নির্বিচারে অরণ্য ধ্বংস ও কৃত্রিম বনসৃজন- কিছু ভাবনা

নানান অসঙ্গতিপূর্ণ এক বা দুই প্রজাতির অর্থাৎ Monoculture বা Monodominant বৃক্ষরোপণ কর্মসূচির মধ্যে দিয়ে আমরা অরণ্যের অভাব পূরণ করতে চাইছি, যদিও পরিবেশ বিজ্ঞানীরা পরিস্কার বলছেন “You can’t replace forest”।

deforestation

  সাধন কুমার ঘোষ

অরণ্য ধ্বংস- কিছু চালচিত্র:

জলবায়ু পরিবর্তন, বিশ্ব উষ্ণায়ন, প্রজাতি বিলুপ্তি, জীববৈচিত্র্য হ্রাস,বন্যা, ভূমিক্ষয় ও তজ্জনিত জল দূষণ – এসবের জন্য সিংহভাগ অবদান যে ব্যাপকহারে অরণ্যের ধ্বংসসাধন সেটা আর অজানা বিষয় নয়। আবার World Economic Forum এর হিসেব বলছে সাম্প্রতিক সময়ের ৩১শতাংশ রোগের প্রাদুর্ভাবের কারণও হল অরণ্যের ব্যাপক ধ্বংস।   Food and Agriculture Organization of United Nation এর তথ্যানুসারে প্রতি বছর ১৮০ লক্ষ একর অরণ্য ধ্বংস হচ্ছে যা প্রতি সেকেন্ডে দেড় একর বা প্রতি মিনিটে ৩৬ টি ফুটবল মাঠের আয়তনের সমান।

কৃত্রিম বনসৃজন:

নানান অসঙ্গতিপূর্ণ এক বা দুই প্রজাতির অর্থাৎ Monoculture বা Monodominant বৃক্ষরোপণ কর্মসূচির মধ্যে দিয়ে আমরা অরণ্যের অভাব পূরণ করতে চাইছি, যদিও পরিবেশ বিজ্ঞানীরা পরিস্কার বলছেন “You can’t replace forest”। কৃত্রিম বনসৃজন প্রকল্পে উৎসাহদান কার্যত অরণ্য ধ্বংসে ইন্ধন যোগানো। UN-এর সংস্থা FAO স্বয়ং 2030 সালের মধ্যে 40 থেকে 90 মিলিয়ন হেক্টর monoculture plantation এর কথা বলছে। তাহলে প্রকৃত চিত্রটি কতটা ভয়াবহ তা সহজেই অনুমেয়। প্রসঙ্গত জানানো যেতে পারে Compensatory Afforestation Fund Management and Planting Authority-র তথ্য অনুযায়ী তিন দশকে ভারতে ১৪ হাজার বর্গকিমি অরণ্য নির্মূল করা হয়েছে যার মধ্যে ৪৯৪৭ বর্গকিমি মাইনিং সেক্টর, ১৫৪৯ বর্গকিমি প্রতিরক্ষা ও ১৩৫১ বর্গকিমি জলবিদ্যুৎ প্রকল্পে দেওয়া হয়েছে। এর পরে আসছে নতুন পরিবেশ আইন EIA 2020।

পুঁজিবাদী উন্নয়নের মডেল নির্বিচারে অরণ্য ধ্বংস আর তার পরিণামে জলবায়ু পরিবর্তনের মোকাবিলায় ক্ষতিপূরণ হিসেবে অন্যত্র বৃক্ষরোপন করার যুক্তি হাস্যকর, কারণ গাছ কাটলে শুধু অরণ্য ধ্বংস হয় না, অরণ্যের ইকোসিস্টেমও ধ্বংস হয়। “Bon challenge,Paris climate accord” ও এই কাজে উৎসাহ দিচ্ছে।

কেন বন ধ্বংস?

