পরিবেশবিদ্যাই স্থায়ী অর্থনীতি

প্রকৃতির জটিলতা বোঝা বিজ্ঞানের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। এই সাধনায় মানুষ পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং মডেলিংয়ের মাধ্যমে অসাধারণ প্রচেষ্টা চালিয়েছে, কারণ এই বোঝাপড়া জলবায়ু পরিবর্তনের মতো পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা এবং টেকসই অনুশীলনের জন্য তথ্য প্রদানের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

graphic image of environment

পি. রাঘবন

পরিবেশবিদ সুন্দরলাল বহুগুণার জনপ্রিয় করা “পরিবেশবিদ্যাই স্থায়ী অর্থনীতি” এই বাক্যটি একটি স্লোগানের চেয়ে অনেক বেশি কিছু। এটি একটি মৌলিক সত্যের গভীর স্মরণিকা যে মানুষের সমৃদ্ধি পরিবেশগত স্বাস্থ্যের সাথে অবিচ্ছেদ্য ভাবে জড়িত। এটি সত্য যে প্রাকৃতিক সম্পদ শোষণ ছাড়া অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং সেগুলো সংরক্ষণ ছাড়া অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অসম্ভব। জলবায়ু পরিবর্তন এবং জীববৈচিত্র্যের দ্রুত ক্ষতির মতো গুরুতর চ্যালেঞ্জের মুখে আমাদের নিজেদের প্রশ্ন করতে হবে যে আমরা কি সত্যিই এই ধারণাটি বুঝেছি এবং গ্রহণ করেছি।

সঠিক ভারসাম্য অর্জন

প্রকৃতির জটিলতা বোঝা বিজ্ঞানের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। এই সাধনায় মানুষ পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং মডেলিংয়ের মাধ্যমে অসাধারণ প্রচেষ্টা চালিয়েছে, কারণ এই বোঝাপড়া জলবায়ু পরিবর্তনের মতো পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা এবং টেকসই অনুশীলনের জন্য তথ্য প্রদানের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদিও এই বৈজ্ঞানিক আলোচনাগুলো মূল্যবান, তবে আমাদের আরও জরুরি এবং মৌলিক একটি সত্যের উপর মনোযোগ দিতে হবে: পরিবেশবিদ্যাই হলো প্রকৃত অর্থনীতি — আমাদের বেঁচে থাকা, নিরাপত্তা এবং অগ্রগতি এর উপর নির্ভর করে। সহজ কথায়, এটাই হতে পারে টেকসই তার সবচেয়ে স্পষ্ট সংজ্ঞা — পরিবেশ রক্ষা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের সহায়তার মধ্যে সঠিক ভারসাম্য খুঁজে বের করা। এই ভারসাম্য ছাড়া দীর্ঘ মেয়াদে পরিবেশ বা অর্থনীতি কোনোটিই সমৃদ্ধ হতে পারে না।

প্রাণীজগতের অংশ হওয়া সত্ত্বেও, সভ্যতার পথে মানুষের বিবর্তন প্রকৃতির সাথে ক্রমবর্ধমান বিচ্ছিন্নতার দিকে নিয়ে গেছে। প্রকৃতির সাথে এই বিচ্ছিন্নতাকে চলমান জীববৈচিত্র্য ক্ষতির একটি কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে (সাম্প্রতিক আন্তঃসরকারি বিজ্ঞান-নীতি প্ল্যাটফর্ম অন বায়োডাইভার্সিটি অ্যান্ড ইকোসিস্টেম সার্ভিসেস বা আইপিবিইএস ট্রান্সফরমেটিভ চেঞ্জ রিপোর্ট)।

