নন্দিনী থেকে গ্রেটা

রবীন্দ্রনাথ যখন বেঁচে ছিলেন তখন তাঁর উপর পরিবেশের প্রভাব এবং তাঁর মৃত্যুর পর অতিক্রান্ত পরবর্তী ৮০ বছরে বিশ্ব উষ্ণায়ণ ও জলবায়ু পরিবর্তন যখন পৃথিবীর উপর এক আগ্রাসী ও ধ্বংসাত্মক প্রভাব ফেলছে, তখন রবীন্দ্রনাথের প্রসঙ্গিকতাই এই নিবন্ধের মূল উপজীব্য।

greata-and-rabindranatha

প্রবীর সেনগুপ্ত

এই নিবন্ধের সময়কাল দুটো পর্বে বিভক্ত।

(১৮৬১ ১৯৪১): রবীন্দ্রনাথের জীবনকাল -৮০ বছর।

 (১৯৪১ ২০২০): রবীন্দ্র মৃত্যু পরবর্তী-৮০ বছর।

রবীন্দ্রনাথ যখন বেঁচে ছিলেন তখন তাঁর উপর পরিবেশের প্রভাব এবং তাঁর মৃত্যুর পর অতিক্রান্ত পরবর্তী ৮০ বছরে বিশ্ব উষ্ণায়ণ ও জলবায়ু পরিবর্তন যখন পৃথিবীর উপর এক আগ্রাসী ও ধ্বংসাত্মক প্রভাব ফেলছে, তখন রবীন্দ্রনাথের প্রসঙ্গিকতাই এই নিবন্ধের মূল উপজীব্য।

 পরিবেশ সংক্রান্ত তথ্যাদি সংরক্ষণ:

১৮৫০ সাল থেকে পৃথিবীর পরিবেশ সংক্রান্ত তথ্যাদি সংরক্ষণ শুরু হয়। সেই তথ্যের ভিত্তিতে দেখা যায় ১৯১০ সাল থেকেই পৃথিবীর গড় উষ্ণতা বেড়ে যাচ্ছে এবং ১৯৩৫-১৯৪৫ এর মধ্যে তা অনেকটাই বেড়ে গেছে ( https://tinyurl.com/y634 lmea)। এর সঙ্গে কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাসের নিঃসরণও ১৯২০-১৯৪০ এর মধ্যে ক্রমশই ঊর্ধ্বগামী হয়ে চলেছিল( https://tinyurl.com/y5hsdst)

রবীন্দ্রনাথের জীবনকালে উষ্ণতা বৃদ্ধি ও কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাসের ক্রমবর্ধমান নিঃসরণের কারণগুলি কী ?

১৭৭০ সালে শিল্প বিপ্লবের সূচনা হয়। ক্রমশ শিল্প-কলকারখানার প্রসার ঘটে। রেলগাড়ি, জাহাজ বিমান, মোটর যানের চলাচল শুরু হয় এবং এদের ব্যবহার ক্রমশ বাড়তে থাকে। জীবাশ্ম জ্বালানির বহুল ব্যবহার শুরু হয় এবং কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাসের নিঃসরণ বাড়তেই থাকে।

ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য ও বাসস্থানের চাহিদা মেটানোর জন্য অরণ্য ধ্বংস করা।

১৯২০থেকে ১৯৪০ সালের মধ্যে পৃথিবীর বহু স্থানে আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ, লাভা ও ছাইয়ের উদগীরণ।

 প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব।

 জীবাশ্ম জ্বালানির ক্রমবর্ধমান ব্যবহার – এইসবই যে উষ্ণতা বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম প্রধান কারণ তা রবীন্দ্রনাথ উপলব্ধি করেছিলেন।

তিনি বললেন-” মানুষ অমিতাচারী। যতদিন সে অরণ্যচর ছিল ততদিন অরণ্যের সঙ্গে পরিপূর্ণ ছিল তার আদান-প্রদান। ক্রমে সে যখন নগরবাসী হলো তখন অরন্যের প্রতি মমত্ববোধ সে হারাল।

তরুলতাকে নির্বিচারে আক্রমণ করলে ইঁটকাঠের বাসস্থান তৈরি করবার জন্য। তার ফলে আবার মরুভূমিকে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ হয়েছে”(অরণ্য দেবতা)।

