বিজন পাল : সারা পৃথিবীর অন্যান্য জায়গার মতো প্রতি বছর তামিলনাডু, অন্ধ্রপ্রদেশ, উড়িষ্যা,পশ্চিমবঙ্গ ও আমাদের প্রতিবেশী বাংলাদেশের মানুষদের যে প্রাকৃতিক দুর্দশার শিকার হতে হয় তাকে প্রকৃতিক দুর্যোগ বলেই ধরা হয়। আমরা কি শুধুই প্রাকৃতিক দুর্যোগই বলবো?
করোনা মহামারী চলাকালীন বঙ্গোপসাগরের উপর দিয়ে বয়ে গেল এক বিধ্বংসী সাইক্লোন আমফান। প্রতি বছর শুধু আমফানই নয়, পাঁচ থেকে ছটি সাইক্লোনের উৎপত্তি হয় বঙ্গোপসাগরে। তারমধ্যে দুই থেকে তিনটি বিধ্বংসী রূপ ধারণ করে। সাধারণত মে,অক্টোবর এবং নভেম্বর মাসে এই সাইক্লোনগুলি ঘটতে দেখা যায়। এই ঝড় বঙ্গোপসাগরের উপকূলে বিশেষ করে অন্ধ্রপ্রদেশ, উড়িষ্যা, পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের স্থলভূমিতে আছড়ে পড়ে। বঙ্গোপসাগরের সাইক্লোন আরব সাগরের তুলনায় মারণ ক্ষমতায় ও সংখ্যায় বেশি। তার কারণ গ্রীষ্মকালে আরব সাগর বঙ্গোপসাগরের তুলনায় ঠান্ডা থাকে। আসলে আরব সাগরের উপরিতলের জলের সঙ্গে সমুদ্রের তলাকার ঠান্ডা জলের একটা মিশ্রণ (Turbulence) ঘটে চলে, কিন্তু বঙ্গোপসাগরে সেটা হয় না। ভারতবর্ষের সমুদ্র উপকূল তিন দিকেই নোনা জলের দ্বারা আবদ্ধ এবং দুটি সাগরেই জলের গতি প্রধানত পূর্ব থেকে পশ্চিমে। কিন্তু বঙ্গোপসাগরে সাইক্লোনের সময় এই গতি উপকূলের দিকে ধেয়ে আসে। দেখা গেছে ২০০ মিলিবার বায়ু চাপ ও ২৬.৫ ডিগ্রি উষ্ণতা যদি তিন থেকে চার দিন একটানা অবস্থান করে তাহলে সাইক্লোন তৈরি হয়। কিন্তু এবার বঙ্গোপসাগরের তাপমাত্রা 34°C ছাড়িয়ে গেল। এভাবে উষ্ণতা বেড়ে যাবার কারণ হিসাবে বিজ্ঞানীরা বিশ্ব উষ্ণায়নকেই দায়ী করেছেন। কিন্তু এবার উৎপাদন কম হওয়াতে তাপমাত্রা কমই ছিল তবুও বঙ্গোপসাগরের তাপমাত্রা বাড়ল কেন? আসলে বঙ্গোপসাগরে সাইক্লোন একটা অতিরিক্ত শক্তি সঞ্চয় করে বাইরের থেকে; যখন তা উপকূলের দিকে ধেয়ে আসে তখন আকার ফানেলের মতো হয়ে যায়। ফলে বাতাসের গতিবেগ ও চাপকে আরো বাড়িয়ে উপকূলে ধাক্কা মারে। এইরূপ আরব সাগরে না হওয়ার কারণ ওখানে যে চাপ উৎপন্ন হয় তা ওখানেই পড়ে শেষ হয়ে যায়। বাইরের আশেপাশের কোনো চাপকে সে আহরণ করতে পারে না বা টেনে নিতে পারে না। তাছাড়া পশ্চিমঘাট পর্বতমালা এটাকে আটকে দেয়।
বঙ্গোপসাগরে যে নদীগুলি মিশেছে তার মধ্যে প্রধান গঙ্গা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র এবং তাদের নানান উপনদী। এছাড়া মেঘনা, মহানদী, গোদাবরী, কৃষ্ণা, কাবেরী ইত্যাদি নদী গুলিও বঙ্গোপসাগরে মিশেছে। এই নদীগুলি ভারতবর্ষের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে প্রবাহিত হয়েছে। ভারতবর্ষের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে বৃক্ষছেদন করে নগরায়ন ও শিল্পায়ন হয়েছে, এর প্রভাবে নদী গুলি ও বঙ্গোপসাগরের জলে দ্রবীভূত কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
