উত্তর পূর্ব ভারত সহ বাংলাদেশ, পাকিস্তান, চীন, আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়ার এক বড় অংশের জনজীবন ভয়াবহ বন্যা, প্লাবন ও ধ্বসে বিপর্যস্ত, নীরব ও নিশ্চুপ থাকা এখন অপরাধ

পোস্টটি দেখেছেন: 35 সন্তোষ সেন প্রকৃতি আজ রুষ্ট। বেশ কয়েক বছর ধরেই প্রকৃতির রুদ্ররুপ প্রত্যক্ষ করছেন বিশ্বের নানান প্রদেশের মানুষজন, বর্তমানে যা এক ভয়াবহ রূপে হাজির হয়েছে বিশ্ববাসীর সামনে। আসলে মুষ্টিমেয় মানুষের অতি লোভ, ফুলে ফেঁপে ওঠা পুঁজির নতুন নতুন বিনিয়োগ ও আরো আরো মুনাফার অন্ধগতির কারণে প্রকৃতি পরিবেশ লুঠ হচ্ছে প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে। কর্পোরেটের স্বার্থে […]

সন্তোষ সেন

প্রকৃতি আজ রুষ্ট। বেশ কয়েক বছর ধরেই প্রকৃতির রুদ্ররুপ প্রত্যক্ষ করছেন বিশ্বের নানান প্রদেশের মানুষজন, বর্তমানে যা এক ভয়াবহ রূপে হাজির হয়েছে বিশ্ববাসীর সামনে। আসলে মুষ্টিমেয় মানুষের অতি লোভ, ফুলে ফেঁপে ওঠা পুঁজির নতুন নতুন বিনিয়োগ ও আরো আরো মুনাফার অন্ধগতির কারণে প্রকৃতি পরিবেশ লুঠ হচ্ছে প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে। কর্পোরেটের স্বার্থে আর কিছু মানুষের তথাকথিত সুবিধের অজুহাতে অপরিকল্পিত ও অবৈজ্ঞানিক উন্নয়নের রথের চাকায় পিষ্ঠ হচ্ছে জল জঙ্গল জমি নদী পাহাড় –সব, সবকিছুই। হেক্টরের পর হেক্টর বনভূমি ধ্বংস করে ধরিত্রীর বুক ফাটিয়ে তুলে আনা হচ্ছে কয়লা লোহা বক্সাইট। কয়লা ও পেট্রোলিয়ামের মতো জীবাশ্ম জ্বালানি বিপুল পরিমাণে ব্যবহারের কারণে পৃথিবীর জ্বর বাড়ছে, প্রকৃতি-মা দিন দিন তপ্ত হচ্ছে। গত ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে মানুষের পরিবেশবিরোধী নানা রকম ক্রিয়াকলাপের ব্যাপক বৃদ্ধি এবং বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাইঅক্সাইড, ক্লোরোফ্লুরো কার্বন, মিথেন, ওজোন, নাইট্রাস অক্সাইড ইত্যাদি গ্রিনহাউস গ্যাসগুলোর উপস্থিতি বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে বায়ুমণ্ডলের নিচের স্তরের উষ্ণতা বেড়ে গিয়ে তা প্রভাবিত করছে পৃথিবীর জলবায়ুকে। বিভিন্ন অঞ্চলে বদলে যাচ্ছে তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাতের প্রকৃতি, পরিমাণ এমনকি ঋতুছন্দও। গত ২৫ বছরের বেশি সময় ধরে পৃথিবীর উষ্ণতা প্রতি দশকে প্রায় দশমিক ১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস হারে বেড়ে চলেছে। গলে যাচ্ছে হিমবাহ ও মেরু প্রদেশের বরফ। সমুদ্রতলের উচ্চতা ক্রমশ বেড়ে চলেছে, সমুদ্রের তাপমাত্রাও বাড়ছে। এসবের ফলস্বরূপ দানবীয় সামুদ্রিক ঝড়ঝঞ্ঝার তীব্রতা ও সংখ্যা বাড়ছে চক্রবৃদ্ধি হারে।

ভূউষ্ণায়ন, তাপমাত্রা বৃদ্ধি, বরফের গলন এবং একদিকে অল্প সময়ে অত্যধিক বৃষ্টিপাত বন্যা, প্লাবন, ধ্বস ও অন্যদিকে তীব্র তাপপ্রবাহ, অত্যধিক আর্দ্রতা, খরা –এসবের হাত ধরে বিশ্বজুড়েই জলবায়ু পরিবর্তন আজ নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর ফলে জনজীবন বিপর্যস্ত হচ্ছে, ঘটছে প্রাণহানি এবং চাষের ক্ষতি। আগামীদিনে খাদ্য সংকটের সম্ভাবনাও দরজায় কড়া নাড়ছে। এখনো কি আমরা নিরব দর্শক হয়ে থাকব? বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন যে –পরিবেশ মেরামতিতে এখনই ব্যবস্থা না নিলে এইসব এক্সট্রিম ঘটনাগুলো বারবার ঘটবে সারা বিশ্বজুড়েই এবং এটা আজ ভবিষ্যতের পদধ্বনি নয়, ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয় আজ ঘটমান বর্তমান। এর ফলে সারা পৃথিবী জুড়েই এক বড় অংশের মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ধ্বস্ত হচ্ছে বারেবারে, অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতিও বাড়ছে। ২০২২ এর প্রথম থেকে আজ পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে এইসব বিপর্যয়ের কিছু খতিয়ান তুলে ধরব এই নিবন্ধে।