কর্পোরেট পুঁজি তার জল, জমি, জঙ্গল লুন্ঠন কর্মসূচিতে বৃক্ষরোপণকে নিপুণ ভাবে ব্যবহার করেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে বৃক্ষরোপণ শুধুমাত্র কাঁচামাল যেমন কাঠ, রাবার, পাম তেল, পাল্প ইত্যাদি উৎপাদনের উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়। বাণিজ্যিক স্বার্থে টিম্বার প্ল্যান্টেশন, অয়েল পাম প্ল্যান্টেশন সরাসরি অরণ্য ধ্বংসের জন্য দায়ী। পামতেল প্রায় শতকরা পঞ্চাশ ভাগ ভোগ্যপণ্যে যেমন পশুখাদ্য,  কুকিজ,স্নাক্স, ক্লিনিং ফ্লুইড ইত্যাদিতে ব্যবহৃত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাপাম বোমা তৈরিতেও পাম তেল ব্যাপক ব্যবহৃত হয়েছিল। এই Palm oil ইন্ডাস্ট্রির প্রয়োজনে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, সুমাত্রায় প্রতি ঘন্টায় ৩০০ ফুটবল মাঠের সমান বনভূমি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে।

কৃত্রিম বনসৃজনের কুপ্রভাব:

পরিবেশের সাথে সাথে ওরাং-ওটাং, পিগমি এলিফ্যান্ট এর মতো বিরল প্রজাতির প্রাণীও বিলুপ্ত হতে চলেছে। ইন্দোনেশিয়ায় oil palm plantation কীভাবে ব্যাপক জীববৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ ঘন অরণ্য ধ্বংস করেছে ও Leuser Ecosystem উপর তার বিরূপ ফলাফল –পরিবেশ সাংবাদিক Paul Hilton তাঁর তথ্যচিত্রে দেখিয়েছেন। একসময়ের ভাইব্রেন্ট রেইন ফরেস্টকে কৃত্রিম অরণ্যে রূপান্তর তিনি সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন- যেখানে প্রকৃতির প্রবেশ নিষেধ, ওরাং-ওটাং দের জন্য বরাদ্দ shot on sight। ইন্দোনেশিয়ার ঘটনা আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে কৃত্রিম বনসৃজন পরিবেশের উপর কি ভয়ঙ্কর প্রভাব ফেলতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনে, জীববৈচিত্র্য রক্ষায় এর ভূমিকা সামান্যই। কর্মসংস্থান,স্থায়ী উন্নয়ন বা স্থানীয় অধিবাসীদের এ থেকে কিছুই পাওয়ার নেই।

Monoculture বা Monodominant plantation এ জীববৈচিত্র্য থাকে না। অন্যদিকে প্রাকৃতিক অরণ্যে শুঁটি জাতীয় উদ্ভিদ নাইট্রোজেন আবদ্ধ করে পুষ্টি যোগায়, ভূমি আচ্ছাদিত ফসল টপসয়েলের উর্বরতা বৃদ্ধি করে ও নানা প্রজাতির উপকারী কীটপতঙ্গ বাসা বাঁধে। একটি diverse forest এর ইকোসিস্টেম প্রাকৃতিক check & balance এর কাজ করে, কৃত্রিম অরণ্যে যা অনুপস্থিত। পক্ষান্তরে প্রাকৃতিক অরণ্য ও তার ইকোসিস্টেম ধ্বংস করে সৃষ্ট বৃহৎ বনসৃজন প্রকল্পগুলি ভূগর্ভস্থ জলের হ্রাস ও দূষণ, মাটির উর্বরতা হ্রাস, ও নেট কার্বন নিঃসরণ ঘটানোর কারণ হয়। পরিবেশ এক্টিভিস্ট Jeremy Hance তাই মনোকালচার প্ল্যান্টেশনকে ফরেস্ট নয়, গ্রীন ডেজার্ট বলেছেন। এই মনো কালচার প্ল্যান্টেশনের বিরুদ্ধে Friends of the Earth International ১৯৬২ সাল থেকে প্রতিবছর ২১ শে সেপ্টেম্বর International Day of Struggle against monoculture tree plantation পালন করে আসছে। তারা ও অন্যান্য পরিবেশ সংগঠন টিম্বার প্ল্যান্টেশন এর বিরুদ্ধে সচেতনতা আন্দোলন চালিয়ে আসছেন। এই বৃহদাকার প্ল্যান্টেশন প্রকল্পগুলি কোনো পতিত, অনুর্বর,অধঃপতিত, নেড়া, জলাভূমিতে করার কারও উৎসাহ নেই কারণ তা ব্যয়বহুল। উপরন্তু বৃহৎ কীটনাশক প্রস্তুতকারী সংস্থা BASF, Bayer, Dow, Monsanto, Dunpont, Syngenta বৃহৎ প্ল্যান্টেশন প্রকল্পগুলিতে উৎসাহী। তাদের লক্ষ্য অরণ্য নয়, তাদের লক্ষ্য মুনাফা। এদের তৈরী কীটনাশক, রাসায়নিক সার ক্রমাগত বাড়িয়ে যেতে হয়, যা মাটি ও জল দুষণ, পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতিসাধন করে।

