সন্তোষ সেন
শুরুর কথা
করোনা অতিমারী ও লকডাউন এর প্রভাবে এটা সকলের কাছে স্পষ্ট যে, যানবাহন কম থাকায়,
কারখাণায় উৎপাদন প্রায় বন্ধ থাকায় এবং জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কম হওয়ার কারণে প্রাণ প্রকৃতি পরিবেশ নিজের স্বাভাবিক ছন্দ কিছুটা হলেও ফিরে পেয়েছে। বিজ্ঞানীরা বারবার সতর্কবার্তা শোনাচ্ছেন- এই নীল গ্রহে মানবসভ্যতাকে টিকিয়ে রাখতে হলে গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করে, পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে আটকাতে হবে। বন্ধ করতে হবে অরণ্য নিধন, সবুজ ধ্বংস। জীবাশ্ম জ্বালানির পরিবর্তে শক্তির অন্যান্য উৎসগুলোর ব্যবহার বাড়াতে হবে।
জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ বিপর্যয়ের হাত ধরে মানবপ্রজাতি সহ তামাম জীববৈচিত্র্যই ষষ্ঠ গণ অবলুপ্তির যুগে প্রবেশ করেছে। ঠিক এই আবহেই মুনাফাসর্বস্ব বহুজাতিক কোম্পানিগুলো ও তাদের দোসর সরকার -প্রশাসন নতুন করে মেতে উঠেছে পরিবেশ নিধনে।
পশ্চিমবঙ্গের দেউচা- পাচামি, ওড়িশার তালাবিয়া জঙ্গলের একাংশে, আসামের সংরক্ষিত বনাঞ্চল দেহিং পাটকাই সহ নয়া নয়া কয়লা খনি প্রকল্প
ছাড়পত্র পেয়ে যাচ্ছে অনায়াসে। এই নিবন্ধে আমরা দেহিং -পাটকাই কয়লা খনি ও তার হাত ধরে পরিবেশ বিপর্যয়ের কিছুটা হদিস দেওয়ার চেষ্টা করব। এত কয়লা খনি প্রকল্পের ছাড়পত্রই বা কেন সেই প্রসঙ্গেও দু’চার কথা বলব।

নৈসর্গিক দেহিং-পাটকাই:
জঙ্গলের মাঝ বরাবর বয়ে চলেছে দেহিং নদী। এর দু’পাশে পাটকাই পর্বত। সবটা মিলিয়েই জীববৈচিত্র্যে ভরপুর নৈসর্গিক দেহিং-পাটকাই।
পুর্বভারতের আমাজন হিসেবে পরিচিত এই বৃষ্টি অরণ্যের একাংশকে ২০০৪ সালে বন্যপ্রাণ সংরক্ষিত অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করা হয়। বিশ্বের ৩৪ টি
বায়োডাইভারসিটি- হটস্পটের মধ্যে ভারতের যে চারটি অঞ্চলকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম আসামের দেহিং-পাটকাই। এখানে আছে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, প্রচুর হাতি, গিব্বন, ম্যাকাও, মেছোবিড়াল সহ ৪৭ রকমের স্তন্যপায়ী প্রজাতি, ৪৭টি সরীসৃপ প্রজাতি, ৩০ রকমের প্রজাপতি আর তিনশো ধরনের নানা প্রজাতির পাখি। আসামের বিখ্যাত হলং গাছও প্রচুর পরিমাণে ছড়িয়ে আছে এই জঙ্গলে। এসব কিছুই বিপর্যস্ত হবে নতুন কয়লা খনি প্রকল্প রূপায়িত হলে।
কয়লা- খনির প্রেক্ষাপট:
আমাদের দুর্ভাগ্য – বন্যপ্রাণদের মৃগয়াক্ষেত্র এই অঞ্চলে প্রকৃতি বহুল পরিমাণে কয়লার ভান্ডার জমিয়ে রেখেছে। এই “কালো- সোনার” উপর নজর পড়েছিল ব্রিটিশ আমল থেকেই।
“Asam Railways and Trading Company”র হাত ধরে ১৮৮২ সালে পাটকাই পর্বত গুঁড়িয়ে শুরু হয় কয়লা উত্তোলন। স্বাধীনতার পর থেকেই কোল ইন্ডিয়া লিমিটেড ও কয়লা মাফিয়াদের বদান্যতায় শুরু হয়ে যায় পাহাড়-জঙ্গল ধ্বংস করে কয়লা তুলে আনার কালো করবার। এর ফলে বাড়তে থাকে পরিবেশ দূষণ, কমতে থাকে স্থানীয় আদিবাসীদের জঙ্গলের উপর অধিকার, বাড়তে থাকে বনবাসী জনজাতির ক্ষোভ বিক্ষোভ। বিশেষ করে ২০০৩ সালে অনুমোদন শেষ হয়ে গেলেও ২০১৯ পর্যন্ত বেআইনিভাবে কয়লা খননের বিরুদ্ধে আদিবাসী জনজাতির মানুষ বারেবারে প্রতিবাদ জনিয়েছেন। কে শোনে কার কথা?
