পরিবেশ আন্দোলনের শ্রেণিচরিত্র: মধ্যবিত্ত নাকি শ্রমিক?

পরিবেশ আন্দোলন কি শুধুই শহুরে মধ্যবিত্তদের চিন্তার ফসল, না কি শ্রমজীবী মানুষের অস্তিত্বের লড়াই? পরিবেশ আন্দোলনের শ্রেণিচরিত্র বিশ্লেষণ করলেন বঙ্কিম দত্ত।

environmental movement

বঙ্কিম দত্ত

” একটা সবুজ পৃথিবী চাই!”

এই স্লোগান আজ রাস্তায়, বিদ্যালয়ে, সোশ্যাল মিডিয়ায়—সর্বত্র। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই ‘সবুজ’ পৃথিবীর জন্য লড়াই কারা করছে? কারা এই লড়াইয়ের আসল শরিক, আর কারা কেবল সচেতনতার ব্যানার নিয়ে সামনে এসেছে? পরিবেশ আন্দোলনের এই শ্রেণিচরিত্র—অর্থাৎ এটি কি মূলত মধ্যবিত্তদের চিন্তাজগতের ফসল, না কি শ্রমজীবী মানুষের অস্তিত্বের লড়াই—এই প্রশ্ন ওঠাটা আজ সময়ের দাবি।

আধুনিক পরিবেশ আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল ইউরোপ ও আমেরিকায়। ১৯৭০-এর দশকের ‘আর্থ ডে’ থেকে শুরু করে গ্রেটা থুনবার্গের “ফ্রাইডেস ফর ফিউচার”—সব কিছুতেই চোখে পড়ে এক ধরনের মধ্যবিত্ত, শিক্ষিত, শহুরে শ্রেণির নেতৃত্ব। এই আন্দোলনগুলো জলবায়ু পরিবর্তন, প্লাস্টিক বর্জন, পুনঃব্যবহারযোগ্য শক্তি, এবং কার্বন নিঃসরণ ইত্যাদি নিয়ে সচেতনতা তৈরি করেছে—এ কথা অস্বীকার করা যাবে না।

কিন্তু এই মধ্যবিত্ত নেতৃত্বের মধ্যে একটা মৌলিক সীমাবদ্ধতা আছে। তারা সমস্যাকে অনেকটা ‘মোড়ক’ হিসেবে দেখে—একটি ‘গ্লোবাল ক্রাইসিস’ হিসেবে। তারা দুর্যোগের ছবি তুলে ধরে, তথ্য প্রকাশ করে, কিন্তু এ সংকট যে শ্রেণিভিত্তিতে ভিন্ন প্রভাব ফেলে, সে বিষয়ে তারা অনেক সময় নীরব থাকে। এই আন্দোলনের ভাষা  প্রযুক্তিনির্ভর, নীতিনির্ধারকমুখী—যার সাথে মাটির কাছাকাছি থাকা মানুষদের বাস্তবতা অনেক দূরে।

প্রকৃত অর্থে পরিবেশের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক তৈরি হয় সেই মানুষদের, যাদের জীবিকা প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল। কৃষক, মজুর, মৎস্যজীবী, বনবাসী, খনি শ্রমিক, চরবাসী, নদীভাঙনের শিকার মানুষ—প্রতিদিন জলবায়ু পরিবর্তনের বাস্তবতার মুখোমুখি হচ্ছেন তারাই।

খরা মানে শুধু কম বৃষ্টি নয়। এর মানে চাষ বন্ধ হওয়া। বন্যা মানে শুধু রাস্তাঘাট ভেসে যাওয়া নয়,  ঘর হারানো ও বে-রোজগার । জঙ্গল কাটা মানে শুধু গাছের ক্ষতি নয়, এর মানে এক একটি আদিবাসী গোষ্ঠীর জীবনের ভেঙে পড়া। অথচ এই শ্রেণির কথা পরিবেশ আন্দোলনের মূলধারায় প্রায়শই অনুপস্থিত।

পরিবেশ নিয়ে যে শুধু শিক্ষিত শহুরে মানুষেরাই ভাবে, এমনটা মনে করা  এক ধরনের শ্রেণি-ভিত্তিক ভ্রান্তি। চিপকো আন্দোলন বা নর্মদা বাঁচাও আন্দোলনের দিকে তাকালেই বোঝা যায়—এইসব আন্দোলনের চালিকাশক্তি ছিল মূলত শ্রমজীবী কৃষক ও নারী আদিবাসীরা।