বিপর্যস্ত উত্তর-পূর্ব ভারত:

অসম, মেঘালয়, ত্রিপুরা সহ উত্তর পূর্ব ভারতের এক বড় অংশ বেশ কিছুদিন ধরেই জলমগ্ন, গ্রাম শহর সব জল থইথই। অসমের ৩২ টি জেলার আশি লক্ষের বেশি মানুষ বন্যায় বিপর্যস্ত, প্রাণহানির খবরও আসছে। বিঘার পর বিঘা কৃষিজমি ও কৃষিশস্য জলের তলায়। বন্যার কবলে পড়া কয়েক লক্ষ মানুষকে আশ্রয় শিবিরে নিয়ে যেতে বাধ্য হলো প্রশাসন, জলে ভেসে গেছে কয়েক হাজার গবাদি পশু। রেল সহ গণ পরিবহন ব্যবস্থা পুরোপুরি ব্যাহত হলো কয়েক দিন ধরে।

আসামের শিলচরে এর আগে বড়সড় বন্যা হয়েছিল ২০০৪ সালে। তথ্য বলছে, ৪০ বছরে অন্তত পাঁচবার বন্যায় ডুবেছে শিলচর, বরাক উপত্যকা ও কাছাড় জেলা। নদীমাতৃক আসামের মানুষ জল-যন্ত্রণার ছবি দেখে জন্ম গ্রহণ করেন – বেড়ে ওঠেন– মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু এ বছরের মে মাসের মাঝামাঝি আর জুনের বন্যা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। হাঁটু কিংবা কোমর জল থেকে বুক জল এবং বুক জল থেকে শেষ পর্যন্ত ডুব। উত্তর-পূর্ব ভারতের বৃহত্তম শপিং মলের বেসমেন্ট ডুবে গেল দশফুট গভীর জলে। সারা আসাম জুড়ে রাস্তাঘাট জলের তলায়, যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। অথচ পানীয় জল, আলো-পাখা, মোবাইল ও ইন্টারনেট সংযোগহীন শহুরে মানুষদের বেশ কয়েক দিন চলল শুধুই দুর্ভোগ- আতঙ্ক- উৎকণ্ঠার প্রহর গুনে। নাগরিক জীবনে এমন ঘটনা এর আগে খুব একটা ঘটেনি।

সরকারি মতে অমরনাথে এরমধ্যেই ১৬ জন মানুষ মারা গেছেন, নিখোঁজ কম করে ৪০ জন পুন্যার্থী (যদিও বেসরকারি মতে নিখোঁজের সংখ্যা ১০০ ছাড়িয়ে যাবে), ভেসে গেছে একাধিক তাঁবু , ১১২ জন বাঙালি পর্যটক সহ আটকে পড়েছেন বহু মানুষ। কাদামাটি সরিয়ে মৃতদের নিথর দেহ তুলে আনা হচ্ছে, আহতদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত। অমরনাথ যাত্রা আপাতত বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। না, জঙ্গী হানা নয় –মেঘভাঙা তুমুল বৃষ্টি, হড়পা বান ও ভূমি ধ্বসের কারণেই অমরনাথে এই ভয়াবহ বিপর্যয়। উত্তরাখণ্ডের স্মৃতি আবারও ফিরে এলো অমরনাথের মানুষের জীবনে।

হিমাচল প্রদেশের সিমলাতেও কয়েকদিন আগে মেঘ ভাঙ্গা তুমুল বৃষ্টি, হড়পা বাণ ও ধ্বসের কবলে নাজেহাল হলেন কয়েকহাজার মানুষ, পর্যটকদের একাধিক গাড়ি মাটি পাথর চাপা পড়ে তালগোল পাকিয়ে গেল।

এমনিতেই ভঙ্গুর ও এখনো স্থিতিশীল না হওয়া হিমালয়ের বুকে ডিনামাইট ফাটিয়ে রাস্তাসহ অন্যান্য নির্মাণ কার্য, নদীর স্বাভাবিক গতিপথ আটকে দেওয়া ও যত্রতত্র বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের অবৈজ্ঞানিক পরিকল্পনার চাপে হিমালয় আজ আক্ষরিক অর্থেই বিপন্ন। যার ফল ফিরে ফিরে ভোগ করতে হচ্ছে পর্যটক সহ স্থানীয় আদিবাসী জনজাতির মানুষদের।

এখন এটা স্পষ্ট করে বুঝে নেওয়ার সময় এসেছে যে, এইসব ঘনঘন তীব্র মাত্রার প্রাকৃতিক দূর্যোগ ও মানুষের দুর্ভোগ প্রকৃতির রোষে নয়, বরং তা অনেক বেশি করে মানুষের দোষে। তাই বিনষ্ট হয়ে যাওয়া পরিবেশকে কিভাবে সুস্থ করে তোলা যায় সেই বিষয়ে যেমন আমাদের ভাবতে হবে, বিজ্ঞানী ও পরিবেশবিদদের মতামত ও প্রস্তাবকে গুরুত্ব দিতে হবে। ভাবতে হবে তথাকথিত উন্নয়ন কাদের স্বার্থে, কিসের বিনিময়ে? পাশাপাশি এই প্রশ্ন তোলারও সময় এসেছে – হিমালয়ের উত্তুঙ্গে, প্রকৃতির কোনায় কোনায় এত পর্যটক ও তাদের আরাম আয়েসের জন্য পরিবেশ বিঘ্ন করে পর্যটন শিল্পের রমরমায় রাশ টানার প্রয়োজন কিনা?

