জঙ্গলের গোপন জীবন

পোস্টটি দেখেছেন: 32 প্রীতিলতা বিশ্বাস মানব সভ্যতার বর্তমান ইতিহাস বলে, মানুষ কৃষিকাজ শিখেছে আজ থেকে অন্তত বারো হাজার বছর আগে। গম, যব, ধান, ভুট্টা ইত্যাদি আজকের যে কোন শস্যই ক্রমাগত বীজ সংরক্ষণ ও রোপনের ফলে প্রাকৃতিক নির্বাচনে বুনো শস্য থেকে গৃহপালিত শস্যে পরিণত হয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় গাছের জন্ম, বৃদ্ধি, ফুল-ফল ও মৃত্যু সম্পর্কে মানুষের এক […]

প্রীতিলতা বিশ্বাস

মানব সভ্যতার বর্তমান ইতিহাস বলে, মানুষ কৃষিকাজ শিখেছে আজ থেকে অন্তত বারো হাজার বছর আগে। গম, যব, ধান, ভুট্টা ইত্যাদি আজকের যে কোন শস্যই ক্রমাগত বীজ সংরক্ষণ ও রোপনের ফলে প্রাকৃতিক নির্বাচনে বুনো শস্য থেকে গৃহপালিত শস্যে পরিণত হয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় গাছের জন্ম, বৃদ্ধি, ফুল-ফল ও মৃত্যু সম্পর্কে মানুষের এক পরম্পরাগত জ্ঞান সঞ্চিত আছে। প্রাচীন পুঁথিতে রয়ে গেছে যার কিছু প্রমাণ। অষ্টাদশ শতক থেকে মানুষের জ্ঞানচর্চায় পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োগ শুরু হয়। গাছের গঠনতন্ত্র ও জীবনচক্র সংক্রান্ত বিষয়ে ফলিত বিজ্ঞান যখন অনেকটাই জেনেছে, সেইরকম একটা সময়ে বিংশ শতকের একদম শুরুতেই স্যার জগদীশ চন্দ্র বোস বললেন, গাছেরও জীবন আছে। বিশ্ব চমকিত হল। কী ছিল তার বক্তব্য? তাঁর লেখা থেকেই জেনে নিই।

“……এই যে গাছগুলি কোন কথা বলে না, ইহাদের যে আবার একটা জীবন আছে, আমাদের মত আহার করে, দিন দিন বাড়ে, আগে এসব কিছুই জানিতাম না। এখন বুঝিতে পারিতেছি। এখন ইহাদের মধ্যেও আমাদের মত অভাব, দুঃখ-কষ্ট দেখিতে পাই। জীবনধারণ করিবার জন্য ইহাদিগকেও সর্বদা ব্যস্ত থাকিতে হয়। কষ্টে পড়িয়া ইহাদের মধ্যেও কেহ কেহ চুরি ডাকাতি করে। মানুষের মধ্যে যেরূপ সদগুণ আছে ইহাদের মধ্যেও তাহার কিছু কিছু দেখা যায়। বৃক্ষদের মধ্যে একে অন্যকে সাহায্য করিতে দেখা যায়, ইহাদের মধ্যে একের সহিত অন্যের বন্ধুতা হয়। তারপর মানুষের সর্বোচ্চ গুণ যে স্বার্থত্যাগ, গাছের মধ্যেও তা দেখা যায়। মা নিজের জীবন দিয়ে সন্তানের জীবন রক্ষা করেন। সন্তানের জন্য নিজের জীবন-দান গাছের মধ্যে সচরাচর দেখা যায়। গাছের জীবন মানুষের জীবনের ছায়ামাত্র”।

