সন্তোষ সেন
মার্কিন প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই ডোনাল্ড ট্রাম্প একের পর নয়া নীতির ঘোষণা বা প্রয়োগ করে চলেছেন। তাঁর অভিবাসন নীতি, শুল্কনীতি বা গাজা দখল করে পুনর্গঠনের মধ্য দিয়ে আমেরিকার ও ইজরায়েলের অর্থ-পুঁজির মালিকদের নয়াবিনিয়োগের ক্ষেত্র তৈরির পরিকল্পনা বিশ্ববাসীর কাছে আজ আর অপরিচিত নয়। এইসব নীতি বিশ্ববাণিজ্য এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতির নতুন সমীকরণও তৈরি করছে। আমরা আলোচনায় আনব –ইউক্রেনের বিপুল খনিজ ভান্ডার দখলের চেষ্টা সহ গ্রিনল্যান্ডকে কিনে নেওয়া বা দখল করার ট্রাম্পের বাসনা এবং গভীর সমুদ্রে খনন কার্যের নেপথ্যের কারণকে। তাঁর এইসব নীতি বিশ্বের প্রাণ প্রকৃতি পরিবেশকে ভয়ানক বিপদ ও সংকটের দিকে ঠেলে দেবে। আমেরিকার নাগরিকের প্রতিক্রিয়া ও প্রতিবাদও আসবে আলোচনার বৃত্তে।
গভীর সমুদ্র খননের নির্দেশ এক ভয়ঙ্কর দিকে নিয়ে যাবে মানবসভ্যতাকে:
আন্তর্জাতিক নিয়ম উপেক্ষা করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গভীর সমুদ্র-খনন দ্রুত শুরু করতে নির্দেশ দিয়েছেন। শুধু নিজের দেশের সমুদ্র অঞ্চল নয়, অন্যান্য অঞ্চলেও এর কাজ বিস্তার ঘটানোর কথা বলেছেন। আন্তর্জাতিক নিয়মনীতি লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে চীন এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। সমুদ্রের তলদেশ থেকে খনিজসমৃদ্ধ সামগ্রী ও অন্যান্য মূল্যবান উপাদান সংগ্রহে বৈশ্বিক নিয়ন্ত্রক কাঠামোকে এড়িয়ে বিশ্ব নেতৃত্বে উঠে আসার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে ট্রাম্প বাহিনী।
হোয়াইট হাউসের কর্তারা বলছেন –প্রেসিডেন্টের এই সিদ্ধান্ত আমেরিকার অর্থনীতিতে কয়েক লক্ষ কোটি ডলার যোগান দেবে এবং গুরুত্বপূর্ণ সব মিনারেল উৎপাদনের ক্ষেত্রে বেজিং-এর একাধিপত্যকেরোখার ক্ষেত্রে সাহায্য করবে। কিন্তু তাঁরা বলছেন না, ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গভীর সমুদ্র খননের ফলে পরিবেশ দূষণের বিষয়ে আন্তর্জাতিক কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তকে আমূল অগ্রাহ্য করা হবে। এই প্রসঙ্গে আমেরিকার নাগরিকদের প্রতিক্রিয়া কী দেখা যাক।
প্রথমত: পরিবেশ সংরক্ষণ নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংস্থা ও বিজ্ঞানীরা এই আদেশের তীব্র সমালোচনা করেছেন। তাঁদের মতে –গভীর সমুদ্র খননের ফলে সমুদ্রের জটিল ও অজানা বাস্তুতন্ত্রের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি সৃষ্টি করবে। যা সমুদ্রের কার্বন ডাইঅক্সাইড শোষণ ক্ষমতা হ্রাস করে জলবায়ু পরিবর্তনকে নিশ্চিত করেই ত্বরান্বিত করবে। পাশাপাশি সমুদ্রের অতল গহীনে রয়েছে নানান ধরনের মাছ সহ অসংখ্য সামুদ্রিক প্রাণী, প্রবাল, শৈবাল এবং অসংখ্য উপকারী অণুজীব। সমুদ্র খননের ফলে যাদের অস্তিত্ব চরম বিপদে পড়বে। বিলুপ্ত হয়ে যাবে প্রচুর প্রাণ ও উদ্ভিদ প্রজাতি।