বিশ্বায়নের আগে অধিকাংশ কল-কারখানাগুলি ও বাজার ইউরোপ, আমেরিকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। তারপর কল-কারখানা বাড়ার ফলে সেখানকার বায়ুমন্ডলে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বাড়তেই থাকল। ফলে জল ও স্থল উভয়েরই উষ্ণতা বেড়ে গেল, তাপমাত্রা বিকিরণের সুযোগ কমে গেল।

এই উষ্ণতা সমুদ্রের জলের মাধ্যমে এশিয়া, আফ্রিকা মহাদেশ পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়তো। আর সেখানের আকাশে কার্বন-ডাই-অক্সাইড কম থাকার ফলে তাপ বিকিরণের সুযোগ পেত, যেহেতু এশিয়া আফ্রিকা মহাদেশে তখনো শিল্প উৎপাদনের মাত্রা কম। ফলে সারা পৃথিবীর গড় তাপমাত্রার একটা সামঞ্জস্য থাকতো। বিশ্বায়নের পর উৎপাদন ইউরোপ-আমেরিকা থেকে এশিয়া, আফ্রিকা তথা তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে স্থানান্তরিত হতে লাগলো। ফলে এশিয়া, আফ্রিকার আকাশেও কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বাড়তে লাগলো, ফলে তাপমাত্রা বিকিরণের সুযোগ কমে গেল। ইউরোপ-আমেরিকা থেকে উৎপাদন সরে গেলেও সেখানে বাজার ও নগরায়ন ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেল। পাশাপাশি বৃদ্ধি পেয়েছে পেট্রোল, ডিজেলের ব্যবহারও। ফলে ইউরোপ-আমেরিকায় কার্বন-ডাই-অক্সাইড বেড়েই চলল। সমস্ত পৃথিবী কার্বন-ডাই-অক্সাইড দ্বারা অবরুদ্ধ হলো। এসবের যোগফলে গ্রীনহাউস এফেক্ট-এর জন্য সূর্যের আলো সমুদ্রে পড়ার পর তা বিকিরিত হয়ে ফিরে যেতে পারে না। ফলে সমুদ্রের জলের উষ্ণতা বেড়ে যাচ্ছে। আজ এই বিশ্বজুড়ে উষ্ণায়ন যে মাত্রায় পৌঁছেছে তাতে মেরু প্রদেশের বরফ ব্যাপক হারে গলে যাচ্ছে। পৃথিবীর বহু শহর জলের তলায় তলিয়ে যাবে। করোনা মহামারীর আবহে লকডাউনের কারণে দূষণ কিছুটা পরিমাণে কম হলেও উষ্ণতা ৩৪ ডিগ্রি পৌঁছে গিয়েছিল। তার ফলস্বরূপ সুপার সাইক্লোন আমফানের হামলা। এর সাথেই বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে নোনা জলে। সুন্দরবন অঞ্চলের বহু অংশই প্রতিবছরই বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয়। ভূগর্ভস্থ জল ও চাষের জমি নোনা জলে ভরে যায়, যা চাষযোগ্য জমিকে অনুর্বর করে দেয়। সুন্দরবনে যে ম্যানগ্রোভের জঙ্গল এই প্লাবনকে আটকায়, আজ সেই জঙ্গলকে কেটে হোটেল, রিসোর্ট, মাছের ভেড়ি