছেন বিজ্ঞানীদের একটা বড় অংশ। তাই সবার আগে এই প্রাকৃতিক ভারসাম্যহীনতাকে মেরামত করা দরকার।ফিরে আসা দরকার বিপর্যয়ের খাদের ধার থেকে।

কী করা যেতে পারে তা নিয়ে ভাবনার অন্ত নেই। শুধু বিজ্ঞানীরাই নন এই ভাবনায় সামিল সংবেদনশীল সর্বস্তরের মানুষ ও জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অনেক প্রতিষ্ঠান। তবে বিভিন্ন তরফের স্বার্থের বিভিন্নতাও ক্রমশ: স্পষ্ট হয়ে উঠছে। স্বার্থের দরকষাকষিকে সামাল দিতে ঘনঘন অনুষ্ঠিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক সম্মেলন। লক্ষ্য, উৎপাদনে লাগাম না টেনে বিকল্প পথের অনুসন্ধান। এরকমই এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনের নাম সি. ও. পি। তার ২৬ তম সম্মেলনটি অর্থাৎ। সি ও পি – ২৬ সদ্য শেষ হয়েছে ২০২১ এর ১৩ ই নভেম্বর । ২২২৭৪ জন বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধি, ১৪১২৪ জন পর্যবেক্ষক আর ৩৮৮৬ জন গণমাধ্যমের প্রতিনিধির সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন ১২০ জন রাষ্ট্রনেতা।

সিওপি-২৬ নিয়ে আলোচনা এখনো জীবন্ত। এই কনফারেন্স অফ পর্টিজ( সি ও পি) কে সিদ্ধান্ত গ্রহণের নিরিখে ব্যর্থ বলে অভিহিত করা হচ্ছে।  “They (the States) take important steps, but unfortunately the collective political will was not enough to overcome some deep contradictions.” -বলছেন স্বয়ং জাতিসংঘের প্রধান অ‍্যান্টনিও গ্রুটেরাস। বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত যে মানুষের হস্তক্ষেপের কারণে ভূ- উষ্ণায়ন বাড়ছে। জীবাশ্ম জ্বালানি  পেট্রোল ও কয়লার  দহনজনিত ব্যবহার এর প্রধান কারণ। ইতিমধ্যেই  পৃথিবীর গড় উষ্ণতা  শিল্প বিপ্লবের সময় থেকে (১৮৯০ ভিত্তিবর্ষ ধরে) ১.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। যদি তা বেড়ে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি হয়ে যায় তবে সমস্ত পৃথিবীতে এমনভাবে  বিধ্বংসী প্রাকৃতিক বিপর্যয় নেমে আসবে যে তা অপরিবর্তনীয়। এসব কথা ভেবেই বিভিন্ন দেশের মধ্যে মতবিনিময় ও শপথ গ্রহণের লক্ষ্যে জাতিসংঘের মত আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান কনফারেন্স অফ পর্টিজ আহ্বান করে যাতে এই নীল গ্রহ থেকে মানুষ নামক প্রজাতিটি অবিলম্বে বিলুপ্ত হয়ে না যায়। ২০৩০ কে ভিত্তিবছর ধরে  বিভিন্ন দেশ  পরিবেশমুখি সিদ্ধান্ত নেবে এই আশা নিয়ে দেশগুলিকে ইংল্যান্ডের গ্লাসগোতে বসানো হয়েছিল এবছর ৩১ অক্টোবর থেকে ১৩ ই নভেম্বর।  চলেছিল কনফারেন্স অফ পর্টিজ-২৬ যার কিতাবি নাম ইউনাইটেড নেশন ক্লাইমেট চেঞ্জ কনফারেন্স। লক্ষ্য পূরণে তা ব্যর্থ হয়েছে। জীবাশ্ম জ্বালানি প্রধানত কয়লার ব্যবহার ধীরে ধীরে বন্ধ করে দেবার  সিদ্ধান্তটি নেওয়ার ক্ষেত্রে  ভারত ও চীন তীব্র প্রতিবন্ধকতা  তৈরি করেছে। তারা কয়লা ব্যবহার ধীরে ধীরে বন্ধ করার বদলে কয়লার ব্যবহার কমিয়ে আনার প্রশ্নটিকে গুরুত্ব দিয়েছে। ২০৩০ তো নয়ই এমনকি ২০৫০ কেও নয়; ‘জিরো এমিশন’ অর্থাৎ গ্রীন হাউজ গ্যাস নির্গমন সম্পূর্ণ বন্ধ করার জন্য ২০৭০ কে লক্ষ‍্যবর্ষ নির্ধারণ করেছে ভারতবর্ষ। দেশের প্রধানমন্ত্রী এই মিলন উৎসবে উপস্থিত ছিলেন। অথচ আমরা দেখতে পাচ্ছি ভারত এবং চীন কয়লানির্ভর  বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের  অনেকগুলি পরিকল্পনা নিয়েছে, কয়লার প্রয়োজন মেটাতে মাটির তলা থেকে কয়লা তুলে আনার জন্য জোর কদমে প্রস্তুতি চলছে।  ভারতে  এই মুহূর্তে ৪০০ টির বেশি কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র বসানোর পরিকল্পনা রয়েছে। এ দেশে উৎপন্ন বিদ্যুতের শতকরা ৭৫ ভাগই কয়লা-বিদ্যুৎ। তাই প্রয়োজন কয়লার। এই রাজ্যে বীরভূম জেলার অন্তর্গত দেউচা পাচামি এরকমই একটি প্রকল্প। কয়লা-ব্লকটির মালিকানা কেন্দ্রীয় সরকারের হলেও কয়লা তোলার  দায়িত্বে রাজ্যের সরকার।

