সন্তোষ সেন
যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা মানে
ট্রিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বিক্রি
বাজে রনডঙ্কার মিসাইল দুন্দুভি
হাজারে হাজারে সাঁজোয়া গাড়ি।।
আসলে যুদ্ধ মানে
ন্যাংটো ক্ষুদার্থ শিশুর মৃত্যু মিছিল
যুদ্ধ বয়ে আনে
অসংখ্য সেনার মৃত শরীর।।
আসলে যুদ্ধ মানে
মা বাবা হারা শিশুর আর্ত চিৎকার।।
যুদ্ধ মানে
অন্যের জমির দখলদারি
যুদ্ধ মানে রাষ্ট্রের দাদাগিরি
যুদ্ধ মানে অর্থের দাপাদাপি।।
আসলে যুদ্ধ মানেই
আকাশ বাতাস জল মাটি
প্রাণ প্রকৃতির স্বাস্থ্য হানি
যুদ্ধ শেষে শুধু পড়ে থাকে
লক্ষ মানুষের লাশ রক্ত
শুকিয়ে যায় চোখের পানি।।
এসো নতুন সাজে সাজি
বিশ্ব মানবতার পথে হাঁটি
কাঁটাতারের বেড়া ভাঙি।।
দূষণহীন সুস্থ সুন্দর নির্মল
একটা মুক্ত পৃথিবী গড়ি
এসো আসল যুদ্ধে নামি।।
(২৭/২/২২)
দু–দুটো বিশ্বযুদ্ধ কেন:
সভ্যতার ক্রম বিকাশের সাথে সাথে বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করেছেন একের পর এক গৃহযুদ্ধ, এক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অন্য রাষ্ট্রের খবরদারি-দাদাগিরি। কলোনি দখল করে তৃতীয় বিশ্বের দেশের সস্তা শ্রম ও অফুরন্ত প্রাকৃতিক সম্পদের ভাণ্ডার দখল করে পণ্য উৎপাদন– উন্নত দেশে রপ্তানি এবং পুনরুৎপাদনের দুষ্ট চক্র সচল ও জীবন্ত রাখতে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা বাজিয়ে দিল পুঁজির মালিকেরা। লক্ষ কোটি মানুষকে হত্যা করে, দেশান্তরী-উদ্বাস্তু মানুষের মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর করে, অসংখ্য স্বজনহারা মানুষের হাহাকার, আর্তনাদ, চোখের জল সাথে নিয়ে, আকাশ-বাতাস-মাটি-জল বিষাক্ত করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একরকম পরিসমাপ্তি ঘটল। যুদ্ধের শেষলগ্নে আমেরিকার পরমাণু অস্ত্রের ধ্বংসাত্মক মারণশক্তির পরিচয় পেয়ে বিজ্ঞানী মহলসহ বিশ্ববাসী আতঙ্কে শিউরে উঠলেন। দু-দুটো শহর বিশ্বের মানচিত্র থেকে স্রেফ হাওয়া হয়ে গেল। তেজস্ক্রিয় বিকিরণের করালগ্রাসে মৃত্যু হলো কয়েক হাজার মানুষের। ধুঁকতে ধুঁকতে মারা গেলেন আরো কয়েক হাজার মানুষ। নাগাসাকি-হিরোশিমা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে অকাল গর্ভপাত ও বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ল। এমনকি প্রায় আশি বছর পর আজও অসংখ্য নবজাতকের মধ্যে অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করা যায় ঐ সব অঞ্চলে।
আর্য-জাতির বিশুদ্ধ রক্ত (!) ও আর্য-গরিমা প্রতিষ্ঠিত করার উদগ্র বাসনায় হিটলার-মুসোলিনির যুগলবন্দী লক্ষ-কোটি ইহুদীদের কচুকাটা বা গ্যাস চেম্বারের বিষাক্ত গ্যাসে শ্বাসরুদ্ধ করে মেরে ফেলল। আর্য-গরিমা প্রতিষ্ঠিত না হলেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এই ভয়াবহতা, বীভৎসতা আজও বিশ্ববাসীর স্মৃতি থেকে মুছে যায় নি।
ঠান্ডা যুদ্ধের যুগ:
রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ও ব্যাংক পুঁজির গাঁটবন্ধনে তৈরী হওয়া ফিন্যান্স-পুঁজি আরো বেগবান হওয়ায় এখন আর কলোনি দখলের প্রয়োজন পড়ল না। বরং বড় বড় কারখানাগুলো ভেঙে টুকরো টুকরো করে ‘ভার্টিক্যাল ডিভিশন অফ লেবার’ এর মধ্য দিয়ে উৎপাদনের উপকরণ ও প্রক্রিয়া ছড়িয়ে দেওয়া হলো এশিয়া, আফ্রিকা সহ সারা বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তে। আন্তর্জাতিক পুঁজিপতি গোষ্ঠীর কব্জায় চলে এল বিশ্ব বাজার। পুঁজির উৎপাদন ও পুনরুৎপাদনের শৃংখল বড় হলো ঠিকই, কিন্তু প্রকৃতি হলো বিপর্যস্ত-বিধ্বস্ত। কৃত্রিমভাবে চাহিদা তৈরি করে মধ্যবিত্তশ্রেণি সহ সমাজের একটা বড় অংশকে অপ্রয়োজনীয় গাদাগাদা ভোগ্যপণ্যের বাজারে টেনে আনা হলো। মানুষ বিচ্ছিন্ন হলো প্রকৃতি থেকে। সমাজ ও অপর থেকে বিচ্ছিন্ন মানুষকে একটি স্বার্থপর ব্যক্তিমানুষে পরিণত করা হলো। চামড়ার মধ্যে আবদ্ধ রক্তমাংসের ছোট শরীরটাকেই ভোগবাদী মানুষ বড় করে দেখতে শিখল। অথচ চামড়ার বাইরে গাছপালা, জল, জঙ্গল, পাহাড় সহ বিরাট বিপুলা বসুধার (extended body) রূপ-রস-গন্ধ আস্বাদন করতে পারছে না একক মানুষ। গ্রাম ও শহরের মধ্যে, মানুষের সাথে মানুষের, প্রকৃতির সাথে মানুষের ফাটল (rift) দিন দিন বেড়েই চলল। পুঁজির এই অশ্বমেধের ঘোড়াকে ছুটিয়ে নিয়ে যেতে, বিশ্ববাজার নিজেদের আয়ত্তে রাখতে কর্পোরেট বাহিনী ও তাদের সেবাদাস রাষ্ট্র সরাসরি কলোনি দখল না করেও উগ্রপন্থীদের আস্কারা দিয়ে এবং অস্ত্র ও অর্থ সরবরাহ করে দেশের মধ্যে বাধিয়ে দিল গৃহযুদ্ধ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে রাসায়নিক ও জৈব অস্ত্রের সরবরাহের জন্য গড়ে ওঠা কারখানাগুলোকে রাসায়নিক সার এবং কীটনাশক তথা বিষ তৈরির কারখানায় রূপান্তরিত করা হলো। সারা বিশ্বজুড়ে কৃষি বাস্তুতন্ত্রের সংকট বাড়লো। কর্পোরেটের মর্জিমাফিক রাসায়নিক চাষ করতে গিয়ে কৃষকরা সর্বশান্ত হলেন বারেবারে, মানুষের রোগ অসুখ দিন দিন বাড়তেই থাকল। বিষ ঢুকে পড়ল খাদ্যশৃঙ্খলে, এমনকি জলচক্রেও। তথাকথিত উচ্চফলনশীল চাষে প্রচুর জল ব্যবহৃত হওয়ায় জলের সংকট ও দূষণ বাড়ল। দৃশ্যমান সামরিক যুদ্ধ কোন সময় জারি না থাকলেও সারা বিশ্বজুড়ে মানুষের বিরুদ্ধে, প্রকৃতির বিরুদ্ধে পুঁজিপতিদের এই যুদ্ধের অন্তঃসলিলা চির প্রবাহমান। মূল্যবোধ, ন্যায়-নীতি, মানবিকতা এই সবকিছুই জলাঞ্জলি দিয়ে দৃশ্যমান সামরিক যুদ্ধে মানবতার অপমৃত্যু ঘটে অসংখ্য মানুষের জীবনহানির মধ্য দিয়ে। প্রচুর প্রাণহানি, অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতি, উদ্বাস্তুর লম্বা মিছিল, আক্রান্ত মানুষের অন্তরে চিরকালের মতো আতঙ্ক- উদ্বেগ- উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে দিয়ে, প্রকৃতি-পরিবেশকে নতুন করে বিপর্যস্ত-বিধ্বস্ত করে, জল-মাটি-বায়ু দূষণ কয়েকগুণ বাড়িয়ে এক সময় হয়তো এই যুদ্ধ থেমেও যায়।
কিন্তু ফিন্যান্স পুঁজির যুগে ফুলে-ফেঁপে ওঠা ফিকটিশাস ক্যাপিটালকে জীবন্ত ও সচল রাখতে নির্বিচারে অরণ্য ধ্বংস করে ও প্রাকৃতিক সম্পদ লুঠ করে পুঁজির নতুন নতুন বিনিয়োগ- উৎপাদন- বিশ্ববাজার-মুনাফা ও পুঁজির পুনরুৎপাদন প্রক্রিয়া চালু রাখতে– প্রাণ প্রকৃতি পরিবেশের ধারাবাহিক বিপর্যয় ঘটিয়ে, মানুষকে প্রকৃতির থেকে আরো বিচ্ছিন্ন করে নিরবিচ্ছিন্নভাবে যে অঘোষিত যুদ্ধ জারি রেখেছে কর্পোরেট বাহিনী ও রংবেরঙের রাষ্ট্রনায়করা, তা যেমন মানুষকে অপ্রাকৃতিক করছে, পাশাপাশি গোটা মানবসভ্যতাকে গণবিলুপ্তির দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়েছে। এই প্রবহমান যুদ্ধটাকেই আমাদের চিনতে হবে, চিতায় তুলতে হবে চিরজীবনের মতো, দাঁড়াতে হবে প্রকৃতি লুঠের এই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বিরুদ্ধে। নচেৎ কামান-গোলা-গ্রেনেডের হানায় মৃত্যু না ঘটলেও কয়েক বছরের মধ্যেই শুধু আপনি বা আমি নই, তামাম মানবসভ্যতাই চিরকালের মতো হারিয়ে যাবে কালের গর্ভে। এই আলোকেই বিচার করতে হবে আজকের ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধকে।

ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধের প্রেক্ষাপট:
লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিক পার্টির হাত ধরে রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব– সর্বহারার একনায়কতন্ত্র স্থাপন, পূর্ব ইউরোপের একের পর এক দেশের ‘সোভিয়েত রাশিয়ায়’ অন্তর্ভুক্তি, পরবর্তীকালে মাও সে তুংয়ের নেতৃত্বে চীনে লাল ফৌজের উত্থান ও বিপ্লব , রাশিয়া- চীন ছাড়িয়ে কমিউনিজমের এই আকাঙ্ক্ষা বিস্তৃত হচ্ছিল লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকা, এমনকি এশিয়ার বেশ কিছু দেশেও। এইসব দেখেশুনে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রনায়কদের কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ চওড়া হলো। ‘কমিউনিজমের ভূত’ তাদের সর্বক্ষণ তাড়া করতে থাকল। পুঁজিপতিরা তাদের সাধের সাজানো বাগান তছনছ হয়ে যাওয়ার ভয়ে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ল। মূলত আমেরিকা, ব্রিটেন, জার্মানির মতো দেশগুলো তথাকথিত ‘সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোকে’ ভিতর থেকে দুর্বল করে দেওয়ার ঘৃণ্য চক্রান্তে লিপ্ত হলো। শ্রমিকশ্রেণীর একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে তারা সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতার স্বপ্ন ফেরি করতে থাকল। তাদের স্বর্গরাজ্যে সবাই সমান– নিজের ইচ্ছে মতো কাজ করে খাওয়ার স্বাধীনতা (কাজ না পেলে না খেয়ে মরার স্বাধীনতাও আছে), খোলা বাজারে যতখুশি ভোগ্যপণ্য কিনে মুক্ত জীবন উপভোগ করার বাণী প্রচারিত হতে থাকল নিরন্তর। আর অন্যদিকে ছিল একের পর এক সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সরাসরি যুদ্ধ বা অবরোধের অর্থনীতি (sanction economy) জারি রাখা। এই শীতল-যুদ্ধ বজায় থাকল দীর্ঘদিন ধরে, বিশেষ করে সোভিয়েত রাশিয়ার আনুষ্ঠানিক পতন না হওয়া পর্যন্ত। তাই ফ্রান্সের উপনিবেশের বিরুদ্ধে ভিয়েতনামের জনগণের সর্বাত্মক যুদ্ধ আবার কমিউনিজমের জন্ম দিতে পারে– এই আতঙ্কে আমেরিকার সরকার ভিয়েতনামে হানা দিল আধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ১৯৫৫ সালে। হো চি মিনের নেতৃত্বে ভিয়েতনামের সাধারণ জনগণের দুর্দমনীয় লড়াই, আমেরিকায় যুদ্ধ বিরোধী জনস্রোত ও সরকারের মধ্যেই যুদ্ধের বিরুদ্ধে নানা চাপে ১৯৭৫ সালে আমেরিকার সৈন্য শেষ পর্যন্ত ভিয়েতনাম থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে ফিরে আসতে বাধ্য হয়। যদিও এই দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ প্রাণ কেড়ে নিয়েছে কয়েক লক্ষ ভিয়েতনামবাসী ও আমেরিকার সৈন্যের। অন্যদিকে ১৯৬২ সালে আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ( জন কেনেডি) ফিদেল কাস্ত্রোকে জব্দ করতে অর্থনৈতিক অবরোধের মুখে ঠেলে দেয় কিউবাকে। কারণ, রাজনৈতিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে ততদিনে কিউবায় ‘সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র’ গঠিত হয়েছে। যদিও এই অবরোধ কিউবার পক্ষে একরকম শাপে বর হয়ে দাঁড়ায়। কিউবার সরকার বাধ্য হলো দেশীয় পদ্ধতিতে হাল-বলদের সাহায্যে জৈব চাষে ফিরে যেতে। শহরেও ‘ভার্টিক্যাল গার্ডেন’ সহ কৃষিকার্যের নানান পদ্ধতি চলতে থাকল সরকারের সামগ্রিক পরিকল্পনায়। বিকল্প চাষ তথা ‘ইন্টিগ্রেটেড ফার্মিং’র এক উন্নত মডেল হাজির করল কিউবা। অন্যদিকে, অন্যদেশের সাহায্য-সমর্থন না পেয়ে তারা নিজেদের দেশের স্বাস্থ্য পরিকাঠামোকে ঢেলে সাজাতে বাধ্য হয় এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় যথেষ্ট উন্নতি সাধন করে জনস্বাস্থ্যের এক প্রতিকল্প হয়ে দাঁড়াল কিউবা। তাই আমরা দেখলাম যে, অর্থনৈতিক অবরোধে জর্জরিত হলেও করোনা অতিমারির দুই বছরে বিশ্বের অনেক দেশকে ওষুধ ও চিকিৎসা- সরঞ্জাম দিয়ে প্রভূত সাহায্য করেছে কিউবার মতো একটি ছোট দেশ।
সাদ্দাম হোসেনের বিরুদ্ধে আমেরিকার যুদ্ধ ঘোষণা ( ১৯৯০- ৯১) এবং সাদ্দামকে মেরে ফেলার পিছনেও মূল কারণ ডলার সাম্রাজ্যবাদ। ডলারকে উপেক্ষা করে ইউরোতে ক্রুড পেট্রোলিয়াম কেনাবেচার সিদ্ধান্ত নিলে সাদ্দাম সহ ইরাককে গুঁড়িয়ে দেওয়া প্রধান কর্তব্য মনে করেছিল আমেরিকা সরকার ও সৈন্যবাহিনী, না হলে ডলার যে টলমল হয়ে যাবে। তাই কুয়েত দখল করতে চায় ইরাক– এই অজুহাতে সাদ্দামকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়া হলো। রয়ে গেল সিরিয়া, প্যালেস্তাইন, আফগানিস্তানে আমেরিকা, ইউরোপ, কখনো বা রাশিয়ার দাদাগিরি এবং এই পর্বের সব যুদ্ধের পেছনে মূল কারণ অর্থনীতি। অর্থনীতির যুদ্ধ–যুদ্ধের অর্থনীতির সাম্প্রতিক ঘটনার দিকে চোখ রাখব এবার।
অর্থনীতির যুদ্ধ–যুদ্ধের অর্থনীতি:
আপাতদৃষ্টিতে এই যুদ্ধের একদিকে আছে একসময় সোভিয়েত রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত ইউক্রেন, আর অন্যদিকে তথাকথিত সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ার উত্তরসূরি রাষ্ট্রীয় পুঁজিতে বলীয়ান পুতিনের নেতৃত্বে রাশিয়া। আসলে এই যুদ্ধের একদিকে আছে রাষ্ট্রীয় পুঁজি ও আধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত রাশিয়া, আর অন্যদিকে আমেরিকা, ইউরোপের নানান দেশসহ ন্যাটো বাহিনী। এই যুদ্ধকে ঘিরে রাজনৈতিক প্রশ্নটাকে একটু বিচার করা যাক।
আমেরিকা ও ইউরোপের ১২টি দেশ NATO জোট গঠন করে ওয়ারশ চুক্তির বিরুদ্ধে তথা স্তালিনের নেতৃত্বে রাশিয়ার বিরুদ্ধে। ওয়ারশ চুক্তি বাতিল হয়েছে ১৯৯১ সালে ‘সোভিয়েত রাশিয়া’ ভেঙে যাওয়ার প্রেক্ষিতে। পূর্ব-ইউরোপের ‘কমিউনিস্ট রাষ্ট্রগুলি’ রাশিয়ার পতনের প্রেক্ষিতে ন্যাটো জোটে সামিল হয় একমেরু বিশ্বের নেতা আমেরিকাকে মান্যতা দেওয়ার জন্যে । সোভিয়েত রাশিয়া ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তানে সৈন্য মোতায়েন করে এবং তাদের ধামাধারী এক পুতুল সরকার গঠন করে। লক্ষাধিক আফগান নিরীহ নাগরিক মারা যায় সেই শাসনে। আর্থিক ক্ষতি এবং মর্যাদাহানি হয় সোভিয়েতের। এই সময় গোটা পূর্ব- ইউরোপ পুঁজিবাদী শিবিরে যোগ দেয়। কমিউনিস্ট পূর্ব-জার্মানি ভোগবাদের মায়ায় মোহিত হয়ে মিলিত হয় পশ্চিম-জার্মানির সাথে। ১৯৯১ সালে সোভিয়েতের পতন ঘটে পাকাপাকিভাবে