বানানো হচ্ছে মুনাফার স্বার্থে। আর এই নোনা জলের ফলে ভেড়িতে মাছ চাষের জন্য এখানে পুঁজির অনুপ্রবেশ ঘটছে। এর ফলস্বরূপ সুন্দরবন অঞ্চলের বাস্তুতন্ত্র বিপন্ন হচ্ছে। প্রতি বছর এখান থেকে পরিবেশের কারণে উদ্বাস্তু হয় বহু মানুষ। সরকারি ভাবে এর সমাধান হল বাঁধ তৈরি। সমুদ্রের উপকূল ও নদীর যেদিকে বন্যাপ্রবণ এলাকা সেদিকে বাঁধ তৈরি করা। বার বার বাঁধ তৈরি হয়, আবার ভেঙেও যায়। ফলে সুন্দরবন অঞ্চলের মানুষের দুর্দশা বেড়েই চলে।
সুন্দরবন অঞ্চলের মানুষেরাও বিশ্বাস করে এই বাঁধ দিয়েই সমাধান হবে। বাঁধ দিয়ে প্লাবন কিছুটা আটকানো যাবে। এখানে প্রশ্ন সুন্দরবন অঞ্চলে নদীগুলির সাথে সমুদ্রের স্বাভাবিক যে মিলন, বাঁধের ফলে কীভাবে তা স্বাভাবিক হবে? নদীর জলের মধ্যে কার্বন-ডাই-অক্সাইড ও সমুদ্রের নোনা জলের মিশ্রণ এই স্বাভাবিকত্ব রক্ষা করে। বাঁধের বিকল্প হিসাবে প্রাকৃতিক ভাবে যে সমাধান সামনে রয়েছে তা হল এই ম্যানগ্রোভের জঙ্গল। এই ম্যানগ্রোভের জঙ্গল দিয়ে প্লাবনকে আটকানো যাবে, নোনা জল ঢুকতে পারবে না ও ঝড়-ঝঞ্জার তীব্রতাকেও আটকানো যাবে। পাশাপাশি এই সাইক্লোনের তীব্রতাকে আটকাতে গেলে তাপমাত্রাকে নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। কিভাবে সমুদ্রের এই তাপমাত্রাকে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে?

বিজ্ঞানীদের কাছে যে প্রযুক্তি আছে তার সঠিকভাবে ব্যবহার করে কল-কারখানা থেকে নির্গত বাতাসের কার্বন-ডাই-অক্সাইডকে যদি নোনা জলের সাথে মিশ্রণ ঘটানো যায় তাহলে ক্যালসিয়াম কার্বনেট উৎপন্ন হয়। পৃথিবীর অনেক দেশেই এই প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয়। আবার এই ক্যালসিয়াম কার্বনেট কৃষিক্ষেত্রে সার হিসাবে ব্যবহৃত হতে পারে। ফলে বাতাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ কমবে, সমুদ্রের তাপমাত্রা কমবে ও ঝড়ের তীব্রতাও কমে যাবে। প্রকৃতির ভারসাম্য যেভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে এবং মানব সমাজের উপর যে বিপর্যয় নেমে আসছে তা শুধু আমফানকে কেন্দ্র করেই নয়, কোভিড-19, আমাজনের জঙ্গল জ্বালিয়ে দেওয়া, রাসায়নিক সারের ব্যবহারের ফলে সমুদ্রের জলে মাইক্রোবায়োম নষ্ট হয়ে যাওয়া , সবক্ষেত্রেই মনুষ্য সমাজ আজ ধ্বংসের মুখোমুখি। তাই মনুষ্য সমাজের সামনে প্রকৃতির বাস্তুতন্ত্রকে সুস্থ রাখার কর্তব্যই হাজির হচ্ছে।
তথ্যসূত্র
Good wrighting specially on the topics of environmental disasters people and animals going to face. But the roll of Finance capital could be more analytic.
ধন্যবাদ