আন্তর্জাতিক স্তরে রাজনীতিবিদ, বিভিন্ন এনজিও, কর্পোরেট কর্তা প্রত্যেক স্তরেই বিভিন্ন ধরনের আলাপ-আলোচনা, সিদ্ধান্ত এসব চলছে একদিকে, অন্যদিকে পৃথিবী গরম হয়েই চলেছে। আর তার ফলে জলবায়ুর পরিবর্তন স্পষ্ট হয়ে উঠছে, আমাদের নাড়িয়ে দিচ্ছে বিভিন্ন প্রতিকূল অবস্থার মুখোমুখি হবার কারণে। ‘আগুন লেগেছে বনে বনে’— দাবানল (ফরেস্ট ফায়ার) এর সংখ্যা যথেষ্ট বেড়ে গেছে। চলছে প্রবল বৃষ্টিপাত এবং  টাইফুন টর্নেডো সহ আম্ফান,  ইয়াশ, ইত্যাদি ও প্রবল বন্যা। বাতাসে  কার্বন-ডাই-অক্সাইড বেড়ে যাওয়ার কারণে সমুদ্র জলের অম্লত্ব বাড়ছে প্রবলভাবে, ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে সামুদ্রিক প্রাণীকূল। বরফ গলে যাকে পার্মাফ্রস্ট বলে তা বিপজ্জনকভাবে উন্মুক্ত হয়ে যাওয়ায় মিথেনের মতো উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন গ্রীন হাউজ গ্যাস বাতাসে বেরিয়ে আসছে। দক্ষিণ-পূর্ব আমাজন বনভূমি এতটাই ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে যে তাকে আগুন লাগিয়ে  পশু খামার ও সোয়াবিন চাষের উপযুক্ত জমি তৈরি করাটা আত্মহত্যার শামিল। যদিও ব্রাজিলের তৎকালীন রাষ্ট্রপ্রধান এই কাজের সঙ্গে যুক্ত বলে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। ভু-উষ্ণায়নকে আর কোনোভাবেই বাড়তে দেওয়ার অর্থ মানব প্রজাতির নরকের দ্বার খুলে যমালয়ে প্রবেশ। ভূ-উষ্ণায়ন এর প্রশ্নটিই তাই তথাকথিত উন্নয়নের সম্পূর্ণ মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। অদূর ভবিষ্যতে শব-দহনের জন্য বৈদ্যুতিক চুল্লিতে কাজে লাগানোটাই  হয়ে উঠবে না তো বিদ্যুতের  সবচেয়ে অপরিহার্য ব্যবহার!