 কিভাবে তৈরি হল অরণ্য: 

প্রায় চার হাজার লক্ষ বছরের পরীক্ষা নিরীক্ষা অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে উদ্ভিদ জগত নানা প্রজাতির সমন্বয়ে কার্বন শোষন, সঞ্চয়ের এক নিখুঁত ব্যবস্থা ও ভারসাম্যের ইকোসিস্টেম গড়ে তুলেছে। কার্বণ শোষনের প্রযুক্তি ও কৃত্রিম অরণ্য একে প্রতিস্থাপিত করতে পারে না। অরণ্যে নানা প্রজাতির মধ্যে থেকে উদ্ভিদ প্রাকৃতিক উপায়ে তার উপযুক্ত প্রতিবেশী নির্বাচিত করে নেয়। উদ্ভিদ তার পাতায় অবস্থিত সুক্ষ ছিদ্রযুক্ত স্টোমাটার সাহায্যে বাতাসের কার্বন ডাইঅক্সাইড শোষন করে,  অক্সিজেন ও জলীয় বাষ্প নিঃসরণ করে। বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ এই ছিদ্র বন্ধ ও খোলার সময়ের তারতম্য ঘটিয়ে শোষণ বর্জন প্রক্রিয়ার ভিন্নতর কৌশল গ্রহণ করে। নানা প্রতিকূল পরিস্থিতিতে বিশেষত খরা মোকাবিলায় অরণ্য দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় ঝাড়াই বাছাই এর মধ্যে দিয়ে উপযুক্ত প্রজাতি নির্বাচন করে তার টিকে থাকার উপযুক্ত কৌশল গ্রহণে সক্ষম হয়। অরণ্যের এই কৌশলকে এক ঝুড়িতে সব ডিম না রাখার সঙ্গে তুলনা করা যায়।

সমাধান কোন পথে:

আসলে বৃহদাকার প্ল্যান্টেশন কোনো সমাধান নয়, দরকার অবশিষ্ট অরণ্যগুলির সুরক্ষা, কৃষিবাস্তুবিদ্যার প্রয়োগ, অরণ্যকে পুনঃসৃজনের সুযোগ দেওয়া। অধঃপতিত অরণ্যকে মানুষের হস্তক্ষেপ ছাড়া প্রাকৃতিক উপায়ে পুনরুজ্জীবনের জন্য ছেড়ে রাখলে ভৌগোলিক ও পরিবেশগত বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী সবচেয়ে উপযুক্ত প্রজাতির উদ্ভিদ প্রাধান্য বিস্তার করে সম্ভাব্য বৃহত্তম প্রজাতির উদ্ভিদের অরণ্যে পরিণত হয়। ছত্তিশগড়ে যেমন শাল। এটা সম্পূর্ণ জৈব পদ্ধতি। আমাদের বুঝতে হবে পথের ধারে, পার্কে, ফাঁকা জায়গায় গাছ পোঁতা নিশ্চয়ই সদর্থক কাজ কিন্তু তাতে অরণ্যের প্রয়োজন মিটবে না। জলবায়ু সঙ্কট থেকে বাঁচতে, পৃথিবীর জীবজগৎ সহ মানবসমাজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য অরণ্য সংরক্ষণ ছাড়া পথ নেই।

