সন্তোষ সেন
ভারতের প্রাচীনতম পর্বতশ্রেণীগুলির মধ্যে আরাবল্লী পর্বতশ্রেণী বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। প্রায় ৩.৫ থেকে ৪ বিলিয়ন বছর আগে গঠিত এই পর্বতশ্রেণী উত্তর-পশ্চিম ভারতের গুজরাট থেকে শুরু করে রাজস্থান, হরিয়ানা হয়ে দিল্লি পর্যন্ত বিস্তৃত। বয়সের দিক থেকে হিমালয়ের তুলনায় অনেক প্রাচীন হলেও পরিবেশগত গুরুত্বের দিক থেকে আরাবল্লীর ভূমিকা আজও অপরিসীম। এই পর্বতশ্রেণী একদিকে যেমন মরুকরণের অগ্রগতি রোধ করে, অন্যদিকে তেমনি জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও জলচক্র নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
আরাবল্লী অঞ্চলের বাস্তুতন্ত্র প্রধানত শুষ্ক ও অর্ধ-শুষ্ক প্রকৃতির। এখানে শুষ্ক পর্ণমোচী বন, কাঁটাযুক্ত ঝোপঝাড়, তৃণভূমি এবং শিলাময় পাহাড়ি পরিবেশ একসঙ্গে বিদ্যমান। অল্প বৃষ্টিপাত ও দীর্ঘ শুষ্ক মৌসুমের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া এই বাস্তুতন্ত্র মাটি সংরক্ষণ ও পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। বিশেষ করে কাঁটাযুক্ত বনভূমি ও তৃণভূমি মরুকরণ প্রতিরোধে কার্যকর প্রাকৃতিক বাধা হিসেবে কাজ করে।
আরাবল্লী পর্বতশ্রেণীর উদ্ভিদজগৎ বৈচিত্র্যময় ও পরিবেশের সঙ্গে সুসমন্বিত। এখানে ধাও, খেজুর, বাবুল, নীম, পালাশ ও বেলের মতো গাছ প্রচুর পরিমাণে দেখা যায়। এই উদ্ভিদগুলি খরা সহনশীল এবং অল্প জলেই টিকে থাকতে সক্ষম। এছাড়াও গুলঞ্চ, অশ্বগন্ধা, ও সাফেদ মুসলির মতো বহু ঔষধি উদ্ভিদ এই অঞ্চলে জন্মায়, যা স্থানীয় মানুষের জীবনযাপন ও ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসা ব্যবস্থার সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত।
প্রাণিজগতের দিক থেকেও আরাবল্লী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই অঞ্চলে চিতল, সাম্বর হরিণ, নীলগাই, চিতা বিড়াল, শিয়াল, হায়েনা ও নেকড়ের মতো স্তন্যপায়ী প্রাণী দেখা যায়। একসময় চিতা এখানে বিচরণ করলেও বর্তমানে তা বিলুপ্ত। পাখিজগতে ময়ূর, ঈগল, শকুন, বাজপাখি, বাবুই পাখি ও বিভিন্ন পরিযায়ী পাখির উপস্থিতি আরাবল্লীর জীববৈচিত্র্যকে আরও সমৃদ্ধ করেছে। পাশাপাশি সাপ, গিরগিটি ও অন্যান্য সরীসৃপও এই বাস্তুতন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