মানুষের ইতিহাসের প্রাথমিক পর্যায়ে, যাযাবর জীবনযাত্রা ব্যক্তিদের তাদের মৌলিক, দৈনন্দিন বেঁচে থাকার প্রয়োজনের জন্য শুধুমাত্র প্রাকৃতিক সম্পদের উপর নির্ভর করতে এবং তা ব্যবহার করতে বাধ্য করেছিল। সময়ের সাথে সাথে এই ব্যক্তি-কেন্দ্রিক সম্পদ ব্যবহার ক্রমবর্ধমান সম্প্রদায়ের চাহিদা মেটানোর লক্ষ্যে সমষ্টির ভোগে পরিণত হয়েছে। মানব সমাজ যখন সম্প্রসারিত হয়ে জাতি হিসেবে সংগঠিত হয়েছে, তখন এই চাহিদা আরও বৃদ্ধি পেয়ে সমগ্র দেশের প্রয়োজন মেটানোর জন্য বিস্তৃত হয়েছে। অবশেষে এই অগ্রগতি বিশ্বজুড়ে প্রতিযোগিতার জন্ম দিয়েছে, যেখানে জাতিসমূহ শুধুমাত্র বর্তমান চাহিদা মেটানোর জন্যই নয়, বরং ভবিষ্যৎ উন্নয়নের জন্য সম্পদ নিরাপত্তার জন্যও প্রকৃতিকে শোষণ করতে শুরু করেছে। মানুষের বিপরীতে, প্রাণীজগতের অন্য কোনো প্রজাতি প্রাকৃতিক সম্পদের এই ধরনের বৃহৎ আকারের, প্রত্যাশিত শোষণের নমুনা প্রদর্শন করে না। অন্যান্য প্রাণী তাদের পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্য রেখে বাস করে, তাৎক্ষণিক বেঁচে থাকার জন্য যা প্রয়োজন শুধু তাই গ্রহণ করে, তারা যে বাস্তুতন্ত্রে বাস করে তার দীর্ঘমেয়াদি ভারসাম্য বিঘ্নিত না করে।

নতুন জটিলতা 

মানুষের ক্রমবর্ধমান ভোগবাদ ও বিশ্বব্যাপী প্রতিযোগিতার চক্র পৃথিবীর বাস্তুতন্ত্রের উপর অপ্রতিদ্বন্দ্বী চাপ সৃষ্টি করেছে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের গতি ব্যাপকভাবে ত্বরান্বিত করেছে—এটি একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া যা এখন মানব সৃষ্ট কর্মকাণ্ডের কারণে বিপজ্জনকভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। এই ক্রমবর্ধমান পরিবেশগত চ্যালেঞ্জগুলোর প্রতিক্রিয়ায়, প্রকৃতি-ভিত্তিক সমাধানকে সারাবিশ্বে সংরক্ষণ প্রচেষ্টায় ব্যাপকভাবে সমর্থন করা হয়েছে। এই পদ্ধতিগুলির লক্ষ্য হলো বাস্তুতন্ত্রের সহজাত সহনশীলতাকে কাজে লাগিয়ে জলবায়ুর প্রভাব প্রশমিত করা, জীববৈচিত্র্য পুনরুদ্ধার করা এবং টেকসই উন্নয়নকে সমর্থন করা। তবে এখানে একটি বৈপরীত্য দেখা দেয়: আমরা আমাদের প্রয়োজেন ও লালসা মেটাতে প্রকৃতির শোষণ চালিয়ে যাচ্ছি, আবার একই সময়ে এই শোষণের ফলাফল থেকে রক্ষা পেতে একই প্রাকৃতিক ব্যবস্থার উপর নির্ভর করছি। এই দ্বৈত নির্ভরতাবাস্তুতন্ত্রের আরও গভীর ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টির ঝুঁকি বাড়ায় এবং জলবায়ুসংকট মোকাবিলার সামর্থ্যকে আরও জটিল করে তুলতে পারে। 

এই প্রেক্ষাপটে, বাস্তুতন্ত্রের জটিলতাকে কেবল বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে বোঝার চেষ্টা করার বদলে একটি মৌলিক সত্যকে স্বীকার করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ–বাস্তুতন্ত্রই হলো স্থায়ী অর্থনীতি। এই নীতিকে স্বীকার করে নিলে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি স্বল্পমেয়াদি শোষণ থেকে দীর্ঘমেয়াদি তত্ত্বাবধানের দিকে স্থানান্তরিত হয়, যেখানে বাস্তুতান্ত্রিক সুস্থতাকে একটি বাধা হিসেবে নয়, বরং মানুষের অস্তিত্ব, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও জলবায়ু সহনশীলতার ভিত্তি হিসেবে দেখা হয়। 