man pouring water from dipper on blue and grey house
Photo by hitesh choudhary on Pexels.com

ভারতের অন্যান্য প্রদেশে প্রকৃতির রুদ্ররূপ:

ভারতের তেলেঙ্গানা রাজ্যে চলমান ভারী বর্ষণের কারণে ১১ জুলাই থেকে তিন দিনের জন্য সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। ইতিমধ্যে তেলেঙ্গানায় ভয়াবহ বৃষ্টি হয়েছে জয়শঙ্কর ভুপালাপল্লি, মাঞ্চেরিয়াল, নির্মল, নিজামাবাদ, পেদ্দেপল্লি জেলায়। এ ছাড়া প্রচণ্ড বৃষ্টির মুখে রয়েছে আদিলাবাদ, জাগিতইয়াল, মুলুগু প্রভৃতি জেলা। কয়েকদিন ধরে ভাসছে বাণিজ্য নগরী মুম্বাই, বারবার একই ঘটনা ঘটছে মুম্বাইয়ে। ৯ ই জুলাই থেকে প্রবল বৃষ্টিতে মহারাষ্ট্রের আরো তিন জেলা বানভাসির কবলে। এই মরশুমে অতিভারী বর্ষণ ও বন্যার কারণে মহারাষ্ট্রে ৮৯ জন মারা গেছেন। দক্ষিণ ও মধ্য গুজরাটে এবং কেরালার বেশ কিছু অঞ্চল অত্যধিক বৃষ্টিপাতে প্লাবিত, সেখান থেকেও প্রাণহানির খবর পাওয়া যাচ্ছে।

জুলাই মাসের প্রথম থেকে উত্তরবঙ্গের একাধিক অঞ্চলও প্রবল বৃষ্টিপাতের ফলে জলমগ্ন। তিস্তা তোর্সা জলঢাকা সহ প্রায় সব নদীর জল ফুলেফেঁপে শহরগুলোকে গ্রাস করল, ভাসল আলিপুরদুয়ার, কোচবিহার। আগামীদিনে মুম্বাই, কলকাতা সহ ভারতের বারোটি মেট্রো শহর জলের তলায় তলিয়ে যাবে বলেই বিজ্ঞানীরা বারবার হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন (পৃথিবীর কম করে ৪০০ টি মেট্রো শহরও এই তালিকায় রয়েছে)। কিন্তু কাকস্য পরিবেদন, রাষ্ট্রনায়কদের কুম্ভকর্ণের ঘুম ভাঙছে না, বরং প্রকৃতির লুণ্ঠন ও নিষ্পেষণ দ্রুত ও সর্বত্রগামী হয়েছে। পৃথিবী থেকে মানুষ সহ বন্যপ্রাণ প্রজাতি বিলুপ্ত হওয়ার আগে বোধহয় এই গতি আর থামবে না। তাই জলবায়ু পরিবর্তন, প্রকৃতির নিষ্ঠুর প্রতিশোধ আজ বিশ্ব জুড়ে বারেবারে প্রতিভাত হচ্ছে।

অন্যদিকে গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গ জুনের স্বাভাবিক বৃষ্টি থেকে ৭৭ শতাংশ পিছিয়ে। তীব্র গরম ও অত্যধিক হিউমিডিটির জন্য রাস্তায় বেরনো মানুষজনের নাভিশ্বাস উঠছে। চাষের কাজও ঠিকভাবে শুরু করতে পারেননি কৃষক বন্ধুরা। যেটুকু চাষ হবে, তাও হয়ত ফসল ওঠার আগে অসময়ের অতিবৃষ্টিতে তলিয়ে যাবে মাঠের মধ্যেই। গতবছর নভেম্বর – ডিসেম্বরে অসময়ের বৃষ্টি ও বন্যায় কৃষকদের সর্বস্বান্ত হওয়ার স্মৃতি এখনো তাঁদের তাড়া করে বেড়াচ্ছে। অথচ বাংলারই উত্তরভাগ ১২৩ শতাংশ বেশি বৃষ্টির জলে থই – থই। কয়েকদিন আগেই মাত্র তিন ঘণ্টায় ১৪৬ মিলিমিটার বৃষ্টিতে জলমগ্ন হয়ে পড়ে পুরো শিলিগুড়ি শহর। সব ঘেঁটে ঘ –আবহাওয়া দপ্তরের কাছে প্রকৃতির এই অস্বাভাবিক আচরণের কোন সদুত্তর নেই।

প্রতিবেশী পাকিস্তান বন্যায় নাজেহাল:

