হর্ষ দাস
এবারের সুন্দরবনের সাইক্লোন ‘যশ’ যেন অমিতাভ ঘোষের “দ্য হাংরি টাইড” গল্পটাকে জীবন্ত করে তুলেছে। যেখানে লেখক গল্পের নায়িকা( পিয়ালী রায়) এর চোখ দিয়ে সুন্দরবনের ব দ্বীপ অঞ্চলের মানুষের জীবনের সংগ্রামকে তুলে ধরেছেন। পিয়ালি মেরিন বায়োলজি নিয়ে পাশ করা এক যুবতী। পাশ করেছেন আমেরিকার ‘স্ক্রিপস ইনস্টিটিউট অফ ওসিনোগ্রফি’ থেকে। তিনি এসে দেখেন সুন্দরবনের মানুষকে কিভাবে লড়তে হয় জোয়ারের সাথে, ঝড়ের সাথে, দারিদ্রতার সাথে, রাজনীতির সাথে, কুসংস্কারের সাথে বাঘের সাথে এবং সমুদ্রের লবণাক্ত জলের সাথে। অমিতাভ ঘোষ গল্পটিকে ঘটনার পরম্পরায় এমনভাবে দাঁড় করিয়েছেন যাতে সুন্দরবনের সমস্যাটা একটা আন্তর্জাতিক চরিত্র পায়। আরেকটি বই ‘দ্য গ্রেট ডিরেজিমেন্ট’- এ তিনি দেখিয়েছেন এই অঞ্চলে ব্রিটিশ শাসক বন্দর তৈরি করতে গিয়েছিল এক নাম করা ব্রিটিশ পরিবেশবিদের সতর্কতাকে অগ্রাহ্য করেই। এবং বন্দর গড়ার পরিকল্পনা যে মস্ত বড় ভুল সিদ্ধান্ত ছিল, তা প্রকৃতি প্রমাণ করে দিয়েছিলো বিশাল এক সাইক্লোন ঝড়ে বন্দরটাকে তুলে দিয়ে।
বঙ্গোপসাগরে সাইক্লোনের কারণ কি?
এখানে সাইক্লোন তৈরি হবার পিছনে মূলত দুটো কারণ আছে। একটি কারণ আঞ্চলিক, দ্বিতীয় কারণটি আন্তর্জাতিক। প্রথম কারণটি হলো কলকাতাকে ঘিরে যে পরিমাণ নগরায়ন বাড়ছে, সেই পরিমাণে নগরায়নের ফলে ধীরে ধীরে মানুষের চাপ সুন্দরবনগামী হচ্ছে। দ্বিতীয় কারণটি হলো ‘বিশ্ব উষ্ণায়নের’ ফলে একদিকে সমুদ্রের জলের স্তর বাড়ছে, ফলে জলচাপ সুন্দরবনের ওপর প্রভাব ফেলছে, লবণাক্ত জল কৃষি জমিতে অনুপ্রবেশ করে চাষকে বিপর্যস্ত করে দিচ্ছে। এর থেকে পরিত্রাণের জন্য মানুষজন যখন চিংড়ি চাষের দিকে যাচ্ছে বাঁধ দিয়ে জলকে এক জায়গায় বেঁধে রেখে সেটাও কিন্তু সুন্দরবনের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের আরেকটা কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। মূলত ব-দ্বীপ অঞ্চলে জোয়ারের সময় সমুদ্রের লবণাক্ত জল নদীর মধ্য দিয়ে মূল ভূখণ্ডে প্রবেশ করে। সেই লবণাক্ত জল আর উপর থেকে আসা নদীর কার্বন-ডাই-অক্সাইড মিশ্রিত জল উভয় উভয়ের সংস্পর্শে এসে লবণকে পরিবর্তিত করে বিভিন্ন কার্বোনেটে, যার মধ্যে ক্যালসিয়াম কার্বোনেট আবার চাষের উপযুক্ত, ফলে পলি মাটির উর্বরতা শক্তি বাড়িয়ে দেয়। এই কারণে মোহনা অঞ্চলের ব-দ্বীপ গুলির মুখগুলি উন্মুক্ত রাখা প্রয়োজন সমুদ্রের জলের উর্ধগতিকে বাধাহীন রাখার জন্য। নচেৎ নদীগুলির জলের কার্বন ডাই অক্সাইডের মাত্রা বেড়ে যায়, যা সমুদ্রের জলের তাপমাত্রা বাড়িয়ে তোলে। ১৬৬০ সালে ব্রিটিশ সরকারের সিদ্ধান্তে দুটো বন্দর তৈরির পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল, একটা নিউইয়র্কে আর একটা বোম্বেতে। নিউইয়র্কে এরকম ব-দ্বীপ বুজিয়ে বন্দর তৈরি করা হয়েছিল, আর পুরো বোম্বে শহরটা ব-দ্বীপ বুঝিয়েই তৈরি করা হয়েছে। নিউইয়র্ক শহরে যেমন সাইক্লোন ঘটে গেছে, বোম্বেতে যেকোনো সময় ঘটবে, কোটি কোটি মানুষের প্রাণ যাবে কিন্তু রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ীদের কারণে এই খবর চেপে দেওয়া হয়েছে। অমিতাভ ঘোষ তাঁর ‘দ্য গ্রেট ডিরেন্জমেন্ট ‘ বইতে এমনই তথ্য দিয়েছেন ।
প্রকৃতি বিপর্যয়ের একটা বড় কারণ সাম্রাজ্যবাদী পরিকল্পনা