দ্বিতীয়ত: ‘ওপেন কনজারভেন্সি’রভাইস প্রেসিডেন্ট বলেছেন –“গভীর সমুদ্র খনন শুধুই সমুদ্রের তলদেশ নয়, পুরো সামুদ্রিক স্তর ও এর উপর নির্ভরশীলজীববৈচিত্রের ওপর ভয়ঙ্কর প্রভাব ফেলবে।” অর্থাৎ ট্রাম্পের এই আদেশ কার্যকর হলে সামগ্রিকভাবে সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রের ধ্বংস প্রক্রিকায়াকে আরও এগিয়েনিয়ে যাবে, একথা নিঃসন্দেহেই বলা যায়।
তৃতীয়ত: ‘গ্রিনপিসইউএসএ’ এই পদক্ষেপকে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক সমুদ্র তলদেশ কর্তৃপক্ষকে উপেক্ষা করে একতরফা সিদ্ধান্ত হিসেবে অভিহিত করেছে। এই সিদ্ধান্ত আমেরিকার বহুপাক্ষিক সহযোগিতার প্রতি অসম্মান প্রদর্শন। ট্রাম্প এন্ড কোম্পানি কবে আর এইসবকেতোয়াক্কা করেছে? যদিও কিছু শিল্পপতি ও তাদের সমর্থকদের বক্তব্য – “মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ সব খনিজসম্পদের ওপর চীনের একচেটিয়া আধিপত্য মোকাবিলার জন্য আমেরিকার নিজস্ব খনিজ-উৎসউন্নয়ন জরুরী।”
রেয়ার আর্থ মেটিরিয়ালকে কেন্দ্র করে চীন আজ বিশ্ব-বাণিজ্য জগতে প্রথম স্থানে পৌঁছে গেছে। এবং নির্দিষ্ট কয়েকটি মূল্যবান খনিজ পদার্থ আমেরিকাকে রপ্তানি বন্ধ করার সিদ্ধান্তের পর মার্কিন প্রশাসন চরম বিপাকে পড়েছে। বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির যুগে এইসব খনিজের অবদান অনস্বীকার্য। তাই মার্কিন প্রশাসন আজ মরীয়া। মায়ানমারেররাখাইন প্রদেশ সহ জম্মু কাশ্মীরের বিপুল রেয়ার আর্থ মেটিরিয়াল এবং ভৌগোলিকভাবে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ মায়ানমার সংলগ্ন সেন্ট মার্টিন দ্বীপের দখল নেওয়ার ক্ষেত্রে আমেরিকা ও চীনের দ্বন্দ্ব, তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থ এবং বাংলাদেশের ভূমিকা আজ ভারতীয় উপমহাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরির ক্ষেত্রে কী ভূমিকা নিচ্ছে, তা নিয়েও আমাদের গভীরে ভাবা ও চর্চা করা ভীষণ জরুরী হয়ে পড়েছে।
সামুদ্রিক খনিজ সম্পদ, প্রাকৃতিক গ্যাস ও পেট্রোলিয়াম খননের সিদ্ধান্তের পক্ষে-বিপক্ষে মতামত থেকে এটা স্পষ্ট যে, এই বিতর্কের কেন্দ্রে রয়েছে পরিবেশ সংরক্ষণ ও রক্ষা বনাম জাতীয় নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক স্বার্থের সমন্বয়। এই স্বার্থেই কি তাহলে মার্কিন প্রশাসনের গ্রীনল্যান্ড দখলের আকুল বাসনা?