চিপকো আন্দোলনে গাছকে জড়িয়ে ধরে রক্ষা করেছিলেন পাহাড়ি গ্রাম্য নারী শ্রমিকেরা। কারণ গাছ কাটা মানে পাহাড়ে ভূমিক্ষয়, জলের উৎসের বিলুপ্তি এবং সর্বোপরি জীবিকার বিপর্যয়। আবার নর্মদা নদীর ড্যামের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন, তাও কোনো ‘গ্লোবাল গ্রিন ক্যাম্পেইন’ ছিল না। তা ছিল নিজেদের ভূমি, বসতভিটা, চাষের জমি রক্ষা করার লড়াই।

এইসব লড়াইয়ে ‘পরিবেশ’ শব্দটা হয়তো বারবার উচ্চারিত হয়নি, কিন্তু সেই লড়াইয়ের ভিতরেই লুকিয়ে আছে আসল পরিবেশচেতনা—যা জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে, শুধুমাত্র আদর্শগত ভাবে নয়, বরং কঠিন বাস্তব হয়ে ।

শহরের  মধ্যবিত্ত শ্রেণি পরিবেশ রক্ষাকে দেখছে মূলত ভোগের পরিবর্তনের মাধ্যমে—বাইসাইকেল চালানো, কাগজের ব্যাগ ব্যবহার, প্লাস্টিক বন্ধ করা ইত্যাদি। এগুলো  গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ হলেও, তাতে মূল ব্যবস্থার ভিত্তি বদলায় না। বরং এক ধরনের “ইকো-আত্মতুষ্টি” তৈরি হয়—নিজেকে দায়মুক্ত করার একটি ‘গ্রিন পাস’ যেন।

অন্যদিকে, শ্রমিক শ্রেণির চেতনা আসে প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা থেকে। তারা জানেন, কয়লাখনি বা নির্মাণশিল্পে কাজ করতে গিয়ে তারা যেমন নিজের স্বাস্থ্য হারান, তেমনই পরিবেশেরও ক্ষতি হয়। কিন্তু বিকল্প না থাকায় তারা বাধ্য হন এই বিপজ্জনক শ্রমে। ফলে পরিবেশ আন্দোলন তাদের জন্য একটি অস্তিত্বের প্রশ্ন—অর্থনৈতিক শোষণ ও পরিবেশগত ধ্বংসের বিরুদ্ধে একযোগে লড়াই।

পরিবেশ আন্দোলন যদি সত্যিই কার্যকর এবং র‍্যাডিকাল হতে চায়, তবে তাকে এই শ্রেণিচরিত্রের বিষয়টি মেনে নিতে হবে। কেবলমাত্র সচেতন মধ্যবিত্তর শ্লোগান বা আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আলোচনায় সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। আন্দোলনের ভাষা, নেতৃত্ব ও দৃষ্টিভঙ্গি—সবই শ্রমজীবী মানুষের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে গ্রহণ করতে হবে।

এখানে প্রয়োজন এক নতুন ধরনের সংহতি—যেখানে শিক্ষিত সমাজ শ্রেণিবিশেষের সুবিধাজনক অবস্থা থেকে নেমে এসে শ্রমিক শ্রেণির সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াইয়ে অংশ নেবে। কারণ পরিবেশ সংকট শুধু তথ্যগত নয়, এটি এক ধরনের সামাজিক ও রাজনৈতিক সংঘাত—সম্পদ কাদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে তার প্রশ্ন।

পরিবেশ আন্দোলনকে  ‘সবুজ বিপ্লব’ বা ‘লাল-সবুজ বিপ্লব’ যাই বলা হোক, এই বিপ্লবের নেতৃত্ব নিচুতলার মানুষদের হাতেই আসা দরকার।

সবুজ অর্থ শুধু গাছ নয়, এটি জীবিকা, মাটি, জল, এবং শোষণমুক্ত ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি। আন্দোলনের নেতৃত্বের প্রশ্নে একে লাল হতেই হবে। অন্যথায় সমাধান দুরস্ত।

পরিবেশ আন্দোলনের শ্রেণিচরিত্রকে অস্বীকার করলে আন্দোলন ব্যর্থ হবে। কারণ সমস্যা যদি শোষণ ও বৈষম্যভিত্তিক হয়, তাহলে তার সমাধানও হতে হবে শ্রেণিসচেতন এবং র‍্যাডিকাল।

আমাদের প্রয়োজন একটি একীভূত পরিবেশ আন্দোলন—যেখানে পরিবেশ বাঁচানোর মানে হবে শুধু বাতাস পরিষ্কার রাখা নয়, সেইসব মানুষের কণ্ঠকে প্রাধান্য দেওয়া, যারা প্রকৃতির সবচেয়ে কাছাকাছি বাস করে, এবং সবচেয়ে বেশি শোষিত হয়।

তাদের হাতেই হোক আগামী দূষণমুক্ত পৃথিবীর সূচনা।

আগের যে লেখাগুলো পড়তে পারেন

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top