প্রবীর সেনগুপ্ত
১৯১৮ সাল। ৭ সেপ্টেম্বর। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলছে। আমেরিকার বস্টন শহরে একজন সৈন্য হঠাৎ প্রবল জ্বরে আক্রান্ত হলেন। মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই অসুস্থ হয়ে পড়লেন প্রায় বারো হাজার সৈন্য। মারা গেলেন প্রায় আটশো জন।
যারা মারা গেলেন তাদের দেহের রং হয়ে গেল নীলাভ। প্রবল শ্বাসকষ্ট। মৃতদেহ ময়নাতদন্ত করে দেখা গেল ফুসফুসে মিশে আছে রক্ত মিশ্রিত তরল। একসময় আমেরিকার সীমানা ছাড়িয়ে অজানা জ্বর ছড়িয়ে পড়ল সমগ্র পৃথিবীতে। সংক্রমণ চলল ১৯২০ সাল পর্যন্ত। মারা গেল প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ।
আমেরিকায় শুরু হলেও এই জ্বর পরিচিত হলো স্প্যানিশ ফ্লু নামে। রেড ক্রস মানুষকে সতর্ক করার জন্য বিজ্ঞাপণ ছাপল। তাতে বলা হল নিশ্বাসের মাধ্যমে এই রোগ ছড়ায়। তাই যারা কাশছেন বা হাঁচছেন তাদের এড়িয়ে চলুন। ঠান্ডা লাগলে বাড়িতে থাকুন। হাঁচি বা কাশি হলে মুখ ঢাকা দিন। কাজে বা অফিসে হেঁটে যান। অসুস্থ রোগীর ঘরে ঢোকার আগে নাক-মুখ ভালো করে ঢেকে নিন।
তখনও অ্যান্টিবায়োটিক আসেনি। তাই স্প্যানিশ ফ্লু-তে আক্রান্ত ব্যক্তির ফুসফুসে সংক্রমণ হলে তাকে প্রায়শই বাঁচান যেত না। অসংখ্য মানুষের মৃত্যু হল যার মধ্যে ১৫ থেকে ৩৫ বছর বয়সী মানুষের সংখ্যাই ছিল বেশি। একসময় এই কালান্তক জ্বর এল ভারতে। এল বাংলায়। পরিচিতি পেল
যুদ্ধজ্বর নামে। ১৯১৮ এর শেষের দিকে মিস ফেরিং নামে একজন ডেনিশ মহিলা এলেন শান্তিনিকেতনে। দিন কয়েকের মধ্যেই তিনি জ্বরে আক্রান্ত হলেন। তাঁর সেবা যাঁরা করেছিলেন তাঁদের প্রায় সকলেই সংক্রমিত হলেন। যাঁরা সংক্রমিত হলেন তাদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের বড়দা দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুত্রবধূ সুকেশী দেবী মারা গেলেন। রবীন্দ্রনাথের পুত্রবধূ প্রতিমা দেবীরও শারীরিক অবস্থা অত্যন্ত আশঙ্কাজনক হয়ে পড়ল। প্রায় দু-মাস তিনি অসুস্থ ছিলেন। তাঁর ফুসফুস এতই ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল যে পরবর্তীকালে তাঁকে চিকিৎসার জন্য বিদেশেও নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং আক্রান্ত হলেন এই জ্বরে।
এক সপ্তাহ তাঁকে বিশ্রাম নিতে হল। একসময় সেই জ্বর ছড়িয়ে পড়ল শান্তিনিকেতন আশ্রমে। বহু ছেলে হাসপাতালে ভর্তি হল। রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং ছেলেদের দেখভাল করতেন। কবিরাজি চিকিৎসাও করতেন। নানা রকম গাছ গাছড়া দিয়ে তৈরি করা পঞ্চতিক্ত পাচন খাওয়াতেন।
তিনি বিশ্বাস করতেন প্রকৃতির মধ্যেই রোগ আরোগ্য করার উপাদান আছে। ” বর্তমানে আমরা সভ্যতার যে প্রবণতা দেখি তাতে বোঝা যায় যে, সে ক্রমশই প্রকৃতির সহজ নিয়ম পেরিয়ে বহুদূরে চলে যাচ্ছে। প্রকৃতির নিয়মসীমায় যে সহজ স্বাস্থ্য ও আরোগ্য তত্ত্ব আছে তাকে উপেক্ষা করেও কি করে মানুষ স্বরচিত প্রকাণ্ড জটিলতার মধ্যে কৃত্রিম প্রণালীতে জীবনযাত্রার সামঞ্জস্য রক্ষা করতে পারে এই হয়েছে আধুনিক সভ্যতার দুরূহ সমস্যা। বর্তমান সভত্যা প্রাকৃত বিজ্ঞানের সঙ্গে সন্ধি করে আপন জয়যাত্রায় প্রবৃত্ত হয়েছিল, সেই বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে হৃদয়বান মানুষের চেয়ে হিসাব- করা ব্যবস্থাযন্ত্র বেশি প্রাধান্য লাভ করে।” (উপেক্ষিতা পল্লী)
