সন্তোষ সেন
সবুজ বিপ্লবের হাত ধরে বর্তমান প্রযুক্তি নির্ভর উচ্চফলনশীল চাষের ফলে পরিবেশের যে যে ক্ষতি হচ্ছে এবং নয়া কৃষি আইনে এই ক্ষতি কিভাবে আরো ত্বরান্বিত হবে, তা এই নিবন্ধে সংক্ষেপে উপস্থাপনা করব।
এক। প্রচুর পরিমাণে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারের ফলে জমির উর্বরতা শক্তি কমছে। ফলে পরের বারের চাষে আগের মত ফলন পেতে আরো বেশি বেশি করে সার ও কীটনাশক প্রয়োগ করতে হচ্ছে। তাই আমেরিকা ও ইউরোপের অনেক জায়গায় একবছর ছাড়া ছাড়া চাষ করতে হচ্ছে।
দুই। উপকারি অনুজীব, ব্যাকটেরিয়া ও কীটপতঙ্গ, যেমন ভ্রমর,মৌমাছি, প্রজাপতি ব্যাপক হারে মারা পড়ছে। লন্ডনের মতো যেসব অঞ্চলে প্রচুর সার ও কীটনাশক ব্যবহার করা হয় সেখানে নব্বই শতাংশ এর মত কীটপতঙ্গ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। পরাগমিলনের মধ্য দিয়ে এখনও সত্তর শতাংশ ফসল ফলে, তাই মৌমাছি, প্রজাপতিরা প্রকৃতি থেকে হারিয়ে গেলে মানুষের পেটেও টান পড়বে ।
তিন। ব্যবহৃত রাসায়নিকের খুব কম অংশই মাটি ও গাছ শুষে নেয়, কিন্তু বেশির ভাগটাই নদী নালা খাল বিল বেয়ে সমুদ্রে মেশে, ফলে সমুদ্রের তলা বিষাক্ত হচ্ছে- তৈরী হয়েছে কম করে চারশো ডেড জোন, যেখানে সামুদ্রিক প্রাণীরা ঝাঁকে ঝাঁকে মারা পড়ছে এবং শ্যাওলাদের অস্বাভবিক বৃদ্ধি হচ্ছে (algal bloom)। চোরা পথে এইসব দূষিত মাছ আমাদের ডাইনিং টেবিলে স্থান পেলে আমাদের রোগাক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও নিসন্দেহে বাড়বে।

চার। ২০০০ সালে আমেরিকার এগ্রোকেমিক্যালস ও এগ্রিকালচারাল বায়োটেকনোলজি কোম্পানি মনসান্তো প্রেরিত বিটি তুলো (যা কিনা জেনেটিক্যালি মডিফায়েড শস্য) মহারাষ্ট্র ও অন্ধ্রপ্রদেশের চাষীদের সর্বনাশ ও আত্মহত্যার মিছিল বয়ে নিয়ে এসেছিল এবং ঐ অঞ্চলের জীব-বৈচিত্র্যের ব্যাপক ক্ষতিসাধন করেছিল। এই নিয়ে বিশদে অন্যত্র আলোচনা করার ইচ্ছে থাকল।
পাঁচ। বিষাক্ত রাসায়নিক ফসলে মিশে যাওয়ার ফলে মানুষের ক্যান্সার সহ নানান রোগ অসুখ বাড়ছে। পাঞ্জাব হরিয়ানার চাষীরা সবুজ বিপ্লবের কুফল হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন এবং ভুলটাও বুঝতে পারছেন। দিল্লী সীমান্তে আন্দোলনরত কৃষকদের সাথে কথা বললে তাঁদের এই অনুভুতি স্পষ্ট হচ্ছে।
ছয়। মাটির তলার সঞ্চিত জল উচ্চফলনশীল চাষের জন্য প্রচুর পরিমাণে তুলে নেওয়ায় ভূগর্ভস্থ জল আরো আরো নীচে নামছে। অর্থাৎ কর্পোরেটদের মুনাফার জন্য তাদের নির্দেশিত পথে চাষাবাদের ফলে সামগ্রিকভাবে প্রাণ প্রকৃতি পরিবেশের সমূহ ক্ষতি হচ্ছে। সংসদীয় রাজনৈতিক দলগুলো নয়া কৃষি আইনের বিরোধিতা করলেও এইভাবে ভাবছেন বলে তো মনে হয় না। অন্তত তাদের প্রচার ও ইশতেহারে সেরকম কিছু দেখা যাচ্ছে না।
নয়া আইনে নতুন কি হবে?