এবং সোভিয়েতের ১৪ টি অঙ্গরাজ্য স্বাধীন হয়ে যায় । ১৯৪৯ সালে ‘ন্যাটো অ্যালায়েন্সের’ ১২টি প্রতিষ্ঠাতা সদস্য দেশ ছিল: বেলজিয়াম, কানাডা, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, আইসল্যান্ড, ইতালি, লুক্সেমবার্গ, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে, পর্তুগাল, যুক্তরাজ্য এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বর্তমানে ন্যাটোর সদস্য সংখ্যা ৩০। ক্রমাগত সামরিক শক্তি সংগঠিত হচ্ছে পূর্ব ইউরোপে। ইউক্রেন চায় ন্যাটো গোষ্ঠীতে যোগ দিতে । সীমানা বরাবর চারিদিকে ন্যাটোর সামরিক জোটের আতঙ্কে রাশিয়ার রাতের ঘুম উধাও। আর উন্নতমানের কয়লা সহ খনিজসম্পদে ভরপুর ইউক্রেনের জমি দখলের বাসনাও চাগিয়ে উঠেছে পুতিন বাহিনীর।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণটা হলো অর্থনৈতিক। রাশিয়া, আমেরিকা, ইউরোপ ও চীনসহ শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর অর্থের ঝনঝনানির মধ্য দিয়ে আসলে এটা মূলত একটা ‘কারেন্সি ওয়ার’। একদিকে ডলার আধিপত্যকে বজায় রাখার আমেরিকার মরিয়া প্রচেষ্টা, আর অন্যদিকে রাশিয়ার রুবেল, ইউরোপীয় ইউনিয়নের ইউরো, চীনের মুদ্রা ইয়েনকে শক্তিশালী করার লড়াই। রাশিয়া থেকে বিপুল পরিমাণে জ্বালানি অর্থাৎ প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহ হয় ইউরোপের দেশগুলোতে। তাই রাশিয়ার বিরুদ্ধে সর্বাত্মক বিরোধিতায় যেতে পারছে না ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এখনো পর্যন্ত ক্রুড পেট্রোলিয়াম কেনাবেচা হয় শুধুমাত্র ডলারের মাধ্যমে। আমেরিকা মরিয়া প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এই ডলার আধিপত্যবাদ কায়েম রাখতে। তবে ডলার সাম্রাজ্যের ভাঙ্গনের কিছু ইঙ্গিতও পাওয়া যাচ্ছে এই যুদ্ধকে ঘিরে। তাই আন্তর্জাতিক বাজারের তুলনায় অনেক কম দামে রুবেল এর মাধ্যমে ভারতকে অপরিশোধিত তেল যোগানের প্রক্রিয়া ভারত ও রাশিয়ার মধ্যে শুরু হলেও রাশিয়া বা ভারতের বিরুদ্ধে বাইডেন এন্ড কোম্পানি সেভাবে সোচ্চার হতে পারছে না। ভারতও চাইছে কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে পাকিস্তান সীমান্তে যুদ্ধ এবং চীনের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রাশিয়াকে পাশে পেতে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী আমেরিকা বা রাশিয়া কাউকেও সেভাবে চটাতে চাইছেন না, তাই তথাকথিত জোট নিরপেক্ষ অবস্থান। রাগে ক্ষোভে ফেটে পড়ে খুব সংগতভাবেই আইরিশ পার্লামেন্টের ভার্চুয়াল বক্তৃতায় (৬ই মার্চ,২০২২) জেলেনস্কি বলেন –” রাশিয়া একদিকে আমার দেশটাকে ছারখার করে শ্মশানে পরিণত করবে, আর অন্য শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো শুধু মৌখিক উষ্মা প্রকাশ করবে–এটা আর মেনে নেওয়া যাচ্ছে না। আমার তো মনে হয় এইসব দেশগুলো নিজের-নিজের ব্যবসা নিয়েই বেশি উদ্বিগ্ন”।
যুদ্ধ বনাম পরিবেশ বিপর্যয়:
নিবন্ধের শুরুতেই আমরা আলোচনা করেছি–পুঁজিকে বেগবান রাখতে ও কর্পোরেটের আরো আরো মুনাফার স্বার্থে কিভাবে প্রতিদিন প্রতিনিয়ত নির্বিচারে প্রকৃতি নিধন চলছে। সাথে বাতাসে বারুদের গন্ধ মিশলে প্রকৃতির বিপর্যয় নতুন করে বাড়ে পাল্লা দিয়ে। যুদ্ধবিরোধী মিছিল আমাদের চেতনায় ধাক্কা দেয় নিশ্চয়। কিন্তু এই যুদ্ধবিরোধী মিছিলে একটি কথা অনুচ্চারিত থেকে যায় তা হলো, যুদ্ধ মানেই পরিবেশ ভারসাম্যের উপর এক চরম আঘাত। বিশ্বজুড়ে পরিবেশের আলোচনা যখন প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে তখন যুদ্ধবিরোধী প্রতিবাদসভা ও মিছিলে পরিবেশ ধ্বংসের সঙ্গে যুদ্ধের বিষয়টিকে উপেক্ষা করা যায় না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মানুষ নিরাপত্তার জন্য পথ হাতড়ে বেড়িয়েছে, কিন্তু পায়নি। ক্ষমতার কুটিল আবর্তে নিরাপত্তা সংক্রান্ত নীতি মুছে গেছে। আদিম অতীতের গহ্বর থেকে উঠে এসেছে এক দানবীয় মানুষ। একটির পর একটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। ভিয়েতনাম থেকে আরম্ভ করে কম্বোডিয়া এবং পরবর্তী ক্ষেত্রে বিশেষ করে আরব দুনিয়াতে দানবীয় যুদ্ধের আত্মপ্রকাশ। ভিয়েতনাম যুদ্ধে আমেরিকার সৈন্যের বিরুদ্ধে ভিয়েতনামের মানুষের যুদ্ধের কৌশল ছিল ‘গেরিলা যুদ্ধ’। ফলতঃ ভিয়েতনামে ও কম্বোডিয়ায় ব্যাপক বনাঞ্চল ছিল তাদের প্রধান আশ্রয়। ভিয়েতনামের স্বদেশপ্রেমী গেরিলা বাহিনীকে খুঁজে বের করার জন্য আমেরিকার সৈন্য প্রায় সমস্ত বনাঞ্চলকে নির্মমভাবে ধ্বংস করে। আর এই যুদ্ধে নাপাম বোমার ব্যবহারের ফলে মানুষের জীবন ও প্রকৃতি পরিবেশ দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। আধুনিক কালের ভয়াল ভয়ানক যুদ্ধে কিভাবে পরিবেশ ধ্বংস হয় এবং যুদ্ধের পরবর্তী ক্ষেত্রেও তার সুদূরপ্রসারী প্রভাব জনজীবনের উপর থেকে যায়, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ ভিয়েতনামের যুদ্ধ। পরবর্তী ক্ষেত্রে আফগানিস্তানে, যুগোশ্লোভিয়ায় এবং উপসাগরীয় যুদ্ধে গণবিধ্বংসী অস্ত্রের উল্লাস পরিবেশের ওপর এক ভয়ানক ও সুদূরপ্রসারী ক্ষতচিহ্ন এঁকে দিয়ে যায়। ১৯৯০-৯১ সালের উপসাগরীয় যুদ্ধকে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ সামুদ্রিক দূষণের ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, ব্যাপক বোমাবর্ষণ করে মেসোপটেমিয়ার ১৫০০০ কিলোমিটার জলাভূমির জীববৈচিত্র্যকে নিশ্চিহ্ন করা হয়েছে। সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০০ কোটি মানুষ কেবলমাত্র জলাভাবে মৃত্যুর জন্য প্রতীক্ষারত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ক্রমাগত আফ্রিকা এবং আরবভূমিতে যুদ্ধের ফলে জলের সমস্ত রকম উৎসের ব্যাপক ক্ষতিসাধন হয়েছে, বেড়েছে জল ও স্থলের দূষণ।
ইউক্রেন যুদ্ধে পরিবেশের উপর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে এর মধ্যেই। জল, বাতাস, মাটির দূষণ বাড়ছে, যা দীর্ঘকালীন প্রভাব রেখে যাবে ইউক্রেন-পোল্যান্ড- হাঙ্গেরি-রোমানিয়া- বুলগেরিয়া-পর্তুগাল সহ তদানীন্তন সোভিয়েত রাশিয়ার এক বড় অংশে। আরো উদ্বেগের বিষয়– পরিবেশ দূষণের অনেক নতুন নতুন মাত্রা অদূর ভবিষ্যতে স্পষ্ট প্রতীয়মান হবে। পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রে বিস্ফোরণ (১৯৮৬) গভীর ক্ষত রেখে গেছে পুরো চেরনোবিল জুড়েই। ইউক্রেন জুড়ে ছড়িয়ে থাকা এক ডোজনের বেশি পরমাণুচুল্লির ওপর বোমা বর্ষিত হলে তেজস্ক্রিয় বিকিরণের লম্বা হাত কতদূর পৌঁছাবে তা ভেবেই শিউরে উঠছেন বিজ্ঞানী ও পরিবেশবিদরা। ইতিমধ্যেই ইউক্রেনের বুচায় পেট্রোলিয়াম কারখানায় বোমা ফেলায় বায়ুদূষণের মাত্রা নিঃসন্দেহে কয়েকগুন বাড়িয়ে দেবে এবং এর রেশ কোথায় কতটা ভয়ঙ্কর হবে তা আমাদের এখনো অজানা। শিল্প-সমৃদ্ধ ইউক্রেনের প্রাকৃতিক পরিবেশ যুদ্ধের আগে থেকেই বিপর্যস্ত কারখানা-নিষ্কৃত দূষণের