আরাবল্লী পর্বতশ্রেণী জলসম্পদ সংরক্ষণে এক অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে। বর্ষার জল ধারণ করে এই পাহাড় ভূগর্ভস্থ জলকে পুনরায় সঞ্চিত করতে প্রভূত ভূমিকা পালন করে। লুনি, বানাস ও সবরমতীর মতো একাধিক নদীর উৎস এই পর্বতশ্রেণীতে অবস্থিত। ফলে আরাবল্লী না থাকলে থর মরুভূমির বিস্তার আরও দ্রুত পূর্ব দিকে অগ্রসর হত এবং উত্তর ভারতের জলসংকট তীব্র থেকে তীব্রতর হত।
মানব সমাজের সঙ্গেও আরাবল্লীর সম্পর্ক গভীর। ভীল, মিনা ও গরাসিয়া প্রভৃতি আদিবাসী জনগোষ্ঠী যুগ যুগ ধরে এই অঞ্চলের বন ও প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর নির্ভর করে জীবনযাপন করে আসছে। তাঁদের জীবনধারা মূলত কৃষি, পশুপালন ও বনজ সম্পদের টেকসই ব্যবহারের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে, যা প্রকৃতির সঙ্গে সহাবস্থানের এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
তবে দুঃখজনকভাবে, আজ আরাবল্লী পর্বতশ্রেণী নানা সংকটের মুখোমুখি। অবৈধ খনন, নির্বিচার বন উজাড়, দ্রুত নগরায়ণ ও শিল্পায়নের ফলে এই প্রাচীন পর্বতশ্রেণীর জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশগত ভারসাম্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এর ফলস্বরূপ জলস্তর নেমে যাচ্ছে, তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং বহু প্রাণী ও উদ্ভিদ প্রজাতি বিলুপ্তির পথে এগিয়ে যাচ্ছে।
আরাবল্লীর মাটির গভীরে থরে থরে সাজানো আছে নানান রকমের উৎকৃষ্ট ধাতব ও অন্যান্য খনিজ। কর্পোরেট বাহিনীর কাছে এইসব খনিজ মহা মূল্যবান। ওদের চাই সাত রাজার ধণ মানিক। মাটির গভীর গহীনে লুকিয়ে থাকা এইসব খনিজ চাই ওদের ব্যবসা বাণিজ্য বাজার ও মুনাফার জন্য। ওদের চাওয়াটাই শেষ কথা। তার যোগানের ব্যবস্থা কোন্ পথে হচ্ছে, তা বোঝার আগে একঝলকে দেখে নেওয়া যাক আরাবল্লীর মৃত সম্পদের ভান্ডার।
তামা : প্রাচীনকাল থেকেই আরাবল্লীর তামার খনন পরিচিত; বিশেষ করে Khetri ও আশপাশের অঞ্চলগুলোতে।
সীসা ও জিঙ্ক : দক্ষিণ আরাবল্লী অঞ্চলে, বিশেষ করে রাজপুরা-দারিবা, রামপুরা-অগিচা, ইত্যাদি অঞ্চলে বড় মাপের সীসা-জিঙ্ক বেল্ট আছে।
লোহা ও অন্যান্য বেস-মেটাল : আরাবল্লীর কুয়াচিত্রে আয়রন, সিলভার-সহ অন্যান্য ধাতুর উপস্থিতি নথিভুক্ত আছে।
সোনা : আরাবল্লী বান্দর অঞ্চলের কিছু সেকশনে স্বল্প/বিস্তৃত সোনার সন্ধানও পাওয়া গেছে। তাছাড়া সাম্প্রতিক জরিপে ইউরেনিয়াম ও থোরিয়াম এর মতো পারমাণবিক খনিজের কিছু উপস্থিতি রেকর্ড করা হয়েছে।