ইতিহাসের সরণি বেয়ে চলুন পৌঁছে যায় ২০২০ সালে। এই বছর জানুয়ারি মাসে “National Board of Wildlife” হাতিদের জন্য সংরক্ষিত এই বনাঞ্চলের প্রায় ১০০ হেক্টর এলাকায় কয়লা উত্তোলনের প্রাথমিক ছাড়পত্র দিয়ে দিল কোল ইন্ডিয়া লিমিটেডকে।
কেন ওদের এত তৎপরতা?
আত্মনির্ভর(!) ভারত ২০২৪ সালের মধ্যে পাঁচ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের অর্থনীতিতে পৌঁছে যেতে চায়। তার জন্য দরকার পরিকাঠামোর উন্নতি আর পরিকাঠামো নির্মাণে সবচেয়ে বেশি করে দরকার বিদ্যুৎ শক্তির। ফলে ২০২৪ সালের মধ্যে ফি বছর 5% বেশি হারে কয়লার উত্তোলন ও ব্যবহার চলতেই থাকবে। এই লক্ষ্যেই এগোচ্ছে দেশি-বিদেশি বহুজাতিক সংস্থা ও কেন্দ্র রাজ্য সরকার।
তাই বলি প্রদত্ত হবে হাতিদের জন্য সংরক্ষিত আসামের দেহিং-পাটকাই বনাঞ্চল, ডিব্রু- সাইখোয়া জাতীয় উদ্যান, ওড়িশার তালাবিয়া বনাঞ্চল, বীরভূমের দেউচা -পাচামি সহ আরো অনেক বনাঞ্চল- উদ্যান- পাহাড় পর্বত। পাশাপাশি, কিছু মানুষের রাক্ষুসে খিদে, লোভ লালসা মেটাতে চলতে থাকবে কয়লাখনির বেসরকারিকরণ। ইকোনমিক টাইমসের রিপোর্ট (০২.০১.২০২০) থেকে জানা যাচ্ছে –নতুন করে দু’শোর বেশি কোল-ব্লক তুলে দেওয়া হবে বেসরকারী মালিকদের হাতে বাণিজ্যিকভাবে কয়লা উত্তোলনের জন্য।
কম করে ৪০ কোটি মেট্রিক টন কয়লা তুলে আনা হবে ২০২৪ সালের মধ্যে। এই পরিকল্পনার অঙ্গ হিসেবেই কয়েক হাজার বন্যপ্রাণীর প্রাকৃতিক বাসস্থানকে ধ্বংস করে, দেহিং নদীর জল অরো দূষিত করে, বায়ু দূষণের মাত্রা কয়েকগুণ বাড়িয়ে নতুন করে কয়লা উত্তোলনের পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হলো।
মানুষ কি ভাবছেন?
এই বনাঞ্চলে বাস করেন বারোটি জনজাতির কয়েক হাজার মানুষ। প্রাণ প্রকৃতি পরিবেশের ধ্বংস সাধনের এই নয়া পরিকল্পনার বিরুদ্ধে স্থানীয় মানুষরা ক্ষোভে ফুঁসছেন। বেআইনি কয়লাখনির বিরুদ্ধে এর আগেও তারা প্রতিবাদে সামিল হয়েছেন। এবারে সাথে যুক্ত হয়েছেন ছাত্র-শিক্ষক- পরিবেশ ও বিজ্ঞান কর্মী সহ বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন। আসামের নানান রাজনৈতিক দলও প্রতিবাদে সামিল হয়েছেন। লকডাউনের কারণে মাঠে নেমে প্রতিবাদে সামিল হতে না পারলেও ফেসবুক, ইনস্ট্রাগ্রাম, টুইটারের মতো সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। কেন্দ্রীয় পরিবেশ মন্ত্রকের দরবারে প্রায় ৫০,০০০ সই সম্বলিত ইমেইল পাঠানো হয়েছে পরিবেশ ও মানুষের জীবন বিপর্যয়কারি এই তুঘলকি পরিকল্পনার বিরুদ্ধে।

উপসংহারের পরিবর্তে:
মুষ্টিমেয় স্বার্থান্বেষী মানুষের আরো আরো মুনাফার স্বার্থে পরিবেশ লুঠের বন্দোবস্ত, নাকি নিজেদের স্বার্থে- আগামী প্রজন্মকে বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থে সর্বাত্মক প্রতিবাদ-প্রতিরোধ? কোনদিকে এগোবে দেশ, দেশের মানুষ, ভবিষ্যতই তার উত্তর দেবে। প্রকৃতি ধ্বংস করে পরিবেশ দূষণ আরো বাড়িয়ে দেওয়ার এইসব নয়া নয়া পরিকল্পনার বিরুদ্ধে সমাজ জুড়ে যেটুকু ক্ষোভ বিক্ষোভ ধ্বনিত হচ্ছে, প্রতিবাদ প্রতিরোধে মানুষ সামিল হতে বাধ্য হচ্ছেন তাকে আটকানোর জন্যই কি “EIA 2006” আইনের পরিবর্তে EIA -2020 ড্রাফ্ট নিয়ে আসা হলো? এই ড্রাফ্ট আইনে পরিণত হলে আর লুকিয়ে-চুরিয়ে বা বেআইনিভাবে নয়, বরং আইনের ছাড়পত্র নিয়েই সরকারি মদতে মসৃণভাবে আরো বেশি মাত্রায় ও দ্রুত গতিতে পরিবেশে লুঠ চলতে থাকবে।