অর্থাৎ গাছের জন্ম-মৃত্যু সম্পর্কে জানা থাকলেও তাদের জীবনে যে একপ্রকার  যূথবদ্ধতা আছে, খিদে-তৃষ্ণা, দুঃখ-কষ্টের অনুভূতি আছে, আছে সহযোগিতা ও স্বার্থত্যাগ—এই জ্ঞানের আলো প্রথম দিলেন জগদীশ চন্দ্র বোস। তাঁর গবেষণার প্রায় ১২০ বছর বাদে আজকের বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষায় আরো দৃঢ় ভাবে বিষয়গুলি প্রতিষ্ঠিত। খালি চোখে আমাদের কাছে গাছেদের এই গোপন জীবন খুব একটা দৃশ্যমান হয় না। আর হয় না বলেই বোধহয় আমরা বেশিরভাগ সময় তাদের এই জীবন সম্পর্কে উদাসীন থেকে যাই। এই লেখায় জঙ্গল তথা গাছের গোপন জীবন সম্পর্কে কিছু জানার চেষ্টা করব।

বন্ধুতা, কথা-বার্তা ও নিরাপত্তা:

আফ্রিকার সাভানা অঞ্চলে অ্যাকাকিয়া গাছের জঙ্গলে জিরাফ তার লম্বা গলা দিয়ে অ্যাকাকিয়ার ছাতার মত বিস্তৃত পত্ররাজি খেতে বেশ পছন্দ করে। কিন্তু অ্যাকাকিয়ার বিষয়টি মোটেই পছন্দ নয়। তাই যে মুহূর্তে জিরাফ পাতা খেতে শুরু করে অমনি অ্যাকাকিয়া তার পাতায় বিষাক্ত পদার্থ পাম্প করে জিরাফকে বলে—দূর হটো। আর তার আশেপাশের অ্যাকাকিয়াদের সতর্ক করার জন্য বাতাসে ইথিলিন গ্যাস ছড়িয়ে বলে দেয়—সাবধান, বিপদ শিয়রে। মুস্কিল হল তার এই বার্তা ১০০ ইয়ার্ডের বেশি যেতে পারে না, তাও বাতাসের সাহায্য দরকার হয়। জিরাফেরও জানা আছে বিষয়টি। তাই সে বিষের হাত থেকে বাঁচার জন্য ১০০ ইয়ার্ডের বেশি সরে গিয়ে পাতা খেতে শুরু করে। আবার সেখানেও তাড়া খায়। তাই কখনও কখনও হাওয়ার উল্টোদিকে হাঁটা লাগায়।

হাওয়ার উপর শুধুমাত্র ভরসা করা চলে না। জঙ্গলে তাই যোগাযোগের অন্য একটি মাধ্যম আছে। এটি মাটির নিচে প্রায় ফাইবার-অপটিক কেবলসের মত আচরণ করে সংবাদ দেওয়া নেওয়ার ক্ষেত্রে। ভ্যাঙ্কোভারের ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলম্বিয়ার বিজ্ঞানী সুজানে সিমার্ড নব্বই-এর দশকে দেখান যে মাটির নিচে মাইকোরিজিয়া নামক এক প্রকার মিথোজীবী ছত্রাক একই প্রজাতির এবং ভিন্ন প্রজাতির মূলাত্রের মধ্যে সংযোগ সাধন করে। দীর্ঘ জালিকাকারে বিস্তৃত এই যোগযোগ ব্যবস্থাকে তিনি নাম দেন—”উড ওয়াইড ওয়েব”। গাছ মাটির উপরে যতটা বিস্তৃত হয়, মাটির নিচে হয় তার থেকে অনেক বেশি। তাই আক্রান্ত হলে পাশের গাছের কাছে খবর মাটির নিচ দিয়ে তাড়াতাড়ি পৌঁছোয়। সব থেকে মজার জিনিস হল গাছ তার শত্রুদের খুব নির্দিষ্ট ভাবে চেনে। গায়ে ঠিক কোন্ পোকাটা বসে কামড়াচ্ছে তা তারা অনায়াসে বুঝতে পারে, কারণ ভিন্ন ভিন্ন পোকার লালারস ভিন্ন হয়। তাই আক্রান্ত হলে খবরও সেইভাবেই পাঠায়, যাতে অন্যরা সঠিক পদক্ষেপটি নিতে পারে। বিভিন্ন শত্রুকে ঘায়েল করার উপায়ও যে বিভিন্ন।