 ভৌগলিক কারণেই পাকিস্তান, আফগানিস্তান প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর। হিমালয়, হিন্দুকুশ ও কারাকুলাম পাহাড়ের অতুলনীয় সংযোগস্থল নিয়ে আবৃত পাকিস্তানের এক বড় অংশ। আর এই পাহাড়গুলো বরফাচ্ছাদিত থাকে বছরের অধিকাংশ সময়। কিন্তু মানুষের অবিমৃশ্যকারীতায় প্রকৃতির স্বাভাবিক ঘটনাগুলোই আজ সব অস্বাভাবিক, অপ্রাকৃতিক হয়ে পড়েছে। তাই এইসব পাহাড়ের

বরফের বড় বড় অংশগুলো হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ছে চোখের পলকে। ভূউষ্ণায়নের কারণেই এরকমটা হচ্ছে বলে জানা যাচ্ছে। এপ্রিল মাস জুড়ে পাকিস্তানের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে তাপমাত্রা ছিল ৪০ থেকে ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা ওখানকার গড় স্বাভাবিক তাপমাত্রার থেকে আট থেকে দশ ডিগ্রি বেশি। অত্যধিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং তাপপ্রবাহের কারণে মে মাসের সাত তারিখে একটি বিশাল আকারের বরফের পাহাড় (Shisper glacier) সম্পূর্ণরূপে গলে যায়, যার ফলে নদীতে প্রবল জলস্ফীতি ভাসিয়ে নিয়ে গেল পাকিস্তানের কারাকোরাম হাইওয়ের সন্নিকটে চীনের সাথে সংযোগকারী গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক ‘হাসানাবাদ সেতু’ কে। প্রবল জলস্রোতের কারণে সেতুর সাথে সাথে দুটি জল-বিদ্যুৎ কেন্দ্র, প্রচুর বাড়ি, আবাসন, প্রশাসনিক ভবনও জলের তলায় তলিয়ে গেছে। বাজারি সংবাদপত্রে এইসব খবর সামনে না এলেও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংবাদসংস্থা থেকে এই ভয়াবহতার খবর শুনে প্রকৃতি প্রেমিক মানুষজন আতঙ্কে শিউরে উঠছেন।

বরফের গলনের সাথে যুক্ত হয়েছে ১৪ ই জুন থেকে প্রবল বর্ষণ, একেই বলে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। ফলে বেশ কয়েকটি নদীর জল উপচে পড়ছে, বানভাসি হয়েছে কমকরে ৮ টি প্রদেশ। সবচেয়ে ভয়ানক অবস্থা বালুচিস্তান প্রদেশের, শহর মফস্বল সব জলের তলায়। পাকিস্তানের ভয়াবহ বন্যায় এখনো পর্যন্ত ৭৭ জনের প্রাণহানির খবর পাওয়া গেছে, এই সংখ্যাটা আরো বাড়বে বলেই আশঙ্কা করা হচ্ছে (nbc news.com–6th July)। পাকিস্তানে কয়েকদিনের টানা বর্ষণের কারণে বন্যা সাংঘাতিক আকার ধারণ করেছে। এছাড়া, সাম্প্রতিক কয়েকদিনের টানা বৃষ্টিতে পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদ ও সর্ববৃহৎ শহর করাচির বিশাল অংশও জলমগ্ন হয়ে পড়েছে (রয়টার্স, হিন্দুস্তান টাইমস -১০ ই জুলাই)। ২০১০’ এর সেই ভয়ঙ্কর বর্ষণ ও বন্যার স্মৃতি আবারো ফিরে এল পাকিস্তানবাসীর হৃদয়ে। পাকিস্তানের এক মন্ত্রী শেরি রেহমানের কথায় –”এবারের বৃষ্টিপাতের পরিমাণ স্বাভাবিক গড়ের থেকে ৮৭% বেশি”। পাকিস্তানের পরিবেশ কর্মীদের মতে –”তাপপ্রবাহ, বরফের গলন, অত্যধিক বর্ষণ ও প্লাবন আজ আর শুধু প্রাকৃতিক ঘটনা নয়, এর পিছনে মানুষের দায়ভার অনেক বেশি। আমরা দখল করছি পাহাড় পর্বত গ্লেসিয়ার সব কিছু, যার ফল পাচ্ছি হাতেনাতে”।

১২২ বছরের ইতিহাসে বাংলাদেশে সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যা:

২০২২ সালের জুন মাসে বর্ষা মরশুমের শুরুতে বাংলাদেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বভাগের অঞ্চলগুলিতে প্রবল বন্যার কারণে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ও মৃত্যুর স্বাক্ষী থাকলেন বাংলাদেশের আপামর জনগণ। সিলেট, সুনামগঞ্জ, রংপুর ও কুড়িগ্রাম জেলায় সবমিলিয়ে ৩৫ লক্ষ জনসাধারণ বন্যায় আক্রান্ত হয়েছেন। কেবল সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলাতেই ৩০ লক্ষ মানুষ বন্যাদুর্গত। অধিকাংশ নদী বইছে বিপদসীমার ওপর দিয়ে, ১২টির বেশি উপজেলা তলিয়ে গিয়েছে জলের তোড়ে, বিশাল জনপদ জলবন্দী হয়ে গেছে, বিদ্যুৎসংযোগ ও টেলিযোগাযোগ বন্ধ হয়ে গিয়েছে,  দেশের অনান্য অঞ্চলের সাথে সড়ক যোগাযোগ কার্যত বিচ্ছিন্ন। ১৯৮৮ ও ১৯৯৮ সালের বন্যার পরে বাংলাদেশের এবারের বিপর্যয়কে সাম্প্রতিক ইতিহাসের সবচেয়ে মারাত্মক বন্যা হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। সিলেট ও সুনামগঞ্জের যথাক্রমে ৮০% ও ৯০% এলাকা বানভাসি হয়েছে। সিলেটের ‘আন্তর্জাতিক ওসমানী বিমানবন্দরে’ বিমান চলাচল বন্ধ হয়ে যায় বেশ কিছুদিনের জন্য।