আমেরিকার নয়া নীতি পরিবেশ বিপর্যয়কে আরও ত্বরান্বিত করবে:
বিশ্ব জুড়েই আজ জলবায়ুবিপর্যয় মোকাবিলার প্রয়োজনীয়তানিয়ে সচেতনতা বাড়ছে। বিভিন্ন মহল থেকে প্রতিবাদ প্রতিরোধের স্বরও শোনা যাচ্ছে। কিন্তু পৃথিবীর অন্যতম পরিবেশ দুষ্কৃতি ট্রাম্প মহাশয় পরিবেশ বিপর্যয়কে একটি সমস্যা বলেই মনে করেন না। তিনি বলেন, এসব গুজব বা গল্পকথা। তাই প্রথম জামানায় আমেরিকাকে তিনি বার করে আনেন প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে। তাঁর মতে, এর ফলে আমেরিকাকে অহেতুক প্রচুর ডলার জোগাতে হচ্ছে রাষ্ট্রপুঞ্জের ভান্ডারে। দুঁদে ব্যবসায়ীর মতোই কথা বলেছেন ট্রাম্প। যদিও জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার ও বাতাসে কার্বন নিঃসরণের ক্ষেত্রে প্রথম সারিতে রয়েছে আমেরিকা। নয়া প্রেসিডেন্ট সগর্বেঘোষনা করলেন –তথাকথিত নবায়নযোগ্য শক্তি অর্থাৎ সৌরশক্তি, বায়ুশক্তিরউৎপাদনের উপর আর কোন উৎসাহ বা ছাড় দেওয়া হবেনা। খনিজ তেল ও গ্যাস উৎপাদকদের আহবান করলেন আরও বেশি পরিমাণে খনিজ তেল উত্তোলন করে নিজেদের ও আমেরিকার অর্থব্যবস্থার সমৃদ্ধি ঘটাতে। যদিও অপরিশোধিত খনিজ তেলের মোট আন্তর্জাতিক উৎপাদনের এক পঞ্চমাংশ আসে শুধুমাত্র আমেরিকা থেকে। একক দেশ হিসাবে ভূগর্ভস্থ তেল উৎপাদনে আমেরিকা দুনিয়ায়বৃহত্তম।
সাম্প্রতিক কালের দুই দুটি দীর্ঘ যুদ্ধ ডলার অর্থনীতিকে চাপে ফেলে দিয়েছে অনেকটাই। ‘ডি-ডলারাইজেশনের’ কালো মেঘ চেপে বসছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘাড়ে। তাই ট্রাম্প তাঁর নয়াশুল্কনীতি ও দখলদারির রাজনীতির মধ্য দিয়ে ডলারকে চাঙ্গা করতে মরীয়া। তিনি চান সারা বিশ্বে বাণিজ্য বিস্তার করতে এবং পৃথিবীর অর্থনীতির হর্তাকর্তা হতে।
ইউক্রেন ও গ্রিনল্যান্ডেরখনিজ ভান্ডার দখলের বাসনা :
মার্কিন অর্থনীতির টালমাটাল পরিস্থিতি সামলাতে এবং কর্পোরেটদের ব্যবসা বাণিজ্য ও মুনাফার আরও সুযোগ করে দিতেই ইউক্রেনের সাথে খনিজ-চুক্তি করতে চেয়েছিলেন মহামান্য ট্রাম্প। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ থামানোরবিনিময়ে তিনি চান ইউক্রেনের বিপুল খনিজ ভান্ডারের ওপর দখলদারি। ইউক্রেনের সাথে খনিজ চুক্তিতে জেলেনস্কি সই করতে রাজি না হওয়ায় ‘বিশ্বত্রাতা’ গেলেন ক্ষেপে। খনিজ সম্পদের দখলদারিই যদি না পাওয়াযায়, তাহলে আর ইউক্রেনকে বিলিয়ন ডলারের যুদ্ধাস্ত্র সাহায্য করে কী লাভ? তিনি হুংকার ছাড়লেন –“এই চুক্তিতে সই না করলে, আমরাও আর আপনাদের পাশে নেই।” এটাই হচ্ছে মহামান্য ট্রাম্পের আসল বাসনা। বলাই বাহুল্য যে, আমেরিকার অর্থনৈতিক চাপ ও যুদ্ধাস্ত্র সরবরাহ না করার হুমকির কাছে জেলেনস্কি আজ না হোক কাল আমেরিকার শর্তেই খনিজ চুক্তিতে সই করতে বাধ্য হবেন।