স্প্যানিশ ফ্লু যে এক ধরনের ভাইরাস-সংক্রমণ তা জানতে বিজ্ঞানীদের দশ বছরেরও বেশি সময় লেগে যায়। একসময় প্রকৃতির নিয়মেই স্প্যানিশ ফ্লু-র সংক্রমণ কমে এল কিন্তু আরো অনেক ভাইরাসের মত রয়ে গেল পৃথিবীতে। এরপর ১৯৫৭- ৫৮ সালের এশিয়ান ফ্লু ও ১৯৬৮ সালের হংকং ফ্লু-তে মারা যান আনুমানিক ১০ লক্ষ থেকে ৪০ লক্ষ মানুষ। এভাবেই সার্স ও মার্স- মহামারীর পথ ধরেই এল করোনা ভাইরাস যা কোভিড -১৯ নামে পরিচিতি লাভ করলো। চীনের উহানে প্রথম এই ভাইরাস সংক্রমণ দেখা দিয়ে একসময় ছড়িয়ে পড়ল সমগ্র বিশ্বে। মাস কয়েকের মধ্যেই আক্রান্ত হলেন কোটিরও বেশি মানুষ। মারা গেলেন কয়েক লক্ষ মানুষ।
অতিমারীর শুরু থেকেই বিজ্ঞানীমহলে একটি কথা বহুল প্রচারিত হয়েছে যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বা ইমিউনিটির অভাবেই করোনা সংক্রমণের এই বাড়বাড়ন্ত। যদিও বাস্তবটা একেবারেই আলাদা। আসলে কোভিড রোগী তার দেহের শত্রু করোনা ভাইরাসের মোকাবিলায় যে প্রতিক্রিয়া দেখায়, ডাক্তারি পরিভাষায় তাকে বলে ‘ হাইপার ইমিউন, হাইপার ইনফ্লামেটরি রেসপন্স’- যা রোগকে অনেক সময় সংকটজনক করে তোলে। অথচ ইমিউনিটি বৃদ্ধির জন্য ইতিমধ্যেই বাজারে বহু খাদ্য ও ওষুধের প্রচার চলছে। যদিও এর বৈজ্ঞানিক সারবত্তা বিশেষ নেই।
দ্বিতীয় ধাপে চলেছে প্রতিষেধক টিকা বাজারজাত করার আপ্রাণ প্রচেষ্টা, যাতে সামিল পৃথিবীর বহু দেশ। ভারত সহ পৃথিবীর অন্যান্য জনঘনত্ব সম্পন্ন দেশে করোনা টিকা-র এক বিশাল-বিপুল বাণিজ্যিক বাজার অপেক্ষারত। শক্তিধর দেশ গুলির মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা চলছে এই বাজার দখল করার জন্য।
এত তাড়াহুড়ো করে যে টিকা অচিরেই বাজারে আসবে বলে প্রচার চলছে তাতে এই টিকা কতটা নিরাপদ, তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়।অথচ গত ২৫ বছরে এডস ও ডেঙ্গির টিকা এখনো বেরোল না।
করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ক্ষমতা যেহেতু বেশি আর মারণক্ষমতা তুলনামূলকভাবে কম, তাই মৃত্যু ভয় আর রোগীভীতির বাতাবরণ বজায় থাকলে করোনা চিকিৎসার ব্যবসা অনেক দূর যাবে এতে সন্দেহ নেই।
এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ আগেই সাবধান করেছেন। “অনান্য রিপুর মতোই লোভটা সমাজবিরোধী প্রবৃত্তি। যতক্ষণ এ রিপু পরিমিত থাকে ততক্ষণ এতে করে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের কর্মোদ্যম বাড়িয়ে তোলে, অথচ সমাজনীতিকে সেটা ছাপিয়ে যায় না । কিন্তু লোভের কারণটা যদি অত্যন্ত প্রবল ও তার চরিতার্থতার উপায় অত্যন্ত বিপুল শক্তিশালী হয়ে ওঠে তবে সমাজনীতি আর তাকে সহজে ঠেকিয়ে রাখতে পারেনা। এতে করেই ব্যক্তি স্বার্থের সঙ্গে সমাজ স্বার্থের সামঞ্জস্য টলমল করে উঠছে ।”(পল্লী প্রকৃতি)
“যখন লোভের বিষয়টা কোন কারণে অত্যুগ্র হয়ে ওঠে যখন ব্যক্তিগত প্রতিযোগিতায় অসাম্য সৃষ্টি করতে থাকে। এই অসাম্যকে ঠেকাতে পারে মানুষের মৈত্রীবোধ , তার শ্রেয়োবুদ্ধি।” (উপেক্ষিতা পল্লী)
বিজ্ঞান গবেষণার মূল নীতি হল তথ্য থেকে সত্যে পৌঁছানো। আমরা আশা করব করোনা সংক্রমণ রোধ করার ক্ষেত্রে এবং প্রতিষেধক টিকা আবিষ্কারের ক্ষেত্রে এই নীতি পালিত হবে।
রবীন্দ্রনাথ ১৯৩৪ সালেই উপলব্ধি করেছিলেন, “প্রকৃতির দান এবং মানুষের জ্ঞান এই দুইয়ে মিলেই মানুষের সভ্যতা নানা মহলে বড়ো হয়েছে– আজও এই দু’টোকেই সহযোগী রূপে চাই। শক্তি ব্যক্তিবিশেষে একান্ত হয়ে উঠে মানুষকে যেন বিচ্ছিন্ন না করে– শক্তি যেন সর্বদাই নিজের সামাজিক দায়িত্ব স্বীকার করতে পারে।” (পল্লী প্রকৃতি)
মানুষের শুভবুদ্ধি জাগ্রত হলে আমরা অচিরেই এই অতিমারীকে জয় করতে সক্ষম হব। এই আশা টুকুই বর্তমান বিষাদ কালে আমাদের পাথেয় হয়ে উঠুক।
লেখক পরিচিতি
প্রাক্তন শিক্ষক ও সঙ্গীত শিল্পী।
email: senguptaprabir4@gmail.com