এসবের পাশাপাশি সর্বাধিক পরিচিত শিল্প উপযোগী অধাতব খনিজ সম্ভার। যেমন –মার্বেল, গ্রানাইট, স্যান্ডস্টোনের জন্য আরাবল্লী রেঞ্জ বিখ্যাত। এবং সিমেন্ট ও রত্ন শিল্পের কাঁচামাল –চুনাপাথর, ডোলোমাইট, জিপসাম, ওলাস্টোনাইট, কোয়ার্টজ, গারনেট, করান্ডাম, কায়ানাইট, স্টিয়াটাইট, ট্যালক/ সোপস্টোন, বেন্টোনাইট ইত্যাদি খনিজ রয়েছে প্রচুর পরিমাণে। পুঁজির কালচক্রে এটাই আরাবল্লী পাহাড়, জঙ্গল ও স্থানীয় মানুষের চরম দুর্ভাগ্য।
তাই আগের থেকে ধ্বংস প্রক্রিয়া চালিয়ে যাওয়ার কারণে আরাবল্লীর মৃতপ্রায় শরীরে শেষ পেরেকটি গেঁথে দিতে আদাজল খেয়ে কোমর বেঁধে নেমে পড়েছে কর্পোরেট বাহিনী ও তাদের সেবাদাস কেন্দ্রীয় সরকার। তাদের যুক্তি –দেশের উন্নয়নের স্বার্থে, জনগণের বিকাশের স্বার্থে কিছু না কিছু বলি তো দিতেই হয়। এখানে না হয় একটু বেশিই হয়ে গেছে। একটা গোটা পাহাড়, এই আর কী? ৬৭০ কিলোমিটার বিস্তৃত দেশের প্রাচীনতম পর্বতমালাটাই কর্পোরেটের ভোগে চলে গেল। চারটে বিশাল রাজ্যকে পাঁচিলের মত আগলে রাখা আরাবল্লী খনি-মাফিয়াদের পকেটে ঢুকে গেছে কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক পাহাড় পর্বতের নতুন সংজ্ঞার উপর আদালত সিলমোহর দেওয়ায়। রাজামশাই বলেছেন, পাহাড় জঙ্গল নদী বলিপ্রদত্ত হলে ‘আচ্ছেদিন’ হুড়মুড় করে আছড়ে পড়বে গণ দুয়ারে। পাহাড় ধূলিসাৎ করে দাও, জঙ্গল উচ্ছেদ করো। বন্যপ্রাণ তো কোন্ ছার, আদিবাসী জনগণ সহ একটা গোটা মানব সমাজকে পিষে মারো। ন্যায়াধীশ ও রাজামশায়ের কাছে আমাদের বিনীত জিজ্ঞাসা, মানব সমাজটাই বিলুপ্ত হয়ে গেলে আপনাদের উন্নয়নের ফলে ভোগ করবে কে?
রাজস্থানের আরাবল্লী গায়েব করে খনি বানানোর কয়েক হাজার কোটির বরাত আগের থেকেই দেওয়া আছে অস্ট্রেলিয়ার কোম্পানি আইএসএল’কে। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে তারা কাজ শুরুর ছাড়পত্তর পেল এই আর কী?
আনুমানিক কয়েকলক্ষ কোটি টাকার খনিজ নিজের গর্ভে লুকিয়ে রাখা আরাবল্লীর ফাঁসির হুকুম হয়েছে। হিসেব বরাবর।
কীভাবে এই ম্যাজিক ক্রিয়া সম্পন্ন হইল?
নতুন সংজ্ঞা অনুসারে স্থানীয় ভূপৃষ্ঠ থেকে ১০০ মিটারের কম উচ্চতা হলে সেই পাহাড় বা টিলাকে নাকি আর পর্বত বলা যাবে না। লে হালুয়া! এতদিন জানতাম পাহাড়ের উচ্চতা মাপা হয় সমুদ্রতল থেকে। মামদোবাজি নাকি? এতকিছু নিয়মনীতি মানতে হলে উন্নয়ন মার খাবে না? অতএব, নতুন করে ভূপ্রকৃতির ইতিহাস রচনা করো। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৮০ মিটার উচ্চতার রাজস্থানের কোনও টিলার উচ্চতা যদি স্থানীয় ভূপৃষ্ঠ থেকে ৯৯ মিটারও হয়, তবে তা আর পাহাড় বলে গণ্য হবেনা। তাকে অবলীলায় গুঁড়িয়ে উন্নয়নের রথ ছুটিয়ে দেওয়া যাবে।