বাংলাদেশে বন্যার কারণ বিবিধ:

২০২২-এর জুন মাসে মাত্র তিন দিনে ভারতের আসাম ও মেঘালয়ে আড়াই হাজার মিলিমিটারের মতো বৃষ্টিপাত হয়, যা গত ২৭ বছরে তিন দিনে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাতের রেকর্ড। এই পর্যায়ে বিশ্বের সবচেয়ে বৃষ্টিপ্রবণ অঞ্চল মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জিতে (বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে মাত্র ৩০ কিলোমিটার দূরে) ২৪ ঘণ্টায় ৯৭২ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়, যা বিগত ১২২ বছরের মধ্যে এক দিনে তৃতীয় সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত। অতিবৃষ্টির কারণে সৃষ্ট আসাম ও মেঘালয়ের ঢলের জলস্রোত ভারতের বরাক নদী হয়ে সিলেট অঞ্চলের সুরমা ও কুশিয়ারা নদীসহ বহুসংখ্যক উপনদী ও হাওর অঞ্চল হয়ে  কিশোরগঞ্জে মেঘনা নদীতে গিয়ে মেশে। হাওরগুলিতে অপরিকল্পিতভাবে সড়ক, স্লুইসগেট ও বাঁধ নির্মাণ ও উন্নয়নের নামে নদীর গতিপথ সংকোচন, নদীতে বর্জ্য ফেলা, নদী দখল, উজানে নির্বিচারে পাহাড় ও টিলা কাটার ফলে ভূমিক্ষয়ের কারণে পলি জমা হয়ে বাংলাদেশের নদীগুলির ক্রমশঃ নাব্যতা হ্রাস, ভারতে উজানে বাঁধ নির্মাণ ও বর্ষার সময় ড্যাম থেকে অতিরিক্ত জল আকস্মিক ছেড়ে দেওয়া, ইত্যাদি কারণে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বন্যার ঝুঁকি সাম্প্রতিককালে বৃদ্ধি পেয়েছে।

 ‘প্রথম আলো ‘ ওয়েব পত্রিকা (৯ই জুলাই) থেকে জানা যাচ্ছে –বাংলাদেশের হাওর অঞ্চলে দফায় দফায় বন্যা হয়েছে। লাখ লাখ মানুষ ঘরবাড়ি হারিয়েছেন। তাঁদের খেতের ফসল, গোলার ধান জলে ভেসে গেছে। অনেকে হাঁস, মুরগি, গবাদিপশুও রক্ষা করতে পারেননি। কোন কোন এলাকা নতুন করে আবার বন্যার জলে প্লাবিত হচ্ছে। এ অবস্থায় হাওরপারের ও সোমেশ্বরীর তীরের লাখ লাখ মানুষ ঈদের আনন্দ থেকে বঞ্চিত হলেন। নেত্রকোনার এক ব্যবসায়ী আক্ষেপ করে বলেছেন, “বন্যা আমাদের নিঃস্ব করে দিয়েছে। আমাদের এবার কোনো ঈদ নেই। বন্যা উপদ্রুত এলাকার সব মানুষ নিঃসম্বল হয়ে পড়েছে। ঘরে খাবার নেই। ঈদ করবে কী করে”?

বাংলাদেশ রেড ক্রেসেন্ট সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক জানাচ্ছেন –” সুনামগঞ্জ ও সিলেটে এইরকম বিপুল বৃষ্টিপাত, প্রবল জলরাশি ও বন্যা আমাদের জীবদ্দশায় এর আগে কোনদিন দেখিনি। বন্যাদুর্গতদের সহায়তায় আমাদের কর্মী ও স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী জান কবুল করে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন”। তথ্য বলছে –এবারের বন্যা, প্লাবন অতীতের সব রেকর্ড ভেঙেচুরে নতুন ইতিহাস তৈরী করছে। IFRC (The International Federation of Red Cross and Red Crescent Society) জরুরী ভিত্তিতে ৭৮ লক্ষ ডলারের আর্থিক অনুদানের জন্য আবেদন করেছেন বাংলাদেশের তিন লক্ষের বেশি বন্যাদুর্গতদের উদ্ধারকার্যে ও তাঁদের স্বাভাবিক জীবন প্রবাহে ফিরিয়ে আনতে

 (ifrc.org / press release -28th June).