জঙ্গলে একই প্রজাতির বৃক্ষের নিচে অনেক ছোট চারা গাছ দেখতে পাওয়া যায়। আসলে ওরা ঐ বৃক্ষ মায়ের সন্তান। বৃক্ষ মায়ের পত্ররাজি এত বিস্তৃত থাকে যে চারা গাছগুলিতে ভালোভাবে সূর্যের আলো পৌঁছোয় না। এই অবস্থায় মনে হতে পারে সালোসংশ্লেষের ফলে শর্করা উৎপাদনের হার বড় গাছের পাতায় বেশি হবে আর চারা গাছে কম হবে। কিন্তু একই প্রজাতির সব গাছের পাতায় শর্করা উৎপাদনের হার সমান থাকে। এই সমতা তৈরী হয় ছত্রাকের ঐ উড- ওয়েবের জন্য। বৃক্ষ মা তার তৈরী অতিরিক্ত শর্করা পাঠায় চারা গাছগুলিতে। অনেক সময় এই সহযোগিতা দুটি ভিন্ন প্রজাতির গাছের মধ্যেও দেখা যায়। যেমন শীত প্রধান অঞ্চলে জন্মানো বির্চ (birch) এবং ফার গাছের মধ্যে প্রয়োজনীয় পুষ্টিগুণের আদান-প্রদান হয় উড ওয়েবের মাধ্যমে।

উড ওয়ে

স্মৃতি :

এই যে বললাম পোকাদের লালারস গাছ চিনে রাখে অর্থাৎ একবার তিক্ত অভিজ্ঞতা হলে পরেই তাকে চিনে মনে রেখে দেয়। তেমন মাটির নিচ দিয়ে মূল যখন অগ্রসর হয় তখনও তার নিজের প্রজাতিকে সে খুব ভালো করে চিনতে পারে। আবার অন্যদেরও চিনে মনে রাখে। বন্ধুত্বটা এক একজনের সঙ্গে বেশি হয়। যেমন একই জঙ্গলে ফার, বির্চ, স্প্রুস পাশাপাশি থাকলেও খাদ্যগুণ আদান-প্রদান হয় ফার আর বির্চের মধ্যে।

অস্ট্রেলিয়ার বিজ্ঞানী মনিকা গ্যাগলিও মিমোসাস, যাকে আমরা লজ্জাবতী বলে চিনি, তাই নিয়ে পরীক্ষা করে দেখেন—এক ফোঁটা জল একবার পড়লেই পাতা বুজে যায়, কিন্তু ফোঁটা ফোঁটা করে জল যখন পড়তেই থাকে তখন সে অভ্যস্ত হয়ে যায়, বোঝে কোন বিপদ নেই, তাই আর গুটিয়ে যায় না। এক সপ্তাহ পরে ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলে সে বিষয়টি মনে রাখে ও একই আচরণ করে।

গাছের চিনে রাখার দরকার হয় আরও একটা কারণে। সন্তান জন্ম দেবার জন্য। প্রকৃতির প্রায় আশি শতাংশ গাছের একই ফুলেই পুংকেশর ও গর্ভাশয় থাকে। আর এ দুটির মিলনের ফলেই জন্ম নেয় নতুন গাছের বীজ। এই কাজে গাছকে সাহায্য করে বন্ধু পোকা, যেমন মৌমাছি, ভ্রমর, বোলতা ইত্যাদি আবার কখনো বাতাস। কিন্তু একই ফুলের বা একই গাছের অন্য ফুলের মধ্যে এই মিলন ঘটুক গাছ তা মোটেই চায় না। কারণ সেক্ষেত্রে জিনের মিউটেশনে টেকসই উপাদান কমে যাবার বা নষ্ট হবার সম্ভাবনা। এই সম্ভাবনাকে রোধ করার জন্য গাছ কিছু পন্থা অবলম্বন করে। কিছু প্রজাতির মধ্যে একই গাছের ফুলে পুংকেশর ও গর্ভাশয় পরিণত হয় ভিন্ন সময়ে। তাই মিলন নিশ্চিত হয় ঐ প্রজাতির অন্য গাছের ফুলের সঙ্গে। আর কিছু প্রজাতি নিজের জিনকে চিনে রাখে। যদি নিজের গাছের ফুলের মধ্যে পরাগ সংযোগের উপক্রম হয়, তাহলে তা বুঝে নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে রাস্তা বন্ধ করে দেয়।