ছবি সৌজন্যে NewsClick

বীরভূমের মুহম্মদবাজার ব্লকের ১১.২২২ একর এলাকা জুড়ে দেওচা-পাচামি কয়লা ব্লক। কয়লার পরিমান সম্ভাব‍্য ২.২ বিলিয়ন টন। ইস্টার্ন কোলফিল্ড কয়লা উত্তোলনের দায়িত্ব না নেওয়ায় ২০১৪ সালে কেন্দ্রিয় সরকার পশ্চিমবঙ্গ সহ ছয়টি রাজ্যকে এটি নেবার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু লাভজনক নয় বলেই কেউ এগিয়ে আসে নি। অবশেষে ২০১৮-তে কেন্দ্র পশ্চিমবঙ্গকে এই কয়লা তোলার প্রস্তাব দেয়। রাজ্য সরকার সাগ্রহে রাজি হয়।

ঘোষিত প্রকল্প এলাকার মধ্যে ১২টি গ্রাম আছে, যার মোট পরিবারসংখ্যা ৪৩১৪ টি এবং মোট লোকসংখ্যা ২১ হাজার, যার সংখ্যাগরিষ্ঠ হচ্ছেন আদিবাসী। আদিবাসী মানুষের প্রকৃতিমুখী কৌমজীবন যে মানুষের সুস্বাস্থ‍্যের দিশা, করোনাকালীন সময়ে তা স্পষ্ট প্রমানিত। এই ব‍্যবস্থাকে অক্ষত রেখে চলতে পারাটা আগামীদিনে সুস্থভাবে বেঁচে থাকার অন‍্যতম পূর্বশর্ত। আজকের কথার মোহজালে আমরা ভবিষ্যৎ ভাবনাকে জলাঞ্জলি দিতে পারি না। আদিবাসীদের একটা অংশ ধর্মান্তরিত হয়ে খ্রীষ্টান , আছেন মুসলমান ও বাউরী সম্প্রদায়ের মানুষেরা।

সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামে কৃষিজমি রক্ষার আন্দোলন ছিল কৃষির স্বার্থে, কৃষকের স্বার্থে, পরিবেশের স্বার্থে। জমির বিনিময়ে কম-বেশী টাকার দরদাম তা ছিল না। কৃষিজমির চরিত্র বদলের বিরোধিতা ছিল এর মর্মবস্তু। নন্দীগ্রামে অন‍্যততম প্রধান বিরোধিতা ছিল বিপজ্জনক রাসায়নিক শিল্প স্থাপন। নতুন কর্মস্থাপনের প্রতিশ্রুতি সেখানেও ছিল। কিন্তু ধোপে টেকেনি। এখন ‘উল্টা বুঝলি রাম’ ।
রাজ্যের উন্নয়ন দেওচা-পাচামির কয়লার ওপর নির্ভর করে আছে এমনটা নয়! রাজ্যে বিদ‍্যুৎ উদ্বৃত্ত, অপচিত । এখনই রয়েছে কয়লার যথেষ্ট সঞ্চয়। আবার সদ্য সমাপ্ত গ্লাসগো সম্মেলনে দেওয়া প্রতিশ্রুতি মতো কয়লার ব্যবহার ধীরে কমিয়ে আনার প্রশ্নে ভারত দায়বদ্ধ। তাই জীবাশ্ম জ্বালানি কম পুড়িয়ে বাতাসে কার্বনের মাত্রা কমানো জরুরী। উৎপাদিত বিদ্যুতের অপচয়ের সংস্কৃতিতে রাশ টানাটা আজ মানবিক তো বটেই, রাজনৈতিক কর্মকান্ডেরও অংশ । প্রচুর গাছ লাগিয়ে পরিবেশের যে ক্ষতি পুষিয়ে দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে, তা এক কথায় হাস্যকর! লক্ষাধিক বছর ধরে গড়ে ওঠা ওই অঞ্চলের বনজ সম্পদ, মৃত্তিকা, বন্যপ্রাণের যে ক্ষতি হবে তা শুধুমাত্র কিছু গাছ লাগিয়ে পূরণ করার কথা বলাটা ভাবের ঘরে চুরি। মাটির নীচে কয়লার অবস্থান অঞ্চলের প্রাচীনত্বের প্রমান। স্বভাবতই এসব অঞ্চলের জঙ্গল মানে গাছেদের যোগফল নয়। কিছু গাছ লাগিয়ে তাই এই ক্ষতিপূরণ হবে না। এক বিপুল জীববৈচিত্র্য ও বাস্তুতান্ত্রিক সম্পর্কের আধার এসব জঙ্গল। তা  ধ্বংসপ্রাপ্ত হলে মানুষ প্রজাতির বিলুপ্তি তরান্বিত হবে। মনে রাখতে হবে প্রানের ‘ষষ্ঠ গণ- বিলুপ্তি পর্ব’-এর মধ‍্যে দিয়ে আমরা চলেছি। আমাদের ও আমাদের সন্তানদের মৃত‍্যুকে তরান্বিত করাটা অমানবিক এক আচরণ হিসাবেই কেবল গ্রাহ‍্য হতে পারে।