কারণে। বিশেষ করে ডনবাস শহর সবচেয়ে দূষণযুক্ত অঞ্চল হিসেবে আগেই সুনাম অর্জন করেছে তার কয়লাখনি, ধাতু-শিল্পের কারখানা ও কয়েকশ রাসায়নিক কারখানার জন্য। তাই শিল্পোন্নত শহরে বোমা- গ্রানাইড- মিসাইল বর্ষণ মানে দূষণের মাত্রা ও ভয়াবহতা আরো বাড়িয়ে দেওয়া। বিষাক্ত রাসায়নিক গ্যাস আশেপাশের অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনাও বাড়ে অনেক বেশি করে। পেট্রোলিয়াম পণ্য সহ অন্যান্য দাহ্যবস্তুতে পূর্ন কারখানায় একটি বোমা মানে পরিবেশের তাৎক্ষণিক ও দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি। অন্যদিকে ইউক্রেনের জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো বিস্ফোরণে উড়ে গেলে বাঁধের নিম্নঅববাহিকার বিস্তীর্ণ অঞ্চল ভেসে যাবে প্রবল বন্যায়।
বাস্তব চিত্রটা ঠিক কেমন:
২০২১ সালের আগস্টে প্রকাশিত আইপিসিসির ষষ্ঠ রিপোর্টে পৃথিবীবাসীর জন্য ভয়ানক বিপদের বার্তা এসেছে বারেবারে। আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই মনুষ্যসৃষ্ট ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে তামাম বিশ্ববাসী। এই রিপোর্টকে কেন্দ্র করে অনেক আলোচনা, সেমিনার , লেখাপত্র চলছে সমগ্র বিশ্বজুড়েই। বিপর্যস্ত পরিবেশ মেরামতি ও পুনরুদ্ধারের দাবিতে ছাত্রছাত্রী, কিশোর ও যুবা বাহিনী এবং বিজ্ঞানীসহ পরিবেশ কর্মীদের বিক্ষোভ- প্রতিবাদ প্রতিদিন সংগঠিত হচ্ছে বিশ্বের কোন না কোন প্রান্তে। এই দাবিতে এই বছরের ২৫ শে মার্চ ‘ফ্রাইডেজ ফর ফিউচার’ এর ডাকে বিশ্ব জলবায়ু ধর্মঘট সংঘটিত হলো। আমেরিকা, ইউরোপের বিভিন্ন দেশসহ নানান দেশের ছাত্র-ছাত্রী জমায়েত হয়ে স্লোগান তুলেছে–” আমাদের পরিবেশ ফিরিয়ে দাও, আমাদের সুস্থভাবে বাঁচতে দাও এই নীল গ্রহে”। গত বছর লন্ডনের গ্লাসগো শহরে অনুষ্ঠিত হলো আন্তর্জাতিক জলবায়ু সম্মেলন (COP-26)। এই সম্মেলনে পরিবেশ বিপর্যয় ও জলবায়ু পরিবর্তনের সমাধানে রাষ্ট্রনায়করা গালভরা প্রতিশ্রুতি দিলেও এখনো পর্যন্ত কার্যকরী বৈজ্ঞানিক পদক্ষেপ সেভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। কিন্তু আন্তর্জাতিকস্তরে ক্রমবর্ধমান পরিবেশ আন্দোলনের চাপে রাষ্ট্রনায়ক ও নীতিনির্ধারকরা পরিবেশ রক্ষার কাজে সামান্যতম হলেও যেসব পদক্ষেপের কথা ভাবছিলেন বা কোথাও কোথাও কিছুটা অগ্রগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছিল, সেই সব ভাবনাচিন্তা ও কাজ বিশবাঁও জলের তলায় তলিয়ে যাবে দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা ইউক্রেন- রাশিয়া ও অন্যান্য যুদ্ধের অজুহাতে। অন্যদিকে মার্চের প্রথম সপ্তাহে (২০২২) আইপিসিসি তাদের একটি স্পেশ্যাল রিপোর্ট সামনে এনেছে। যার মূল নির্যাস– আগে যেরকমটা ভাবা হয়েছিল, বর্তমানে বিপর্যয় তার চেয়ে অনেক দ্রুতহারে ও বেশিমাত্রায় বাস্তবে হাজির হচ্ছে। এখনই সদর্থক ব্যবস্থা না নিলে আগের সব হিসেব নিকেশ উড়িয়ে দিয়ে কয়েক দশকের মধ্যেই পৃথিবীর বেশ কিছু অঞ্চল বন্যপ্রাণ, কীটপতঙ্গ, পশুপাখি সহ মানুষের বসবাসের অযোগ্য হয়ে যাবে।
যার কোন শেষ নেই:
এরমধ্যেই যুদ্ধের বলি আবাল বৃদ্ধবনিতা সহ কয়েক হাজার প্রাণ। ইউক্রেনের বুচা শহরে নাগরিকদের উপর যথেষ্ট অত্যাচার করে গণহত্যা ঘটিয়েছে রুশসেনা। তাদের অত্যাচার থেকে রেহাই পায়নি শিশু ও নারীরাও। নারীদের ধর্ষণ করে খুন করা হয়েছে। শহরময় শুধুই মৃতদেহ, এতো লাশ দেখে শকুন-শেয়ালও বোধহয় লজ্জায় মুখ ঢাকবে। আসলে যে কোন যুদ্ধেই সবচেয়ে বেশি করে আক্রান্ত, নির্যাতিত হয় শিশু ও নারীরা, এটাই বোধ করি ক্ষমতা প্রদর্শনের মাপকাঠি। এছাড়াও রুশ সেনারা তাদের আস্ফালন দেখিয়েছে আবাসন ভবন, স্কুল-কলেজ, শিশু হাসপাতাল, অ্যাম্বুল্যান্স সহ একের পর এক নাগরিক পরিষেবা ক্ষেত্রে নির্বিচারে বোমা বর্ষণ করে। যুদ্ধ শুরুর ৪৫ দিনের মাথায় কম করে ৬৫ লক্ষ মানুষ ইউক্রেন ছেড়ে সীমান্ত পেরিয়ে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড, রোমানিয়া সহ বিভিন্ন দেশে। যুদ্ধ থেমে যাওয়ার পরও আর্থসামাজিক কারণে আরো প্রচুর মানুষ উদ্বাস্তু মিছিলে নাম লেখাবেন, মিছিলে নতুন নতুন মুখ যুক্ত হবে পরিবেশগত বিপর্যয়ের কারণে। প্রাণ প্রকৃতি পরিবেশের এই ধ্বংসলীলার বিরুদ্ধে মানুষ অতীতের মতো এবারও সরব হয়েছেন। রাশিয়াজুড়ে যুদ্ধবিরোধী বড় বড় মিছিলে অংশগ্রহণ করছেন প্রচুর মানুষ, সেই মিছিলে রাষ্ট্রের দমন-পীড়নও নেমে আসছে। আমেরিকার নানান শহরে শান্তিকামী গণতান্ত্রিক মুখের মিছিল লম্বা হচ্ছে। এর ঢেউ এসে লেগেছে আমাদের দেশেও। মানুষের যুদ্ধবিরোধী এই স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভ-প্রতিবাদকে যথেষ্ট সম্মান জানিয়েই বলছি–” যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই” শুধুমাত্র এই শ্লোগানে আবদ্ধ থাকার দিন নয় আজ। সময় দাবি করছে– ইউক্রেন ও রাশিয়াকে কেন্দ্র করে শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর কারেন্সি অর্থাৎ মুদ্রাকে চ্যাম্পিয়ন করার প্রবল উদ্যম, অন্যদিকে ডলার সাম্রাজ্যে ভাঙ্গন ধরিয়ে রুবেল , ইয়েনকে প্রতিষ্ঠা করার অর্থনৈতিক স্বার্থের লড়াইকে বোঝা ও মানুষের কাছে নিয়ে যাওয়া। বিশ্বজুড়ে অর্থ ও অস্ত্রের ঝনঝনানি, ফুলে-ফেঁপে ওঠা পণ্যসর্বস্ব ভোগবাদী অর্থনীতির বিরুদ্ধে এক উন্নত সহযোগিতামূলক সমাজব্যবস্থা গঠনের দিকে অগ্রসর হওয়ার এটাই প্রকৃত সময়। সাথে বুঝে নিতে হবে এই চরম সত্যকে যে , সেই সমাজের পদধ্বনি শুনতে হলে নিজেদের ও পরবর্তী প্রজন্মকে এই পৃথিবীতে টিকিয়ে রাখতে হবে, আর তা সম্ভব হবে ‘লেবার-ক্যাপিটাল কন্ট্রাডিকশনের’ পাশাপাশি নেচার-ক্যাপিটাল দ্বন্দ্বকে সজোরে সামনে তুলে ধরে পরিবেশ মেরামতির দাবিতে সকলের সমবেত প্রয়াস। পরিশেষে একটি তথ্য হাজির করব পাঠকের দরবারে। ৭৫টি দেশের এক হাজারের বেশি মানুষ ও বিভিন্ন সংস্থা ‘এনভাইরনমেন্টাল পিসবিল্ডিং অ্যাসোসিয়েশনের’ মধ্য দিয়ে একটি খোলা চিঠি প্রকাশ করেছেন (৩রা মার্চ, ২০২২)। এই চিঠিতে যুদ্ধ-বিধ্বস্ত ইউক্রেনের প্রতি সহমর্মিতা জানিয়ে তারা বলেছেন–”এই যুদ্ধ অসংখ্য মানুষের জীবনযাত্রা নানান দিক দিয়ে ব্যাহত করবে, পাশাপাশি পরিবেশের ওপর এক ভয়ানক বিপর্যয় নামিয়ে আনবে, যার ক্ষত হয়তো আর কোনদিনই নিরাময় করা সম্ভব হবে না”।
লেখক পরিচিতি:
বিজ্ঞান শিক্ষক, বিজ্ঞান ও পরিবেশ আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক।
যোগাযোগ: santoshsen66@gmail.com