উন্নয়নের বুলডোজারে শুধু রাজস্থানেই গুঁড়িয়ে দেওয়া যাবে ১১,০০০ টিলা। ফলাফল? আরাবল্লী পর্বতমালা বলে কিছু আর অবশিষ্ট থাকবে না। যে কটি পাহাড় বা টিলা স্থানীয় ভূ-পৃষ্ঠ থেকে ১০০ মিটারের বেশি উঁচু কেবল সেগুলোই কিছুদিন কোনক্রমে টিকে থাকবে। মাঝের প্রায় ৯০% টিলা খুবলে খাবে উন্নয়ন আর খনিমাফিয়ারা। খনিজ তুলবে অস্ট্রেলিয়া, কানাডার কোম্পানি। আর কাটমানি ঢুকবে সরকারী নেতাদের পকেটে। সাথে রাজস্থানের মরুভূমির বালি, কচ্ছের ধুলো দমবন্ধ করে দেবে দিল্লি, হরিয়ানা, রাজস্থান, গুজরাতের কোটি কোটি শিশু, বৃদ্ধের। তাতে কী? দেশের জিডিপি তো বাড়বে নাকি? জিডিপির চরণামৃত খেয়ে বেঁচে থাকবে দেশের আপামর জনগণ।
আসলে, নয়া উদারবাদী অর্থনীতির যুগে ফাটকা পুঁজির ফানুস যাতে ফেটে না পড়ে, তারজন্যই এত আয়োজন। বাজার নির্ভর অর্থ-পুঁজির নতুন বিনিয়োগের জায়গা, আরো ব্যবসা, অধিকতর লাভের ব্যবস্থা করে দিতেই সুবিস্তৃত হিমালয় পর্বতরাজির সাড়ে সব্বনাশ করে এবার হাত পড়েছে মানবসভ্যতার আর এক প্রাণকেন্দ্র আরাবল্লীর উপর। পুঁজির রক্তে লেগেছে ধ্বংসের নেশা। ভাঙো, গুঁড়িয়ে দাও, লুঠপাট করে মুনাফার পাহাড় গড়ে তোলো, এই নীতি নিয়েই চলেছে বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার ও তাদের সাঙ্গপাঙ্গরা। আর বাধা দিলে লাঠি, গুলি, বন্দুক, বেয়নেট, জেল হেফাজত তো আছেই। জল, জঙ্গল, নদী, পাহাড় লুঠ করে চলা নেতারা আজ দেশপ্রেমিক, দেশদেবক। আর প্রকৃতি বাঁচানোর লড়াইয়ে এগিয়ে এলে তাঁরা দেশদ্রোহী?
ভুলে গেলে চলবে না, আরাবল্লী পর্বতশ্রেণী কেবল একটি ভৌগোলিক গঠন নয়; এটি উত্তর-পশ্চিম ভারতের পরিবেশগত মেরুদণ্ড। এর জীববৈচিত্র্য ও বাস্তুতন্ত্র রক্ষা করা মানে জলবায়ু, মানবসভ্যতা ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অস্তিত্ব রক্ষা করা। তাই আরাবল্লী সংরক্ষণ আজ শুধু একটি পরিবেশগত প্রয়োজন নয়, বরং একটি জাতীয় দায়িত্ব। এই দায়িত্ব পালনে ঐতিহাসিক ভূমিকা গ্রহণে ব্যর্থ হলে পরবর্তী প্রজন্ম আমাদের ক্ষমা করবে না। আমাদের দিকে আঙুল তুলে বলবে –কোথায় ছিল তোমাদের গণতান্ত্রিক চেতনা, কোথায় ছিল তোমাদের প্রগতিশীল ভূমিকা? সমাজ প্রকৃতি পরিবেশ থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে কোন্ মহান কাজ তোমরা করেছ এযাবৎ কাল? শুধুই ধূ ধূ মরুভূমি, ধূলো ধোঁয়া, বালি, আর দূষণ জর্জরিত আকাশ বাতাস? এ বাতাসে আমরা শ্বাস নিতে পারিনা। আমাদের দমবন্ধ হয়ে আসছে। এখানে জল নেই। তেষ্টায় আমাদের গলা শুকিয়ে কাঠ। সবুজ বনানী নেই, ফল নেই, ফুল নেই, পাখি নেই। নেই আর নেই আর জগতে খনিজ চিবিয়ে কি আমরা বেঁচে থাকতে পারি?