এটা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে ১৯৯০ সালের উদার অর্থনীতির হাত ধরে। বাজার অর্থনীতির বিকাশ ঘটছে যে পরিমাণে সেই পরিমাণে সমুদ্র উপকূলবর্তী স্থানগুলিতে ট্যুরিস্ট ব্যবসাকে কেন্দ্র করে যেভাবে বন্দর ও নগরায়ণ বেড়ে চলেছে, তাতে সমুদ্র ও নদীর মোহনা স্থলগুলি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ব্যপক ভাবে।
বঙ্গোপসাগরে সাইক্লোনের মূল কারণ
আরব সাগরের তুলনায় বঙ্গোপসাগরের উপরের স্তরের জলের তাপমাত্রা বেশি হয়। কারণ আরব সাগরের উপরের গরম জলের সাথে তলার ঠান্ডা জলের সবসময় একটা টার্বুলেন্স ফ্লো চলে, যা বঙ্গোপসাগরে চলে না। কিন্তু ইদানিং আরব সাগরের তাপমাত্রাও বেড়ে যাচ্ছে গ্লোবাল ওয়ার্মিং-এর কারণে, আরব সাগরেও কিন্তু পরপর একাধিক সাইক্লোন ঘটলো ইদানিং। এই গ্লোবাল ওয়ার্মিং বঙ্গোপসাগরের সাইক্লোনকে যে আরও ভয়াবহ করে তুলবে প্রতিবছর এটা খুবই স্বাভাবিক।
গ্লোবাল ওয়ার্মিং-এর কারণ কি?
আমরা সবাই জানি কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাসের বৃদ্ধির কারণে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। যদি আমরা একটু পর্যালোচনা করি তাহলে দেখতে পাব– ১৯৪৪ সালের আগে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা কোন বছর বেড়ে গেলে পরের বছরেই আবার কমে গিয়ে গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি জিরোতে ধরে রাখত। এরপর থেকেই পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি আর জিরোতে ধরে রাখা যাচ্ছে না। তার কারণ কি? কারণ হচ্ছে নতুন ধরনের এক অর্থনীতির বিকাশ। যে অর্থনীতিতে খনিজ তেল অর্থনৈতিক কেন্দ্রবিন্দু হয়ে গেছে। যেহেতু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন পরিস্থিতিতে অটোমোবাইল শিল্পের ব্যাপক বিকাশ হয়, সেই বিকাশকে ধরে রাখার জন্যই এই অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। সোনার পরিবর্তে ডলারের সাথে তৈল অর্থনীতির এক সম্পর্ক স্থাপন হয়। ১৯৯০ সালের পরে এই অর্থনীতি এক মহীরুহ রূপ ধারণ করে আউটসোর্সিংয়ের মারফত। সস্তা শ্রমের কারণে ইউরোপ ও আমেরিকার গাড়ি শিল্প এশিয়ায় স্থানান্তরিত হতে শুরু করে। ফলে এশিয়াতেও কার্বন ডাই অক্সাইডের মাত্রা বেড়ে যায়। এর ফলে সারা বিশ্ব কার্বন ডাই অক্সাইডের খাঁচায় বন্দি হয়ে পড়ে। এই কারণেই চিত্র ২’ এ দেখা যাচ্ছে ১৯৯০ সালের পর থেকেই পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বাঁধনহারা ভাবে বেড়ে চলেছে।
নতুন পথের খোঁজে বাইডেনরা
এই কারণেই আমেরিকায় বাইডেনরা গ্রীন অর্থনীতির নামে নতুন পথ নিচ্ছেন। তাঁরা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ২০৫০ সালের মধ্যে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের নিঃসরণ মাত্রা জিরোতে নিয়ে আসবেন। তার জন্য তারা ট্যাক্সও ধার্য করেছেন। এই পথ কি ভারতবর্ষ নিতে পারবে কর্পোরেটদের উপরে ট্যাক্স চাপিয়ে?
বাইডেনদের কাছে প্রশ্ন কার্বন-ডাই-অক্সাইডের নিঃসরণের মাত্রা নামাতে গিয়ে যে ধরনের অর্থনীতি তারা গড়ে তুলছেন তাতে ধাতু দূষণ বেড়ে যাবে। এই সম্পর্কে তাদের পরিকল্পনা কি?
মূলত প্রকৃতির পুনরুৎপাদন না করে আজকের এই অবস্থার থেকে কি বেরনো যাবে?
এই প্রসঙ্গে পরিপ্রশ্নে প্রকাশিত আরও লেখা পড়তে পারেন : সুন্দরবন: প্রকৃতি, মানুষ ও বিপন্ন বাস্তুতন্ত্র