অবাক জলপান:

গাছের জলপানের বিষয়টি অবাক করার মতই। মাটি থেকে জল মাধ্যাকর্ষণের বিপরীতে উপরে উঠে পাতায় পৌঁছায়, অনেক ক্ষেত্রেই একশ মিটার বা তারও সামান্য বেশি উচ্চতায়। এই জলে দ্রবিভূত অবস্থায় থাকে বিভিন্ন খাদ্যগুণ। মূল মাটি থেকে যে জল শোষণ করে তার  একটা বিশেষ কায়দা আছে, যাকে বলে ওসমোসিস। আর দিনের বেলায় রোদে বেরিয়ে গরম লাগলে আমরা যেমন ঘেমে যাই, পাতাও তেমন রোদে ঘেমে যায়, আর পাতার ছিদ্র দিয়ে জলকণা বাষ্পীভূত হয়। একে বলে ট্রান্সপিরেশন। মূল থেকে পাতা পর্যন্ত জল পৌঁছানোর কাজটা হয় জাইলেম কলা নামক গাছের একধরণের মৃতকোষ দিয়ে তৈরী নলের মাধ্যমে। পাতা গরম হলে যেই ট্রান্সপিরেশনের মাধ্যমে একটা জলের কণা বার করে অমনি তার টানে পর পর জলকণা উঠে আসে আর বেরিয়ে যায়। জলকণার এই টানকে কোহেশন ফোর্স বা সংহতি বল বলা যেতে পারে। গাছের জাইলেম কলা ঠিক যেন একটা স্ট্র-এর মত কাজ করে। গাছের ভিতরে জলের এই প্রবাহে তৈরী হওয়া শব্দতরঙ্গকে বিজ্ঞানীরা বিশেষ যন্ত্রের সাহায্যে ধরেছেন। যা আসলে একপ্রকার আল্ট্রাসোনিক সাউন্ড বা উচ্চ কম্পাকের শব্দ, সাধারণভাবে যা শোনা মানুষের পক্ষে কিছুতেই সম্ভব নয়। মজার বিষয় হল, রাত্রে যখন কোন ট্রান্সপিরেশন নেই, গাছের রান্নাঘরও বন্ধ, তখনও এক মৃদু শব্দতরঙ্গ ধরা পড়ে। বিজ্ঞানীদের ধারণা কার্বন ডাই অক্সাইডের ক্ষুদ্র বুদবুদ এর উৎস। তাহলে প্রশ্ন আসে জলকণার পরস্পরের মধ্যে কোহেশন বা সংহতি বলের কী হবে। ভবিষ্যতে হয়ত আরও পরিষ্কার করে জানতে পারা যাবে এর উত্তর।

তবে প্রচন্ড খরায় মাটিতে যখন জলের অভাব হয়, তৃষ্ণার্ত গাছের জলতরঙ্গের ধ্বনি তখন পাল্টে যায়। উচ্চ কম্পাঙ্কের সেই শব্দকে গাছের বিশেষ অভিব্যক্তি হিসাবে মানতে নারাজ বিজ্ঞানীরা। তারা মনে করেন জলের অভাবে কান্ডে একধরনের কম্পন অনুভূত হয়। এই শব্দ তারই বহিঃপ্রকাশ, সম্ভবত পার্শ্ববর্তী গাছের জন্য কোন সংকেত নয়। এ ক্ষেত্রেও নিশ্চিত উত্তর এখনও পাওয়া যায় নি।

 বৃদ্ধ তাত:

পৃথিবীর বুকে জীবন্ত বৃদ্ধ গাছটির বয়স নয় হাজার পাঁচশ পঞ্চাশ বছর। একটি স্প্রুস গাছ। দেখে মোটেই খুব বয়স্ক বলে মনে হয়না। এনাদের পরিবারে আরও অনেক বয়স্করা আছেন। কুড়িজন আছেন যাদের বয়স আট হাজারের আশেপাশে, কেউ আছেন নয় হাজার বছরের। একজনের বয়স সাড়ে পাঁচ হাজারের একটু বেশি। সকলেই থাকেন সুইডেনের ডালারনা প্রদেশে। পৃথিবীর উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া হাজারো প্রাকৃতিক ঝঞ্ঝা, মানুষের খাদ্য-সংগ্রাহক থেকে খাদ্য-উৎপাদক হয়ে ওঠা, এমনকি মানুষের আজকের বিধ্বংসি রূপ—এসবেরই তারা নীরব সাক্ষী। কীভাবে সম্ভব এই দীর্ঘ জীবন? Coppicing বলে একটি বিষয় আছে। কিছু গাছের কান্ড গোড়া থেকে কেটে দিলে কিছুদিনের মধ্যে পাশ থেকে মূল আবার একটি কান্ড বার করে দেয়, তখন সেটি বড় হতে থাকে। এই বিষয়টি ক্রমাগত হতে থাকে। তাই মাটির উপরের অংশটি নবীন হলেও মাটির নিচের অংশের “কার্বন-১৪ আইসোটোপ” পরীক্ষার মাধ্যমে প্রাচীনতা বিষয়ে জানতে পারা গেছে। গাছের মূলেই সঞ্চিত আছে হাজার হাজার বছরের কাহিনী। গাছের মূল সব রকমের রাসায়নিক আদান-প্রদানের সিদ্ধান্ত নেয়, মাটির নিচে তার গতিপথ তৈরি করে, পরিবর্তিত পরিস্থিতি মোকাবিলার পদ্ধতি বার করে। অর্থাৎ মূল অনেকটাই গাছের মস্তিস্কের মত কাজ করে। বিজ্ঞানীদের কাছে এটা এখন অনেকটা গ্রহনযোগ্য বিষয়, যদিও প্রতিষ্ঠিত বলা যাবে না, গবেষণা চলছে। তবে ২০০৮ সালে এই প্রাচীন স্প্রুসেদের কথা জানার পর বিজ্ঞানীরা ভাবছেন পৃথিবীর জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত গবেষণার বিষয়ে এরা বিশেষ সাহায্য করতে পারে।

একতাই শক্তি:

জঙ্গলের জীবনে গাছেরা যেমন নিজের খিদে-তেষ্টা মেটাতে সচেষ্ট থাকে সর্বদা, তেমন আবার অপরকেও সাহায্য করে। এই কাজে তাদের সব থেকে বেশি সাহায্য করে ছত্রাক। ছত্রাক আসলে গাছ ও প্রাণীর মধ্যবর্তী একটি জীব। ছত্রাকের কোষের দেওয়াল chitin নামক একটি পদার্থ দিয়ে তৈরী, যা গাছের মধ্যে কখনো দেখতে পাওয়া যায় না। যেটা কিছু পোকামাকড়ের মধ্যে দেখতে পাওয়া যায়, আবার ছত্রাক প্রাণীর মত সালোকসংশ্লেষে অপারগ। তবে সব ছত্রাক যে গাছের বন্ধু হবে তা একেবারেই নয়। অনেক ছত্রাক আছে যারা গাছের জন্য ক্ষতিকারক। বন্ধু ছত্রাকদের সঙ্গে গাছের মিথোজীবীতার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ২০০৮-এর গবেষণা থেকে জানা যাচ্ছে যে, ছত্রাক প্রথমে গাছ কী চাইছে সেটা বুঝে নেয়। তার উপর নির্ভর করে গাছের হরমোন তৈরী করে, যা গাছকে বাড়তে সাহায্য করে। গাছের সঙ্গে মিথোজীবীতায় থাকা ছত্রাক গাছকে ব্যাকটেরিয়া এবং ক্ষতিকারক ছত্রাকের আক্রমণ থেকে রক্ষা করে। প্রয়োজনে ছত্রাক নিজের থেকেই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়। যেমন মাটিতে নাইট্রোজেনের অভাব দেখা দিলে পাইন গাছের সহযোগী ছত্রাক “লেকারিয়া বাইকালার”  নিজের দেহ থেকে বিষাক্ত পদার্থ নিঃসরণ করে বিভিন্ন ক্ষতিকারক জীবানুদের মেরে, সেখান থেকে নাইট্রোজেন বার করে। উড ওয়েবের কথা তো আগেই বলেছি, যা শুধু একই প্রজাতি নয়, বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করে। তাই গাছের বৈচিত্র্য জঙ্গলের স্বাস্থ্যকে বাড়িয়ে তোলে।