ছবি: AP: Anupam Nath via https://www.abc.net.au/

ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তানের বন্যার মূল কারণগুলো বিশ্লেষণ করলে এটা জলের মত পরিষ্কার যে, পরিবেশের বিপর্যয় আজ রাষ্ট্রীয় সীমানা ছেড়ে আন্তর্জাতিক পরিসরে হাজির। আজ পৃথিবীজোড়া প্রাণ-প্রকৃতির আন্দোলন এই প্রশ্ন তুলে দিয়েছে যে, সাইবেরিয়ার একখণ্ড বনভূমি কেটে উড়িয়ে দিলে তার critical impact শুধু সাইবেরিয়ায় সীমাবদ্ধ থাকবে না, সারা পৃথিবী সেই সঙ্কটের ভাগীদার হবে। তাত্ত্বিকভাবে এটি সবসময়ের জন্য সত্য হলেও, বাস্তবে সাম্প্রতিক সময়ে তা সর্বোচ্চ অর্থে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। এবং এটাও সত্য যে, এইসব দূর্যোগ ও মানুষের দুর্ভোগ রাজনৈতিক দল, জাতি ধর্ম, শিশু মহিলা নির্বিশেষে সকলকে সমানভাবে ধস্ত করে ও করবে। তাই এর সমাধান করতে হবে আন্তর্জাতিক স্তরে রাষ্ট্রগুলোর সৌহার্দ্য- সহযোগিতা ও বৈজ্ঞানিকভাবে সামগ্রিক পরিকল্পনা গ্রহণের মধ্য দিয়েই। নাহলে শিয়রে শমন, শেষের সেই ভয়ঙ্কর দিনের জন্য উদ্বেগ উৎকণ্ঠা নিয়ে বসে থাকা আর হাহুতাশ করা ছাড়া হাতে পড়ে থাকবে শুধুই পেন্সিল।

চরম আবহাওয়া, অত্যধিক তাপমাত্রা ও বন্যার কবলে চীন:

সারা দেশ চরম আবহাওয়া জনিত জরুরী অবস্থার সাথে লড়াই করছে। এ বছর জুন মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে চীনের দক্ষিণ ও পূর্ব প্রদেশের বিস্তৃত অঞ্চল প্রবল বর্ষণ, বন্যা ও ভূমিধ্বসে আক্রান্ত। বলা হচ্ছে যে, ১৯৬১ সালের পর চীনে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে এল আবার।

ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র পিপলস ডেইলির মতে, সারা দেশে শতাধিক নদীতে জলস্তর বন্যা সতর্কতা মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে।

কয়েকদিন ধরে তুমুল বৃষ্টি ও বন্যার কারণে গুয়াংডং প্রদেশের কর্তৃপক্ষ সর্বোচ্চ স্তরে সতর্কতা জারি করেছেন এবং ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় স্কুল, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও গণপরিবহন বন্ধ করে দিয়েছেন।

দক্ষিণ চীনের প্রায় পাঁচ লক্ষ বন্যাদুর্গত মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা পুরোপুরি ব্যাহত হয়েছে। সরকারি মিডিয়া কর্তৃক প্রকাশিত ছবিতে দেখা যাচ্ছে –বন্যায় আটকে পড়া বাসিন্দাদের উদ্ধার করতে নৌকা, প্যাডেল বোট নিয়ে জলাবদ্ধ রাস্তা জুড়ে নিরন্তর উদ্ধারকার্য চালিয়ে যাচ্ছেন প্রশাসন। রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন থেকে জানা যায় –

শাওগুয়ানের কারখানাগুলিকে উৎপাদন বন্ধ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, কারণ এইসব অঞ্চলে জলের স্তর সর্বাধিক উচ্চতায় পৌঁছে যায়।

গুয়াংডং এর জরুরী ব্যবস্থাপনা বিভাগ বলেছে – এবারের প্রবল বৃষ্টি ও বন্যার কারণে প্রায় ৩০ হেক্টর ফসল নষ্ট হয়েছে এবং ১,৭০০ টিরও বেশি বাড়ি ভেঙে পড়েছে, ১৭০ কোটি ইয়েন মূল্যের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে (সিনহুয়া নিউজ এজেন্সি)। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে গ্রীষ্মকালীন বন্যার সাথে লড়াই করতে হয় চীনের সরকার ও জনসাধারণকে। তবে এই বছর গ্রীষ্মে ব্যাপক তাপপ্রবাহ ও তারপর তুমুল বন্যা হাত ধরাধরি করে এসেছে, যা দেশের উত্তর অংশে আঘাত হানে। কেন্দ্রীয় আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র জানিয়েছে যে, এইসব অঞ্চলে আগামী দিনে ভারী বৃষ্টিপাতেরও আশঙ্কা করা হচ্ছে। বলা বাহুল্য যে, উত্তর ও মধ্য প্রদেশে গ্রীষ্মকালীন তাপমাত্রা সর্বোচ্চ ৪০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে পৌঁছেছে। অন্যদিকে হেনান প্রদেশে তাপমাত্রা ৫০ ডিগ্রির সীমারেখাও ছাড়িয়ে যাওয়ায় সিমেন্টের রাস্তাগুলি ফেটে চৌচির হয়ে যায়। প্রচণ্ড গরমের কারণে চীনের কিছু জনবহুল প্রদেশে, বিশেষ করে ১০ কোটি বাসিন্দা সম্বলিত শানডং-এ, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার চাহিদা বেড়েছে, ফলে রেকর্ড পরিমাণ বিদ্যুতের ব্যবহার হয়েছে।