অন্যদিকে গ্রিনল্যান্ড দখলের বাসনার পিছনেও রয়েছে ডলার সাম্রাজ্যের আধিপত্য বিস্তারের নয়া দিশা খোঁজার নীল নকশা। খনিজ ভান্ডারে ভরপুর গ্রিনল্যান্ড দখল করার হুমকি দিয়েছেন তিনি। ২০১৯ সালেই গ্রিনল্যান্ড কিনে নিতে চেয়েছিলেনতৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। আসলে গ্রিনল্যান্ডের ভূগর্ভে জমাট বরফের নিচে স্তরে স্তরে সাজানো আছে লিথিয়াম, জারকোনিয়াম’র মতো দুর্লভ খনিজ এবং অবশ্যই ইউরেনিয়াম। বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যাটারি, সোলার প্যানেল, তথ্য প্রযুক্তি ও কোয়ান্টামকম্পিউটিং এবং পারমাণবিক শক্তি উৎপাদনের কাঁচামাল যে ভূমিতে মজুদ আছে, তার অর্থনৈতিক এবং বাণিজ্যিক গুরুত্ব বলে বোঝানোর দরকার হয়না। অন্যদিকে বরফের নিচে বড় মাপের পেট্রোলিয়াম ও প্রাকৃতিক গ্যাসের ভান্ডার থাকার সম্ভাবনাও আছে। বরফ যত গলবে, তত বেশি করে সেই ভান্ডার নাগালে আসবে। এভাবে আমেরিকার নয়া প্রেসিডেন্ট চায়রেয়ার আর্থ মেটিরিয়ালের ক্ষেত্রে চীনের একচেটিয়া মালিকানাকে চ্যালেঞ্জ করতে। যদিও তার এই বাসনার বিরুদ্ধে জল ঢেলেছে গ্রিনল্যান্ড, ডেনমার্ক, রাশিয়া, চীন সহ ইউরোপীয় ইউনিয়ন ভুক্ত দেশগুলো।
গ্রিনল্যান্ড দখলের অযৌক্তিক পরিকল্পনার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া:
ডোনাল্ডট্রাম্পের এই অধিগ্রহণের ঘোষণা বিশ্বজুড়েই ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। যা আন্তর্জাতিক মহলের উদ্বেগ, কূটনৈতিক উত্তেজনা ও রাজনৈতিক প্রতিরোধের জন্ম দিয়েছে। গ্রিনল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীর স্পষ্ট বক্তব্য –“গ্রিনল্যান্ড আমাদের। এই দ্বীপের ভবিষ্যৎ গ্রিনল্যান্ডবাসীর দ্বারা নির্ধারিত হবে, বাইরের কোন শক্তি দ্বারা নয়।” গ্রিনল্যান্ডের সমস্ত রাজনৈতিক দল যুক্তরাষ্ট্রের অধিগ্রহনের হুমকির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ অবস্থান নিয়েছে। সমীক্ষালব্ধ তথ্য –যুক্তরাষ্ট্রের অংশ হওয়ার বিরুদ্ধে মতামত ব্যক্ত করেছেন ৮৫ শতাংশ গ্রিনল্যান্ডবাসী। ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন –“আমেরিকার এই অযৌক্তিক, অবাস্তব প্রস্তাব কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।” ইউরোপীয়ইউনিয়নেরসহযোগিতা চাওয়ার পাশাপাশি ডেনমার্ক আর্কটিক অঞ্চলে তাদের সামরিক উপস্থিতি জোরদার করেছে। এমনকি আমেরিকার কংগ্রেস এবং নাগরিক সমাজের একাংশ এই প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে মত ব্যক্ত করেছেন। ট্রাম্পের এই জোরপূর্বকঅধিগ্রহন নীতির বিরোধিতা করেছে ফ্রান্স, জার্মানি, সুইডেন ও যুক্তরাজ্য প্রশাসনও। ট্রাম্পের এই প্রচেষ্টা স্বাভাবিক কারণেই আর্কটিক অঞ্চলে ভূরাজনৈতিক উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। ফলে রাশিয়া, চীন এবং তুরস্ক এই অঞ্চলে তাদের উপস্থিতি জোরদার করেছে।
উদ্বেগের বিষয় যে, পৃথিবীর তাপমাত্রা সবচেয়ে বেশি বাড়ছে উত্তরমেরু অঞ্চলে। যার পরিণামে গ্রিনল্যান্ডেরচিরতুষার বছরে গড়ে ২৭ হাজার কোটি টন ক্ষয়ে যাচ্ছে। যা আন্টার্কটিকার বরফের গলনের থেকে ৮০% বেশি। বেলাগামবিশ্বউষ্ণায়নের জেরে মেরুবরফের গলন আরও প্রবল হওয়ার সম্ভাবনা যথেষ্ট। আশঙ্কা, আগামী দশকের শেষে গ্রিনল্যান্ডেরচিরতুষার বলে আর কিছু থাকবে না। এর প্রভাবে দুনিয়া জুড়ে সমুদ্রের জলস্তরবাড়ছে। বিপন্ন হচ্ছে উপকূলবর্তী বিস্তীর্ণ অঞ্চল এবং মৎস্যজীবি সহ লক্ষ লক্ষ সাধারণ মানুষের জীবনযাপন। আর খনন কার্যের অভিঘাতে গভীর সমুদ্র বা মেরুবরফের নিচে সঞ্চিত মিথেন গ্যাসের ভান্ডার একবার উন্মুক্ত হয়ে গেলে বাতাসে গ্রিনহাউস গ্যাস বেড়ে যাবে প্রবল বেগে। তার দায় নেবে কে?