তবু মাটির বুক চিরে ভেতর থেকে লুট করা হচ্ছে খণিজ সম্পদ। এর জন‍্য ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে প্রকৃতির সজীব ও নির্জীব অংশের সবকিছুই। লুটের এই কারবারে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছে প্রাচীন জঙ্গলগুলি এবং বনবাসী আদিবাসী মানুষজন। কারণ প্রকৃতিমুখী এই বনবাসী আদিবাসী মানুষের জীবন গড়ে উঠেছে এই ধরনের জঙ্গলগুলিকে কেন্দ্র করে। খনিজ পদার্থ আকীর্ণ এই জঙ্গলগুলিকে ব্যক্তিগত মালিকানায় ভোগ দখলে পরিবর্তিত করতে চাইছে কর্পোরেট সংস্থাগুলি। নানাভাবে তাতে মদত করছে এদেশের সরকার। রাজ্যগুলি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সহায়ক ভূমিকা নিচ্ছে।

কয়লাখনি প্রকল্প নিয়ে ভারত রাষ্ট্রের কর্পোরেটমুখী পরিকল্পনা শুরু হয়েছে অনেক আগেই। কয়লা শিল্পে ১০০ শতাংশ বিদেশি পুঁজি বিনিয়োগের ছাড়পত্র, একের পর এক কয়লা খনিগুলির বেসরকারিকরণ, খোলামুখ কয়লাখনির ক্রমাগত সংখ‍্যা বৃদ্ধি , পরিবেশ জরিপ সমীক্ষা -২০২০ লাগু করার চেষ্টা, বিরোধী দলের অনুপস্থিতিতে খণিজ বিল সংশোধন লোকসভায় পাশ করিয়ে নেওয়া ইত‍্যাদি এসবের উদাহরণ। প্রাণ ও প্রকৃতির উপর মাটি ফুঁড়ে কয়লা উত্তোলন, আর এর বহুমুখি ব‍্যবহারের বিধ্বংসী কুপ্রভাব সর্বজনস্বীকৃত। দেউচা-পাচামি প্রকল্পটির দেহে পরিবেশ বির্পযয় হলো আত্মা। একটাকে যে অন‍্যটা থেকে আলাদা করা অসম্ভব রাজ্য সরকারের তা অজানা এমনটা কেউ মনে করেন না। মাঠে নেমে গা গরম করতে শুরু করা “সমাজসেবী” সংগঠনও যথেষ্টই ওয়াকিবহাল। তবু যে এই বিধ্বংসী পথে এগুনো হচ্ছে তা অর্থনৈতিক রাজনৈতিক বাধ‍্যবাধকতার কারণে। তাই বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর বেশীর ভাগেরই বিরোধিতা আটকে আছে চলে বেড়ানোর ছোট দড়ির পুর্নবাসন প্রান্তে যার অন‍্যপ্রান্ত উন্নয়নের খোঁটায় কষে বাঁধা। সেই উন্নয়ন আবার কর্পোরেট নির্দেশিত। তাই পরিবেশ প্রশ্নে জেদী চোয়ালচাপা ভাবটা নিতে হচ্ছে অঞ্চলের মানুষ আর চারপাশে ছড়ানো ছিটানো কিছু প্রতিবাদীকেই। প্রতিবাদে জোর লাগাতে গেলে আজকের বিশ্ব-অর্থনীতির প্রেক্ষিত বিচার বিশ্লেষণের মধ‍্যে দিয়েই এগোতে হবে। পরিবেশ ভাবনা শুধু প্রাণের জিয়নকাঠির সন্ধান দেবে এমন নয় এই ভাবনা ছাড়া আজকের রাজনীতিই অপ্রাসঙ্গিক।

