অনির্বান দাস
জলবায়ু পরিবর্তন বিভিন্নভাবে মানুষের স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব ফেলে। পরিবেশের চূড়ান্ত পরিবর্তনগুলি বিদ্যমান স্বাস্থ্য সমস্যাকে বাড়িয়ে তুলতে পারে এবং পাশাপাশি নতুন সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। চরম তাপমাত্রা, ক্রমবর্ধমান দূষণ, অপুষ্টি প্রভৃতি শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটায়। গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব অঞ্চলে সবুজায়ন বেশি সেই অঞ্চলের অধিবাসীদের রোগ অসুখ অনেক কম।
WHO এর মতে– গবেষকরা ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন যে, জলবায়ু পরিবর্তনের নির্দিষ্ট কিছু প্রভাব ২০৩০ সালের মধ্যে প্রায় ২,৫০,০০০ লোকের মৃত্যু বাড়াতে ভূমিকা রাখবে। যেমন – উচ্চতাপের কারণে অপুষ্টি, ডায়রিয়া, ম্যালেরিয়া, ইত্যাদি রোগের প্রাদুর্ভাব বাড়বে। WHO জলবায়ু পরিবর্তনকে “একবিংশ শতাব্দীর বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্যের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি” হিসেবে বিবেচনা করেছে। চরম আবহাওয়া এবং প্রাকৃতিক বিপর্যয় অর্থনৈতিক দিক থেকে পিছিয়ে থাকা মানুষের কাছে বেদনাদায়ক ও চাপজনক হতে পারে। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সাথে জড়িতদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় ভারতের পাঞ্জাবে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য কৃষিকাজ ভালো না হওয়ায় কৃষকরা ঋণগ্রস্থ হয় এবং তার ফলে কৃষকদের আত্মহত্যার মিছিল লম্বা হয়। এছাড়া বিভিন্ন ধরনের প্রকৃতিক বিপর্যয়ের ফলে প্রিয়জনদের হারানোর শোক, বাস্তুচ্যুত হওয়া, কৃষিজমি হারানো ইত্যাদি বিপর্যয় মানুষদের মধ্যে হতাশা ও অবসাদ বাড়িয়ে তোলে। ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা বিশেষ করে বয়স্ক, শিশু এবং দীর্ঘস্থায়ী স্বাস্থ্য সমস্যার সাথে জড়িত মানুষদের উপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারে। উচ্চতাপমাত্রার ফলে হিটস্ট্রোক, হিটঅ্যাম্পেয়ার, পেশির কার্যক্ষমতা হ্রাস, হার্ট অ্যাটাক ইত্যাদি সমস্যা দেখা দিতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিভিন্ন উদ্ভিদের পরাগযোগের সময় বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে এখান থেকে অ্যালার্জি সংক্রমণ বৃদ্ধি পায়। এছাড়া বায়ু দূষণের ফলে বিভিন্ন এরোসোল অ্যালার্জি সৃষ্টি করতে পারে। বায়ুদূষণ মানব স্বাস্থ্যের উপর সবথেকে খারাপ প্রভাব বিস্তার করে। ২০১৯ সালে ভারতবর্ষে ১,১৬,০০০ শিশু কেবলমাত্র বায়ু দূষণের জন্য মারা গিয়েছিল। মারাত্মক বায়ু দূষণের ফলে হাঁপানি, ফুসফুসে ক্যান্সার, বুকে ব্যথা, হৃদরোগের সম্ভাবনা বাড়ছে।
জলবায়ু পরিবর্তন ফসল উৎপাদনকে প্রভাবিত করে। ফলে কম উৎপাদন বা ফসল নষ্টের কারণে বা অন্য কোনো কারণে খাদ্যের দাম বাড়লে দরিদ্র মানুষদের মধ্যে অপুষ্টি, খাদ্যাভাব দেখা দেয় মারাত্মকভাবে। বিশেষজ্ঞদের মতে- বায়ুমণ্ডলে

কার্বন ডাই অক্সাইডের মাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ফসলের পুষ্টির পরিমাণও কম হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে স্ট্রেস জনিত প্রভাব স্নায়বিক স্বাস্থ্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং চরম আবহাওয়ার ঘটনাগুলি মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সমস্যা, সংক্রমণের ঝুঁকি এবং মৃত্যুর কারণ হতে পারে। পরিবেশে ক্রমবর্ধমান দূষণ, টক্সিন এবং অ্যালার্জেনের কারণে শ্বাসকষ্ট, হার্ট ও ফুসফুসের অসুখ ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। বিশেষ করে শিশু ও বয়স্ক এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে পিছিয়ে থাকা মানুষজনের ক্ষেত্রে এই সমস্যা জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে।
জলবায়ু পরিবর্তন জনিত এইসব হাজারো সমস্যার সমাধানে রাষ্ট্রনায়করা সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ। প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণকে কমিয়ে আনার কথা বলা হয়, কিন্তু বাস্তবে প্রতিনিয়ত কার্বন নিঃসরণ বেড়েই চলেছে। কয়লা, পেট্রোলিয়াম, লোহা ও হিরার মতো আকরিক উত্তোলনের জন্য বহুল পরিমাণ বনভূমি ধ্বংস করা হচ্ছে। তাই বিপর্যস্ত পরিবেশকে মেরামত করতে হলে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার অতি দ্রুত শূন্যের দিকে নিয়ে যেতে হবে, কয়লা নির্ভর অর্থনীতির পরিবর্তে বিকল্প শক্তির ব্যবহারের ওপর জোর দিতে হবে এবং স্থিতিশীল উন্নয়ন নিয়ে গভীরে চর্চা করতে হবে।
আশার কথা- বর্তমানে সারা বিশ্বে এক ঝাঁক ছাত্র ছাত্রী, কিশোর কিশোরী, শিক্ষক সমাজ এবং বিজ্ঞানীকূল জলবায়ু পরিবর্তন ও বিশ্ব উষ্ণায়ণ এর বাস্তবতা ও মানব সমাজে তার প্রভাব জানতে বুঝতে পারছেন, বিষয়গুলোকে গভীর চর্চায় এনেছেন। তাই তাঁরা নিজেদের ও পরবর্তী প্রজন্মের ভবিষ্যতকে সুরক্ষিত করার জন্য বিশ্ব জুড়েই এক বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তুলেছেন। প্রতিদিন বহু মানুষ পরিবেশ রক্ষার দাবিতে প্রতিবাদের ঝড় তুলছেন। এই প্রতিবাদ এতটাই স্বতস্ফূর্ত ও স্বাধীন যে রাষ্ট্রশক্তিও ভয় পেয়েছে। তাই পরিবেশ রক্ষার আন্দোলনকে দমন করার জন্য পরিবেশ কর্মীদের হুমকি, মিথ্যা অভিযোগে গ্রেফতার, তাদের সামাজিক সংবাদ মাধ্যমগুলোকে যখন তখন বন্ধ করে দেওয়া ইত্যাদি রাষ্ট্রীয় আগ্রাসন লেগেই রয়েছে। তবে এতে মানুষ আর ভয় পায়নি বরং সরকার প্রশাসনের চোখ রাঙানি উপেক্ষা করেই সমাজের সব স্তরের মানুষ, বিশেষ করে যুবসমাজ আরও বেশি করে পরিবেশ রক্ষার আন্দোলনে এগিয়ে আসছে।
ছবি সৌজন্যে : indusdictum.com
লেখক পরিচিতি:
Youth environmental activist & founder of “Ecological Recovery Network”.
Email:- mranirbandas07@gmail.com