মানুষ নানা প্রয়োজনে গাছ কেটে কেটে পৃথিবীর ছায়াবস্ত্র হরণ করে তাকে দিতে লাগল নগ্ন করে। তাতে তার বাতাসকে করতে লাগল উত্তপ্ত”

(হলকর্ষণ)।

এই উত্তাপ প্রতিফলিত হল তাঁর গানে। ১৯২০-১৯৪০ সময় কালে পৃথিবীর উষ্ণতা যখন বেড়েই চলেছে, তখন তিনি লিখলেন- হে তাপস তব শুষ্ক কঠোর রূপের গভীর রসে (১৯২২), দারুণ অগ্নিবাণে রে (১৯২২), নাই রস নাই , দারুণ দহনবেলা  (১৯২৬)। মধ্যদিনে যবে গান বন্ধ করে পাখি (১৯২৭)।

চক্ষে আমার তৃষ্ণা (১৯৩৩) সহ আরো বহু গান।

 গান লিখেই তিনি থেমে থাকলেন না। ১৯২৮ এর একুশে জুলাই শান্তিনিকেতনে পালিত হল বৃক্ষরোপণ উৎসব। তিনি বললেন -” লুদ্ধ মানুষ অরণ্যকে    ধ্বংস করে নিজেরাই ক্ষতিকে ডেকে এনেছে। বায়ুকে নির্মল করার ভার যে গাছপালার উপর, যার পত্র ঝরে গিয়ে ভূমিকে উর্বরতা দেয়, তাকেই সে নির্মূল করেছে। আজ অনুতাপ করবার সময় এসেছে। ধরণীর প্রতি কর্তব্য পালনের জন্য, তার ক্ষতবেদনা নিবারনের জন্য আমাদের বৃক্ষরোপনের এই আয়োজন। এই অনুষ্ঠানের ফলে চারিদিকের তরুচ্ছায়া বিস্তৃর্ণ হোক, ফলে শস্যে এই প্রতিবেশ শোভিত আনন্দিত হোক”( অরণ্য দেবতা)।

রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণের পর:

 ১৯৪১-এ চলে গেলেন রবীন্দ্রনাথ। তারপর কেটে গেছে প্রায় আরো আশি বছর। জীবাশ্ম জ্বালানির অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারই বিশ্ব উষ্ণায়নের অন্যতম প্রধান কারণ তাতে কোন দ্বিমত নেই। এ বিষয়ে ১৯২৬ সালে রক্তকরবী নাটকে রবীন্দ্রনাথ আমাদের সচেতন করতে চেয়েছেন।

নন্দিনী- “আচ্ছা রাজা পাতালে সুরঙ্গ খুদে তোমরা যক্ষের ধন বের করে আনছ। কিন্তু যখন তার বুক চিরে মরা হারগুলিকে ঐশ্বর্য বলে ছিনিয়ে নিয়ে আস তখন অন্ধকার থেকে একটা কানা রাক্ষসের অভিসম্পাত বয়ে নিয়ে আস।

রাজা- শাপের কথা জানিনে ,এ জানি যে,আমরা শক্তি নিয়ে আসি।

পরিবেশের বর্তমন সঙ্কট:

হ্যাঁ ,ঠিকই। পাতাল থেকে তুলে আনা জীবাশ্ম জ্বালানি ছাড়া সভ্যতা অচল। সেই সঙ্গে কানা রাক্ষসের অভিসম্পাত হিসাবে কার্বন ডাই -অক্সাইড গ্যাসের ক্রমবর্ধমান পরিমাণ পৃথিবীকে ঠেলে দিয়েছে এক গভীর সংকটে ।

পৃথিবীর জল, বায়ু, মাটি আজ দূষিত। গ্রিন হাউস গ্যাসের মাত্রাতিরিক্ত নিঃসরণ পৃথিবীকে করে তুলছে উষ্ণ থেকে উষ্ণতর। এভাবে চলতে থাকলে মেরু প্রদেশের বরফ গলে চলতি শতাব্দীতেই সমুদ্র জলের উচ্চতা বাড়তে পারে প্রায় সাত ফুট। তলিয়ে যাবে পৃথিবীর বহু দেশ। দেখা দেবে অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি সহ চরমভাবাপন্ন জলবায়ু। দেখা দেবে খাদ্যাভাব। বাসস্থান হারাবে অসংখ্য মানুষ।