অপ্রয়োজনীয় ও ক্ষতিকর রাশি রাশি পণ্য (যুদ্ধাস্ত্রসহ) উৎপাদন, সেই সব পণ্যের বিজ্ঞাপন, অর্থের আর পণ‍্যের সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটাতে কোটি কোটি টেরাবাইট ডেটা ব্যবহারের কারণে বিদ্যুৎ শক্তির ব্যবহার বাড়ছে রকেট গতিতে। সবুজ বিপ্লবের যজ্ঞ সামলাতে সার-কীটনাশক তৈরী আর মাটি ফুঁড়ে জল তুলতে দীর্ঘদিন চলছে বিদ‍্যুৎবিলাসী প্রযুক্তি । এই বিদ্যুৎ শক্তির উৎপাদনের প্রয়োজনে ব্যবহার করা হচ্ছে লক্ষ লক্ষ টন পেট্রোল আর কয়লা, প্রতি বছর। আর এসবের যোগফলে পৃথিবী হয়ে পড়েছে বিপজ্জনকভাবে গরম। মেরু অঞ্চলের বরফ গলছে। সমুদ্রের উষ্ণতা ও জলস্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। পাল্টে যাচ্ছে বিভিন্ন অঞ্চলের জলবায়ু। ঘনঘন দেখা দিচ্ছে কোথাও বন্যা কোথাও খরা, যখন তখন নিম্নচাপ আর প্রবল বৃষ্টিপাত। পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে প্রাণহানি হচ্ছে, শস‍্যনষ্ট হচ্ছে, সম্পত্তি ধ্বংস হচ্ছে, ঘরবাড়ি ছেড়ে উদ্বাস্তু হতে হচ্ছে মানুষসহ বিভিন্ন প্রাণীদের। যে পুনর্বাসন প্যাকেজই দেওয়া হোক না কেন এইসব বিধ্বংসী বিপর্যয় আমরা ঠেকবো কী করে? এর মধ্যেই ছয় ঋতুর এই বাংলাদেশে আর ঋতু বৈচিত্র্য স্পষ্ট নয় । ভারতবর্ষের মানচিত্রে পূর্ব দিকের বিস্তৃত নীল জলরাশি যা বঙ্গোপসাগর নামে পরিচিত, আজ তা নিত্যনৈমিত্তিক ঝড়ের আবাসস্থল। সমুদ্র জলের উষ্ণতা বৃদ্ধি এর কারণ। বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইড বেড়ে গেছে। সেই কার্বন ডাই অক্সাইড সমুদ্র জলে দ্রবীভূত হওয়ায় জলের অম্লতা বেড়েছে যার কারণে সমুদ্র দূষণ, কোরালসহ বহু সামুদ্রিক প্রাণের অবলুপ্তি —সমুদ্র আর স্থলভাগের বিপাকীয় ফাটল, প্রাণদায়ী অক্সিজেন চক্রের বির্পযয়।
অন‍্য আর এক দিকে চোখ ফেরানো যাক—রাজনৈতিক উপনিবেশ মুক্ত যুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে বাণিজ‍্য তরীর অশ্বমেধ যাত্রাটার দিকে। বৃহৎ শিল্পগুলোকে টুকরো করে পুঁজি সঞ্চয়ন এর স্বার্থে, সস্তা শ্রম ও সহজলভ্য শ্রমিকের লোভে, পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে তথ‍্য-প্রযুক্তি সামরিক বিভাগের দ্বার খুলে বাজারের পথে-প্রান্তরে। অন্ধ পুঁজির বিশ্ব-পর্যটনের যষ্ঠী। আমরা কী দেখলাম?