তথ্যসূত্র:
- https://ET Energyworld.com ( 21.05.2020)
- countercurrents.org (28.05.2020)
- https://thecrosscurrent.in/an-incomplete biography of rainforest dehing patkai/
লেখক পরিচিতি
লেখক – বিজ্ঞান শিক্ষক ও পরিবেশ কর্মী।
email: santoshsen66@gmail.com
Poribes er upor eta satti osadharon lekha. Ei somosto lekhok ra amader choke angul diye dekhia dei amader next projonmer future koto kharap obostar dike jachee. Onek onek dhonnobad lekhok ke
সত্যিই বড় ভয়াবহ বিষয়, এভাবেই মানুষ অর্থের লোভেই নিজেরাই নিজেদের ক্ষতি করছে….আর তার ওপর ঘৃতাহুতি দিচ্ছে সরকার….
এখনও কি আমরা বুঝবো না আমরা কোন দিকে এগোচ্ছি…. সবাই সরব হোন প্রতিবাদ গড়ে তোলা হোক ✊✊
মনে হচ্ছে প্রকৃতি লুন্ঠনের আইনি ছাড়পত্র দিতেই বুঝি আসছে EIA-2020,মানুষের প্রতিবাদ আন্দোলন স্তব্ধ করে লুন্ঠনের স্বর্গ বানাতে চলছে সর্বাত্মক প্রস্তুতি,তাই কেন্দ্রীয় পরিবেশ দপ্তরে ইমেলে প্রতিবাদ পাঠানোর বিরুদ্ধেও আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার কথা শোনা যাচ্ছে। বস্তার অঞ্চলের সাতটি জেলায় দেশি বিদেশি পুঁজির কয়লা সহ খনিজ উত্তোলনের বিরুদ্ধে আন্দোলন মোকাবিলা করতে সালোয়া জুলুমের ধাঁচে বাহিনী গড়ার কথা শোনা যাচ্ছে। দেহিং পটকাই অঞ্চলের চিত্রটিতেও একই ঘটনার ছায়া বর্ণনায় তুলে ধরা হয়েছে। মানুষকে বিশেষত ছাত্র যুব সমাজকে সচেতন করে তুলতে এসব ঘটনা বেশি বেশি করে তুলে ধরা প্রয়োজন।
সম্পূর্ণ সহমত। লুঠেরা বহুজাতিক কোম্পানির লোভ লালসা এবং ওদের মুনাফার রাস্তা সচল রাখতে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের চক্রান্তের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলত হবে, সর্বস্তরে ঐক্যবদ্ধ লড়াই ছাড়া আজ আর বাঁচার উপায় নেই। আর এটা ঠিক এই কাজে বর্তমান প্রজন্মের ছাত্র ছাত্রী, যুবা বাহিনীকে এগিয়ে আসতে হবে, ওদেরকে যোগ্য সঙ্গত করতে হবে আমাদের।
খুব সুন্দর উপস্থাপনা । EIA 2020 পাশ হয়ে যাবে সম্ভবত এই বাদল অধিবেশনেই । এমনিতেই সারা দেশ জুড়ে এই বনাঞ্চল ও পরিবেশ আইন নিয়ে পাথালগড়ি আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে । আদিবাসি মেয়েরা গুজরাট , মধ্যপ্রদেশ , উড়িষ্যা , ছত্তিশগড় , ঝারখন্ড , বিহার এসব রাজ্যে আন্দোলন ব্যাপক ভাবে শুরু করেছে । গুজরাটে এই আন্দোলনের নেত্রী ববিতা কাছাপকে গ্রেপ্তার করা হয় গত ২৫শে জুলাই । এই প্রেক্ষাপটকে ঘিরে এই নিয়ে আওয়াজ তোলার জরুরী প্রয়োজন , সেজন্যে এ লেখাটি তথ্য , বিশ্লেষণ সমৃদ্ধ ও প্রাসঙ্গিক ।
Scientific contents are excellent, especially the global warming due to generation of green house gases and usefulness of plantation are very well documented! It seems to be an Encyclopedia itself.
Sustaiable Consumption
Sustainable Devevelopment,
EVS er topic gulobkano j Economics a included, along with Global Warming…
R kano j Student porai……?🤔