নয়া কৃষি আইন বাস্তবের মাটিতে প্রয়োগ হলে নয়া মজুতদারি আইনের সুযোগে ফড়ে দালাল ও বড়ো বড়ো কোম্পানিগুলো লাগামহীনভাবে খাদ্যশস্য মজুত করবে। ২০২০ সালে নয়া কৃষি আইন আসার অনেক আগেই কয়েক শত একর জায়গা জুড়ে আদানি আম্বানিদের বেশ কয়েকটি কোল্ড স্টোরেজ তৈরি হয়ে গেছে। তার মানে তাদের স্বার্থেই কৃষি আইন চালু হবে এই খবর কর্পোরেটদের কাছে মজুত ছিল আগেভাগেই (ক্রনোলজি বুঝতে হবে)। আইনসঙ্গত ভাবেই অনিয়ন্ত্রিত মজুত্দারি ও ফাটকাবাজির ফলে একদিকে যেমন কৃষিপণ্যের দাম আকাশ ছোঁয়া হবে, পাশাপাশি দেশে খাদ্যসঙ্কট দেখা দেবে।
নয়া কৃষি আইনে খুল্লমখুল্লা ভাবে চুক্তি চাষের কথা বলা হয়েছে। স্বভাবতই বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর অধিক মুনাফা ও বিদেশে রপ্তানির জন্য যে সব চাষ (বাসমতী, স্ট্রবেরি, আলফানসো আম বা আরো অন্য কিছু) বেশী সহায়ক হবে সেগুলোই চাষ করতে কৃষকরা বাধ্য হবেন এবং অতি ফলন ও ফসলের তথাকথিত গুণমান বজায় রাখার জন্য চাষীরা বাধ্য হবেন আরো বেশী বেশি কীটনাশক ও রাসায়নিক সারের ব্যবহার করতে। আর তার ফলে কর্পোরেটিয় চাষ ও বহুজাতিকদের পাহাড় প্রমান মুনাফার জন্য প্রকৃতি পরিবেশের সর্বনাশ বর্তমান হারের থেকেও দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাবে, প্রাণীর বিলুপ্তি হবে লাগামছাড়া, মানুষের রোগভোগ বাড়বে অরো বেশী বেশী করে।
তাই কৃষক সহ সাধারন মানুষের স্বার্থের কথা ভেবেই বিজ্ঞান ও পরিবেশ আন্দোলনের কর্মীদের সর্বাত্মক ভাবে পরিবেশ ধ্বংসকারী নয়া কৃষি আইনের বিরোধিতা করতে হবে। দেশীয় বীজের চাষ ও সংরক্ষণ, রাসায়নিকের পরিবর্তে জৈব সার, কম জল লাগে এবং স্থানীয় পরিবেশের সঙ্গে সহজে মানিয়ে নিতে পারে এমন ধরনের চাষের কথা ভাবতে হবে, ডিপ ও শ্যালোর মাধ্যমে অতিরিক্ত জল না তুলে নদী খাল বিল ও পুকুর দীঘির মত চিরাচরিত জলসেচের বিকল্প পথ সামনে আনতে হবে। চাষীদের সাথে পরিবেশ বান্ধব বিকল্প চাষ আবাদের বিষয়ে আলোচনা করতে হবে ও পুরুষানুক্রমে অর্জিত তাঁদের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে হবে। দাবী উঠুক– কিছু মানুষ বা কর্পোরেটের স্বার্থে প্রাণ প্রকৃতি পরিবেশ ও জমি লুঠ করার কৃষি আইন বাতিল হোক। প্রাণ্তিক চাষী, ক্ষেতমজুর, ভাগচাষী সহ সমস্ত কৃষক ও আম আদমির প্রয়োজন ও স্বার্থের কথা ভেবেই এবং প্রকৃতি পরিবেশকে বাঁচিয়ে কৃষির সংস্কার হোক নয়া তরিখায়।।
লেখক পরিচিতি:
বিজ্ঞান শিক্ষক, বিজ্ঞান ও পরিবেশ কর্মী। Contact: santoshsen66@gmail.com
ভালো লাগলো লেখাটি।