গাছের বয়স বাড়ার সাথে সাথে তার কান্ডে  “বৃদ্ধি বলয়” তৈরী হয় প্রতি বছর, এই বলয় থেকেই তার বয়স গোনা যায়। আর বলয় তৈরী না হলে তাকে মৃত বলে ধরা হয়। সুইজারল্যন্ডে পাইন গাছের এক জঙ্গলে ২০০২ সালে বিজ্ঞানীরা লক্ষ্য করেন কিছু গাছে প্রায় ৩০ বছর ধরে কোন বলয় তৈরী হয় নি। অথচ সবুজ ছূঁচালো পাতার বাহার নিয়ে দিব্য গাছ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আসলে মূল থেকে জল পাতায় যায় যে নল দিয়ে সেই জাইলেম কলা এমনিতেই মৃত কোষ দিয়ে তৈরী। কিন্ত কোন কারনে গাছের কান্ডে ছত্রাক ঢুকে ক্যামবিয়ামের স্তরটা নষ্ট করে দিয়েছে। তাই পাতা থেকে খাবার মূলে পৌঁছানোর উপায় নেই। তাহলে ৩০ বছর ধরে মূলের চলছে কী করে? পাশের পাইন গাছ দিচ্ছে তাই চলছে।   

পৃথিবীর প্রাচীনতম গাছ

সাধারণ আবাসন তৈরীর মিলিত প্রচেষ্টা:

পরিণত বয়সে গাছের দীর্ঘ, স্ফীত কান্ড পাখ-পাখালি, পোকা-মাকড়, কাঠবেড়ালী, বাদুড় ইত্যাদি আরও অনেকের বাসস্থলে পরিণত হয়। কিন্তু গাছ মোটেও স্বেচ্ছাই এই পরিষেবা প্রদান করে না। কোন কারণে তার প্রতিরোধের ক্ষমতা দূর্বল হয়ে যায়। মূল হয়তো বন্ধু হারাবার ফলে ঠিকমত সঙ্কেত পাঠাতে পারে না, বা হয়ত বুঝতে পারলেও ব্যবস্থা নিতে পারে না। এই সময় প্রথম কাজটা শুরু করে কাঠঠোকরা। তার বাঁকানো শক্ত ঠোট এই কাজের জন্য উপযুক্ত। প্রাথমিকভাবে সে গাছের গায়ে আটকে থাকা পোকা খুটে খেয়ে গাছকে কিছুটা স্বস্তিও দেয়। সেই সঙ্গে নিজের এবং বাচ্চাদের থাকার মত একটা বাসা তৈরীর কাজও চলতে থাকে। পুরোটা তার একার পক্ষে করাটা একটু কষ্টকর। তাই কিছুদূর গর্ত করে সে ছেড়ে দেয়। পিছনে অপেক্ষমান ছত্রাক এবার গর্তটা বড় করার দায়িত্ব নেয়। এদিকে কাঠঠোকরার ডিম পাড়ার সময় হয়ে যায়, ছত্রাক তখনো একটা গর্ত যথেষ্ট বড় করে উঠতে পারে না। বাধ্য হয়ে কাঠঠোকরাকে বাচ্চাদের জন্য একটা আর নিজের জন্য একটা—দু কামরার একটা বাসায় ঠায় নিতে হয়। ছত্রাক ধীর গতিতে তার কাজ চালিয়ে যায়। কাঠঠোকরার বাচ্চারা যখন ওড়ার মত হয় ততদিনে দুই ঘরের দেওয়াল ভেঙে গর্ত বেশ বড় হয়ে গেছে। বাচ্চাদের পক্ষে রোজ অতটা গভীর গর্ত থেকে বেরনো এবং ঢোকা কষ্টকর। তাই এই বাসা এবার ছাড়তে হয়। এরপর ওখানে থাকতে আসে nuthatch , যা অনেকটা কাঠঠোকরারই মত কিন্তু একটু ছোট, আর কাঠে গর্ত করার মত ঠোট নেই। তাই এই তৈরী বাসা তার বেশ পছন্দের। শুধু গর্তের মুখ বেশি বড় বলে যে কেউ ঢুকে পড়তে পারে, তাই মাটি দিয়ে প্রবেশ পথটা একটু ছোট করে নেয়। গাছের বাসা সকলেরই বেশ পছন্দের কারণ গাছের তন্তু খুব ভালো শব্দ পরিবহন করে। গিটার, বেহালা যার সাক্ষ্য বহন করে। তাই কোন শিকারি প্রাণী গাছ বেয়ে উপরে উঠতে গেলেই পাখি টের পেয়ে যায়।