এই বছর চীনে বন্যা এবং তাপপ্রবাহ দিন পেরিয়ে সপ্তাহ ধরে প্রসারিত হয়েছে, যেমনটি হয়েছিল গত বছরে। চীন যে দ্বিমুখী প্রতিকূল  আবহাওয়া জনিত জরুরি অবস্থার সম্মুখীন হচ্ছে তা বৈশ্বিক প্রবণতাকেই প্রতিফলিত করে। শুধু চীন নয়, বরং সারা বিশ্ব ক্রমবর্ধমান ঘন ঘন  জলবায়ু ও ঋতুচক্র পরিবর্তন এবং তীব্র তাপপ্রবাহ, খরা, দাবানল, ঝড়ঝঞ্ঝা, বন্যা প্লাবনের মতো চরম প্রতিকূল আবহাওয়ার এক দীর্ঘ পর্বের মধ্য দিয়ে চলেছে। পৃথিবীর এক বড় অংশের মানুষ বারবার আক্রান্ত ও ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে, লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে পরিবেশগত প্রভাবে উদ্বাস্তু মানুষের মিছিল। (তথ্যসূত্রঃ Zixu Wang হংকং এবং লি ইউ সাংহাই এর রিপোর্ট, ১০ ই জুলাই)।

এই প্রসঙ্গে চীনের কার্বন এমিশন ও বায়ু দূষণের মাত্রা কমানোর লক্ষ্যে কিছু সাম্প্রতিক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপের কথা সংক্ষেপে আলোচনা করব। প্রথমেই বলে রাখি ২০০৬ সালে কার্বন নিঃসরণের নিরিখে বিশ্বের এক নম্বর দেশ ছিল চীন এবং ২০১৮ সালে সারা বিশ্বের বাতাসে মোট গ্রীনহাউজ গ্যাস নির্গমনের এক-চতুর্থাংশের দায়ভার ছিল চীনের। চীনের মোট শক্তি উৎপাদনের সবচেয়ে বেশির ভাগটাই আসত তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে। আরেকটি  অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হলো –চীন একমাত্র দেশ, যা সবচেয়ে বেশি সংখ্যক দরিদ্র মানুষকে তাদের দারিদ্রতা থেকে মুক্তি দিতে পেরেছে বিগত কয়েক বছরে। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের দাবি, অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটাতে গিয়ে চীনে বায়ু দূষণের পরিমাণ মাত্রাছাড়া হয়, যার ফলে জনগণের স্বাস্থ্য সমস্যা অনেকগুণ বেড়ে যায়। শুধুমাত্র বায়ু দূষণের কারণে প্রতিবছর ১১ লক্ষ মানুষ মারা যান। শুধু তাই নয়, প্রতিবছর এই দেশটি ৩৭ বিলিয়ন ডলারের আর্থিক ক্ষতির মুখোমুখি হয় দূষণের জন্য কৃষিশস্যের ফলন কমে যাওয়ার কারণে। এই প্রেক্ষিতকে সামনে রেখে পরিবেশ মেরামতিতে চীন কী কী পদক্ষেপ নিল তা দেখা যাক।

প্রথমেই শি চিনপিং এর নেতৃত্বে সরকার নতুন করে কয়লা পুড়িয়ে তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিলেন এবং দেশের সবচেয়ে দূষিত শহর গুলোতে বেশ কয়েকটি পুরনো তাপবিদ্যুৎ কারখানা বন্ধ করে দিলেন এবং এইসব শহরে গাড়ির সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করার পাশাপাশি পেট্রোল-ডিজেলের পরিবর্তে বিদ্যুৎচালিত বা সৌরশক্তি চালিত বাস চালানোর পরিকল্পনা নিলেন। সাথে দূষণ সৃষ্টিকারী বেশ কয়েকটি লৌহ ইস্পাত শিল্প এবং কয়লাখনি বন্ধ করে দিলেন। ‘ গ্রেট গ্রীন ওয়াল’ প্রকল্পের মধ্য দিয়ে নতুন করে ব্যাপক বনসৃজনের পরিকল্পনা নেওয়া হলো, যার হাত ধরে এখনো পর্যন্ত ১২ টি প্রদেশে ৩৫০০ কোটি গাছ লাগানো হয়েছে পরিকল্পনা মাফিক। বর্তমানে বনসৃজন প্রকল্পে চীনের বিনিয়োগ আমেরিকা এবং ইউরোপকে ছাড়িয়ে পৃথিবীর গড় বিনিয়োগের তিন গুণে পৌঁছে গেছে। ‘নীল আকাশ ফিরে পাওয়ার যুদ্ধ’ পরিকল্পনার ফলে ২০২০ এর শুরু থেকে চীনের আকাশ অনেক বেশি দূষণমুক্ত হলো। নীল আকাশ ফিরে পাওয়ার লড়াই আজ সবথেকে বেশি গুরুত্বপর্ণ কাজ হওয়া উচিত। এই লড়াই কঠিন ও দীর্ঘস্থায়ী হলেও আমাদের প্রত্যাশা – সারাবিশ্বের রাষ্ট্রনায়করা এগিয়ে আসুক পরিবেশ মেরামতিকে সর্বপ্রধান গুরুত্ব দিয়ে সব কাজের সামনের সারিতে রেখে। তবেই বাঁচবে প্রকৃতি, বাঁচবে মানবসভ্যতা। (তথ্যসূত্র: earth.org এ ২০২১ এর ৩০ জুলাই প্রকাশিত হংকংয়ের চাইনিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ Felix Leung এর নিবন্ধ – How China is winning its battle against air pollution).