 ১৯৫১ সাল থেকে এল আর এক সর্বনাশা পণ্য- প্লাস্টিক। ব্যবহৃত প্লাস্টিকের আশি শতাংশই মহাসাগরগুলিতে সঞ্চিত হয়ে একসময় পরিণত হচ্ছে মাইক্রোপ্লাস্টিকে। দূষিত করছে সমুদ্র জলকে। খাদ্য শৃংখলের  মধ্য দিয়ে তা সংক্রমিত করছে মানুষকে। বেড়ে যাচ্ছে ক্যান্সার সহ নানা দুরারোগ্য রোগ। ধ্বংস হচ্ছে নানা সামুদ্রিক প্রাণী, উপকারী অণুজীব।

 রবীন্দ্রনাথ বুঝতে পেরেছিলেন মানুষের সভত্যা  প্রকৃতিকে অগ্রাহ্য করে যেভাবে এগিয়ে চলছে তাতে বিপদ অনিবার্য। “বর্তমানে আমরা সভ্যতার যে প্রবণতা দেখে দেখি তাতে বোঝা যায় যে,সে ক্রমশই প্রকৃতির সহজ নিয়ম পেরিয়ে বহুদূর চলে যাচ্ছে।  প্রকৃতিকে অতিক্রমণ কিছুদূর পর্যন্ত সয়, তারপরে আসে বিনাশের পালা” ( উপেক্ষিত পল্লী)।

  আজ সামান্য একটিমাত্র ভাইরাসের  সামনে পৃথিবীর রাষ্ট্রপ্রধানদের গর্ব অহংকার স্তব্ধ। অথচ কিছুদিন আগেও অধিকাংশ রাষ্ট্রপ্রধানরা পৃথিবীর চরম সংকটে ছিলেন নির্বিকার। পৃথিবীর রাজা ও রাষ্ট্রপ্রধানদের এই ঔদ্ধত্য অবশ্য নতুন নয়।  এর বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ দৌহিত্রী নন্দিনীর নামে সৃষ্টি করলেন এক নারী চরিত্র। তিনি রুখে দাঁড়ালেন ক্ষমতালোভী রাজার বিরুদ্ধে।

   রক্তকরবী প্রকাশিত হবার  ৯৫ বছর পর নন্দিনীর প্রতিরূপ হিসাবে আবির্ভূত হলেন গ্রেটা থুনবার্গ। যিনি ক্ষমতালোভী রাষ্ট্রপ্রধানদের দিকে ছুঁড়ে দিলেন এক অমোঘ প্রশ্ন – তোমাদের তৈরি এই মৃত্যু উপত্যকায়  আমাদের বাস করতে বাধ্য করছো কেন? কেন? গ্রেটার  আহ্বানে সাড়া দিয়েছেন  সচেতন মানুষ। সাফল্যও আসবে নিশ্চিত। কেন আসবে তাও জেনেছি রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকেই – ” মানুষ আপন সভ্যতাকে যখন অভ্রভেদী করে তুলতে থাকে তখন জয়ের স্পর্ধায় বস্তুর লোভে ভুলতে থাকে যে সীমার নিয়মের দ্বারা তার অভ্যুত্থান পরিমিত। সেই সীমায় সৌন্দর্য। সেই সীমায় কল্যান। সেই যথোচিত সীমার  বিরুদ্ধে নিরতিশয় ঔদ্ধত্যকে বিশ্ববিধান কখনোই ক্ষমা করেনা। প্রায় সকল সভ্যতার অবশেষে এসে পড়ে এই ঔদ্ধত্য। আর নিয়ে আসে বিনাশ” (উপেক্ষিত পল্লী)। আমরা জানি ঔদ্ধত্য ও  ক্ষমতার বিনাশ ঘটবে। পৃথিবী দূষণমুক্ত হবে। সেই দূষণমুক্ত পৃথিবীতে জন্ম নেবে নবজাতকরা। যারা গাছের সঙ্গে, ফুলের সঙ্গে, পাখির সঙ্গে হেসে খেলে বড় হয়ে উঠবে। আর তখনই নীল আকাশে রবির কিরণে ধ্বনিত হবে আর এক রবির গান-” তখন কে বলে গো সেই প্রভাতে নেই আমি।”

1 thought on “নন্দিনী থেকে গ্রেটা”

  1. সান্তোষ সেন।

    লেখাটি বেশ প্রণিধানযোগ্য ও মনোমুগ্ধকর। পরের সংখ্যার জন্য লেখা চায়।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top