বড় শিল্পের তুলনায় অনেক ছোটমাপের খন্ডিত এই শিল্পগুলিতে অপ্রয়োজনীয় ও ক্ষতিকর রাশিরাশি পণ্য, যুদ্ধাস্ত্র উৎপন্ন হচ্ছে আর তা তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের সাহায‍্যে value-adding chain গঠন করে কর্পোরেট সংস্থাগুলির পুঁজি সঞ্চয়নকে বাড়িয়েই চলেছে। শিল্পযুগের পর অনেক বছর সময় ধরে শিল্প উৎপাদনের বড় কেন্দ্রগুলি প্রধানত ছিল ইউরোপ আমেরিকায় । বিদ‍্যুতের প্রয়োজনে জ্বালানি হিসাবে কয়লা ও খণিজ তেল ব্যবহার করত, তৈরি হতো প্রচুর কার্বন ডাই অক্সাইড। গাছপালা বাড়ছিল, উষ্ণতাও বাড়ছিল । তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের বহুল ব্যবহার এবং অর্থনীতির বিশ্বায়নের মধ্যে দিয়ে সারা পৃথিবীব্যাপী value-adding chain গঠন করে এই উৎপাদনকে আজ পৃথিবীর কোণে কোণে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। একদিন আমেরিকা ও ইউরোপের তাপবৃদ্ধিজনিত উষ্ণতা পৃথিবীর অন্য অংশে বিকিরণ করে প্রকৃতি পৃথিবীর গড় উষ্ণতাকে বাড়ার হাত থেকে রক্ষা করেছে। আজ সারা পৃথিবীতে ছড়ানো এই ছোট ছোট শিল্পগুলি (যা আবার তুলনামূলক বিচারে বড় শিল্পের চেয়ে বেশি দূষণের ভাগীদার ) সারা পৃথিবীতে দূষণের বৃদ্ধি ঘটিয়েছে। শক্তির প্রয়োজন মেটাতে জীবাশ্ম জ্বালানির দহন সারা পৃথিবীকে মুড়ে দিয়েছে তাপ জ্যাকেটে। নিও-লিবারেল অর্থনীতির হাত ধরে এই উষ্ণতার বৃদ্ধি ঘটেছে সূচকীয়ভাবে অর্থাৎ খাড়াই পথে । এই জমা তাপ সমুদ্রকে গরম করেছে, যাত্রা করেছে শীতলতর আন্টার্কটিকার সমুদ্র- অঞ্চলে , বরফ গলানোর লক্ষ্যে।

বঙ্গোপসাগরেও সমুদ্র জলের উষ্ণতা বৃদ্ধি বিভিন্ন সময়ে এবং খুব ঘনঘন নিম্নচাপের সৃষ্টি করছে যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তীব্র ঝঞ্ঝা হিসাবে আছড়ে পড়ছে উপকূলের জমিতে। বিগত একটা দশকেই আমরা বেশ কয়েকবার এরকম ভয়ঙ্কর প্রাকৃতিক ঝঞ্ঝার সাক্ষী হয়েছি। এই প্রিয় কলকাতার মানুষ বা শহর যা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের হাত থেকে এযাবৎকাল নিরাপদ বলে করা হতো, আজ তাকেও রক্ষা করা যাচ্ছে না। আম্ফানের স্মৃতি স্মরণীয়। আইপিসিসি-র ষষ্ঠ প্রতিবেদনের যে খসড়াটি এবছর আমাদের সামনে এসেছে তা ঘনঘন প্রবল বৃষ্টিপাত এবং তাপ-প্রবাহ বৃদ্ধির কথা নিশ্চিত করছে ভূউষ্ণায়ন তথা জলবায়ু পরিবর্তনের ফল হিসাবে। নাসা থেকে সাম্প্রতিক প্রকাশিত প্রতিবেদনটি জানাচ্ছে ভারতের বারোটি শহর উষ্ণতা বৃদ্ধিজনিত কারণে আবহাওয়া মন্ডলের যে বিকার হচ্ছে তাতে জলমগ্ন হবার সম্ভাবনা রয়েছে। কলকাতা এই শহরগুলির অন্যতম। এমনকি প্রায় নিশ্চিত আশঙ্কা এই যে পৃথিবীর গড় উষ্ণতা বৃদ্ধি 1.5 ডিগ্রী সেলসিয়াসের বেশি হোলে জলস্তর বৃদ্ধি ও অপরিবর্তনীয় প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে বড় নদীগুলির দুপাশের গ্রাম-শহর বছরের বেশিরভাগ সময়টাতেই কোমর জলের নিচে থাকবে। একটি তুলনায় দেখা যাচ্ছে কলকাতা থেকে বর্ধমান পর্যন্ত শহরগুলি সারাবছর ২-৩ ফুট জলের নিচে থাকার সম্ভাবনা খুবই বেশি। সুন্দরবনের বেশ কয়েকটা দ্বীপ অচিরে নদীগর্ভে তলিয়ে যাবার অপেক্ষায় । অনেক সুন্দরবনবাসী প্রাকৃতিক বির্পযয়ের কারণে অঞ্চল ছাড়ছেন। বিশ্ব-উষ্ণায়ণ আর জলবায়ুর পরিবর্তন যে পৃথক সঙ্গা বহন করুক না কেন প্রকৃতি বিপর্যয়ের নিরিখে তা আজ সমার্থক।