লজ্জাবতী

পেঁচার দেহটা তুলনায় বড় হবার কারণে তাকে ঐ একই বাসা ব্যবহার করার জন্য একটু অপেক্ষা করতে হয়। ইতিমধ্যে কাঠ পিঁপড়ের দল ঢুকে পড়ে। গুবরে পোকাও থাকে। গুবরে পোকার লার্ভা পরিণত হতে বেশ খানিকটা সময় লাগে। তাই একটা শক্ত-পোক্ত বাসা দরকার। উত্তর ইউরোপ ও পশ্চিম এশিয়ায় একধরণের বাদুড় থাকে, যাদের মেয়েরা একসঙ্গে মিলে বাচ্চা প্রসব করে তাদের বড় করে। তবে এরা বেশিদিন এক জায়গায় থাকে না, পাছে নিশাচর পাখির হাতে পড়ে যায়। এইভাবে রিলে রেসের মত একজনের পর একজন আসতে থাকে আর সবার ফেলে যাওয়া কাজের কিছু কিছু সারতে থাকে। সম্পূর্ণ নেট ওয়ার্কটি এখনও বিজ্ঞানীদের কাছে পরিষ্কার নয়, তবে শেষ পর্যন্ত মৃত গাছটি মাটিতে পড়ে যায়, যা হতে প্রায় এক দশক সময় তো লেগেই যায়, তখনো সেখানে প্রায় ৬০০০ বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী ও গাছ মৃত গাছটিকে কেন্দ্র করে বাঁচে।

লেপচা জগতে প্রাচীন পাইন গাছের সারি-ছবি সন্তোষ সেন

জঙ্গলের জীবন অত্যন্ত ধীর গতির এক অদ্ভুত সুন্দর ছন্দে বাঁধা। জঙ্গল পৃথিবীর জীব বৈচিত্র্যের আধার, জলবায়ু নিয়ন্ত্রনের মুখ্য সঞ্চালক। মানুষের দ্রুতগতির সমাজ জীবন থেকে তাকে নিয়ন্ত্রন করতে যাওয়ার অর্থ নিজেদের বিপদকে আমন্ত্রন করা। বন্যপ্রাণী ও তার বাসস্থান তথা জঙ্গলকে সংরক্ষণের মধ্যেই নিহিত আছে মানুষের অস্তিত্বের চাবিকাঠি।

সূত্র:

 ‘অব্যক্ত’– জগদীশ চন্দ্র বোস।

The Hidden Life of Trees written by Peter Wohlleben

Lecturer given by Suzanne Simard

Some research references given in the above-mentioned book.

লেখক পরিচিতি:

বিজ্ঞানের ছাত্রী, গণিতে সহকারী শিক্ষিকা হিসেবে কাজ করেছেন এক দশকের উপর। বর্তমানে প্রবাসী এবং ইতিহাস ও সমাজ বিজ্ঞান বিষয়ে জানা বোঝায় আগ্রহী।

যোগাযোগ:

biswaspritilata2017@gmail.com

2 thoughts on “জঙ্গলের গোপন জীবন”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top