       সাম্প্রতিক ছত্তিশগড়ের ৪.২ লক্ষ একর অরণ্য এলাকায় পাঁচ বিলিয়ন টন কয়লা উত্তোলনের জন্য চল্লিশটি কোল ব্লক বেসরকারি ক্ষেত্রে নিলামের (গৌতম আদানি একজন বিডার)  ঘটনার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করা যেতে পারে। “দি গার্ডিয়ান”- এ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে (8/8/20) এই ঘন অরণ্য আচ্ছাদিত আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলের একজন স্থানীয় সরপঞ্চ নেতা উমেশ্বরসিং আমরার প্রতিবাদের কথা জানতে পারি। উমেশ্বর তাঁর প্রিয় জন্মভূমিতে ২০১১ সাল থেকে ওপেন কাস্ট মাইনিং- এর পরিবেশ বিধ্বংসী সংঘর্ষের চেহারা দেখেছেন তাই তিনি আগামী দিনের অরণ্য ধ্বংস করে কয়লা উত্তোলনের সম্ভাব্য পরিণতির কথা ভেবে প্রধান মন্ত্রীকে চিঠি লিখে তাঁর জীবনের বিনিময়ে হলেও এই প্রকল্প বাতিলের আবেদন করেছেন। শক্তির চাহিদা পূরণের  যুক্তিতে যদি দাবী মেটাতে হয় তবে দেখা গেছে গ্রীন হাউজ গ্যাস নিঃসরণকারী একটি নতুন কোল প্ল্যান্ট স্থাপনের চেয়ে ১৪ শতাংশ কম ব্যয়ে পরিবেশ বান্ধব সোলার প্ল্যান্ট স্থাপন সম্ভব

(যদিও এই ব্যবস্থায় আবার তৈরী হবে বিভিন্ন ধাতব মৌলের ব্যাপক দূষণ)। ভারতে অচিরাচরিত শক্তিসহ সৌরশক্তির প্রাচুর্যের জন্য শক্তি ও প্রচুর কর্মসংস্থানের সুযোগও (এতে আবারও গ্রীন হাউজ গ্যাস বৃদ্ধির সম্ভবনা যথেষ্ট)। কিন্তু শেষ কথা এই যে  কর্পোরেট পুঁজির কাছে অরণ্যের সবুজ নয়, মুনাফাই শেষ কথা। 

তথ্যসূত্র:-

1.One green planet by Aisling Maria Cronin  

2.The wire science

3.Guest Isaac Rojas Archives

4.The Guardian (8.8.20)

5.Wikipedia

6.@wwf

আরও পড়তে পারেন

Scrap the EIA proposal, save the citizen

দিবাং ভ্যালি জল বিদ্যুত প্রকল্প বনাম পরিবেশ বিপর্যয়

2 thoughts on “নির্বিচারে অরণ্য ধ্বংস ও কৃত্রিম বনসৃজন- কিছু ভাবনা”

  1. সান্তোষ সেন।

    বেশ ভালো ও প্রয়োজনীয় লেখা। প্রকৃতি পরিবেশকে রক্ষা করতে এইসব লেখা নিয়ে চর্চা,আলোচনা আরো গভীরে গিয়ে করতে হবে।

  2. তাপস চট্টোপাধ্যায়

    ব্যাপকভাবে প্রচারিত হওয়া উচিত। তবে যদি কিছু মাত্র চেতনার উন্মেষ ঘটে। ্

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top