roofs of residential houses in flooded town
Photo by Pok Rie on Pexels.com

সিডনিতে বছরের তৃতীয় বন্যা, সরানো হলো ৫০ হাজার মানুষকে:

এশিয়া মহাদেশ ছড়িয়ে এবারে কম সময়ে প্রচুর বৃষ্টি ও বন্যা আফ্রিকা এমনকি অস্ট্রেলিয়াতেও বেশ জোরাল থাবা বসিয়েছে। ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত –এই ছয় মাসের বিভিন্ন সময়ে অস্ট্রেলিয়ার একাধিক অঞ্চল প্রবল বর্ষণ ও বন্যায় লন্ডভন্ড। প্রতিটি ক্ষেত্রেই কুইসল্যান্ড ও নিউ সাউথ ওয়েলস সবচেয়ে বেশি করে ক্ষতিগ্রস্থ। আর জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহের অধিক বৃষ্টিপাত ভয়ানক বিপর্যয় নামিয়ে আনল অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শহর সিডনি এবং সেন্ট্রাল কোর্ট এলাকায়। সিডনিতে এ বছরে তৃতীয়বারের মতো বন্যা হয়েছে, প্লাবিত হয়েছে বহু এলাকা, শহরগুলো যেন এক একটি বড় নদীতে পরিনত হয়েছে। বন্যাকবলিত হওয়ায় প্রায় ৫০ হাজার মানুষকে ঘরবাড়ি থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে, সড়কপথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে, অনেক ঘরবাড়ি জলের নিচে তলিয়ে গেছে, কয়েক হাজার মানুষ বিদ্যুৎসংযোগ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে। বন্যার কারণে বড় বড় নদী রয়েছে— অস্ট্রেলিয়ার এমন ৫০টি এলাকা থেকে লোকজনকে সরে যেতে প্রস্তুত থাকতে বলা হয়েছে। নিউ সাউথ ওয়েলসের কিছু এলাকায় চার দিনে ৮০০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। সিডনিতে ঝড়ের পূর্বাভাসও দেওয়া হয়েছে

(bbc news.com) । পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তন ও ‘লা নিনা’র প্রভাবে অস্ট্রেলিয়ায় এই ভয়াবহ বন্যা হয়েছে। আর এই কারণেই  অস্ট্রেলিয়ায় বৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড় ও তাপমাত্রা বাড়ছে।

একুশ শতকে এই প্রথম ভয়াবহ দূর্যোগ আফ্রিকা জুড়ে:

২০২২ এর ৮-২১ এপ্রিল জুড়ে টানা বৃষ্টিতে আফ্রিকার কোয়াজুলু – নাতাল প্রদেশের ব্যাপক অংশের জনজীবন ব্যাহত ও বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে। আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী –বানভাসি হয়ে আফ্রিকায় কম করে ৪৩৫ টি প্রাণহানির খবর মিলেছে, প্রবল বন্যা গিলে খেয়েছে কয়েক হাজার ঘরবাড়ি। বিদ্যুৎ সংযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থা পুরোপুরি বিঘ্নিত হয়ে পড়ায় এবং জাতীয় সড়ক সহ সব রাস্তা জলের তলায় চলে যাওয়ায় দক্ষিণ আফ্রিকার এক বিরাট অংশের মানুষের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। সব মিলিয়ে আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ১৬ কোটি মার্কিন ডলার। বিশেষজ্ঞদের দাবি – একুশ শতকে এইরূপ ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয় এই প্রথম উপলব্ধি করলেন আফ্রিকাবাসী (en.m.wikipedia)।

শেষের কথা:

এক শ্রেণীর মানুষের লোভ লালসা, মুনাফা আর তথাকথিত উন্নয়নের অজুহাতে প্রকৃতি পরিবেশ লুঠ চলছে প্রতিদিন প্রতিনিয়ত। প্রকৃতির এই নিষ্পেষণ বন্ধ করতে না পারলে প্রকৃতির প্রতিশোধের মার চলতেই থাকবে ……, যার কোন শেষ নাই। বিশ্বব্যাপী দিন দিন বেড়ে যাওয়া ভয়ঙ্কর প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঘনঘটা থেকে বাঁচতে হলে প্রকৃতিকে বাঁচাতেই হবে, নইলে মানব প্রজাতি অদূর ভবিষ্যতে হারিয়ে যাবে কালের গর্ভে। এখনো কিছুটা সুযোগ ও সময় আছে হাতে, এখনই সঠিক ব্যবস্থা না নিলে, আর ভাবারও সুযোগ থাকবে না, আমরা নিশ্চিতরূপে পোঁছে যাব “পয়েন্ট অফ নো রিটার্ন” র দেশে। “প্রকৃতি মা” আর অত্যাচার সইতে পারছে না, সে জানান দিচ্ছে বারবার নানানভাবে, বাকিটা মানুষের হাতে।

লেখক পরিচিতি:

বিজ্ঞান শিক্ষক, বিজ্ঞান ও পরিবেশ আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক।

যোগাযোগ: santoshsen66@gmail.com

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top