এই উপলব্ধি কেবল সময়োপযোগী নয়—এটি চলমান পরিবেশগত সংকট মোকাবিলা ও একটি টেকসই ভবিষ্যৎ গঠনের জন্য অপরিহার্য। কেবল এই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের মাধ্যমেই মানবতা প্রতিক্রিয়াশীল সংরক্ষণ থেকে সক্রিয় গ্রহ-স্তরের টেকসইযোগ্য ব্যবস্থায় এগিয়ে দিতে পারে। জলবায়ুসংকট কেবল একটি বৈজ্ঞানিক চ্যালেঞ্জ নয়। এটি আমাদের অস্তিত্বের বাস্তুতান্ত্রিক ভিত্তির সাথে একটি নৈতিক ও অস্তিত্বগত হিসাব-নিকাশ।

প্রকৃতির সাথে পুনর্সংযোগের প্রয়োজন 

জলবায়ু পরিবর্তন ও জীব বৈচিত্র্যের বণ্টন প্যাটার্নের পরিবর্তন পৃথিবীর জন্য নতুন কিছু নয়। কিন্তু, অতীতে মানুষের অস্বাস্থ্যকর উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের কারণে এটি এখন যে হারে ঘটছে, তা গ্রহের জীববৈচিত্র্য—যার মধ্যে মানুষও অন্তর্ভুক্ত—এর জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। তাই, আমাদের যে পরিবর্তন দরকার, তা আসতে হবে ভেতর থেকে। 

যেহেতু বিশ্বজুড়ে সব উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড মানুষের চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে পরিচালিত হয়, তাই টেকসই জীবনযাপন পদ্ধতি গ্রহণ করা প্রত্যেক ব্যক্তির দায়িত্ব—যাতে বিশ্ব জুড়ে গড়ে ওঠা টেকসইমুখীন উদ্যোগ সফল হয়। এটি অর্জনের জন্য আমাদের বুঝতে হবে যে, মানুষ প্রকৃতিরই একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। 

প্রযুক্তিগত অগ্রগতি আধুনিক জীবনযাত্রাকে প্রকৃতি থেকে দূরে ঠেলে দিলেও, মানুষের একটি অনন্য প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য হলো—আমরা এখনও আবেগের মাধ্যমে প্রকৃতির সাথে পুনঃসংযোগ স্থাপন করতে পারি (এই ক্ষমতা এখনও আমাদের মধ্যে বেঁচে আছে)। তাই, ভবিষ্যতের সংরক্ষণ প্রচেষ্টা এমনভাবে তৈরি করা উচিত যাতে প্রকৃতির সাথে আমাদের আবেগগত বন্ধন শক্তিশালী হয়। এটি জাগ্রত করতে, “বাস্তুতন্ত্রই স্থায়ী অর্থনীতি”—এই উপলব্ধি প্রকৃতির জটিলতা বোঝার চেয়েও বেশি জরুরি। 

ভাষান্তর:  বঙ্কিমদত্ত

লেখক পি. রাঘবন একজন বিজ্ঞানী যাঁর গবেষণায় আগ্রহের অন্যতম বিষয় বাস্তুতন্ত্র ও বায়ো-জিওকেমিস্ট্রি। তিনি ভারতের উপকূলীয় ও সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্র (ব্লু-কার্বন হ্যাবিট্যাট)-এ ম্যানগ্রোভ সংরক্ষণ ও কার্বন ডাইনামিক্সনিয়ে কাজ করছেন।

সৌজন্যে: দ্য হিন্দু

আগের লেখা: মধ্যপ্রাচ্যেই কি হবে আমেরিকা- সাম্রাজ্যবাদের কবর?

1 thought on “পরিবেশবিদ্যাই স্থায়ী অর্থনীতি”

  1. Tarasankar Bhattacharji

    শব্দগুলো একের সাথে এক লেপ্টে গেছে

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top