জলবায়ু পরিবর্তন জনিত বাস্তব অবস্থা দাবি করছে, কয়লা ও তেলের মতো জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে, নতুন খনন কাজ বন্ধ রেখে বাতাসে গ্রিনহাউস গ্যাসের নির্গমন দ্রুত কমানো। মানব সভ্যতাকে ধরাধামে টিকিয়ে রাখার উদ্যোগ নেওয়া যখন সবচেয়েজরুরি হয়ে পড়ছে, তখন ট্রাম্পের এইসব নীতি নিশ্চিত করেই পরিবেশ বিপর্যয়কে এক ভয়ংকর পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যাবে।
ট্রাম্প প্রশাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ:
এপ্রিল: ২০২৫, সারা মাস জুড়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রদেশে লক্ষ লক্ষ মানুষ বিক্ষোভ, মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশে সামিল হলেন। মূল উদ্দেশ্য ট্রাম্প প্রশাসনের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং শিক্ষা জগতে অগণতান্ত্রিক নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো। সাথে প্রকৃতি পরিবেশ রক্ষার দাবিও জোরালো হয়েছে। ৫ই এপ্রিল আমেরিকার ৫০টি রাজ্যের ১২০০-এর বেশি অঞ্চলে চার লক্ষাধিক মানুষ অভূতপূর্ব ‘হ্যান্ডস অফ’ আন্দোলনে পথে নামলেন। অন্যদিকে উনিশে এপ্রিল ‘ন্যাশনাল ডে অফ অ্যাকশন’ আন্দোলনে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরে সাতশটির মতো ইভেন্ট অনুষ্ঠিত হয়। মূল লক্ষ্য ট্রাম্পেরনয়া নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো, ট্রান্সজেন্ডার নাগরিকদের অধিকার সুরক্ষিত করা এবং গণতান্ত্রিক ও নাগরিক অধিকার সুরক্ষিত রাখা। আর একটি সাড়াজাগানো আন্দোলনের স্বাক্ষী হলেন আমেরিকাবাসী। যার পোশাকি নাম, “50501 মুভমেন্ট”। অর্থাৎ ৫০টি রাজ্য, ৫০টি প্রতিবাদ, ১ দিন ধরে –এই স্লোগানে প্রতিবাদ বিক্ষোভ সংগঠিত হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে আসেন। তাঁরা ট্রাম্প প্রশাসনের অভিবাসন নীতি, পরিবেশ সংরক্ষণে অনীহা এবং উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ওপর হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান। অন্যদিকে ২১ এপ্রিল “All Out on Earth Day” ক্যাম্পেইনেরআওতায়পরিবেশপ্রেমী ও গণতন্ত্রপন্থী সংগঠনগুলো ট্রাম্পের পরিবেশ নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে। নিউ ইয়র্ক, মিলওয়াকি এবং অন্যান্য শহরে মিছিল, পিকেটিং পালিত হয়। জীবাশ্ম জ্বালানি শিল্পের সঙ্গে প্রশাসনের সম্পর্ক, পরিবেশ সংস্থাগুলোর বাজেট ছাঁটাই এবং নবায়নযোগ্য শক্তির জন্য তহবিল হ্রাসের বিরুদ্ধে জোরালো আওয়াজ ওঠে। হার্ভার্ডবিশ্ববিদ্যালয়ের কর-মুক্ত মর্যাদা প্রত্যাহারের হুমকি দেওয়ার প্রতিবাদে বার্কলেতেও ব্যাপক বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের বাইরেও, বার্লিন, প্যারিস, লিসবন এবং লন্ডনে “Hands Off” আন্দোলনের সমর্থনে বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। পাঠক লক্ষ্য করবেন যে, এই সমস্ত আন্দোলনগুলোতে মূল দাবিগুলো প্রায় এক। জনবিরোধী আইন বা নির্দেশ, গণতান্ত্রিক মুক্ত পরিসর বিনষ্ট করা, শিক্ষাক্ষেত্রেঅনৈতিক হস্তক্ষেপ, অভিবাসন নীতির প্রবল বিরোধিতা করার পাশাপাশি প্রকৃতি পরিবেশ রক্ষা ও সংরক্ষণের দাবি সমান তালে সমসুরে উচ্চারিত হচ্ছে। এটাই কি মানবসভ্যতার বেঁচে থাকার জিয়নকাঠি বা প্রধান দাবী নয়? এইসব আন্দোলন ও দাবি থেকে আমরা কি কিছু শিক্ষা গ্রহণ করতে পারিনা?