২০২০ সালের জুন মাস নাগাদ দেশের ৪১টি কয়লা ব্লক নিলামে চড়িয়েছেন স্বয়ং দেশের প্রধানমন্ত্রী, ‘দি মিনারেল ল অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট’ এর জোরে। ৪১টি কয়লা ব্লকের ৫০ শতাংশ অর্থাৎ ৬ লক্ষ হেক্টর জমি ‘নো গো’ এরিয়ায় অর্থাৎ গভীর বনাঞ্চলের অন্তর্গত। মোদীর সঙ্গেই ই-অকশনে শামিল ছিলেন টাটা সনস’র চেয়ারম্যান চন্দ্রশেখরন, বেদান্ত গ্রুপের অনিল আগরওয়াল। আর খরিদ্দার হিসাবে ছুটে এসেছে টাটা, বেদান্ত, আদানি, জিন্দাল, হিন্ডালকো, জেএসডব্লিউ থেকে বিএইচপি, রিও টিন্টো, বিলিটনপিবডির মত বিদেশি গ্রুপ। ১৯৯৩ সাল থেকে দেশের কয়লা সম্পদকে বেসরকারী মালিকদের হাতে তুলে দেবার যে পরিকল্পনা শুরু হয়েছিল তা ২০১৯ সালে কয়লা শিল্পে ১০০ শতাংশ বিদেশী বিনিয়োগের ছাড়পত্র দেওয়ার মাধ্যমে সম্পূর্ণ করেছে কেন্দ্রে বসে থাকা বিজেপি সরকার। রাজ্য সরকারও প্রকৃতি ধ্বংসের এই অরক্রেস্ট্রায় অন্যতম সংগতকারি হিসাবে নজর কাড়ছেন রাজ্যের ও দেশের মানুষের। এইসব উন্নয়ন উদ্দীপনার অন‍্য নাম উন্নয়ন উন্মাদনা । ক্ষোভের বিষয় এই যে বামমার্গী বুদ্ধিজীবীরাও ভিন্নতার সন্ধানের বদলে হয় নিশ্চুপ, অথবা প্রধানত আর্থিক দর কষাকষিতে ব‍্যস্ত । বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির বিরোধিতা পরিণতি পেতে চাইছে ভোটের বাক্সে, পরিবেশের বিপর্যয়ের সামগ্রিক বিরোধিতায় নয়।

ঋণ স্বীকার : স‍্যোসাল মিডিয়ায় প্রকাশিত বিভিন্ন অনুসন্ধানমূলক প্রতিবেদন।
লেখক পরিচিতি:
গনবিজ্ঞান আন্দোলন ও পরিবেশ আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক।
যোগাযোগ: dbankim1@gmail.com

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top