পরিশেষে:
আমাদের স্পষ্ট বুঝে নিতে হবে যে, জোরপূর্বকগ্রিনল্যান্ড বা গাজা দখল করা কিংবা সমুদ্র অঞ্চলে গভীর খননকার্যবিশ্বজুড়েই প্রাণ প্রকৃতি পরিবেশকে ভয়ঙ্করভাবে বিপর্যস্ত করবে। পাশাপাশি বিশ্ব রাজনীতির ক্ষেত্রে তীব্র অস্থিরতা ও উত্তেজনা সৃষ্টি করবে। আসলে যে সাম্রাজ্যের অধীশ্বর হতে চান মহামান্য ট্রাম্প এবং তাঁর সঙ্গীরা, তার নাম অর্থ-পুঁজির সাম্রাজ্য। মুনাফা অর্জনের কাজে অর্থাৎ পুঁজির ভান্ডার সমৃদ্ধ করার কাজে এই পৃথিবীর যা কিছু প্রাকৃতিক পদার্থ বা সম্বল কাজে লাগতে পারে, তার দখল নেওয়াইলুঠেরাদের লক্ষ্য। সেই লক্ষ্য পূরণের স্বার্থে মানুষের জীবন জীবিকাকেও বিপর্যস্ত করা হচ্ছে। সেই দখলদারিরলড়াই চলছে পৃথিবী জুড়ে। পৃথিবীর সীমানা ছেড়ে মহাকাশের পরিধিতিতেও তা আজ বিস্তৃত।
ফুলেফেঁপে ওঠা কাল্পনিক পুঁজির মালিক ক্রোনিক্যাপিটালিস্টরা আজ সারা বিশ্বের সামাজিক, রাজনৈতিক পদক্ষেপ নির্ধারণ করে চলেছে। পুঁজির সংকট কাটাতে মরীয়া কর্পোরেট বাহিনী মানুষের বেঁচে থাকার রসদ জল জঙ্গল জমি পাহাড় নদী জলাশয়, যা প্রকৃত অর্থেই মানুষের বৃহৎ শরীরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ, তাদের বিনিয়োগের ক্ষেত্র গড়ে তোলার জন্য নির্বিচারেলুঠ করে চলেছে। রাষ্ট্রনায়করা এদের মদত দিয়ে চলেছে সমানতালে।
এই অবস্থায় আমরা কোন্ পক্ষ নেব? সব গিলে খাওয়া তথাকথিত উন্নয়ন, নাকি মানবসভ্যতাকেটিকিয়ে রাখার স্বার্থে প্রাণ প্রকৃতি পরিবেশ রক্ষা ও সংরক্ষণের পক্ষে? ‘ক্যাপিটাল বনাম ন্যাচার’ দ্বন্দ্বকে সামনে এনে মানবধর্মকে সজোরে আঁকড়ে ধরব, নাকি এই তো বেশ ভালো আছি মনোভাবনিয়েচলব? আমরা আজ আক্রান্ত। নিজেদের বেঁচে থাকার স্বার্থেই ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রয়োজনীয় কর্মযজ্ঞে সামিল হব কিনা, এই সিদ্ধান্ত আমাদেরকেই নিতে হবে।